সামবেদ ও সোমযাগ
সামবেদের অন্য গুরুত্বপূৰ্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সোমযাগের সঙ্গে তার সম্পর্ক। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি যে, পূর্বার্চিকের দীর্ঘতম অংশ অগ্নি, ইন্দ্র ও পবমান সোমের প্রতি নিবেদিত তিনটি প্রধান অধ্যায়; আর উত্তরার্চিকের কেন্দ্ৰস্থলে এই তিনজন দেবতাই বিরাজ করছেন। এঁদের মধ্যে অগ্নি, ধন ও গোসম্পদের ঐতিহ্যগত দাতা এবং দানব ও পিশাচের বিরুদ্ধে আৰ্য গোষ্ঠীগুলির রক্ষাকর্তা–সেই সঙ্গে তিনি যজ্ঞের ধারক বা দেবতাদের আহ্বানকারী ব’লেই যে কোনো যজ্ঞে সম্পূর্ণ অপরিহার্য। আক্রমণকারী আর্যবাহিনীর সেনাপতিরূপে যুদ্ধজয়ের গৌরবজনক নিদর্শনের অধিকারী ছিলেন বলেই ইন্দ্ৰ আৰ্যদেবগোষ্ঠীর সর্বপ্ৰধান নেতা হিসাবে গণ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সোমযাগে তাঁর এক স্বতন্ত্র ভূমিকা–সোমরসপায়ীদের প্রধান-রূপে তিনি যেন যজ্ঞকারী সোমপায়ী পুরোহিতদের দৈব প্রতিভূতে পরিণত হয়েছিলেন। অন্যভাবে বলা যায় যে, সোমােযাগে তিনি প্ৰধান অতিথি এবং এইজন্য তাঁর প্রাধান্যও তর্কাতীত।
সোম একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। প্রাচীনতর পর্যায়ে সোমকে যজ্ঞের অন্যতম উপকরণরূপে নিছক উদ্ভিদ বলে মনে করা হত; কিন্তু পরবর্তীকালে সংঘটিত দৈবীকরণ প্রক্রিয়ার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। সোমযাগে মোট সাত ধরনের পুরোহিত সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করতেন : মন্ত্র আবৃত্তিকারী ঋগ্বেদীয় হােতা ও তার সহকারীরা, সামগায়ক উদ্গাতা, আহুতি-প্ৰস্তুতিকারী পোতা, যজ্ঞাগ্নিতে সোমরস ও ঘৃত নিক্ষেপকারী নেষ্টা, সমগ্ৰ যজ্ঞানুষ্ঠান পরিদর্শক ও পরিচালক ব্ৰহ্মা বা উপদ্ৰষ্টা এবং বজ্র অর্থাৎ পলাশকাষ্ঠে তৈরি দণ্ড হাতে যজ্ঞভূমির তোরণের কাছে দণ্ডায়মান রক্ষঃ। এইসব পুরোহিত যজমানের সঙ্গে একত্রে সোমযাগের কেন্দ্রে বিরাজ করতেন। বস্তুত সোমযাগ যত জটিল ও দীর্ঘায়ত হয়েছে, বিভিন্ন শ্রেণীর পুরোহিতের মধ্যে দায়িত্বভার বণ্টনও তত অনিবাৰ্য হয়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে ঋগ্বেদের সোমমণ্ডল সঙ্কলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদিক ধর্মের ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বান্তরের সূচনা হয়। ক্রমশ সোম রাজকীয় ক্ষমতা ও পুরোহিত শ্রেণীর গুরুত্বের সঙ্গে প্রায় অবিচ্ছেদ্য হয়ে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়ে ওঠেন। এই সময় আৰ্যবসতিগুলিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ও সুসংগঠিত রাজকীয় ক্ষমতার ক্রমিক উত্থানেরও সূচনা হয়। ফলে সোমযাগ ক্রমশ বহুধাব্যাপ্ত ও ব্যয়বহুল হতে শুরু করে; বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্ৰাপ্ত সুপ্রতিষ্ঠিত পুরোহিতসম্প্রদায় জটিল অনুষ্ঠানপ্রক্রিয়ার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। এর ঐতিহাসিক সময়সীমা সম্ভবত ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ইতোমধ্যে আক্রমণকারী আর্যরা প্রায় সমগ্ৰ উত্তর ভারত জয় করে ফেলেছিলেন; কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে তারা প্ৰাগাৰ্য সিন্ধুসভ্যতার মানুষের কাছে ইটের বাড়ি তৈরি করতে শিখে নিয়েছিলেন। তাছাড়া আদি প্ৰাগাৰ্য জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি থেকে কিছু কিছু চারুকলাও আয়ত্ত করে তারা ধীরে ধীরে আর্যাবর্তের দক্ষিণ-পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে সেখানকার ভিন্ন ভিন্ন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। কৃষিকাৰ্য খুবই সহজসাধ্য, ভূমি উর্বরা ও সহজে কৰ্ষণযোগ্য হওয়ার ফলে আর্যরা অল্প আয়াসে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছিলেন। তাদের উন্নতির অন্যান্য কারণের মধ্যে ছিল পৰ্যাপ্ত পরিমাণে গোধন এবং ব্যাবিলন ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে নৌবাণিজ্যের পুনৰ্যোগস্থাপন যা সিন্ধুসভ্যতার সময় প্রচলিত থাকলেও আর্যদের বসতিবিস্তারের প্রথম পর্বে কিছুকালের জন্য বিপর্যন্ত হয়ে স্থগিত ছিল। এই সমস্ত কারণে আর্যদের দৈনন্দিন বাস্তবজীবন ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ায় তাদের সামাজিক অস্তিত্ব ও তজ্জনিত সামাজিক চেতনা আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেল। রাজনৈতিক দিক দিয়ে তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে উদীয়মান স্বতন্ত্র গোষ্ঠীপতিদের শাসন প্রবর্তিত হচ্ছিল এবং প্ৰত্যেক শাসকেরই কিছু নিজস্ব ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কাৰ্যবাহক ছিলেন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, এইসব রাজন্যগণ সম্পূর্ণ শান্তি ও মৈত্রীর বাতাবরণে বাস করতেন। এই পর্যায়ে আমরা প্রায়ই যে রাজসূয় বা বাজপেয়, সৌত্ৰিমণী ও অশ্বমেধ যজ্ঞের উল্লেখ দেখতে পাই, তা অভ্ৰান্তভাবে ইঙ্গিত করছে যে, তখন প্রতিবেশী শাসকদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবর্তে ছিল রক্তাক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কারণ প্ৰত্যেকেই তার প্রতিবেশীর রাজ্য অধিকার করার জন্য প্ৰাণপণ চেষ্টা করত। তাই অসংখ্য গৌণ অনুষ্ঠানের নির্দেশ সেই সময়কার রচণাগুলিতে পাওয়া যায় যার মধ্যে সমৃদ্ধি ও রাজ্যবিস্তারে অভিলাষী শাসকদের জন্য পালনীয় বিধিসমূহ যেমন উল্লিখিত হয়েছে তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশীর জাদুবিদ্যাকে প্রতিহত করার জন্যও বিভিন্ন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। “রাজকর্মণি” নামক রাজকীয় কর্তব্য-বিষয়ে অথর্ববেদের একটি বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজকীয় শত্রুর উপর প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য শাসকদের পক্ষে পালনীয় নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠান বর্ণিত হয়েছে।
এই প্ৰেক্ষাপটেই সুনির্দিষ্ট পুরোহিত শ্রেণীর অভু্যুদয় ঘটে–রাজপুরোহিতরা অমাত্যদের সঙ্গে রাজকীয় কাৰ্যকলাপ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন যে, লোকায়ত বিষয়ে উপদেশদাতা ব্ৰাহ্মাণ-বংশজাত অমাত্যদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক বিষয়ে উপদেষ্ট রাজপুরোহিতদের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ খুব বিরল ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোহিতরা যে জাগতিক বিষয়েও শাসককে সহায়তা করতেন, তার প্রমাণ রয়েছে। শতপথ ব্ৰাহ্মাণে, যেখানে রাজা বিদেঘমাথব তাঁর পুরোহিত অগ্নিবহনকারী গৌতম রহুগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রাচ্য দেশের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন, উদ্দেশ্য প্ৰাগাৰ্য অধিবাসীদের বাসভূমি, ঊষর জমি ও আরণ্য অঞ্চল দন্ধ করে অধিকার করা। সন্দেহ নেই যে, পুরোহিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণগণ তুলনামূলকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অবস্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন। যখন সমৃদ্ধতর সমাজের ধন রাজকোষগুলিতে ধীরে ধীরে সঞ্চিত হচ্ছিল, সমুদ্রপথে বাণিজ্য ক্রমবর্ধিষ্ণু ছিল, সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে ক্ৰমাগত শাসক পরিবর্তন ঘটছিল এবং অধিক শক্তিশালী রাজন্যরা প্রতিবেশী ভূখণ্ডগুলির উপর অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট ও সমর্থ ছিলেন–সেই সময়ে পুরোহিতশ্রেণীর ব্ৰাহ্মণদের পক্ষে দীর্ঘািয়ত ও সুবিস্তৃত যজ্ঞানুষ্ঠান পালন করার জন্য রাজন্যদের প্রভাবিত করা কিছুমাত্র কষ্টসাধ্য ছিল না। অজ্ঞাত বিপদের ভয়-বিশেষত বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও অন্তর্বিপ্নবের আশঙ্কা, অধিকতর সমৃদ্ধিলাভের আকাঙক্ষা এবং নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তার প্রত্যাশা-স্বভাবতই শাসকদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে বিবেচিত হ’ত বলে তারা জটিল ও ব্যয়বহুল সোমযাগ অনুষ্ঠানে প্ৰবৃত্ত হতেন। স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, সোমযোগে যে বৰ্ণনা পাই তা থেকে এটা সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এটি অগ্নিহােত্ৰ, চার্তুমাস্য বা দর্শপুর্ণমাসের মতো একটি সহজে নিম্পাদ্য স্বল্প ব্যয়ের যজ্ঞ নয়। এর জটিলতা, পুরোহিতবাহুল্য, আনুষঙ্গিক আড়ম্বর, দক্ষিণা ও যজ্ঞকর্মের ব্যয় এবং ব্যাপ্তি এমনই ছিল যে, অত্যন্ত ধনী রাজা বা রাজন্য ভিন্ন কেউই এ যজ্ঞ করতে পারতেন না। শাস্ত্রে দীর্ঘতম সত্ৰ, সোমযাগ, দ্বাদশবর্ষ ধরে’ অনুষ্ঠিত হ’ত; প্রত্নকথা অনুযায়ী সহস্ৰবৎসর ব্যাপী সোমযাগেরও নির্দেশ আছে। এই সময় থেকেই সোমযাগ শ্রেষ্ঠ যজ্ঞরাপে গণ্য হতে থাকে এবং সোম নিতান্ত উদ্ভিদ থেকে দেবতা এবং রক্ষক রূপে ব্ৰাহ্মণদের প্রতিরূপ হয়ে ওঠে। সোমমণ্ডল সংকলনের কাজও এ সময় শুরু হয়, যেহেতু বিষয়বস্তুরাপে সোমযাগের অবিসংবাদিত প্রাধান্য তখন সুপ্রতিষ্ঠিত। সোমের উত্থান ও দৈবীকরণের সঙ্গে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে ব্ৰাহ্মণদের উত্থান অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পূক্ত। ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আধিদৈবিক প্রতিরূপ রাজা সোমকে খুবই সুবিধাজনকভাবে জাগতিক শাসনের সীমার বাইরে স্থাপিত করা হ’ল। কারণ রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে স্পষ্ট বলা হত, রাজা প্রজাদের নিয়ন্তা, কিন্তু ব্ৰাহ্মণদের রাজা সোম; অর্থাৎ শ্রেণীগতভাবে ব্রাহ্মণ পার্থিব রাজার ক্ষমতার সীমার বাইরে রইল, তাদের ওপর রাজার প্রত্যক্ষ আধিপত্য অস্বীকার করা হল। সোমের একটি বহু ব্যবহৃত বিশেষণ ‘রাজা’।
সামবেদের খাদ্য, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনাই অধিক মাত্রায় পাওয়া যায়। সেই সময়ের প্রধানতম যজ্ঞানুষ্ঠান সোমযাগটি যেহেতু বহু অনুপুঙ্খাযুক্ত ও বিপুল ব্যয়-সাধ্য ছিল, প্রচুর খাদ্যসামগ্ৰী তাতে ব্যবহৃত হত। সেজন্যে যজ্ঞধর্মহীন আদিম অধিবাসীদের মধ্যে জীবিকাহীন ব্যক্তি লুণ্ঠনের জন্য প্ৰায় নিকটবর্তী অঞ্চলগুলি থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালাত। তাই সেই সময়ের সূক্তগুলিতে অনেক বেশি পরিমাণে শক্ৰতাপরায়ণ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা রচিত হয়েছে। আবার ঐশ্বর্যের সঙ্গে একটু ভিন্ন ধরনের নিরাপত্তার অভাববোধও দেখা দিয়েছিল; সেই সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র সমুদ্র-বাণিজ্য বিদ্ম-সংকুল ছিল, খরা ও বন্যায় শস্যের ফলন মাঝেমাঝেই ব্যাহত হত, প্রাথমিকভাবে সমাজে যা ছিল শ্রমবিভাগ ইতোমধ্যে তা বংশানুক্ৰমিক বৰ্ণবিভাগে পরিণত হল, অভাবে ও সামাজিক বর্ণগত অবদমনে সমাজের নিম্নবর্গীয় জনতার মধ্যে অসন্তোষ ক্রমেই ধূমায়িত হয়ে উঠছিল। ফলে সমাজের উচ্চস্তরের পুরোহিত ও রাজন্যদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও সংস্কারাচ্ছন্ন ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। প্ৰধান ব্যয়বহুল শ্রৌত যজ্ঞগুলির উদ্ভাবন বৈদিক সমাজের জনসমুহকে স্পষ্ট দুটি ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিল : একদিকে ছিল যজ্ঞ-আবিষ্কারক ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত পৃষ্ঠপোষক ও পুরোহিতবর্গ, রাজা অমাত্য ও গোষ্ঠীপতিরা, রাজন্য ও অভিজাতবর্গ; অন্যদিকে রয়ে গিয়েছিল সমাজের বিপুল জনতা যারা নিতান্ত গৌণ ও তুচ্ছ ভূমিকায় পরোক্ষভাবে হয়ত বা অধিকাংশই কেবলমাত্র নিষ্ক্রিয় দ্রষ্টা হয়ে দূর থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা অনুষ্ঠানের পক্ষে সর্বতোভাবে নিম্প্রয়োজন, যেন বহিরাগত। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই সময়ে সোমচৰ্য শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হয়েছিল; সোমযাগের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকার ফলে একদিকে সামবেদ প্ৰাধান্য অর্জন করল এবং অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ-শ্রেণীভুক্ত রাজপুরোহিত ও অমাত্যদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকল। ঐশ্বৰ্যবান ও ক্ষমতাশালী রাজন্যরা যজ্ঞানুষ্ঠানের জাঁকজমক দেখানোর জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রবৃত্ত হতেন বলে পুরোহিতশ্রেণী দক্ষিণা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যাপারে বিস্তর দান,দক্ষিণা পেয়ে প্ৰভূতভাবে লাভবান হতেন। সুতরাং তাদের সোৎসাহ প্রচেষ্টায় সোমচর্য ও সামবেদ যেমন সর্বাধিক প্রাধান্য অর্জন করে, তেমনি উত্তেজক পানীয় সোমরসের ব্যবহারের ফলেও সোমযাগ পুরোহিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু একসময় এই সোমচর্য যেমন চূড়ান্ত বিন্দুতে উপনীত হল। তেমনি সোমবস্তুটি বিরল হয়ে যাওয়ায় এবং সেই সঙ্গে বিকল্পরাপে উপস্থাপিত অন্যান্য উদ্ভিজগুলি উত্তেজক পানীয়রাপে আকাঙিক্ষত ফলদানে অসমর্থ হওয়ায় সোমযাগের আবেদন ধীরে ধীরে নিম্প্রভ হয়ে এল। তাছাড়া দীর্ঘস্থায়ী সোমযোগে এত বেশিসংখ্যক পশু নিহত হ’ত যে কিছুকাল পরেই এই সম্পর্ক বেশ কিছু আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বস্তুত, বহু অনুপুঙ্খাযুক্ত ব্যাপ্তির আতিশয্য, জটিলতা ও অনুষ্ঠানের পৌনঃপুনিকতা থাকার ফলে সোমব্যাগের মধ্যেই যজ্ঞধর্মের ক্রমাগত অধোগতি সূচনা হয়েছিল। যদিও খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর পূর্বে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্পষ্টভাবে শ্রুতিগােচর হয় নি, আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারি যে, সোমচর্য ও সামবেদের চূড়ান্ত সিদ্ধির দিনেই ক্ষয়প্রক্রিয়ারও সূচনা হয়ে গিয়েছিল।