সমষ্টির কামনা, ব্যষ্টির কামনা নয়
ঋগ্বেদের প্রাক্-বিভক্ত সমাজের স্মারকগুলিকে সনাক্ত করবার চেষ্টা করা হয়নি। ফলে, ঋগ্বেদের কবিতাগুলির একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত প্রকট ও স্পষ্টভাবে আমাদের চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তা বৈদিক সাহিত্যবিদদের চোখে পড়তে চায়নি। বৈশিষ্ট্যটি হলো, ওই যে ধন, অন্ন, পশু, পুত্র, নিরাপত্তা প্রভৃতির কামনা,—যে-কামনাকে সমগ্র ঋগ্বেদের মূলসূত্র বলে দেখতে পাওয়া যায়,—তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের কামনা নয়, সমষ্টিগত কামনা। নিজের জন্যে চাওয়া নয়, দলের জন্যে চাওয়া। “আমাকে দাও”—এমন কথা ঋগ্বেদের কোথাওই খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় বললে নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলা হবে। কেননা দ্বিসহস্রাধিক বছর ধরে রচিত এই সুবিশাল সাহিত্যের সুর আগাগোড়া এক নয়। আমরা একটু পরেই দেখতে পাবে, এ-সাহিত্যের অর্বাচীনতম অংশে ব্যক্তিবিশেষের উচ্চাকাঙ্খা ও দম্ভ সমষ্টিগত জীবনকে পদদলিত করবার আয়োজন করেছে। কিন্তু তবুও এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই যে, ঋগ্বেদের প্রধানতম কথা হলো “আমাদের দাও”, “আমাকে দাও” নয় : আমাদের ধন বর্ধিত হোক, আমাদের পশু বর্ধিত হোক, আমাদের অল্প বর্ধিত হোক, আমাদের শক্রর বিনাশ হোক, আমাদের নিরাপত্তার আয়োজন হোক। এমনকি পুত্রের জন্য যে-কামনা তাও প্রধানতই সমষ্টিগত; আমাদের বীর পুত্র উৎপন্ন হোক। একটি কামনা ঘুরেফিরে বারবার—প্রায় ধূয়ার মতো— ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলে, অর্থাৎ প্রাচীনতম অংশটিতে, ব্যক্ত হয়েছে; বৃহদ্বদেম বিদখে মুবীরা, অর্থাৎ, আমরা বীর পুত্রের জন্য সভায় বিশেষ করিয়া বলিতেছি। দ্বিতীয় মণ্ডলে বাইশবার (এবং নবম মণ্ডলে একবার) এই ধুয়াটির উল্লেখ পাই।
ইতিপূর্বে যে-ঋক্গুলি উদ্ধৃত করেছি তার মধ্যেই এই সমষ্টিগত-কামনার দিকটি দেখতে পাওয়া কঠিন হবে না। এখানে আরো কিছু দৃষ্টান্তের উল্লেখ করবো।
ব্ৰহ্মণস্পতে ত্বমস্য যন্তা সুক্তং চ বোধি তনয়ং চ জিন্ব।
বিশ্বং তদ্ভদ্রং যদবন্তি দেবা বৃহদ্বদেম বিদথে সুবীরাঃ॥
অর্থাৎ, —হে ব্ৰহ্মণস্পতি, তুমি ইহার নিয়ামক। তুমি সূক্তকে জান এবং তনয় দান কর; দেবতারা যাহাদিগকে রক্ষা করেন তাহারা সমস্তই মঙ্গলময়; আমরা বীর পুত্রসমূহের জন্য এই সভায় তোমাকে বিশেষ করিয়া বলিতেছি॥ ঋগ্বেদ : ২.২৩.১৯ এবং ২.২৪.১৬॥
মা নঃ শংসো অবরুষো ধূর্তি প্রণঙ্ মর্ত্যস্য
রক্ষা ণো ব্রহ্মণস্পতে।
অর্থাৎ, —হে ব্ৰহ্মণস্পতি, তুমি আমাদিগের উপদ্রবকারী শক্রকে হিংসা কর, তাহারা যেন আমাদিগকে কদাপি না প্রাপ্ত হয়; হে ব্ৰহ্মণস্পতি, তুমি আমাদিগকে রক্ষা কর॥ ঋগ্বেদ : ১.১৮.৩ ॥
হিরণ্যপাণিঃ সবিতা সুজিহ্বস্ত্রিরা দিবো বিদথে পত্যমানঃ।
দেবেষু চ সবিতঃ শ্লোকমঃশ্রেরাদস্মভ্যমা সুব সর্বতাতিম্॥
অর্থাৎ,–হে হিরণ্যপানি সবিতা, তুমি শোভন জিহ্বাযুক্ত, তুমি তিনবার স্বর্গ হইতে এই সভায় আসিতেছ; হে সবিতা, দেবগণের মধ্যে এই শ্লোকটিকে লইয়া যাও এবং সর্বপ্রকারে আমাদিগকে কাম্যফল প্রেরণ কর॥ ঋগ্বেদ : ৩.৫৪.১১ ॥
শৃন্বস্তু নো বৃষণঃ পর্বতাসে ধ্রুবক্ষেমাস ইলয়া মদন্তঃ।
আদিত্যৈর্নো অদিতিঃ শৃণোতু যচ্ছন্তু নো মরুতঃ শৰ্ম ভদ্ৰম্।
অর্থাৎ, —হে কামবর্ষী পর্বতসমূহ (মরুৎগণ), আমাদের শ্রবণ কর; অন্ন (ইলা) দ্বারা আনন্দিত হইয়া নিশ্চল রূপে আমাদিগকে শ্রবণ কর; আদিত্যগণের সহিত অদিতি আমাদিগকে শ্রবণ করুন এবং আমাদিগকে মরুৎগণ মঙ্গলময় মুখ প্রদান করুন ॥ ঋগ্বেদ : ৩.৫৪.২০ ॥
অস্মভ্যং তদ্বসো দানায় রাধঃ সমর্থয়স্ব বহু তে বসব্যম্।
ইন্দ্র যচ্চিত্রং শ্রবস্যা অনু দ্যূন্ব্য হদ্বদেম বিদথে সুবীরাঃ।
অর্থাৎ, —আমাদিগকে সেই ধন দান করিবার জন্য যাঞ্চা করিতেছি; হে ইন্দ্ৰ, তোমার ধন প্রভূত, তুমি আমাদিগকে দানের জন্য সমর্থ কর; সেই সঞ্চিত ধন ভোগ করিতে ইচ্ছা করি; আমরা বীর পুত্রের জন্য এই সভায় তোমাকে বিশেষ করিয়া বলিতেছি॥ ঋগ্বেদ : ২.১৩.১৩ এবং ২.১৪.১২॥
অস্মভ্যং রোদসী রয়িং মধ্বো বাজস্য সাতয়ে।
শ্রবো বসূনি সং জিতম্॥
অর্থাৎ, —হে দ্যাবাপৃথিবী, তোমরা দুইজন দেবতাদিগের আনন্দজনক অন্ন লাভ করিবার জন্য আমাদিগকে অন্ন এবং ধনসমূহ জয় করিয়া দাও॥ ঋগ্বেদ : ৯.৭. ৯।
ঋগ্বেদ-সংহিতা পার্থিব সম্পদের কামনায় ভরপুর। কিন্তু সে-সম্পদ ব্যক্তির জন্য নয়, সমষ্টির জন্য।
ঋগ্বেদে ব্যক্তিগত সম্পত্তির কথা একেবারেই নেই বা ব্যক্তিগত সম্পদের কামনা কোথাওই দেখতে পাওয়া যায় না,—এ-দাবি ভুল হবে। কেননা, বৈদিক মানুষদের সমাজজীবন একই জায়গায় থেমে থাকেনি : প্রাক্-বিভক্ত সমাজের পরিধি ছেড়ে কালক্রমে বৈদিক আর্যরাও শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। আমরা শুরুতেই দেখেছি, পশুপালন-নির্ভরতার যে উচ্চ স্তরটিতে বৈদিক আর্যরা জীবন যাপন করতেন বলে অনুমান করবার সুযোগ রয়েছে, ঐতিহাসিক বিবর্তনের সাধারণ নিয়ম অনুসারে তাকে প্রাক-বিভক্ত ও শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের মধ্যবৰ্ত্তী সীমা-প্রদেশ বলে সনাক্ত করা অসম্ভব নয়। অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্যের পিছন দিকে প্রাক-বিভক্ত সমাজের স্মৃতি, সামনে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের আভাস। তাই ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রাচীনতর অংশগুলিতে যে-পার্থিব সম্পদের কামনা, তা মূলতই বা প্রধানতই ব্যষ্টিকেন্দ্রিক নয়—গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। অথচ, ঋগ্বেদের এই বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রকট হওয়া সত্ত্বেও বেদ-বিদেরা তার আলোচনা তোলেননি। কেননা, আধুনিক বিদ্বানদের চেতনায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি সনাতন; তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির আকাঙ্ক্ষা বৈদিক সাহিত্যে যতোই গৌণ হোক না কেন এই বৈশিষ্ট্যটি আধুনিক বিদ্বানদের চোখে পড়ে না। আমরা ইতিপূর্বে (পৃ. ১৭৬) দেখেছি, মার্ক্স্ একেই বলেছেন judicial blindness.