সকালবেলা শাহনাজের ঘুম ভাঙল এক ধরনের মনখারাপ ভাব নিয়ে। এখানে সে বেড়াতে এসেছিল আনন্দ করার জন্য এখন বোঝাই যাচ্ছে আনন্দ দূরে থাকুক, সময় কাটানো নিয়ে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। মন ভালো থাকলে যেটাই করা যায় তাতেই আনন্দ হয়, আর মন খারাপ থাকলেই কিছুই করতে ভালো লাগে না। এখানে আসার সময় এতগুলো মজার মজার বই নিয়ে এসেছে, এখন কোনোটাই খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না। সোমাকে যদি হাসপাতালেই থাকতে হয় তা হলে শাহনাজদের তো আর একা একা বাসায় থাকার কোনো কারণ নেই। কীভাবে ফিরে যাবে ইমতিয়াজের সাথে কথা বলে সেটা ঠিক করতে হবে পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে শাহনাজের আরো বেশি মনখারাপ হয়ে গেল।
ঘুম থেকে উঠে নাশতা করার সময় শাহনাজ আবিষ্কার করল ইমতিয়াজ কোথায় জানি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই জেনেও শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে টিটকারি করে কিছু একটা বলবে ভেবেছিল কিন্তু শাহনাজকে অবাক করে দিয়ে ইমতিয়াজ প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল, ঝরনাটা নিজের চোখে দেখে আসতে চাই। জলজ্যান্ত একটা ঝরনা কীভাবে উধাও হতে পারে ইনভেস্টিগেট করা দরকার। মুখে খুব একটা গভীর ভাব করে বলল, মনে হয় কোনো জিওলজিক্যাল একটিভিটি হচ্ছে। দেখে আসি।
ইমতিয়াজের প্রস্তুতি দেখে অবশ্য মনে হল সে দুই মাইল দূরে একটা ঝরনা দেখতে যাচ্ছে না, মরুভূমি বন প্রান্তর সমুদ্র পার হয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযান করতে যাচ্ছে। একটা ব্যাক প্যাকে তার জন্য দুইটা স্যান্ডুউইচ, দুইটা কোল্ড ড্রিংক এবং কিছু ফলমূল দিতে হল। ব্যান্ডেজ, এন্টিসেপটিক লোশন, মাথাব্যথার ট্যাবলেট, ছুরি, নাইলনের দড়ি কিছুই বাকি থাকল না। টি–শার্টের ওপর সোয়েটার, তার ওপর জ্যাকেট, মাথায় বেসবল ক্যাপ, পায়ে টেনিস শু–এক কথায় পুরোপুরি অভিযাত্রী। রওনা দেওয়ার সময় অবশ্য কাজের ছেলেটাকে সাথে সাথে যেতে হল কারণ ইমতিয়াজের নিজের দুই মাইল ব্যাক প্যাক টেনে নেওয়ার শক্তি নেই এবং এই নির্জন জংগুলে জায়গায় যদি বাঘ–ভালুক তাকে খেয়ে ফেলে। সেটা নিয়েও একটা ভয় রয়েছে।
ইমতিয়াজ চলে যাবার পর শাহনাজ সোমার খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করল। কোনো একটি বিচিত্র কারণে চা–বাগানে টেলিফোনের অবস্থা খুব ভালো না। সোমাদের বাসায় যেটা আছে সেটা দিয়েও খুব সহজে কোথাও ডায়াল করা যায় না। সোমা যে হাসপাতালে আছে সেটার টেলিফোন নম্বরটাও জানা নেই–ইচ্ছে থাকলেও পেঁজ নিতে পারবে না। চা–বাগানের একটা। বড় ফ্যাক্টরি আছে, সেখানে অনেকে আছেন, তাদের সাথে কথা বললে হয়তো কেউ খোঁজ দিতে পারবে। শাহনাজ দুপুরবেলা একবার ধোঁজ নেওয়ার জন্য বের হবে বলে ঠিক করল।
শাহনাজের হিসাব অনুযায়ী ইমতিয়াজ ফিরে আসতে আসতে একেবারে বিকেল হয়ে যাবার কথা–শহুরে আঁতেল ধরনের মানুষেরা আসলে দুর্বল প্রকৃতির হয়, সিগারেট খেয়ে ফুসফুঁসের বারোটা বাজিয়ে রাখে বলে হাঁটাহাঁটি করতে পারে না। পাহাড়ি জঙ্গলের পথে দুই মাইল হেঁটে যেতে এবং ফিরে আসতে ইমতিয়াজের একেবারে বারোটা বেজে যাবে– কাজেই সে যে বেলা ডুবে যাবার আগে ফিরে আসতে পারবে না, সে ব্যাপারে শাহনাজের কোনো সন্দেহই ছিল না। ফিরে এসেও সে যে এই দুই মাইল হেঁটে যাওয়া নিয়ে এমন বিশাল একটা গল্প ফেঁদে বসবে শাহনাজ সেটা নিয়েও একেবারে নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু আসলে যেটা ঘটল সেটার জন্য শাহনাজ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ইমতিয়াজ। ফিরে এল দুপুরের আগেই এবং যখন সে ঘরে এসে ঢুকেছে তখন তাকে দেখলে যে–কেউ বলবে সে বুঝি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। উত্তেজনায় সে কথাই বলতে পারছিল না। কাজেই কাজের ছেলেটার কাছে জিজ্ঞেস করতে হল। কিন্তু সে মাথা চুলকে জানাল যে ইমতিয়াজ কী বিষয় নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ে আছে সে বুঝতে পারছে না। তার ধারণা ইমতিয়াজ সেখানে কিছু একটা দেখে এসেছে। শাহনাজ খুব কৌতূহল নিয়ে ইমতিয়াজকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া তুমি কী দেখেছ?
ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে বুকে থাবা দিয়ে বলল, আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। ওয়ার্ল্ড ফেমাস। কেউ আর আটকাতে পারবে না।
পোস্ট মডার্ন কবিতা লিখে ইমতিয়াজ একদিন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও লজ্জার মাঝে ফেলে দেবে এ রকম একটা কথা শাহনাজ অবশ্য আগেও শুনেছে কিন্তু এটি মনে হয় অন্য ব্যাপার। সে জানতে চাইল, কী জন্য তুমি বিখ্যাত হয়ে গেছ?
আমি এমন জিনিস আবিষ্কার করেছি যেটা সারা পৃথিবীর কেউ কোনোদিন দেখে নাই, কোনোদিন কল্পনাও করে নাই। শুধু স্বপ্ন দেখেছে! ইমতিয়াজ এই পর্যায়ে উঠে দাঁড়িয়ে একপাক ভরতনাট্যম কিংবা খেমটা নাচ দিয়ে চিৎকার করে বলল, এখন আমি বি.বি.সির সাথে ইন্টারভিউ দেব, সি. এন. এন.–এর সাথে ইন্টারভিউ দেব। টাইম, নিউজউইকের কভারে আমার ছবি ছাপা হবে, রিডার্স ডাইজেস্টে আমার ওপর লেখা বের হবে
ইমতিয়াজ কথা বন্ধ করে দুই হাত উপরে তুলে ইয়াহু বলে একটা চিৎকার দিল।
শাহনাজের হঠাৎ সন্দেহ হতে থাকে ইমতিয়াজকে পথেঘাটে কেউ কোনো ড্রাগ খাইয়ে দিয়েছে কি না। সে কাজের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়াকে কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে নাকি? ধুতুরার বীজ না হলে অন্য কিছু?
কাজের ছেলেটা ফ্যাকাসে মূর্খে বলল, সেটা তো জানি না, আমি নিচে ছিলাম। স্যার একা টিলার উপরে উঠলেন, তারপর থেকে এইরকম অবস্থা।
অন্য কোনো সময় হলে ওদের এই কথা শুনে ইমতিয়াজ রেগেমেগে চিৎকার করে একটা কাণ্ড করত, এখন বরং হা হা করে হেসে উঠল। বলল, ভাবছিস আমি নেশা করছি? শুনে রাখ এইটা এমন ব্যাপার, কেউ যদি শোনে তার নেশা জন্মের মতো ছুটে যাবে।
কেন? কী হয়েছে?
সেই পাহাড়ে আমি কী দেখেছি জানিস?
কী?
একটা জলজ্যান্ত স্পেসশিপ!
শাহনাজ ভুরু কুঁচকে বলল, কী বললে? স্পেসশিপ?
হ্যাঁ। এরিখ ফন দানিকেন যেটা বলেছিলেন সেটাই মনে হয় সত্যি। ইমতিয়াজের গলা হঠাৎ আবেগে কেঁপে ওঠে, এই পৃথিবীর মানুষেরা হয়তো এসেছে গ্রহান্তর থেকে এই চা–বাগানে পাহাড়ের নিচে লুকিয়ে আছে সেই মহাকাশযান–পৃথিবীর ইতিহাস হয়তো আবার নতুন করে লিখতে হবে, সেই ইতিহাসের মাঝে যে নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে সেটা হচ্ছে– ইমতিয়াজ ধুমসো গরিলার মতো বুকে থাবা দিয়ে বলল, ইমতিয়াজ আহমেদ।
শাহনাজ এখনো পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারছে না। সত্যি সত্যি যদি ইমতিয়াজ একটা স্পেসশিপ খুঁজে পায় সেটা নিশ্চয়ই সাংঘাতিক একটা ব্যাপার, কিন্তু ইমতিয়াজের এই নর্তনকুর্দন দেখে কোনোকিছুই ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না। পুরো ব্যাপারটাই নিশ্চয়ই এক ধরনের বিকট রসিকতা কিন্তু ইমতিয়াজকে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই।
ইমতিয়াজ বুকে থাবা দিয়ে বলল, খালি কি বিখ্যাত হব? নো–ও–ও–ও–ও! নো নো–নো! খ্যাতির সাথে আসবে ডলার। সবুজ সবুজ ডলার। বস্তা বস্তা ডলার! এই বান্দা বড়লোক হয়ে যাবে। বিখ্যাত এবং বড়লোক। কোথায় সেটল করব জানিস? মায়ামিতে! গরমের সময় চলে যাব সিয়াটল!
শাহনাজ ইমতিয়াজের প্রলাপের মাঝে একটু অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। যেরকম উত্তেজিত হয়েছে, মনে হয় আসলেই কিছু একটা দেখেছে। চা–বাগানের কাছে। পাহাড়ের নিচে স্পেসশিপ খুঁজে পাওয়া ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব, কিন্তু সত্যিই যদি হয়ে থাকে? শাহনাজ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল, ভাইয়া, তুমি কেমন করে জান সেটা স্পেসশিপ?।
আমি জানি। তুই স্পেসশিপ দেখলে চিনতে পারবি না, কিন্তু আমি পারি। ইমতিয়াজ আবার বুকে থাবা দিল। যেভাবে খানিকক্ষণ পরপর বুকে থাবা দিচ্ছে, বুকের পাজরের এক আধটা হাড় না আবার ভেঙে যায়।
আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে? আমিও দেখে আসি?
হঠাৎ করে ইমতিয়াজ চুপ করে গেল, তার চোখদুটো ছোট হয়ে যায়, আর সে এক ধরনের কুটিল চোখে শাহনাজের দিকে তাকাল। কিছুএকটা ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছে এ রকম ভাব করে বলল, ও! আমাকে তুই বেকুব পেয়েছিস? ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না?
শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বোঝ না?
তোরও শখ হয়েছে বিখ্যাত হবার টাইম নিউজউইকের কভার? ইমতিয়াজ বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মতো পা দাপিয়ে চিৎকার করে বলল, নেভার। তারপর বুকে আঙুল দিয়ে বলল, আমি এটা আবিষ্কার করেছি, বিখ্যাত হব আমি। আমি। আমি আমি। আমি একা। বুঝেছিস?
শাহনাজের সন্দেহ হতে থাকে যে তার ভাইয়ের মাথাটা মনে হয় একটু খারাপই হয়ে গেছে। সে অবাক হয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকাল। ইমতিয়াজ আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করে বলল, এখন আমি সেখানে ফিরে যাব ক্যামেরা নিয়ে। সেই ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখব। এক–একটা ছবি বিক্রি হবে এক মিলিয়ন ডলারে। বুঝেছিস?
কিন্তু তুমি কি ক্যামেরা এনেছ?
কিন্তু তুই তো এনেছিস? ইমতিয়াজ চোখ লাল করে বলল, আনিস নি?
হ্যাঁ।
দে ক্যামেরা বের করে এক্ষুনি। না হলে খুন করে ফেলব।
শাহনাজ কোনো কথা বলল না। তাড়াতাড়ি সুটকেস খুলে আঘার ক্যামেরাটা বের করে দিল। ইমতিয়াজ সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লিখবে এই ইমতিয়াজ আহমেদ!
ইমতিয়াজ ক্যামেরাটা নিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, ছবি তুলে তুমি কি এখানে আসবে? নাকি সোজাসুজি ঢাকা চলে যাবে?
সোজাসুজি ঢাকা যাব, কেন?
আমিও ঢাকা যাব।
ইমতিয়াজ চিড়বিড় করে তেলে–বেগুনে জ্বলে উঠে বলল, এখন আমার আর কোনো কাজ নেই তোকে ঘাড়ে করে ঢাকা নিয়ে যাই।
তা হলে আমি ঢাকা যাব কেমন করে?
সেটার আমি কী জানি? তোকে এখানে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল, পৌঁছে দিয়ে গেছি। ব্যস আমার কাজ শেষ।
শাহনাজ রাগের চোটে কী বলবে বুঝতে পারল না। অনেক কষ্ট করে বলল, ভাইয়া, এখানে আর কেউ নেই। চাচা–চাচি কবে আসবে আমি কিছু জানি না–
তোর সমস্যাটা কী? বাসায় কাজের মানুষ আছে, বুয়া আছে, তোকে দেখেশুনে রাখবে।
ঐ পাহাড়ে গিয়ে তোমার কোনো বিপদ–আপদ হয় কি না সেটা কীভাবে বুঝব?
হবে না।
যদি হয় তা হলে তো জানতেও পারব না।
ইমতিয়াজ মুখ ভেংচে বলল, আমার জন্য তোর যদি এত দরদ তা হলে ঢাকায় ফোন করে খোঁজ নিস।
এই চা–বাগানের ফোন কাজ করে না, কিছু না–
ইমতিয়াজ ধমক দিয়ে বলল, এখন আমি তোর জন্য এখানে মোবাইল ফোনের অফিস বসাব নাকি?
কাজেই ইমতিয়াজ দুপুরবেলা পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দিল। যাবার আগে শেষ কথাটি ছিল বিবিসি টেলিভিশনটা ধরে রাখতে। পরদিন সেখানে তাকে নাকি দেখা যাবে।
.
রাতটা শাহনাজ একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটাল। ইমতিয়াজ বিখ্যাত হয়ে কোটি কোটি ডলারের মালিক হয়ে গেলে তার কোনো আপত্তি নেই। এক বাসায় থাকতে হলে হয়তো জীবনটা বিষাক্ত করে দিত, কিন্তু নিজেই বলেছে আমেরিকা গিয়ে থাকবে, কাজেই একদিক দিয়ে ভালোই। কিন্তু একা একা কোনো পাহাড়ে গিয়ে, কি স্পেসশিপের ছবি তুলে ফিরে যেতে যদি কোনো বিপদে পড়ে, কেউ তো জানতেও পারবে না। শাহনাজ স্বীকার করছে। তার এই ভাইয়ের জন্য বুকের মাঝে ভালবাসার বান ছুটছে না, কিন্তু সবকিছু নিরাপদ আছে–মনের শান্তির জন্য এইটুকু তো জানা দরকার।
সকালে উঠে সে ঢাকায় তাদের বাসায় ফোন করার চেষ্টা করল, কিন্তু চা–বাগানের টেলিফোন কানেকশন কিছুতেই বাগান থেকে বের হতে পারল না। কী করবে সে ভেবে পাচ্ছিল না। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে বসে চিন্তা করছে, তখন হঠাৎ সে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে দেখতে পেল, লম্বা লোহার মতো একটা জিনিসের আগায় চ্যাপ্টা থালার মতো একটা জিনিস লাগানো, একপাশে একটা ছোট বাক্সের মতো, সেখান থেকে কিছু তার হেডফোনে এসে লেগেছে, গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা শুনতে শুনতে হেঁটে যাচ্ছে। শাহনাজ উঠে দাঁড়িয়ে ডাকল, ক্যাপ্টেন ডাবলু।
প্রথম ডাকে শুনতে পেল না, দ্বিতীয় ডাকে ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকাল। তাকে দেখে খুশি হয়ে সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, শাহনাজ আপু! এই দেখ মেটাল ডিটেক্টর তৈরি করেছি।
মেটাল ডিটেক্টর? কী হয় এটা দিয়ে?
মাটির নিচে কোনো গুপ্তধন থাকলে খুঁজে বের করে ফেলব।
খুঁজে পেয়েছ কিছু?
এখনো পাই নাই, দুইটা পেরেক আর একটা কৌটার মুখ পেয়েছি।
কথা বলতে বলতে শাহনাজ বারান্দা থেকে নেমে রাস্তায় ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার একটা কথা মনে হল, ক্যাপ্টেন ডাবলুকে নিয়ে সে কি ঝরনার কাছে রহস্যময় স্পেসশিপটা দেখে আসতে পারে না?
ক্যাপ্টেন ডাবলু কান থেকে হেডফোন খুলে তার মেটাল ডিটেক্টরের সুইচ অফ করে জিজ্ঞেস করল, শাহনাজ আপু, তুমি আর কত দিন আমাদের চা–বাগানে থাকবে?
শাহনাজ ইতস্তত করে বলল, আমি আসলে জানি না। আমি তো সোমা আপুর কাছে বেড়াতে এসেছিলাম কিন্তু সেই সোমা আপুই হাসপাতালে। আমি এখানে থেকে কী করব?
ক্যাপ্টেন ডাবলু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হল না, তবে সে বেশি মাথা ঘামাল না, মাথা নেড়ে বলল, যদি চলেই যাও তা হলে এখানে দেখার মতো যেসব জিনিস আছে সেগুলো দেখে যাও।
কী আছে দেখার মতো?
ফ্যাক্টরিটা দারুণ। গ্যাস দিয়ে যে হিটার তৈরি করেছে সেটা একেবারে জেট ইঞ্জিনের মতো। ইস্! আমার যদি একটা থাকত!
থাকলে কী করতে?
কত কী করা যেত। একটা হোভার ক্র্যাফটই কাতাম।
আর কী আছে দেখার মতো?
ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু চিন্তা করে বলল, বাগানের একপাশে একটা ছোট নদীর মতো আছে, তার পাশে একটা পেট্রিফাইড উড আছে। বিশাল গাছ ফসিল হয়ে আছে। আমি একটুকরা ভেঙে এনেছি, কার্বন ডেটিং করতে পারলে কত পুরোনো বের করতে পারতাম।
শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর সব ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা আর প্রকাশ করল; জিজ্ঞেস করল, এখানে আর কী কী দেখার আছে? একটা নাকি ঝরনা আছে?
হ্যাঁ একটা ঝরনা আছে। এক শ তেপ্পান্ন মিটার উপর থেকে পানি পড়ছে।
এক শ তেপ্পান্ন?
হ্যাঁ আমি মেপেছি।
শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একনজর দেখে বলল, তুমি জান সেই ঝরনাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু অবাক হয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল, অদৃশ্য হয়ে গেছে!
হ্যাঁ। আমার ভাই দেখতে গিয়েছিল, যেখানে ঝরনাটা ছিল সেখানে ঝরনাটা নাই।
অসম্ভব। ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, এই ঝরনাটায় সারা বছর পানি থাকে।
বলা ঠিক হবে কি না শাহনাজ বুঝতে পারল না, কিন্তু না বলেও পারল না, গলা নামিয়ে বলল, ঐ ঝরনার কাছে নাকি একটা স্পেসশিপ পাওয়া গেছে।
স্পেসশিপ নিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একটুও উত্তেজিত হতে দেখা গেল না। সে মনে মনে কী একটা হিসাব করে বলল, প্রতি সেকেন্ড প্রায় ষোল শ কিউবিক ফুট পানি আসে। এত পানি যদি ঝরনা দিয়ে না এসে অন্য কোথাও যায়, সেখানে পানি জমে যাবে! ঝরনা। বন্ধ হতে পারে না।
কিন্তু স্পেসশিপ
পৃথিবীতে কমিউনিকেশান্স এত ভালো হয়েছে যে কারো চোখকে ফাঁকি দিয়ে এখানে স্পেসশিপ আসতে পারবে না। যদি সত্যি সত্যি এখানে স্পেসশিপ এসে হাজির হয় তা হলে সারা পৃথিবী থেকে সায়েন্টিস্টরা হাজির হবে।
শাহনাজ আবার চেষ্টা করল, কিন্তু আমার ভাই বলেছে সে নিজের চোখে দেখেছে।
অন্য কিছু দেখেছেন মনে হয়। ক্যাপ্টেন ডাবলু তার মেটাল ডিটেক্টরটা কাঁধে নিয়ে বলল, যাই, দেখে আসি।
কী দেখে আসবে?
ঝরনাটা। পানি কোথায় গেছে?
আমিও যাব তোমার সাথে।
চল।
শাহনাজ একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার আম্মা–আব্বা আবার কিছু বলবেন না তো?
ঝরনাতে গেলে কিছু বলবেন না, কিন্তু
কিন্তু কী?
না থাক! শুনলে তুমি আবার হাসাহাসি করবে। প্যারাসুটের দড়িটা যে পেঁচিয়ে যাবে সেটা কি আমি জানতাম?
ঝরনার সাথে প্যারাসুটের দড়ির কী সম্পর্ক, প্যারাসুটের দড়িটা কোথায় পেঁচিয়ে গেল, কেন সেটা হাসাহাসির ব্যাপার, আর সত্যি যদি হাসাহাসির ব্যাপার হয় তা হলে ক্যাপ্টেন ডাবলুর আব্বা–আম্মা কেন রাগারাগি করলেন শাহনাজ কিছুই বুঝতে পারল। কিন্তু শাহনাজ এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে আর কথা বাড়াল না। বলল, চল তা হলে যাই।
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, তুমি একটু দাড়াও, আমি বাসা থেকে আমার টেস্টিং প্যাক নিয়ে আসি।
টেষ্টিং প্যাক?
হ্যাঁ।
কী আছে তোমার টেষ্টিং প্যাকে?
টেষ্ট করতে যা যা লাগে। মাল্টিমিটার থেকে শুরু করে বাইনোকুলার। বাইরে গেলে আমি সাথে নিয়ে যাই।
ঠিক আছে তা হলে, তুমি নিয়ে আস। আমিও রেডি হয়ে নিই।
শাহনাজও তার ব্যাগটা নিয়ে নেয়। ক্যাপ্টেন ডাবলুর মতো পুরোপুরি টেস্টিং প্যাক তার নেই, কিন্তু খাবার জন্য দুই–একটা স্যান্ডউইচ, বিস্কুটের প্যাকেট, কয়েকটা কমলা, বোতল ভরা পানি, ছোট একটা তোয়ালে, মাথাব্যথার ওষুধ, এন্টিসেপটিক টেপ এবং ছোট একটা নোটবই আর পেন্সিল নিয়ে নিল।
কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাপ্টেন ডাবলু এসে হাজির হল। তার টেষ্টিং প্যাক দেখে শাহনাজের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। বিশাল একটা ব্যাক প্যাক একেবারে নানা জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা! জিনিসপত্রের ভারে ক্যাপ্টেন ডাবলু একেবারে কুজো হয়ে গেছে, একটা মোটা লাঠি ধরে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, এতবড় বোঝা নিয়ে তুমি কেমন করে যাবে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, যেতে পারব। আস্তে আস্তে যেতে হবে। পাওয়ার আর এনার্জির ব্যাপার। অল্প করে পাওয়ার বেশি সময় ধরে খরচ করলেই হবে।
এক কাজ করা যাক, তোমার কিছু জিনিস আমার ব্যাগের ভিতর দিয়ে দাও।
না, না। আমার সব টেষ্টিং যন্ত্রপাতি এক জায়গায় থাকুক।
শাহনাজ শুনেছে বিজ্ঞানীরা নাকি নিজেদের যন্ত্রপাতি নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে হয় তাই সে আর জোর করল না। বলল, ঠিক আছে। তুমি কিছুক্ষণ নাও, তারপর আমি নেব।
ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথাটা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। সত্যিই তারা দেখতে দেখতেই পৌঁছাল। নির্জন পথটায় এত সুন্দর ছোট ছোট টিলা, গাছপালা, ফুল, লতাপাতা যে তার সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেল। ক্যাপ্টেন ডাবলুর টেস্ট প্যাকটা দুজনে মিলে টেনে নিতে গিয়ে অবশ্য একেবারে কালো ঘাম ছুটে গেল। ঝরনার কাছাকাছি। পৌঁছানোর অনেক আগেই ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সে মাথা নেড়ে বলল, শাহনাজ আপু, তুমি ঠিকই বলেছ। ঝরনাটা নেই। ঝরনা থাকলে এখান থেকে শব্দ শোনা যেত।
তারা আরো কাছে এগিয়ে যায়, জায়গাটা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উঠেছে। আশপাশে অনেক ফার্ন এবং শ্যাওলা। ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, ঝরনার পানির জন্য এখানে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে তো, তাই এখানে এ রকম গাছ হয়েছিল। দেখেছ, শ্যাওলাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে?
ক্যাপ্টেন ডাবলুর টেস্ট প্যাক টেনে টেনে শাহনাজ শেষ পর্যন্ত একটা ফাঁকা। জায়গায় এসে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ডাবলু দাঁড়িয়ে সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, শাহনাজ আপু, এই যে এখানে ঝরনাটা ছিল। ঐ উপর থেকে ঝরনার পানি এসে পড়ত। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা জিনিস জান? সামনের পাহাড়টা অনেক উঁচু হয়ে গেছে!
শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, পাহাড় উঁচু হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। আগেরবার মেপেছিলাম, এটা ছিল এক শ তেপ্পান্ন মিটার উঁচু। এখন মেপে দেখি কত হয়?
ক্যাপ্টেন ডাবলু তার টেস্ট প্যাক খুলে সেখান থেকে জ্যামিতি বাক্সের চাঁদা লাগানো একটা জিনিস বের করল, একটা টেপ দিয়ে পাহাড়ের গোড়া থেকে কিছু মাপামাপি করল, তারপর তার উচ্চতা মাপার যন্ত্রটা চোখে লাগিয়ে একটা কিছু মেপে কাগজে হিসাব করতে শুরু করল। শাহনাজ বুঝতে পারল ত্রিকোণোমিতি ব্যবহার করে উচ্চতা মাপছে–সে নিজেও মনে মনে হিসাব করতে থাকে, কিন্তু তার আগেই ক্যাপ্টেন ডাবলু ঘোষণা করল, দুই শ এগার মিটার। তার অর্থ পাহাড়টা আটান্ন মিটার উঁচু হয়ে গেছে! ঝরনার পানি আসবে কেমন করে!
একটা পাহাড় উঁচু হয়ে যায় কেমন করে? শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, পাহাড় তো আর গরু বাছুর না যে আগে বসে ছিল এখন উঠে দাঁড়িয়েছে।
ক্যাপ্টেন ডাবলু মুখ গম্ভীর করে বলল, ভূমিকম্প হলে হয়।
এখানে কি কোনো ভূমিকম্প হয়েছে?
হয় নাই। হলেও সেটা রিক্টর স্কেলে পাঁচের কম। আমার ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র রিক্টর স্কেলে পাঁচের কম ভূমিকম্প মাপতে পারে না।
শাহনাজ আবার মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রিক্টর স্কেলটা কী সেটা সম্পর্কে তার ভাসা–ভাসা একটা ধারণা আছে অথচ এই ছেলে নাকি রিক্টর স্কেলে ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছে! পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে শাহনাজ বলল, ভাইয়া বলেছিল এখানে নাকি একটা স্পেসশিপ নেমেছে। কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না।
না। ক্যাপ্টেন ডাবলু তার টেস্ট প্যাক থেকে বাইনোকুলার বের করে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখতে দেখতে বলল, তবে পাহাড়ের মাঝে বড় বড় ফাটল দেখা যাচ্ছে। পাথর পর্যন্ত ফেটে গেছে। কিছু একটা হয়ে গেছে এখানে।
শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছ থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি পাহাড়ের গায়ে বড় বড় ফাটল। ফাটলগুলো একেবারে নতুন তৈরি হয়েছে। পুরোনো হলে গাছগাছালি জন্মে এতদিনে ঢাকা পড়ে যেত। ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, উপরে গিয়ে দেখতে হবে।
শাহনাজের হঠাৎ কেমন জানি একটু ভয় ভয় করতে থাকে, কী আছে উপরে? পরমূহুর্তে তার ইমতিয়াজের কথা মনে পড়ল, ইমতিয়াজের মতো ভীতু মানুষ যদি একা এখানে আসতে পারে তা হলে মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। সে বলল, চল যাই। তারপর ক্যাপ্টেন ডাবলুর ভয়াবহ টেষ্ট প্যাকটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, এটা কি সাথে নিতে হবে?
না। এটা রেখে যাই, শুধু ভিতর থেকে কিছু জিনিস বের করে নিই।
ক্যাপ্টেন ডাবল যেসব জিনিস বের করল—-দুটি ওয়াকিটকি, নাইলনের দড়ি, সুইস আর্মি চাকু, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, বড় টর্চলাইট, ছোট শাবল–সব মিলিয়ে বোঝাটি অবশ্য খুব ছোট হল না। আগে একটা ব্যাগে ছিল বলে টেনে নেওয়া সোজা ছিল, এখন জিনিসগুলো শরীরের এখানে–সেখানে ঝুলিয়ে পকেটে, হাতে করে নিতে হল বলে একদিক দিয়ে বরং একটু ঝামেলাই হল। রওনা দেবার আগে শাহনাজ তার স্যান্ডউইচগুলো বের করল। দেখে ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আনন্দে চিৎকার করে বলল, তুমি খাবার এনেছ! আমি ভেবেছিলাম আজকে না–খেয়ে থাকতে হবে!
তোমার বুদ্ধিমতো খালি যন্ত্রপাতি আনলে না–খেয়েই থাকতে হত।
ক্যাপ্টেন ডাবলু স্যান্ডউইচে বড় একটা কামড় দিয়ে বলল, মানুষের শরীরে যদি কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন না হয়ে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন হত তা হলে কী মজা হত, তাই না?
কী মজা হত?
অল্প একটু খেলেই সারা জীবন আর খেতে হত না। সেখান থেকেই ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার হিসেবে কত শক্তি পাওয়া যেত!
নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশনের ব্যাপারগুলো শাহনাজ একটু জানে, তাই সে বলল, তা হলে তোমার স্যান্ডউইচ খেতে হত না। খেতে হত ইউরেনিয়াম ট্যাবলেট।
সাংঘাতিক একটা রসিকতা করেছে এ রকম একটা ভাব করে ক্যাপ্টেন ডাবলু হঠাৎ হা হা করে হাসতে শুরু করল। বিজ্ঞানের মানুষজন কোটাকে হাসির জিনিস বলে মনে করে সেটা বোঝা মুশকিল।
খাওয়া শেষ করে পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে তারা রওনা দিল। পাথরে পা রেখে তারা উপরে উঠতে থাকে। সমান জায়গায় হাঁটা সহজ, কিন্তু উপরে ওঠা এত সহজ নয়, কিছুক্ষণেই দুজনে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে।
সামনে একটা সমতল জায়গায় বড় বড় কয়েকটা গাছ। গাছগুলোকে পাশ কাটিয়ে তারা আবার উপরে উঠতে শুরু করে। সামনে খানিকটা খাড়া জায়গা, এটাকে ঘিরে তারা ডানদিকে সরে গেল। পাথরে পা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা পাহাড়ের একটা বিশাল ফাটলের সামনে এসে দাঁড়াল। ফাটলটা কোথা থেকে এসেছে দেখার জন্য দুজনে এটার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। সামনে একটা বড় ঝোঁপ, সেটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতেই ক্যাপ্টেন ডাবলু আর শাহনাজ একসাথে চিৎকার করে উঠল। তারা বিস্ফারিত চোখে দেখতে পেল পাহাড়ের বিশাল ফাটল থেকে একটা মহাকাশযান বের হয়ে আছে। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু দুজনেরই প্রথম প্রতিক্রিয়া হল ছুটে কোথাও লুকিয়ে যাওয়া, কিন্তু দুজনেই একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারা নড়তে পারছিল না, বিশাল মহাকাশযানটি থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া একেবারে অসম্ভব একটি ব্যাপার। দুজনে নিশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ডাব নাকমুখ দিয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করে বলল, ডেঞ্জাস্টিক!
শাহনাজ ফিসফিস করে বলল, কী বললে?
সাংঘাবুলাস। ফাটাফাটিস্টিক। একবারে টেরিফেরিস্টিক!
শাহনাজ বুঝতে পারল এগুলো ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুগ্ধ এবং প্রশংসাসূচক কথাবার্তা, সে কথাবার্তা বলতে বলতে চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে আরো কয়েক পা এগিয়ে গেছে। শাহনাজ ভয়–পাওয়া গলায় বলল, বেশি কাছে যেও না ক্যাপ্টেন ডাবলু।
কিছু হবে না। ক্যাপ্টেন ডাবলু কাঁপা গলায় বলল, যারা এই ছ্যাড়াভাড়াস্টিক টেরিফেরিস্টিক ডেঞ্জাবুলাস স্পেসশিপ বানাতে পারে, তারা ইচ্ছা করলে আমাদের যা–খুশি তাই করতে পারে! ভয় পেয়ে লাভ কী?
ক্যাপ্টেন ডাবলু কয়েক পা এগিয়ে যায় এবং উপায় না দেখে শাহনাজও আরো কয়েক পা এগিয়ে যায়। হঠাৎ তার পায়ে কিছু একটা লাগল। শাহনাজ নিচু হয়ে তাকাতেই দেখতে পেল একটা ক্যামেরা। শাহনাজ সাবধানে ক্যামেরাটা তুলে নেয়। চিনতে কোনো অসুবিধে হয় না এটা তার আব্বার ক্যামেরা, ইমতিয়াজ গতকাল এটা নিয়ে ছবি তুলতে এসেছিল। ছবি তুলে নিশ্চয়ই ফিরে যেতে পারে নি, ফিরে যেতে পারলে ক্যামেরাসহই ফিরে যেত। বিখ্যাত হওয়ার জন্য ইমতিয়াজের এই ক্যামেরা ছবিগুলো দরকার।