০৪. সকলেই সজলের অনুপস্থিতিটা

সকলেই সজলের অনুপস্থিতিটা সেদিন যেন সর্বক্ষণ অনুভব করেছে। তবু সকলে অনেক দিন পর একত্রে মিলিত হওয়ায় প্রচুর হৈ-চৈ করতে লাগল।

বৈশাখের ঐ প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও যেন কারো এতটুকু কোন ক্লান্তিবোধ হয়নি। ক্রমে ক্রমে বেলা পাঁচটা বাজে কারোর ফেরার কথা মনেই হয়নি। বরং সবাই স্থির করে, চাঁদনী রাত আছে—সন্ধ্যার পর সকলে ফিরবে।

সুহাস ঐ সময় বললে, কাগজে আজ লিখেছে কিন্তু বজ্রবিদ্যুৎসহ সন্ধ্যার দিকে এক পশলা বৃষ্টি হতে পারে,

অমিয় বললে, তাহলে আজ অন্তত নিশ্চিন্ত থাকতে পার বন্ধু—আমাদের ঐ আবহাওয়া অফিসের ফোরকাস্ট কোনদিনই ঠিক হয় না। যে দিনটি তারা বলেন, ঠিক তার উল্টোটিই হয়—

সকলে অমিয়র কথায় হেসে ওঠে। সুহাস বললে, কিন্তু কদিন ধরেই আবহাওয়া অফিসের ফোরকাস্ট মিলে যাচ্ছে কিন্তু।

অমিয় বললে, আজ আর মিলবে না দেখে নিও, তাছাড়া—-ছন্দপতন তো শুরুতেই ঘটে গিয়েছে—

কাজল শুধায়, কিসের আবার ছন্দপতন ঘটলো?

উদ্যোক্তাই শেষ পর্যন্ত অনুপস্থিত-আসা হলো না তার।

মিত্রানী সুহাসের মুখের দিকে তাকাল। একবার ইচ্ছা হয়েছিল তার সুহাসকে জিজ্ঞাসা করে, সজল তাকে আর কি বলেছিল। কিন্তু পারে না— কেমন যেন একটা সংকোচ বোধ করে।

কাজল ঐ সময় হঠাৎ বলে ওঠে, তোকে আজ যা নীল রংয়ের সিল্কের শাড়িটায় দেখাচ্ছে না—

সুহাস মৃদু হেসে বললে, মিত্রানীর প্রেমে যেন আবার পড়ে যেও না কাজল, দেখো—

সুহাসের কথায় যেন একটু চমকেই তাকাল মিত্রানী তার মুখের দিকে।

কাজল হাসতে হাসতে জবাব দেয়, যাই বলো সুহাস, আমাদের ছেলে-বন্ধুগুলো একেবারে গবে—দলে মিত্রানীর মতো একটা মেয়ে থাকতে এত বছরে এখনো কেউ ওর প্রেমে পড়তে পারল না।

সুহাস বললে, কি করে জানলে কাজল যে আমাদের মধ্যে কেউ এখনো ওর প্রেমে পড়েনি?

মশাই, অত রেখে ঢেকে কেন? কাজল বললে, কেউ কিছু মনে করবে না—বলে ফেলো, বলে ফেলো—আফটার অল উই আর ফ্রেন্ডস হিয়ার!

মিত্রানী বলে ওঠে, আঃ, কি হচ্ছে কাজল

দেখ বাবা–তোরা যে যাই বলিস, কাজল বললে, প্রেমের ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই আমার বড় ভাল লাগে—প্রেমে পড়াটাও যেমন আনন্দ—প্রেমে কেউ কারোর পড়েছে। শুনেও আনন্দ

বিদ্যুৎ হাসতে হাসতে ঐ সময় বলে ওঠে, অমিয়-ক্ষিতীশ-সুহাস, তোরা কেউ কোন কাজের নোস—মেয়েটা প্রেমের জন্য এত হেদিয়ে উঠেছে, অথচ তোরা—এতগুলো পুরুষমানুষ

সুহাস বললে, একেবারে নীরব–পাষাণ-সব পাষাণ বুঝলে কাজল—

কাজল বলে ওঠে, থাক্ বাবা থাক্‌——আমি না হয় কালোকুচ্ছিত আছি০০

সতীন্দ্র তাড়াতাড়ি বলে, ছিঃ, কাজল-ডোন্ট বি সিরিয়াস! সতীন্দ্র ব্যাপারটা হালকা করে দেবার চেষ্টা করে।

মিত্রানী ঐ সময় বললে, আচ্ছা, তোমরা কেউ আর কি কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। যে, প্রেম নিয়ে সকলে বাকযুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছো?

সতীন্দ্র বললে, ঠিক,—অনা কথা বলো, অন্য কথা।বরং একটা গান হোক, মিত্রানী একটা গান গাও—

অবশেষে মিত্রানীর গানের ভিতর দিয়েই সমস্ত ব্যাপারটা যেন হালকা হয়ে গেল।

 

খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকতে ঢুকতেই বেলা প্রায় তিনটে হয়ে গেল। সকলে হাঁটতে হাঁটতে অতঃপর গঙ্গার ধারে যায়। এবং গঙ্গার ধারে অনেকক্ষণ বসে ছিল ওরা—ইতিমধ্যে অপরাহের আকাশে কখন কালো একখণ্ড মেঘ জমতে শুরু করেছে। ওদের খেয়ালও হয়নি কারো, হঠাৎ খেয়াল হলো আচম্বিতে একটা ধুলোর ঘূর্ণি এলোমেলোভাবে ছুটে আসায়। পরিদৃশ্যমান জগৎটা যেন মুহূর্তে সেই ধুলো আর রাশাকৃত ছেড়া পাতায় একেবারে মুছে একাকার হয়ে গেল।

আঁধি!

মেয়েদের শাড়ির আঁচল আর চুলের রাশ এলোমেলো এবং কেউ কিছু ভাল করে বুঝবার আগেই দলের নজন কে যে কোথায় কেমন করে ছিটকে পড়লো ওরা যেন বুঝতেই পারল না। অবশ্য ঐ প্রচণ্ড ধুলোর ঝড়ের মধ্যে কারো দিকে কারো নজর দেবার মত বুঝি কোন সুযোগও ছিল না।

মিনিট পনেরো কি কুড়ি হবে-ধুলোর ঝড় যখন থেমেছে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি—তারই মধ্যে বিদ্যুৎ লক্ষ্য করলো, সে দলছাড়া হয়ে একটা ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক তাকাল বিদ্যুৎ, কিন্তু আশেপাশে দলের আর কাউকেই সে দেখতে পেল না।

বিদ্যুৎ অন্যান্য সবাইকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলল।

পরে জানা গিয়েছিল, একা বিদ্যুই নয়—সতীন্দ্র, অমিয়, মণি (মণিময়), ক্ষিতীশ, কাজল, পাপিয়া সাতজনই ওরা একে অন্যকে বেশ কিছুটা সময় খুঁজে বেড়িয়েছে। অবশেষে সকলে যখন একত্রিত হয়েছে, কাজলই বললে, সুহাস মিত্রানী, তাদের দেখছি না—তারা দুজন কই?

মিত্রানী—সুহাস। তাই তো, সবাই যেন ঐ মুহূর্তে কাজলের কথায়, মিত্রানী ও সুহাস যে, তাদের মধ্যে নেই—ব্যাপারটা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠলো।

মিত্রানী সুহাস কোথায় গেল!

সকলেই সুহাস আর মিত্রানীর নাম ধরে ডাকে আর ওদের খোঁজে।

মিত্রানী—সুহাস! কোথায় তোমরা! মিত্রানী সু-হা-স—

বিদ্যুৎই ওদের মধ্যে শেষ ঝাপসা আলোয় প্রথমটায় সুহাসকে আবিষ্কার। করেছিল—সর্বপ্রথম। অর্থাৎ ওর দৃষ্টিই সকলের আগে সুহাসের উপরে গিয়ে পড়ে।

সুহাস উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে—একটা ভাঙা পত্রবহুল গাছের ডাল, তারই নীচে সুহাসের দেহের নিম্নাংশ চাপা পড়েছে।

বিদ্যুৎ আর অমিয় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ভাঙা ডালটা টেনে সরায়—অন্যরা সুহাসের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। কাজল ডাকে, সুহাস!

সবাই তার গলায় যেন একটা কান্নার সুর শুনছিল।

মিত্রানীর কথা ঐ মুহূর্তে আর কারো মনে ছিল না। মনেও পড়েনি কথাটা কারো যে একা সুহাসই নয়, মিত্রানীকেও পাওয়া যাচ্ছে না সুহাসকে নিয়েই সকলে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কাজল বসে পড়েছিল একেবারে সুহাসের মাথার সামনে। তার মাথাটা নিজের কোলের উপর তুলে নিয়ে ডাকে, সুহাস—সুহাস–

সুহাস যেন অতি কষ্টে চোখ মেলে তাকাল।

সুহাস—কাজল আরো ঝুঁকে পড়ে সুহাসের মুখের কাছে।

কে?

আ—আমি কাজল।

বিদ্যুৎ এগিয়ে এলো। সে বললে, লেগেছে কোথাও তোর সুহাস?

হ্যাঁ—মাথায়—

সত্যিই সুহাসের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ও রক্ত।

সুহাস উঠে বসতে বসতে বললে, উঃ, ভীষণ চোট লেগেছে মাথায়। এখনো মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম করছে, ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে সুহাস বললে। তারপরই একটু থেমে বললে, মিত্রানী—মিত্রানী কোথায়?

বিদ্যুৎ বললে, মিত্রানীকে দেখছি না। তুই দেখেছিস তাকে?

না তো—তবে—

কি তবে? অমিয় সাগ্রহে শুধায়।

ধুলোয় ঘূর্ণির অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, সুহাস পূর্ববৎ ক্লান্ত গলায় বলতে থাকে থেমে থেমে, হঠাৎ আমার মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত পেলাম পিছন থেকে—মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করে উঠলো—সব অন্ধকার হয়ে গেল

তারপর? বিদ্যুৎ শুধালো।

জানি না। তারপর আর কিছু জানি না।