০৪. শেষপর্যন্ত নিউ ইয়র্কগামী প্লেন

শেষপর্যন্ত নিউ ইয়র্কগামী প্লেনের যাত্রীদের বলা হল, তেইশ নম্বর গেটের দিকে এগিয়ে যেতে, প্লেন এখনই ছাড়বে। সুধামাসিকে নিয়ে এগোল অর্জুন। সুধামাসি বললেন, জানিস, অনেক বাঙালি এই এয়ারপোর্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজনকে দেখলাম আমার চেয়ে বয়স্কা, ছেলের কাছে যাচ্ছেন।

অর্জুন হাসল, ইচ্ছে করলে তুমি একাই আসতে পারতে।

অসম্ভব। এই দ্যাখ না, আমরা কোথায় বসেছিলাম আর প্লেনে উঠতে কোথায় হেঁটে যেতে হচ্ছে। সুধামাসি তাল রাখতে একটু দ্রুত হেঁটে চলেছিলেন।

কথাটা ঠিক। এয়ারপোর্টটা এত বড়, চোখ খোলা রেখে না চললে ঝামেলা হবেই। অর্জুনের মনে হচ্ছিল সমস্ত পৃথিবী থেকে মানুষ এই ট্রানজিট লাউঞ্জে এসে একটা মিনি পৃথিবী তৈরি করে ফেলেছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখতে চেষ্টা করছিল। কফির দোকান থেকে সেই যে লোকটা উধাও হয়েছে আর দেখা পায়নি সে। লোকটা অবশ্য ক্রিমিনাল। ওর দাঁতের ভেতরদিকে কিছু একটা বেআইনি জিনিস লুকিয়ে রেখেছে। তার উচিত ছিল নিরাপত্তাকর্মীদের খবরটা দিয়ে দেওয়া। কিন্তু সুধামাসি তাকে বারংবার নিষেধ করেছেন, না বাবা, দেশের বাইরে এসে তুই ওসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস না। আমরা একটা কাজে যাচ্ছি, এইটে মনে রাখিস।

নতুন প্লেনে উঠে সুধামাসির পাশে আরাম করে বসল সে। স্থানীয় সময়ের সঙ্গে ওদের ঘড়ির ভারতীয় সময়ের যে ব্যবধান বেড়ে চলেছে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে হল সুধামাসিকে। এখানে সকাল হলেও কলকাতায় প্রায় বিকেল। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পিছিয়ে গেছে তারা ইতিমধ্যে। আমেরিকায় গেলে আরও পিছিয়ে যাবে। সুধামাসি অবাক হয়ে বললেন, তাই! এতক্ষণে বুঝলাম এ দেশে এসে বাই এত চটপটে কী করে হয়! প্রত্যেকের বয়স কমে যায় যে!

অর্জুন হাসল। এখন বেশ কয়েক ঘণ্টা আকাশে উড়ে যাওয়া। খাওয়াদাওয়ার পর সিনেমা দেখানো হবে। অনেকেই ঘুমোবে। প্লেন আকাশে ওড়ার পর সে টয়লেটের দিকে এগোল। খানিকটা যাওয়ার পর অর্জুন লোকটাকে দেখতে পেল। মাঝখানের সিটে বসে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে, হাই। সে মাথা নেড়ে টয়লেটে ঢুকে গেল। এই লোকটা ক্রিমিনাল হলেও তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করছে। এ তো করবেই। যে-কোনও ক্রিমিনাল হয় কারও বাবা অথবা ছেলে কিংবা স্বামী। অর্থাৎ একজন মানুষ।

কেনেডি এয়ারপোর্টে যখন প্লেন নামল তখন সূর্যদেব বহাল আছেন আকাশে। যাত্রীদের লাইন দিতে হচ্ছে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। অনেক কাউন্টারের পেছনে কম্পুটার নিয়ে বসে আছেন গম্ভীর মুখের কর্মচারীরা।

প্লেনে তাদের একটি ফর্ম দেওয়া হয়েছিল যাতে নাম-ধাম, পাশপোর্ট নাম্বার ইত্যাদি লিখতে হয়েছিল। সেই ফর্ম এবং পাশপোর্ট ওঁরা পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে তবে আমেরিকায় ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে।

সুধামাসি লাইনে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হলেন, এ কী রে! যেন কেরোসিনের লাইন দিয়েছি। আমরা কি এত খারাপ লোক যে, লাইনে দাঁড় করিয়ে পরীক্ষা নেবে?

অর্জুন বলল, যারা বিদেশ থেকে আসে তাদের এই পরীক্ষা আমাদের দেশেও করা হয়ে থাকে সুধামাসি। কে ভাল কে মন্দ তা তো মুখ দেখে বোঝা যায় না।

যাই বলিস, ওরা যেন আমাদের কৃপাপ্রার্থী হিসেবে দেখছে। ওই দ্যাখ, কীরকম ধমকাচ্ছে।

অর্জুন দেখল একজন যাত্রী লাইন ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে নিরাপত্তাকর্মী ধমক দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিল। সত্যি, জলপাইগুড়িতে কেরোসিনের অভাব হলে দোকানে যে লাইন পড়ে তার কথা এখন মনে পড়ে যাচ্ছে। আসলে প্রতি মিনিটে গোটা পৃথিবী থেকে লোক এই এয়ারপোর্টে নামছে আমেরিকায় ঢুকবে বলে। সুতরাং লাইন অে পড়বেই।

শেষ পর্যন্ত ওদের সামনে কেউ নেই এবং একই সঙ্গে পাশাপাশি দুটো কাউন্টার খালি হওয়ায় ওরা এগিয়ে গেল। অর্জুন পাশপোর্ট আর ফর্ম এগিয়ে দিল। লোকটি ফর্মের লেখায় টিক মেরে পাশপোর্টের ভিসার ছাপ দেখল। দেখে জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছ?

অর্জুন বলল, আমি ওই মহিলার এসকর্ট হিসেবে এসেছি।

আর?

আর কিছু নেই।

লোকটি একটি যন্ত্রের ওপর পাশপোর্টের একটা পাতা চেপে ধরল। তারপর নাম্বারটা কম্পিউটারে টাইপ করে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। চট করে মুখ তুলে অর্জুনকে একবার দেখে নিয়ে লোকটি একটা বোতাম টিপল। সঙ্গে সঙ্গে একজন সাদা পোশাকের অফিসার দ্রুত চলে এলেন কাছে। পাশপোর্ট আর ফর্মটা দেখলেন তিনি। কম্পিউটারের দিকে তাকালেন। অর্জুন বুঝতে পারছিল না কী এমন গোলমাল হয়েছে। ওদিকে সুধামাসির পাশপোর্টে ছাপ মেরে ওরা ছেড়ে দিয়েছে। তিনি সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে চিৎকার করে ডাকলেন, এই যে আমি এখানে, চলে আয়।

সাদা পোশাকের অফিসার ইংরেজি বলল কিন্তু জড়ানো উচ্চারণ, আমার সঙ্গে এসো।

অর্জুন চেঁচিয়ে সুধামাসিকে বলল, আপনি অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।

সুধামাসি কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ওই  মহিলা তোমার সঙ্গে?

হ্যাঁ। আমরা একসঙ্গে আসছি। আমি ওঁর এসকর্ট। কিন্তু কী হয়েছে? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

একটু পরেই জানতে পারবে।

দোতলার একটি ঘরে ওকে বসতে বলল অফিসার। সুদৃশ্য কয়েকটি চেয়ার ছাড়া ঘরে কিছুই নেই। অফিসার ভেতরে চলে গেলে অর্জুন চেয়ারে বসল। সে বুঝতে পারছিল, ওরা তাকে আটক করেছে কিন্তু সে ভেবে কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। আমেরিকান সরকারের পক্ষে অপ্রীতিকর কোনও কাজ সে করেনি এবং প্রশ্নও ওঠে না। সুধামাসির জন্যে খারাপ লাগছিল। উনি নিশ্চয়ই খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। এই সময় আর-একজন অফিসার ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জিমকে কতদিন ধরে চেনো? কী সম্পর্ক তোমাদের?

একসঙ্গে কাজ করো?

কে জিম? আমি ওই নামের কাউকে চিনি না।

মিথ্যে কথা বলে কোনও লাভ হবে না মিস্টার অর্জুন।

আমি মিথ্যে কথা বলছি না।

তুমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। এর আগে আমাদের দেশে এসেছিলে কেন?

বেড়াতে।

হুঁ। তুমি জিমকে চেনো না?

না।

ফলো মি। লোকটি ইঙ্গিত করতে অর্জুন তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হল। দ্বিতীয় ঘর পার হওয়ার পর তৃতীয় ঘরে পৌঁছে সে অবাক হয়ে গেল। সেই লোকটাকে চেয়ারে বসিয়ে দুজন অফিসার কথা বলছে। ওকে কখন ইমিগ্রেশনের লাইন থেকে ধরে নিয়ে এল কে জানে!

লোকটিকে তৃতীয় অফিসার জিজ্ঞেস করল, একে তুমি চেনো?

লোকটি মাথা নেড়ে হাসল, হাই।

এবার অফিসার ঘুরে দাঁড়াল, তা হলে তুমি মিথ্যেবাদী।

কখনও না। ওর নাম যে জিম তাই আমি জানি না। এয়ারপোর্টের টয়লেটে আমার সঙ্গে হেসে দু-একটা কথা বলেছিল। আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করিনি। তারপর ওখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে ওর ব্যাপারে প্রশ্ন করে এবং সস্তুষ্ট হয়ে চলে যায়।

এবং তারপরেও তোমরা কফির দোকানে কথা বলেছ।

হ্যাঁ। সেখানে হঠাৎই দেখা হয়ে যায়। আমি আবার বলছি ওকে আমি চিনি না, এর আগে কখনও দেখিনি, নামও এই প্রথম শুনলাম। আমার সঙ্গে আলাপ করেছিল, সাধারণত লোকে যেরকম করে। তা ছাড়া আমার কাজ অপরাধীকে খুঁজে বের করা, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব নয়। অর্জুন বলল।

তার মানে একে অপরাধী ভেবে বন্ধুত্ব করতে চাওনি?

অবান্তর কথা। পথ চলতে আলাপ হওয়া সহযাত্রী সম্পর্কে কোনও ধারণা তৈরি হয় না, যদি না বিশেষ কোনও ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে সেরকম কিছু হয়নি।

অফিসাররা নিজেদের মধ্যে কথা বলার পর একজন এগিয়ে এলেন, আপনাকে একটু কষ্ট করতে হল বলে দুঃখিত। আশা করি আপনার আমেরিকায় থাকতে ভাল লাগবে। আসুন।

অফিসারটি পাশপোর্টে ছাপ মারিয়ে অর্জুনকে ফেরত দিল।

সুধামাসি একমুখ ভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অর্জুনকে আসতে দেখে দ্রুত আসার চেষ্টা কলেন, কী ব্যাপার? তোর এত দেরি হচ্ছিল কেন? ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছিল। কী হয়েছিল?

তেমন কিছু নয়। মাঝে মাঝে এক-একজনকে ওরা প্রশ্ন করে। তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?

না। কী বলল বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম মেয়ের কাছে এসেছি। জামাই হাসপাতালে। তো এই পাশপোর্টে ছাপ মেরে ইশারা করল এদিকে চলে আসতে।

ওরা সামান্য এগোতেই দেখল বেল্টে সুটকেস ঘুরছে। যাত্রীরা এর মধ্যে যার-যার লাগেজ নিয়ে চলে গিয়েছে। শুধু চারটে সুটকেস পাক খাচ্ছে। অর্জুন তাড়াতাড়ি তিনখানা নামিয়ে নিল। চতুর্থ সুটকেস ওদের নয়। ওপাশে দেওয়ালের ধারে সার দিয়ে ট্রলি রাখা আছে। তার একটাকে টেনে বের করতে না পেরে অর্জুনের মনে পড়ল এ-দেশে পয়সা না দিলে ট্রলি ব্যবহার করা যায়। পকেটে দশ ডলারের নীচে নোট নেই অথচ ডলার জমা দেওয়ার গর্তের ওপর লেখা আছে এক ডলার দিতে হবে। কাছাকাছি কেউ নেই যে, জিজ্ঞেস করবে কী করা যায়। এই সময় সে অবাক হয়ে দেখল লোকটা যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। তা হলে ওরা ওকে ছেড়ে দিয়েছে? নিশ্চয়ই ওর সম্পর্কে খবর এসেছিল কিন্তু কোনও প্রমাণ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। লোকটি বাঁ হাত দিয়ে সুটকেস তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, হাই! প্রব্লেম?

আমার কাছে চেঞ্জ নেই কিন্তু ট্রলি দরকার।

কত ডলারের নোট আছে?

দশ।

ওটাই ভেতরে ঢোকাও।

অর্জুন অবাক হয়ে চ্যাপটা সরু গর্ত দিয়ে দশ ডলারের নোট ঢোকাল। তারপরেই ঝনঝন করে কয়েন পড়তে লাগল। পঞ্চাশ সেন্টের আঠারোটা কয়েন। খট করে শব্দ হল। ট্রলিটা টানতেই সেটা বেরিয়ে এল দঙ্গল থেকে। এগিয়ে গিয়ে সুটকেসগুলো তুলল অর্জুন। লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওরা নিশ্চয়ই ওর ওপর নজর রাখছে। সে সুধামাসিকে বলল, চলো।

অরূপ লাহিড়ী বলেছিলেন, আমি টেলিফোনে আপনার মেয়েকে বলে দিয়েছি কোন ফ্লাইটে আপনারা যাচ্ছেন। উনি এয়ারপোর্টে থাকবেন। সুধামাসির মেয়ে নিশ্চয়ই গাড়ি নিয়ে আসবে। এ-দেশে গাড়ি ছাড়া থাকাই যায় না।

অর্জুন দেখল সামনেই কাস্টমসের অফিসাররা দাঁড়িয়ে আছেন। সবুজ এবং লাল, দুরকম গেট রয়েছে বাইরে যাওয়ার জন্যে। যারা কোনও বেআইনি জিনিস সঙ্গে আনেনি তারা স্বচ্ছন্দে সবুজ গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। লাল গেটে একটাও লোক নেই। অর্জুন সুধামাসিকে নিয়ে সবুজ গেটের দিকে এগোচ্ছিল। ওপাশে যেসব কাস্টমস অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের একজন এগিয়ে এসে পাশপোর্ট দেখতে চাইলেন। অর্জুন নিজেরটা বের করে দিতেই তাতে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি নিশ্চিত যে, ডিক্লেয়ার করার মতো কোনও জিনিস তোমার কাছে নেই? একটু ভেবে বলো।

অর্জুন ঘাড় নাড়ল, না। আমরা কোনও বেআইনি জিনিস আনছি না।

ঠিক আছে, তোমরা ওই টেবিলের সামনে যাও।

ওরা সুটকেস খুলতে বলল। অর্জুন বাধ্য হল তার সব জিনিস দেখাতে। সেখানে কোনও বেআইনি জিনিস নেই। লোকগুলো তার সুটকেস ইকে-টুকে দেখে সুধামাসির দুটো সুটকেস খুলতে বলল। কিছু জামাকাপড়, তারপর প্যাকেট বের হতে লাগল। বিভিন্ন ধরনের বড়ি, নাড়, মিষ্টি, চিড়ে, মুড়ি, সরষের তেলের টিন। কাস্টমসের অফিসার প্রত্যেকটির নাম এবং কী কাজে লাগে জেনে নেওয়ার পর সব বাজেয়াপ্ত করে নিল। আমেরিকায় বিদেশ থেকে খাবার নিয়ে আসার অনুমতি নেই। সুধামাসি খুব রেগে গিয়ে ভাঙা ইংরেজি এবং বাংলায় ওদের বোঝাতে চাইছেন এসব তিনি নিজের হাতে বানিয়েছেন। সাহেবরা কোনওদিন খায়নি বলে বুঝতে পারছে না। ইচ্ছে হলে তাঁর মেয়ের বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসতে পারে। মেয়ে এসব খুব পছন্দ করে বলে তিনি অনেক কষ্ট করে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এতে বরফ গলল না। এর ওপর সুধামাসির কাপড়ের ভাঁজে ন্যাপথলিনের গোল বল পেয়ে ওঁদের মুখ চকচক করে উঠল। প্রবল উৎসাহে সেগুলো সংগ্রহ করে খবর পাঠাতে আর একজন অফিসার ভেতর থেকে এলেন। সামান্য পরীক্ষা করে তিনি হেসে মাথা নাড়লেন, ন্যাপথলিন। ছেড়ে দাও। ভদ্রলোক ফিরে গেলেন।

এবার একজন অফিসার অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে সার্চ করতে চাই।

যা ইচ্ছে করুন। দুটো হাত দুদিকে বাড়িয়ে দিল অর্জুন।

পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত আতিপাতি করে খুঁজে কিছুই না পেয়ে জামার তলায় লুকিয়ে থাকা লকেটটি চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী?

লকেট।

অর্জুন বাধ্য হল লকেটসুদ্ধ হার মাথা থেকে বের করে নিতে। সাপের লকেটের দিকে তাকিয়ে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী ধরনের লকেট?

এটা একটা সাপের লকেট।

সেটা দেখতে পাচ্ছি। মেটালটা কী?

মনে হয় গলা বা ওই জাতীয় কিছু। অর্জুন জবাব দিল।

সুতো ধরে লকেট ঝুলিয়ে ভদ্রলোক সহকর্মীদের দেখালেন। তাঁদের তিনজন বলল, বিউটিফুল, নাই, গুড়।

এটা তুমি কেন পরেছ?

যারা আমার সঙ্গে বিনা কারণে শত্রুতা করবে, সাপের দেবতা তাদের ধ্বংস করবেন।

মাই গড। লোকটি লকেট ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, প্যাকআপ করে চলে যান।

সুটকেসে ভাঁজ করে জামাপ্যান্ট ঢুকিয়ে দেওয়ার পর তা আবার খুলে বের করলে নতুন করে ঢোকানো খুব কষ্টকর। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনও উপায় নেই। অর্জুন সুধামাসিকে বোঝাল, কাস্টমস অফিসারদের অধিকার আছে জিনিসপত্র তল্লাশ করার দেশের স্বার্থেই করে ওরা। লকেট গলায় পরে মালপত্র সুটকেসে কোনওমতে ঢুকিয়ে ওরা আবার ট্রলি নিয়ে বাইরের দিকে এগোল। একটা এলাকার পর অনেক মানুষ নজরে পড়ল। দেশ থেকে আসা অতিথিদের নিয়ে যেতে এসেছেন ওঁরা। অর্জুন দেখল সুধামাসির মেয়ে হাত নাড়ছেন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে। সে হাত নেড়ে সুধামাসিকে বলতেই তিনি সেখান থেকে চিৎকার করলেন, কী অসভ্য দেশ রে এরা। তোর জন্যে যাএনেছিলাম সব কেড়ে নিল! নিশ্চয়ই নিজেরা খাবে অথচ তোদের জন্যে নিয়ে আসতে দেবে না।

অর্জুন বলল, সুধামাসি, অত জোরে জোরে বলবেন না।

ততক্ষণে ওরা বেরিয়ে এসেছে। সুধামাসির মেয়ের নাম অঞ্জনা ব্যানার্জি। তাঁর পরনে জিন্স এবং হালকা পুলওভার। চুল কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা। মায়ের হাত ধরে বললেন, তুমি এসেছ তাই যথেষ্ট।

জামাই কেমন আছে, সেটা আগে বল!

এখন একটু ভাল। তবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে দেরি আছে।

তোর সঙ্গে এর আলাপ আছে? আমাদের জলপাইগুড়ির গর্ব, অর্জুন।

হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। ওয়েলকাম। অঞ্জনা একগাল হাসলেন।

এখান থেকে তোর বাড়ি কত দূরে? সুধামাসি জিজ্ঞেস করলেন। বেশি সময় লাগবে না। এই তিনটে সুটকেস তো? তোমরা বাইরে অপেক্ষা করো, আমি পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে আসি। এখানে এত দূরে গাড়ি রাখতে হয়!

ওরা অঞ্জনার পেছন-পেছন বাইরে আসতেই চমৎকার ঠাণ্ডা আবহাওয়া পেল। কড়া শীত নয়, কিন্তু তার আমেজ রয়েছে। অঞ্জনা চলে গেলেন।

সুধামাসি বললেন, এই প্রথম আমি মেয়েকে প্যান্ট পরতে দেখলাম।

ওঁকে কিন্তু চমৎকার মানিয়েছে। অর্জুন বলল।

এর আগেরবার যখন সে লাইটারের সন্ধানে নিউ ইয়র্কে এসেছিল তখনকার কথা মনে করার চেষ্টা করছিল সে। মেজর এখন এখানে আছেন কিনা কে

জানে! অনেকদিন যোগাযোগ নেই ওঁর সঙ্গে। তার ডায়েরিতে ওঁর নাম্বার লেখা আছে কিন্তু সেই নাম্বারে উনি আছেন কিনা কে জানে।

এই সময় সে লোকটিকে আবার দেখতে পেল। সুটকেস নিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটা তো আগেই সবুজ গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তা হলে এখনও চলে যায়নি কেন? এই লোকটার জন্যে তাকে দু-দুবার ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। অর্জুন দেখল লোকটি এগিয়ে আসছে। কিন্তু হাঁটার ভঙ্গি বেশ আড়ষ্ট, কেমন ভয়-ভয় ভাব। অর্জুন চোখ সরিয়ে নিল। অঞ্জনাদি গাড়ি নিয়ে চলে এলে বাঁচা যায়।

সার? কাঁপা কণ্ঠস্বর কানে আসতে মুখ ফেরাল অর্জুন।

লোকটি দাঁড়িয়ে আছে আড়াই হাত দূরে।

সার। যদি কিছু মনে না করেন তা হলে একটা অনুরোধ করতে পারি?

বলুন!

আপনি যে লকেটটা পরে আছেন সেটা একবার দেখাবেন?

লকেট?

হ্যাঁ, খুলতে হবে না, দূর থেকে দেখালেই হবে। প্লিজ।

আপনি আমাকে মিছিমিছি বিরক্ত করছেন।

আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু সার, একবার, প্লিজ।

অর্জুন বিরক্ত ভঙ্গিতে জামার নীচ থেকে লকেটটা বের করে সামনে তুলে ধরল। সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত শব্দ করে উঠল লোকটা। তারপর হাউমাউ করে ঘঁটু মুড়ে বসে পড়ল অর্জুনের সামনে। সুধামাসি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ও কী, ও কী করছে রে?

অর্জুনও বুঝতে পারছিল না। এখন এ দিকটা বেশ ফাঁকা বলে লোকজন দৃশ্যটা তেমন উপভোগ করছে না। বিড়বিড় করে কিছু বলে লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বারংবার মাথা ঝাঁকাতে লাগল। অর্জুনের হাসি পাচ্ছিল। এই সময় অঞ্জনা গাড়ি নিয়ে একেবারে পাশে চলে এলেন। ডিকি খুলে তিনি এগিয়ে আসতেই অর্জুন সুটকেস তাতে তুলে দিয়ে দেখল লোকটা তখন পরম শ্রদ্ধায় মাথা দুলিয়ে চলেছে।

মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। দু পা এগিয়ে গিয়ে অর্জুন বলল, তোমার দাঁতের ভেতরে একটা প্যাকেট আছে, ওটার কথা কিন্তু আমি এদের বলিনি।

কথাটা শোনামাত্র লোকটা সুটকেস তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগল। সুধামাসি পেছনের আসনে বসে ছিলেন। অর্জুন ড্রাইভিং সিটের পাশে বসতেই অঞ্জনা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? ও পালাল কেন? ভূত দেখল নাকি?

বোধ হয় তাই। অঞ্জনাদি, আপনি একটু ঘুর রাস্তায় গাড়ি চালাবেন? আমরা কোথায় যাচ্ছি তা যদি কেউ ফলো করে দেখতে চায়, তা যেন না পায়। অর্জুন বলল।

সর্বনাশ। চেঁকি দেখছি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানছে। পরে গল্পটা শুনব, আগে তুমি সিটবেল্ট বাঁধে। নইলে আমাকে ফাইন দিতে হবে। অঞ্জনা গাড়ি চালু করলেন।