শূন্য দিয়ে ঘেরা
আমরা একটা প্রাচীন বাইভার্বালে করে শহরের মাঝামাঝি ফিরে এলাম। রিয়া যে গেস্ট হাউজে আছে সেটি ভারি সুন্দর, হ্রদের তীরে ছোট একটা কুটিরের মতো, চারপাশে গাছ দিয়ে ঘেরা। সামনে চমৎকার একটি ফুলের বাগান, বখানে নানা রঙের ফুল। আমাদের রেটিনা যদি পতঙ্গের চোখের মতো আরো স্বল্প তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে সংবেদনশীল হত তা হলে না জানি কী বিচিত্র রঙ দেখতে পেতাম।
রিয়া তার ঘরে গিয়ে যোগাযোগ মডিউলে তার মায়ের সাথে যোগাযোগ করল। খানিকক্ষণ কথা বলে আমার কাছে ফিরে এসে বলল, কিছু একটা গোলমাল আছে।
গোলমাল?
হ্যাঁ।
কী গোলমাল?
জানি না।
আমি রিয়ার দিকে তাকালাম, কিন্তু রিয়ার চোখে–মুখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। সে বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কখনো এরকম হয় নি, যে তুমি জান কোথাও কিছু একটা সমস্যা আছে কিন্তু সমস্যাটি কী ঠিক ধরতে পারছ না?
হয়। অবিশ্যি হয়।
এখানেও সেই একই ব্যাপার। যেমন মনে কর মায়ের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটা, আমি ইচ্ছেমতো করতে পারি না। এখানে এসে কথা বলতে হয়। যখন মায়ের সাথে কথা বলি তখন–
তখন কী?
না, কিছু না।
বলো কী বলতে চাইছ।
মনে হচ্ছে মা কিছু একটা গোপন করতে চাইছে, বলতে চাইছে না।
তোমার মা তোমার কাছে কিছু একটা গোপন করছেন?
রিয়া দুর্বলতাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি ঠিক তা বলি নি। বলেছি যে মনে হচ্ছে কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা করছেন।
সেটাই তোমার মনে হবে কেন?
যাই হোক–ছেড়ে দাও। আমাকে এখানে এক সপ্তাহ থাকতে হবে, দুদিন এর মাঝে পার হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে আর পাঁচদিন কাটিয়ে দেব। তোমার সাথে পরিচয় হয়েছে, এখন এত কষ্ট হবে না। তুমি মানুষটা চমৎকার।
আমি রিয়ার দিকে তাকালাম–মেয়েটি খুব সরাসরি স্পষ্ট কথা বলে–ভদ্রতার নামে নিজেকে আড়াল করে রাখার যে পদ্ধতি আছে সেটি সে জানে না। আমি হেসে বললাম, তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জান না। আমাকে দেখেছ বড়জোর দুই ঘণ্টা, আর বলে ফেললে আমি মানুষটা চমৎকার?
তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ। আমি মানুষকে খুব ভালো বুঝতে পারি।
আমি একেবারেই পারি না। আমার ধারণা ছিল আমি মানুষটা অলস, অকর্মণ্য, কঁকিবাজ, বোকা–এক কথায় একেবারে ফালতু।।
রিয়া খিলখিল করে হেসে বলল, অলস, অকর্মণ্য, ফাঁকিবাজ, বোকা আর ফালতু মানুষেরা চমৎকার হতে পারে না তোমাকে কে বলেছে?
আমিও হেসে ফেললাম, বললাম, তা ঠিক।
চলো কোথাও থেকে খেয়ে আসি। খোজাখুঁজি করলে নিশ্চয়ই ভালো একটা খাওয়ার জায়গা পাওয়া যাবে। রিয়া চোখ নাচিয়ে বলল, আমার কাছে অনেকগুলো ইউনিট, খরচ করতে হবে না?
রিয়া খাবার জন্যে যে জায়গাটি খুঁজে বের করল আমি একা হলে কখনোই সেরকম জায়গায় যেতে সাহস পেতাম না। জায়গাটি হ্রদের উপরে ভাসছে, বিশেষ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করে এক ধরনের আলো-আঁধারি রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। টেবিলের উপর খাবারের তালিকা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম আমরা সচরাচর যেসব কৃত্রিম খাবার খাই এখানে তার কিছু নেই, সব খাবার প্রাকৃতিক! আমি ভয়ে ভয়ে রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এরকম খাবার খাওয়ার মতো ইউনিট আছে তো?
রিয়া খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। আমি হচ্ছি রাজকুমারী রিয়া–সারা পৃথিবীর মাঝে একমাত্র নিখুঁত মানুষ ইউনিটের অভাব বলে আমরা এক বেলা ভালো খাবার খেতে পারব না এটা তো হতে পারে না। তবে রিয়া একমুহূর্ত থেমে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার চিন্তা এখন কোনো না অঘটন ঘটে যায়।
কেন? অঘটন কেন ঘটবে?
তাই তো ঘটছে। সারা জীবনে আমার যতগুলো অঘটন ঘটেছে গত দুই দিনে তার থেকে বেশি ঘটে গেছে।
আমি হেসে ব্যাপারটি উড়িয়ে দিলাম।
আমরা যখন খাবারের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি–একটি সুস্বাদু সত্যিকার তিতির পাখির মাংস সত্যিকারের জলপাই তেল এবং মশলায় হালকা করে রান্না করা হয়েছে, সেটি যবের রুটি দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি ঠিক তখন রিয়ার কথা সত্যি প্রমাণিত হয়ে গেল। প্রথমে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম, তারপর হঠাৎ করে ইতস্তত কিছু মানুষ ছোটাছুটি করতে লাগল। রাগী চেহারার একজন ভয়ংকর দর্শন একটা অস্ত্র নিয়ে একবার ছুটে গেল, কিছুক্ষণ পর আবার সে ফিরে এল এবং আমরা তখন নিরাপত্তাকর্মীদের দেখতে পেলাম। ভয়ংকর দর্শন অস্ত্র হাতে রাগী চেহারার মানুষটি হঠাৎ একটি বিচিত্র জিনিস করে বসল, ঝটকা মেরে রিয়াকে আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নেয় এবং তার মাথায় ভয়ংকর দর্শন অস্ত্রটি চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, খবরদার। কাছে এলে এই মেয়ের মাথাটাকে উড়িয়ে দেব।
আমি দেখতে পেলাম নিরাপত্তাকর্মীরা যে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছে। রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম, সেখানে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই–বরং মনে হল একটু কৌতুক ফুটে উঠেছে। আমি নিশ্চিত নই কিন্তু মনে হল সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে একটু হাসারও চেষ্টা করল। হয়তো বলার চেষ্টা করল, বলেছিলাম না?
নিরাপত্তাকর্মীরা অস্ত্র উদ্যত করে রেখে বলল, তুমি কী চাও?
মানুষটি ধমক দিয়ে বলল, তুমি খুব ভালো করে জান আমি কী চাই। একটা চতুর্থ মাত্রার বাইভার্বাল নিয়ে এস এক্ষুনি।
কেন, বাইভার্বাল দিয়ে কী করবে?
আমি এই দ্বীপ থেকে পালাব। এখানে মানুষ থাকে? রিয়া হঠাৎ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মানুষটির ভয়ংকর দর্শন অস্ত্রটাকে প্রায় অবহেলায় সরিয়ে দিয়ে বলল, কী হয়েছে এই দ্বীপটায়?
বের হওয়া যায় না এটার শেষ নাই মানুষটার কথা শেষ হবার আগেই নিরাপত্তাকর্মীরা তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল– মানুষটি মরিয়া হয়ে গুলি করে বসল–আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম রিয়ার শরীরে গুলি লেগেছে, কিন্তু হুটোপুটি শেষ হবার পর দেখলাম রিয়া গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
রাগী চেহারার মানুষটি চিৎকার করতে লাগল এটা নরক, জাহান্নাম, এটা ভূতের বাড়ি–কবরখানা কিন্তু কেউ তার কথার বিশেষ গুরুত্ব দিল না, সম্ভবত ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে মস্তিষ্কের বারোটা বাজিয়ে রেখেছে। মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা সরিয়ে একটা কপোট্রনিক ইন্টারফেস বসিয়ে এখন তাকে একটা সাইবর্গ বানিয়ে ফেলতে হবে।
আমাদের খাবার পর্বটি সেখানেই শেষ করতে হল–দুজনের কারোরই আর সেখানে থাকার ইচ্ছে করল না। বের হয়ে আমি রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এত বড় একটা ব্যাপার তুমি একটুও ঘাবড়ে যাও নি।
বড় ব্যাপার কে বলেছে? পুরোটা সাজানো নাটক।
সাজানো নাটক?
হ্যাঁ, তোমাকে বলেছিলাম না। আমি যেখানেই যাই সেখানেই অঘটন। রিয়া হাসার চেষ্টা করে বলল, এটাও তাই।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না–এটা তাই না। লোকটার হাতের অস্ত্রটি সত্যি। গুলিতে কতটুকু জায়গা ধসে গিয়েছিল দেখেছ? আমি ভেবেছিলাম তোমার গায়ে গুলি লেগেছে।
কিন্তু কখনো লাগে না। আমি তাই দেখছি–শেষ মুহূর্তে আমি রক্ষা পেয়ে যাই। যেন একটা নাটক হচ্ছে। আমি তার নায়িকা। শেষ দৃশ্য পর্যন্ত বাচিয়ে রাখতে হবে।
আমি কোনো কথা না বলে রিয়ার পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। রাত সেরকম গম্ভীর হয় নি কিন্তু এর মাঝে চারপাশে নির্জনতা নেমে এসেছে। ঠিক কী কারণ জানি না, আমি হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। অস্বস্তির কারণটুকু বুঝতে পারছি না বলে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে থাকি। কথা না বলে দুজনে অনেকটুকু হেঁটে গেলাম। একসময় রিয়া মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কী হল, কথা বলছ না কেন?
ভাবছি?
কী ভাবছ?
মানুষটা কী বলছিল মনে আছে? এই জায়গাটা নরক, এটা ভৌতিক দ্বীপ–সেটা?
হ্যাঁ! আমি মাথা নাড়লাম, মানুষটা বলছিল এখান থেকে বের হওয়া যায় না। মনে আছে?
হ্যাঁ।
কেন বলছিল? আমাদের কি এখানে আটকে রাখা হয়েছে? এটা কি বিশেষ একটা এলাকা? কেন এখান থেকে বের হওয়া যায় না?
রিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী বলছ তুমি?
আমি কিছুই বলছি না, কিন্তু মানুষটার কথা আমাকে খুব ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
চলো তা হলে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে গিয়ে জিজ্ঞেস করি।
না, ওখানে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, ওরা বলবে না।
তা হলে?
আমাদের নিজেদের বের করতে হবে।
রিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বের করতে হবে?
আসলেই কি আমাদের আটকে রেখেছে নাকি।
কীভাবে বের করবে?
সোজা। একটা বাইভার্বাল নেব সাইবর্গটাকে অচল করে সোজা এখান থেকে বের হয়ে যাব–দেখি কেউ আটকায় নাকি।
আমি ভেবেছিলাম রিয়া এরকম একটা ব্যাপারে রাজি হবে না–কিন্তু দেখলাম সে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। আমরা তখন রাস্তার মোড়ে একটা বাইভার্বালের জন্যে পঁড়িয়ে রইলাম।
প্রথম দুটি বাইভার্বালকে ছেড়ে দিতে হল–তার চালক একেবারে নতুন মডেলের সাইবর্গ, তাদের মেটাকোড এখনো আমার জানা নেই, এটাকে আমি অচল করতে পারব না। তৃতীয়টি পুরোনো বাইভার্বাল, চালকটিও তৃতীয় প্রজন্মের। আজ সকালেই এদের দুটিকে বালুবেলায় অচল করে এসেছি।
বাইভার্বালটি উপরে ওঠার তিরিশ সেকেন্ডের ভেতরে আমি সাইবর্গটি অচল করে দিয়ে তার নিয়ন্ত্রণটি হাতে নিয়ে নিলাম। শহরের উপরে একবার পাক খেয়ে আমি সেটিকে উড়িয়ে নিতে থাকি। রিয়া আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি বাইভার্বাল চালাতে পার?
না।
তা হলে কেমন করে চালাচ্ছ?
নিজেই চলছে–আমি শুধু বলছি কোন দিকে চলতে হবে!
আমি রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, যে জিনিস সাইবর্গ চালাতে পারে সেটা যে কোন মানুষ চালাতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই জান সাইবর্গের বুদ্ধিমত্তা একটা শিশুর সমান।
আমি নিশ্চিত এরকম একটা পরিবেশে অন্য যে কেউ হলে ঘাবড়ে যেত কিন্তু রিয়ার ভয়ভীতি কম–কে জানে একজন নিখুঁত মানুষ, সম্ভবত সাহসী মানুষ।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক উড়িয়ে নেবার পর আমরা এই শহরটির শেষ মাথায় এসে উপস্থিত হলাম। নিচে রাস্তার আলো কমে এসেছে। আরো কিছুক্ষণ চালিয়ে নেবার পর হঠাৎ করে অন্ধকার কেটে এক ধরনের আলো ফুটে উঠল। আমরা সোজাসুজি এগিয়ে যেতে থাকি এবং হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। যে জিনিসটিকে আমরা আলো হিসেবে ভাবছি সেটি সত্যিকার অর্থে আলো নয়–সেটি হচ্ছে অন্ধকারের অনুপস্থিতি। আমরা ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেলাম শহরটি হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে এবং তাকে ঘিরে এক ধরনের শূন্যতা। কোথাও কিছু নেই–ব্যাপারটি এত অস্বাভাবিক যে তাকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এটি কুয়াশার মতো নয় যে সবকিছু ঢাকা পড়ে আছে। এটি স্পষ্ট এবং এর মাঝে কোনো বিভ্রান্তি নেই। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে সমস্ত সৃষ্টি জগৎ শেষ হয়ে গেছে। সেই ভয়ংকর শূন্যতা দেখে আমার সমস্ত চেতনা হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল, আমি চিৎকার করে বললাম, রিয়া–চোখ বন্ধ কর।
কেন?
এটা দেখলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।
রিয়া দুই হাতে আমাকে শক্ত করে ধরে বলল, এটা কী?
এটা হচ্ছে শূন্যতা। এটা হচ্ছে সত্যিকারের শুন্যতা।
এখানে কেন?
আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে, কিন্তু কিন্তু
কিন্তু কী? রিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, বলো এটি এখানে কেন?
আমি বাইভার্বালটিকে ঘুরিয়ে শহরের ভেতরে নিয়ে এলাম–কিছুক্ষণের মাঝে অন্ধকার নেমে এল, নিচে রাস্তাঘাট, আলো, জনবসতি দেখা যেতে লাগল। রিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, রেস্টুরেন্টে যে মানুষটি আমাকে ধরেছিল সে নিশ্চয়ই এই শূন্যতা দেখে এসেছে।
হ্যাঁ, দেখে পাগল হয়ে গেছে।
আমরা কি পাগল হয়ে গেছি?
আমি একটি নিশ্বাস ফেলে বললাম, হয়ে গেলে মনে হয় ভালো হত।
কেন? রিয়া ভয় পেয়ে বলল, কেন তুমি এ কথা বলছ?
আমি সাবধানে বাইভার্বালটিকে হ্রদের তীরে বালুবেলায় নামিয়ে এনে তার ইঞ্জিন বন্ধ করে দরজা খুলে দিলাম। প্রথমে রিয়া এবং তার পিছু পিছু আমি নেমে এলাম। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে, হ্রদের পানিতে সেই বড় চাঁদের প্রতিফলন ঘটে পানি চিকচিক করছে। বিশাল বালুবেলা ধূসর একটি সুবিস্তৃত প্রান্তরের মতো–পুরো দৃশ্যটিকে খানিকটা অতিপ্রাকৃতিক বলে মনে হতে থাকে।
রিয়া আমার পাশে প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, কী হয়েছে ত্রাতুল, তুমি কেন বলছ আমাদের পাগল হয়ে যাওয়া উচিত ছিল?
তুমি বুঝতে পারছ না? কথা বলতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে গেল, তুমি এখনো বুঝতে পার নি?
না।
তোমার মনে আছে আমার এবং তোমার মাথায় ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস লাগানো আছে?
হ্যাঁ।
ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস লাগিয়ে আমাদের মস্তিষ্কের ম্যাপিং করা হয়েছে?
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, আমি জানি।
যার অর্থ আমাদের একটা অস্তিত্ব তৈরি করে একটা তথ্যকেন্দ্রে জমা করে রেখেছে।
হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?
আমরা সেই অস্তিত্ব। আমরা সত্যিকারের ত্রাতুল নই, সত্যিকারের রিয়া নই।
রিয়া একটা আর্তচিৎকার করে আমাকে ধরে ফেলল, তারপর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। আমি গভীর মমতায় তাকে ধরে রেখে খুব সাবধানে বালুবেলায় বসিয়ে দিলাম। সে অপ্রকৃতিস্থের মতো আমার কাঁধে মাথা রেখে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। আমি রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, আমি খুব দুঃখিত রিয়া। আমি খুব দুঃখিত।
আমি আকাশে পূর্ণ একটি চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই চাঁদ, চাঁদের আলো, হ্রদ, হ্রদের পানি, বালুবেলা সব কৃত্রিম, সব একটি বিশাল তথ্যভাণ্ডারের তথ্য। আমি এবং রিয়াও কৃত্রিম—আমাদের ভাবনা–চিন্তা, দুঃখ–কষ্ট আসলে বিশাল কোনো এক যন্ত্রের ভেতরের হিসাব, আলো এবং ইলেকট্রনের বিচ্ছুরণ, কিছু যান্ত্রিক পদ্ধতি।
গম্ভীর হতাশায় আমার বুকের ভেতরে কিছু একটা গুঁড়িয়ে যেতে থাকে। আমি আমার হাতের দিকে তাকালাম, কী আশ্চর্য–আমি আসলে সত্যিকারের আমি নই? কৃত্রিম একটা ছোট শহরের জগতে আটকে পড়ে থাকা কিছু তথ্য? ভ্রাতুল এখন কোথায় আছে? সত্যিকারের ত্রাতুল?