০৪. লীম গভীর আগ্রহে

লীম গভীর আগ্রহে নুহাশকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। নুহাশ যা দেখছে তাতেই বিস্মিত হচ্ছে। একজন মানুষের জন্যে এত প্রকাণ্ড বাড়ি? বাড়ির পেছনে ফুলের বাগান দেখে নুহাশ হকচকিয়ে গেল। এত সুন্দর!

নুহাশ বলল, ফুলের বাগান বাড়ির পেছনে কেন?

লীম দুঃখিত গলায় বলল, স্যার পছন্দ করেন না, এই জন্যেই ফুলের বাগান বাড়ির পেছনে।

উনি ফুল পছন্দ করেন না?

না।

আর কি কি উনি পছন্দ করেন না?

গান পছন্দ করেন না।

কি বল তুমি?

লীম দুঃখিত গলায় বলল, আমি খুব ভালো গাইতে পারি। কিন্তু এই বাড়িতে গান গাওয়ার উপায় নেই। স্যার বিরক্ত হন।

কখনো গেয়ে দেখেছিলে?

একবার রান্নাঘরে বসে গুন-গুন করছিলাম। স্যার বললেন, গলায় কি হয়েছে। এরকম করছ কেন?

দেখি আমাকে একটা গান শুনাও তো।

কোন ধরনের গান শুনতে চান?

তোমার যা ইচ্ছা তুমি গাও। সব ধরনের গানই আমার ভালো লাগে।

একটি প্রেমের গান গাইব?

গাও।

ফিহা চোখ বন্ধ করে একের পর এক সংখ্যা বলেছেন, পাঠক তা মেমোরি সেলে সাজিয়ে নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া আবার ব্যাহত হল। লীমের গানের শব্দে আবার সব এলোমেলো হয়ে গেল।

ফিহা বললেন, এসব কি হচ্ছে?

পাঠক বলল, গান হচ্ছে স্যার।

ফিহা বললেন, কে গান করছে?

লীম। পিআর ধরনের রোবটদের ভয়েস সিনথেসাইজার খুব উন্নত মানের। তারা চমৎকার গাইতে পারে।

ফিহার অসম্ভব বিরক্ত হওয়া উচিত, কারণ কাজটা আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। কিন্তু তিনি বিরক্ত হচ্ছেন না। তাঁর ভালো লাগছে। অসম্ভব ভালো লাগছে। তিনি কান পেতে গানের কথাগুলি শোনার চেষ্টা করছেন।

 

দিনের প্রথম আলোয় তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম তুমি এলে না। মধ্যাহ্নের তীব্র আলোয় তোমাকে কেমন দেখায় জানা হল না, কারণ তুমি মধ্যাহ্নে এলে না। সূর্যের শেষ রশ্মি কি তোমার রঙ বদলে দেয়? আমি জানি না, কারণ তুমি এলে রাতের অন্ধকারে। প্রিয়তম, আমি শুধু তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। অন্ধকারে কি করে দেখব?

ফিহা মুগ্ধ গলায় বললেন, গাধাটাতে ভালো গাইছে। বেশ ভালো গাইছে।

পাঠক বলল, ডাটা এন্ট্রির কাজটা আজ বন্ধ থাকলে কি ক্ষতি হবে?

থাকুক বন্ধ থাকুক।

আপনাকে এবং আপনার স্ত্রীকে আমি কি অভিনন্দন জানাতে পরি?

হ্যাঁ পার।

পাঠক নিচু গলায় বলল, মানুষের আনন্দ অনুভব করার ক্ষমতা আমার নেই। তারপরেও মনে হয় আপনার আনন্দ আমি খানিকটা বুঝতে পারছি।

ধন্যবাদ পাঠক।

সময় সমীকরণের অনেকগুলি ধাপ আপনি অতিক্রম করে এসেছেন। সীমাহীন আপনার প্রতিভা। শেষ ধাপটি অতিক্রম করতে আপনার স্ত্রী আপনাকে সাহায্য করবে। এই শুভ কামনা।

সে কি করে সাহায্য করবে? এই জটিল জগতে তার স্থান কোথায়?

সে তার মতো করে আপনাকে সাহায্য করবে। গণিত এবং পদার্থবিদ্যার সাহায্যের প্রয়োজন আপনার নেই, স্যার।

হ্যাঁ তাও বোধ হয় ঠিক। একটি ক্ষুদ্র জায়গায় আমি আটকে গেছি। আমি জট খুলতে পারছি না।

আপনি জটটা বুঝতে পারছেন। সারাক্ষণ তাকিয়ে আছেন জটটির দিকে। এই জট আপনাআপনি খুলবে।

না খুললে সমূহ বিপদ পাঠক। জট খুলতে না পারলে মেটালিস্টরা আমাদের গ্রাস করে নেবে। সামনের পৃথিবী হবে মানবশূন্য পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে থাকবে শুধু মেন্টালিস্ট আর কেউ না। মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে পাঠক। অতি দ্রুত কমে আসছে।

পাঠক বলল, যে ক্ষমতাধর সেই টিকে থাকবে। এ সত্য স্বীকার করে নেয়াই কি ভালো না স্যার?

তুমি মেন্টালিস্টদের ক্ষমতাধর বলছ?

হ্যাঁ বলছি। ওরা যে টিকে যাচ্ছে এটিই কি সবচে বড় প্রমাণ নয় যে ওরা ক্ষমতাধর।

সময় সমীকরণের আমি সমাধান বের করব। আমি নিজে যাব অতীতের পৃথিবীতে। প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট যে বিশেষ পরীক্ষাটি করে প্রথম মেন্টালিস্ট শিশু তৈরি করেছিলেন সেই পরীক্ষা আমি করতে দেব না।

তা যদি করতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে মানুষই ক্ষমতাধর। মেন্টালিস্টরা নয়।

অবশ্যই মানুষ ক্ষমতাধর। আমি তা প্রমাণ করব পাঠক। আমি তা প্রমাণ করব। শোন পাঠক, আমার সমস্যা কোন জায়গাটায় হচ্ছে আমি তোমাকে বলিখুব সাদামাটাভাবে বলা যায় সময়ের শুরু হচ্ছে বিগ বেংগে। তারপর সময় এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে…

আমাকে বলে কোনো লাভ হবে না। আমি তো স্যার এ ব্যাপারে আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না–

আমি জানি, আমি জানি, তবু তুমি শোন—একজন কাউকে শুনাতে ইচ্ছা করছে—সময়কে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্রের সঙ্গে তুলনা কর। খুব সহজ অর্থে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র কি বলছে? বলছে সময় যতই এগুচ্ছে। গরম জিনিস ততই শীতল হচ্ছে। ধর এক কাপ কফি টেবিলে রাখা হল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গরম কফি আরো গরম হবে না। ঠাণ্ডা হতে থাকবে।

এই তথ্য স্যার আমি জানি।

হ্যাঁ জান। অবশ্যই জান। কিন্তু এর মধ্যে একটি মজার ব্যাপার আছে। এটি একটি পরিসংখ্যানগত সূত্র। পরিসংখ্যান কাজ করে অসংখ্য অণুপরমাণু নিয়ে। সমষ্টিগতভাবে এই সব অণুপরমাণু গরম থেকে শীতল অবশ্যই হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান আরো বলে এর মধ্যে কিছু অণুপরমাণু গরম থেকে আরো গরম হয়ে যেতে পারে। তাতে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র ব্যাহত হবে না। বুঝতে পারছ?

পারছি।

তাহলে বুঝতেই পারছ—এই সব অণু পরমাণু সময়ের উল্টো দিকে যাচ্ছে। আমার কাজ হচ্ছে তাদের নিয়ে। আমি প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করেছি যে সময়ের উল্টোদিকে যাওয়া সম্ভব।

হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব। দেখ পাঠক বহু পুরাতন একটা সূত্র দেখা যাক।

Tau = √(1–v2 / c2)

ধরা যাক y হচ্ছে একটি বস্তুর গতি। c আলোর গতি।

অতীতে যেতে হলে তাঁর মান হতে হবে আলোর গতির চেয়ে বেশি। যখন তা হবে তখন বস্তুর ওজন, বস্তুর দৈর্ঘ্যপ্রস্থ সব হয়ে যাবে কাল্পনিক সংখ্যা। সবার আগে চলে আসবে √-12 আসবে না?

আসবে।

এই সমস্যার সমাধান আমার কাছে খুব জটিল কখনো মনে হয় নি। গণিত শাস্ত্রে আমরা কাল্পনিক সংখ্যা নিয়ে শুরু করি এবং এক সময় সেটাকে সত্যিকার সংখ্যায় রূপান্তরিত করি। আমি অগ্রসর হচ্ছি কোন দিকে জান?

আমার জানার কথা নয় স্যার।

হা তোমার জানার কথা নয়। অবশ্যই তোমার জানার কথা নয়— দুধরনের বস্তুর কণার কথা চিন্তা করা যাক। আলোর চেয়ে কম গতিসম্পন্ন বস্তুকণা যেমন ধর, ইলেকট্রন, প্রোটন, যাদের বলা হয় টারডিওস, আবার অন্য কণা চিন্তা কর যাদের গতি আলোর চেয়ে বেশি। এরা হচ্ছে টেকিওনস…

এরা কাল্পনিক কণা। এদের অস্তিত্ব নেই।

যার অস্তিত্ব নেই তাকে অস্তিত্ব দিতে হলে কি করতে হবে? তুমি স্পেস নিয়ে চিন্তা কর। স্পেসকে কি করলে এই কণাগুলি তৈরি হবে…

স্যার আপনি কি গ্রেগরিয়ান এ্যানালিসিসের কথা বলছেন?

হ্যাঁ আমি গ্রেগরিয়ান এ্যানালিসিসের কথা বলছি। আমি কতটা কাছাকাছি চলে এসেছি তুমি কি তা বুঝতে পারছ?

বুঝতে পারছি না। তবে আপনার আনন্দ দেখে খানিকটা অনুমান করতে পারছি।

আমি খুব কাছাকাছি আছি। খুব কাছাকাছি। একটি মাত্র জট সেই জট খুলে যাচ্ছে।

স্যার আপনি বিশ্রাম করুন। পেছনের বাগানে চেয়ার পেতে দি। আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করুন।

সে এখন আমার স্ত্রী নয় পাঠক। আমাকে মারলা লির কাছে যেতে হবে। লাইসেন্স নিয়ে আসতে হবে।

কখন যাবেন?

এখন যাব।

আমি কি স্যার আপনার সঙ্গে আসব?

তুমি আসতে চাচ্ছ কেন?

আপনাকে খুব অস্থির লাগছে। সে জন্যেই আসতে চাচ্ছি।

না আমি অস্থির না। আমি ঠিক আছি। আমি মারলা লির সঙ্গে দেখা করব। তার কাছ থেকে আমি আরো কিছু গ্রন্থও আনতে চাই। তুমি আমার টুপি এনে দাও।

আপনি কি আপনার স্ত্রীকে কিছু বলে যাবেন না?

না। ওর সামনে পড়তে কেন জানি লজ্জাও লাগছে। আচ্ছা পাঠক, মেয়েরা কি উপহার পেলে সবচে খুশি হয় বলত? আমি ফেরার পথে ওর জন্যে কিছু উপহার আনতে চাই। | পাঠক মৃদু স্বরে বলল, ভালবাসার চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে, স্যার!

ভালো বলেছ পাঠক। ভালো বলেছ। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে ভালবাসা। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জান—এই উপহার আমি একমাত্র আমার পালক পিতামাতার কাছ থেকেই পেয়েছি। যারা দুজনই মেন্টালিস্ট।

স্যার, আপনি আমাদের ভালবাসাও পেয়েছেন। তবে আমরা যন্ত্র। আমাদের ভালবাসা মূল্যহীন।

পাঠক, ভালবাসা মূল্যহীন নয়। আজ সম্ভব না, কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই ভালবাসাকে অঙ্কে নিয়ে আসা যাবে। অঙ্কের মডেল তৈরি করা হবে। হয়তো আমিই তা করব…

আমি কি আপনাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেব স্যার?

দাও এগিয়ে দাও। গাধা লীম দেখি এখনো গান গাইছে। ব্যাটার গলা এত। সুন্দর তাতো জানতাম না। তাকে বার বার গাধা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।