রেজোলিউট বেশ দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছিলো, তবু পথও তো অনেক লম্বা, কাজেই দিনের পর দিন ফার্গুসন তাঁর সহযাত্রীদের কৌতূহল নিবারণের জন্যে বেলুনের সম্বন্ধে নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে চললেন। একদিন তিনি সকলকে তার যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ভালো করে বুঝিয়ে বললেন :
একদিন এই রহস্যময় মহাদেশ আদি পৃথিবীকে উপহার দিয়েছিলো লোভনীয় এক সভ্যতার গৌরব। প্রাচীন মিশর—ছেলেবেলা থেকে কত গল্পই না শুনেছি তার—কত তার রহস্য, আর কী বিপুল ঐশ্বর্য! সাত হাজার বছর আগেকার মানুষদের সেইসব ঐশ্বর্য একবার নিজের চোখে দেখে আসতে পারবো না, তাও কি হয়। অথচ যেমহাদেশ এই সভ্যতার আশ্রয়, কত সামান্যই আমরা জানি তার, কত কম; বলতে গেলে কিছুই না। কিন্তু কোনোদিনও তা জানবো না, তা কী করে হয়? কাজেই আফ্রিকা যাবার পরিকল্পনা আমার মাথায় অ্যাদ্দিন ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
কী শুনেছি আমরা মিশর সম্বন্ধে? না, মিশর হলো অতীতের জাদুঘর; সেই জাদুঘর চোখে দেখলে মাথা ঘুরে যায়। মনে হবে, আজকের পৃথিবী থেকে হঠাৎ যেন ছিটকে সেই পাঁচ-সাত হাজার বছরের পুরোনো পৃথিবীতে ফিরে-যাওয়া গেছে। আর কী তার ঐশ্বর্য-চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে দেয়। সোনা-রুপো হিরে-মুক্তোর যেন ছড়াছড়ি, কত শৌখিনতা, কী অপরূপ শিল্প-আজকের এই উনিশ শতকের তথাকথিত অগ্রসর মানুষও বুঝি তা কল্পনাতেই আনতে পারে না। অথচ এ-সব জিনিশ পাওয়া গেছে কোথায়-না, রাজারাজড়াদের কবরে। অবাক করে দিতে পারে এই প্রশ্ন : কবরের ভেতরেই এত জিনিশ! কিন্তু ঠিক তাই। কেননা তারা মনে করত, মরার পরই মানুষের সব শেষ হয়ে যায় না, কবরের মধ্যেও মানুষ থেকে যায়। আর কবরের ভেতরে এভাবে থাকার সময় রাজাদের যাতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের এতটুকুও অভাব না-হয়, সেইজন্যেই থরে থরে সাজিয়ে রাখা হতো এত-সব রকমারি জিনিশ। আশবাবপত্র, অলংকার, শৌখিন শুমার খাপ, বাজনার যন্ত্র, খাবার-দাবার, বাসন-কোশন—এমনকী দাসদাসী ধোপা নাপিতের দল পর্যন্ত। কবরের ভেতর পাথরের তৈরি সারি-সারি পুতুল পাওয়া গেছে-আসলে তা তো আর পুতুল নয়, কবরের মধ্যে পাওয়া দাসদাসীর দল। তারা ভাবতো, এই প্রস্তরীভূত মূর্তিগুলোই কবরের ভেতর সেবার কাজ চালাতে পারবে। গোটা জিনিশটা ভাবতেও অবাক লাগে—এত-সব জিনিশ কিনা কোনোদিন জীবিতের ভোগে লাগেনি। যে-ধনরত্ন সমস্ত কল্পনাকেও হার মানায় তা কিনা সব মৃত্যুর অপেক্ষায় গুছিয়ে রাখা! মরার আয়োজন নিয়ে এমন মত্ত হয়ে উঠেছিলো যে আদি সভ্যতা–তার জন্যে কি তাকে কোনো দাম দিতে হয়নি?
হয়েছিলো; সেই দাম যে কী ভীষণ, তার প্রমাণও আছে—ঐ কবরের ভেতরই। কবরে তাদের ছবি আর মূর্তি পাওয়া গেছে-রাজার জন্যে তারা বয়ে নিয়ে চলেছে কী বিপুল বিলাস-সামগ্রী, তার ভারে নুয়ে পড়েছে পিঠ, ধনুকের মতো বেঁকে গেছে শিরদাঁড়া, হাড় আর চামড়া ছাড়া শরীরে সামান্যতম মাংস নেই। পরনে ছিড়ে-যাওয়া নেংটি, আর পিঠের কাছে নিষ্ঠুর প্রহরীর উদ্যত চাবুক।
এই ঐশ্বর্যের সম্ভার যারা গড়ে তুলেছিলো, তারা প্রাণ দিয়ে মৃতের জন্যে সব আয়োজন করে গেলো! যে-পিরামিড আজকের পৃথিবীর সরচেয়ে বড়ো-একটি আশ্চর্য, তাও মৃতের জন্যে তৈরি। জীর্ণ পুরোনো পুঁথিতে লেখা আছে, একলাখ লোক বিশ বছর ধরে অক্লান্ত ও একটানা পরিশ্রম করে গড়েছিলো এই পিরামিড। তার চৌকো ভিতের একদিকের মাপ হলো লম্বায় সাতশো পঞ্চান্ন ফুট, মাটি থেকে তার চুড়োটা প্রায় পাঁচশো ফুট উঁচু। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পিরামিড। যেদিন শুন্যে তার চুড়ো অসীম স্পর্ধায় মাথা তুলে দিলে সেদিন হিশেব করে দেখা গেছে এ-পিরামিড় গাঁথতে লেগেছে ২,৩০০,০০ পাথরের চাই, গড়পড়তায় তার একেকটার ওজন প্রায় সত্তর মণ। সব পাথর তো আর সমান নয়—কোনোটা ছোটো কোনোটা বড়ো, আর বড় পাথরের মধ্যে একটি আছে যার ওজন প্রায় দশ হাজার মণ, তার দিকে তাকালেই নাকি মাথা ঘুরে যায়।
পাথরগুলো আনা হয়েছিলো মরুভূমি পেরিয়ে নীলনদের ওপারের অনেক দূরের একটি পাহাড় থেকে। অতদূর থেকে এমন-সব মস্ত পাথরের টুকরো কী করে নীল নদ পার করে মরুভূমির বুকের ওপর দিয়ে এতদূর নিয়ে আসা হয়েছিলো ভাবতে গেলে কোনো থই পাওয়া যায় না! গোটা ব্যাপারটাই এমনি অতিকায় যে প্রায় অলৌকিক বলে মনে হতে চায়। আর তাও কি আজকের কথা?
এই অতিকায় ব্যাপারটি গড়ে তুলেছে কিনা পাঁচ হাজার বছর আগেকার দুর্ধর্ষ মানুষ! ঐশ্বর্যের সকল সম্ভারের কথা যদি ছেড়েও দেয়া যায়, তাহলেও এই একটি জিনিশ যারা নির্মাণ করেছিলো, তাদের ক্ষমতা কী বিপুল ছিলো, সে-কথা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
অথচ আজকের পৃথিবীতে—এই উনবিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতের বাসিন্দা হয়েও আমরা কতটুকু জানি আফ্রিকার কথা, এই বোধই চিরকাল আমার মগজে জ্বালা ধরিয়েছে। যতবারই আমি ভ্রমণে বেরিয়েছি সবসময়েই এই অসম্পূর্ণতার চিন্তা আমাকে মগ্ন করে রেখেছে। তাই শেষকালে এই প্রচেষ্টার জন্যে আমি তৎপর হয়েছি। যে-উৎস থেকে একদিন স্রোত এসেছিলো নীলনদের, আদি পৃথিবীকে যা দিয়েছিলো সভ্যতার গরীয়ান দীপ্তি, সেই এতকালের অনাবিষ্কৃত উৎসস্থল আবিষ্কারের জন্যেই তাই এই অভিযানে বেরিয়েছি আমি আজ। জানি, আমার পিছনে আছে সারা জগতের শুভেচ্ছা আর ঈশ্বরের দয়া, তাই অভিযান যে সফল হবেই, এ-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই আর নেই।