০৪. রাস্তা একেবারে অন্ধকার

রাস্তা একেবারে অন্ধকার। এদিকে গাড়ি বিশেষ চলে না, সাইকেল রিকশাও কমে এসেছে। ছোটমামা সাইকেল চালিয়ে গিয়ে দুটো সাইকেল রিকশা ডেকে আনলেন।

রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে মানুষজন জেগে আছে, না এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা বোঝার উপায় নেই। লোডশেডিং, কয়েকটা বাড়িতে টিম টিম করে হ্যারিকেন জ্বলছে।

বাজারের কাছে অবশ্য এখনও অনেক লোক আছে। কিছু কিছু দোকান খোলা রেখেছে হ্যাজাক জ্বালিয়ে। বাজারের বাইরের রাস্তায় বসা তরকারিওয়ালারা চেঁচাচ্ছে, নিয়ে যান, শস্তায় পটল! শস্তায় ঝিঙে! দেড় টাকায় একটা লাউ, নিয়ে যান, নিয়ে যান!

বাজার পেরিয়ে আরও খানিকটা যাওয়ার পর গগন সাহার বাড়ি।

নতুন বাড়ি, দোতলা। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, সামনে লোহার গেট। একতলা অন্ধকার, দোতলায় আলো জ্বলছে, অর্থাৎ এদের নিজস্ব জেনারেটার আছে। গ্রামে সেটাই বড়লোকদের চিহ্ন।

লোহার গেটে তালাবন্ধ। ছোটমামা কয়েকবার ঘটাঘট শব্দ করলেন, কেউ এল। তখন হাঁক দিলেন, গগন, গগন!

এবারে ভেতর থেকে একজন বলল, দাদা নেই!

ছোটমামা বললেন, একবার গেটটা খোলো। আমি চাঁদুবাবু বলছি!

ভেতর থেকে আবার উত্তর এল, বলছি তো দাদা বাড়ি নেই।

কোথায় গেছে?

তা জানি না।

একবার গেটটা খুলতে পারছ না?

কী মুশকিল! দাদা বাড়ি নেই। গেটে তালা পড়ে গেছে, এখন খোলা বারণ!

ওপরে তো আলো জ্বলছে দেখছি!

আলো জ্বালা কি নিষেধ নাকি?

গগন বাড়িতে নেই বলছ!

বাড়িতে নেই, তবু কি আছেন বলব? দাদার জ্যাঠাবাবু এসে এখানে রয়েছেন, তাই তেনার ইচ্ছেতে আলো জ্বালিয়েছেন!

কাকাবাবু বললেন, এরপর একমাত্র পুলিশই জোর করে বাড়িতে ঢুকতে পারে। আমরা তা পারি না।

জোজো বলল, অন্যভাবেও ঢোকা যায়। পেছনের জলের পাইপ বেয়ে সন্তু অনায়াসে ছাদে উঠে যেতে পারে।

সন্তু বলল, আমি তো পারবই। তুই পারবি না?

জোজো বলল, আমিও পারি। কতবার দশতলা-বারোতলা উঠে গেছি, এ তো মোটে দোতলা। আমার শুধু একটাই মুশকিল। যদি কুকুর থাকে? আমি কুকুর ম্যানেজ করতে পারি না।

কাকাবাবু বললেন, থাক, অতটা দরকার নেই।

সন্তু বলল, ভেতর থেকে যে-লোকটা কথা বলল, তার দাড়ি আছে, আর একটা চোখ ট্যারা।

জোজো বলল, তুই কী করে জানলি?

সন্তু বলল, তুই গিয়ে দেখে আয় মেলে কিনা!

জোজো বলল, শার্লক হোমস হলে এখান থেকেই প্রমাণ করে দিত।

ছোটমামা বললেন, আমার মনে হয়, গগন সত্যিই বাড়ি নেই। এতটা বাড়াবাড়ি সে করবে না। তবে, আজ বিকেলেও আমি তাকে দেখেছি।

কাকাবাবু বললেন, ভেতরের লোকটি তো বলল, রাত্তিরে আর সে ফিরবে না।

ছোটমামা বললেন, এক হতে পারে, গগনের গ্রামেও একটা বাড়ি আছে। এখন সে শহরে থেকে ব্যবসা করলেও গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। সেখানকার বাড়িটা আরও বড় করে, সুন্দর করে সাজিয়েছে। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকে দু-একদিন।

কাকাবাবু বললেন, চলো, সেই বাড়িতে।

ছোটমামা প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, এখন? অসম্ভব!

কাকাবাবু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, অসম্ভব কেন? অনেক দূর!

ছোটমামা বললেন, না, অনেক দূর নয়। কিন্তু রাস্তা খারাপ। বর্ষাকালে কাদায় ভরা। সাইকেল রিকশা যেতে পারবে না।

কাকাবাবু বললেন, গগন যায় কী করে?

ছোটমামা বললেন, মোটরসাইকেল যেতে পারে। জিপগাড়িও যেতে পারে। এমনিতে রাস্তা চওড়া, তবে—

কাকাবাবু বললেন, একটা জিপগাড়ি জোগাড় করো!

ছোটমামা বললেন, তুমি কী বলছ রাজাদা? এত রাতে আমি জিপ জোগাড় করব কোথা থেকে?

কাকাবাবু এবার প্রচণ্ড রেগে উঠে বললেন, দ্যাখো চাঁদু, তুমি এত বছর ধরে গ্রামে আছ। জিপ কোথা থেকে জোগাড় করবে, তা কি আমাকে বলে দিতে হবে? যেখান থেকে পারো একটা জিপ নিয়ে এসো!

কাকাবাবুর ধমক খেয়ে ছোটমামা কুঁকড়ে গেলেন। খানিকটা কাজও হল। সবাইকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে ছোটমামা একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে চলে গেলেন বাজারের দিকে।

জোজো বলল, সন্তু, বাজি ধরবি, ছোটমামা জিপ আনতে পারবেন কিনা।

সন্তু বলল, ঠিক পঁয়তিরিশ মিনিটের মধ্যে জিপ নিয়ে এসে পড়বেন।

কাকাবাবু বললেন তোমরা বরং আর একটা বাজি ধরো। গগন সাহা এবাড়িতেই লুকিয়ে আছে, না গ্রামের বাড়িতে আছে?

জোজো বলল, এ-বাড়িতেই আছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কী করে বুঝলি?

জোজো বলল, তুই যেভাবে তখন বুঝলি যে, ভেতরে লোকটার দাড়ি আর এক চোখ ট্যারা।

সন্তু বলল, এত সাততাড়াতাড়ি গেটে তালা দেওয়ার কী মানে হয়? মোটে তো নটা বাজে!

কাকাবাবু বললেন, তোদের কী মত? এই রাত্তিরেই গ্রামের বাড়িটা একবার দেখে আসা উচিত।

দুজনে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল, নিশ্চয়ই!

কাকাবাবু বললেন, কিছু না পাওয়া গেলেও রাত্তিরবেলা গ্রাম তো ঘুরে আসা হবে। তাই বা মন্দ কী?

দূরে একটা মোটরসাইকেলের আওয়াজ শোনা গেল।

তীব্র হেডলাইট জ্বেলে সেটা এদিকেই আসছে।

জোজো বলল, এইবার গগন সাহা ধরা পড়বে! ওর কাছে যদি বোমা থাকে?

কাকাবাবু বললেন, তোমরা একটু দূরে সরে গিয়ে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে থাকো।

অন্য সাইকেল রিকশাটা এর মধ্যে চলে গেছে। কাকাবাবু একলা দাঁড়িয়ে রইলেন মাঝরাস্তায়।

মোটরসাইকেলটা গর্জন করতে করতে এসে থামল এই বাড়ির সামনে। যে চালাচ্ছে, তার মাথায় হেলমেট। এবার সেটা খুলতেই, অল্প আলোয় বোঝা গেল, তার বয়েস মাত্র তেইশ-চব্বিশের বেশি নয়। অর্থাৎ সে গগন সাহা হতেই পারে না।

সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল বাড়িটার ভেতরের দরজা, বেরিয়ে এল দুজন। তাদের মধ্যে একজন গাঁট্টাগোট্টা লোক, আর একজন মেয়ে। উনিশ-কুড়ির মতন বয়েস।

গেটও খোলার পর মেয়েটি এসে বসল মোটরবাইকের পেছনের সিটে।

যে-চালাচ্ছে, সে চেঁচিয়ে বলল, সব ঠিক আছে তো নিবারণদা?

অন্য লোকটি কী বলল তা শোনা গেল না। মোটরসাইকেলটি আবার বেরিয়ে গেল হুস করে।

এবার সে বাড়ির দোতলার আলোও নিভে গেল। সন্তু আর জোজো কাছে চলে আসার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, কী বুঝলি?

জোজো বলল, যাকে বলে, রহস্য ঘনীভূত! এই কি সেই মোটরসাইকেলের লোকটা, যে বোমা ছুড়েছে? ও আসতেই গেট খুলে গেল কেন?

কাকাবাবু বললেন, অনেক সময় অনেক সাধারণ ঘটনাও রহস্যময় মনে হয়। আরও অনেক লোক মোটরসাইকেল চালাতে পারে। হয়তো এই মেয়েটা এই বাড়িতে কোনও কাজ করে। এই ছেলেটি রোজ এইসময় তাকে নিয়ে যায়!

জোজো বলল, ছেলেটা যে বলল, সব ঠিক আছে তো?

কাকাবাবু বললেন, তারও অনেক রকম মানে হতে পারে।

সন্তু বলল, অন্য যে-লোকটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, তার দাড়ি ছিল। সে-ই নিশ্চয়ই আগে কথা বলছিল।

জোজো বলল, হ্যাঁ, দাড়ি ছিল, আমি দেখেছি। কিন্তু ট্যারা ছিল কি?

সন্তু বলল, ট্যারা হতে বাধ্য। কাল এসে দেখে যাস।

দূরে চোখে পড়ল একটা গাড়ির হেডলাইট।

সন্তু বলল, ওই যে ছোটমামা জিপ নিয়ে আসছেন। পঁয়তিরিশি মিনিট হয়েছে—

সন্তুর কথা পুরোপুরি মিলল না।

সামনে এসে যে-গাড়িটা দাঁড়াল সেটা জিপ নয়। অ্যাম্বাসাডর। সেটা থেকে নেমে ছোটমামা বললেন, ওঃ রাজাদা, এই ড্রাইভারকে ডেকে তুলতে আমাকে কী কাণ্ডই না করতে হয়েছে। ও একেবারে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিল। নেহাত আমি ওর ব্যাঙ্কের ঋণের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, তাই আসতে রাজি হয়েছে। ওর নাম সুধীর।

সবাই মিলে ওঠা হল গাড়িতে।

ড্রাইভার রুক্ষ গলায় বলল, শুনুন স্যার, আমি কিন্তু হাফ অ্যান আওয়ারের বেশি দেরি করতে পারব না। কাল সকালেই আমাকে ভাড়া খাটতে যেতে হবে।

কাকাবাবু খুব মোলায়েম গলায় বললেন, সুধীর, তুমি যে আসতে রাজি হয়েছ, তাতেই আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ! তুমি তোমার গাড়ি ভাড়া খাটাও? তোমার লাইসেন্স আছে?

সুধীর বলল, নিশ্চয়ই লাইসেন্স আছে! আমি বেআইনি কোনও কাজ করি না।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তুমি এই আইন জান নিশ্চয়ই, যে মুহূর্তে আমি তোমার গাড়িতে চাপলাম, তারপর থেকেই তুমি আমার ড্রাইভার হয়ে গেলে? এখন আমি যেখানে যাব, তোমাকে নিয়ে যেতে হবে! এমনকী, যদি দার্জিলিং যেতে চাই–

লোকটি মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি এমনি এমনি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি। আমরা বেশিক্ষণ তোমাকে আটকাব না। বড়জোর এক ঘণ্টা। ডবল ভাড়া পাবে!

ছোটমামা বললেন, বাজারে সবাই জেনে গেছে যে, পুলিশসাহেবের ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না, তার মা কান্নাকাটি শুরু করেছে।

কাকাবাবু বললেন, ছেলেটা যদি অবাধ্য, ছটফটে হত, তা হলেই না হয় মনে করা যেত সে নিজেই কোথাও চলে গেছে। কিন্তু শান্তশিষ্ট, নরম স্বভাবের ছেলে, খুব উৎসাহের সঙ্গে রিহার্সাল দিচ্ছিল!

জোজো বলল, কাকাবাবু, দেবলীনা সুকোমলকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায়নি তো? ও বলেছিল, আমাদের থিয়েটার ভণ্ডুল করে দেবে!

সন্তু বলল, সুকোমল কি বাচ্চা ছেলে যে, ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাবে?

কাকাবাবু বাইরে তাকিয়ে বললেন, রাস্তাটা তো বেশ চওড়া দেখছি।

ছোটমামা বললেন, গগন নিজে উদ্যোগ নিয়ে রাস্তাটা সারিয়েছে। তার গ্রামের বাড়িতে অনেকে বেড়াতে আসে!

সারা সকাল বৃষ্টি হলেও তেমন কাদা নেই, গাড়ি চালাতে অসুবিধে হচ্ছে না। মাঝে মাঝে কুকুর ডাকছে। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

ড্রাইভার গগনের বাড়ি চেনে। একটু বাদেই সে বলল, এই তো এসে গেছি!

বেশ বড় বাড়ি, পাকা বাড়ি। এটাও পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের সামনে আলো। একজন লোক টুলের ওপর বসে ঢুলছিল, এত লোকজনের শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়াল। তার হাতে বন্দুক।

কাকাবাবু বললেন, বেশ পাহারার ব্যবস্থা আছে দেখছি!

ছোটমামা বললেন, গ্রামে যারা হঠাৎ বড়লোক হয়, তাদের ওপর ডাকাতদের নজর থাকে। পাহারা তো রাখতেই হয়। এখানে ডাকাতি হয় প্রায়ই।

তিনি এগিয়ে গিয়ে দরোয়ানটিকে বললেন, গগনবাবুকে খবর দাও! বলো, চাঁদুবাবু এসেছেন।

দরোয়ানটি বলল, আভি কুছু হবে না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, গগনবাবু এ বাড়িতে আছেন?

দরোয়ানটি একই ভাবে বলল, বলছি তো, আভি কুছু হবে না। রাত হো গিয়া।

ছোটমামা বললেন, তোমার বাবু আমাকে চেনেন। নাম বলো গিয়ে—

দরোয়ানটি বলল, নাম বলনে সে কেয়া হোগা? ইতনা রাত মে গেট খুলনে কা হুকুম না আছে! যাইয়ে যাইয়ে!

লোকটি বন্দুকটি তুলে বলল, কাল সকালমে আইয়ে। আভি কুছু হবে না!

কাকাবাবু বললেন, আমরা যদি ডাকাত হতাম, তা হলে কি ওই বন্দুকটা আমাদের আটকাতে পারত?

সন্তু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, বাদুড়! বাদুড়! ওই যে একটা বাদুড়!

সবাই মুখ তুলে তাকাল ওপরের দিকে।

তারই মধ্যে সন্তু এক ঝটকায় দরোয়ানের হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়েছে।

লোকটি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।

সন্তু বলল, রাগ মাত কিজিয়ে দরোয়ানজি, আমি শুধু একটু মজা করেছি!

বাড়ি থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে? কারা এসেছে?

গলার আওয়াজ চিনতে পেরে ছোটমামা বললেন, গগন, আমি চাঁদুদা।

গগন নামের লোকটি বেশ লম্বা-চওড়া। পাজামার ওপর গেঞ্জি পরা। এগিয়ে আসতে আসতে বলল, চাঁদুদা? কী ব্যাপার, এত রাতে?

ছোটমামা বললেন, হ্যাঁ, রাত হয়ে গেছে বটে। একটা বিশেষ কারণে তোমার সঙ্গে একজন একটু কথা বলতে চান। এঁর নাম রাজা রায়চৌধুরী, নাম শুনেছ বোধ হয়।

গগন বলল, আমি নাম শুনিনি, তবে নিশ্চয়ই খুব বিখ্যাত মানুষ। আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন!

ভেতর থেকে একটা বেশ বড় কুকুরের ঘাউ ঘাউ ডাক শোনা গেল।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কুকুরটা বাঁধা আছে!

গগন বলল, বাঁধা না থাকলে এতক্ষণ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমার এই দরোয়ানটা কোনও কম্মের না। কিন্তু এই কুকুরের ভয়ে রাত্তিরে কেউ আমার বাড়ির ধারে কাছে আসে না।

ভেতরে বেশ সাজানো গোছানো বসবার ঘর। কয়েকখানা চেয়ার আর জাজিম পাতা। এদিকের দেওয়ালে কয়েকখানা লক্ষ্মীর সরা আটকানো।

গগন বলল, বসুন, বসুন!

ছোটমামা বললেন, বেশি সময় নেব না। গ্রামের ছেলেদের নিয়ে আমরা একটা নাটক করছি জান তো?

গগন বলল, জানব না কেন? চতুর্দিকে পোস্টার পড়েছে।

তারপর কাকাবাবু দিকে তাকিয়ে বলল, সেই পোস্টারেই তো আপনার নাম দেখেছি। আপনি বুঝি কলকাতায় থিয়েটার করেন?

কাকাবাবু হাসিমুখে দুদিকে মাথা নাড়লেন।

তিনি কথা না বলে গগনকে লক্ষ করে যাচ্ছেন।

ছোটমামা বললেন, সারারাত ধরে ফাংশান হবে, কলকাতার শিল্পীরা আসবেন, আমাদের গ্রামের স্কুলের টাকা তোলার জন্য আমাদের কেউ কিছু করবে না? তাই ছেলেদের নিয়ে এই থিয়েটার।

সে তো ভাল কথা।

তুমি তো আমাদের কোনও সাহায্য করলে না।

আপনার অনেক চ্যালা আছে, আকবর আলি, নিতাই ঘোষ, তারাই তো খুব খাটাখাটনি করছে। আমি আর কী সাহায্য করব? আপনি কি আমার কাছে কোনও বিশেষ সাহায্য চাইতে এসেছেন?

হ্যাঁ। এই নাটকে রামের পার্ট করছে আমাদের সার্কেল অফিসারের ছেলে সুকোমল।

পুলিশের কর্তার ছেলে হিরোর পার্ট পাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

সেজন্য নয়। ওর মতন সুন্দর চেহারায় ছেলে আর কে আছে?

বেশ, মানলাম।

সেই সুকোমলকে আজ বিকেল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তাই নাকি?

ছোটমামার সঙ্গে কথা বলতে বলতে গগন বারবার তাকাচ্ছে কাকাবাবুর দিকে।

এই ভদ্রলোক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, অথচ কোনও কথা বলছেন না, এতে তার খটকা লেগেছে।

সুকোমলকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে গগন তেমন কিছু অবাক হয়নি, কাকাবাবু সেটাও লক্ষ করলেন।

ছোটমামা বললেন, আমাদের থিয়েটার যাতে না হয়, সেইজন্য কেউ ছেলেটাকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে মনে হচ্ছে।

চিঠি আসেনি?

চিঠি?

চাঁদুদা, যারা ছেলে চুরি করে, তারা এসব থিয়েটার ফিয়েটার গ্রাহ্য করে না। তারা টাকা চায়। এমনি এমনি কেউ অতবড় একটা ছেলেকে লুকিয়ে রাখার ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? তাও পুলিশের ছেলে।

সুকোমলকে চুরি করেছে কেউ?

তাই তো মনে হয়। আজকাল এরকম আকছার হচ্ছে।

কী সর্বনাশ!

এইবারে কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি একটু বাথরুমে যেতে পারি?

গগন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন। কাছেই আছে, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

বাথরুমের দরজার কাছে এসে কাকাবাবু গগনের কাঁধে হাত রেখে নিচু গলায় বললেন, অন্যদের সামনে বলতে চাইনি, আমি স্পষ্ট জিজ্ঞেস করছি। আপনি সুকোমলকে লুকিয়ে রেখেছেন?

গগন ভুরু তুলে বলল, আমি? এরকম একটা বাজে কাজ আমি করতে যাব কেন?

কাকাবাবু বললেন, থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে চন্দ্রশেখরের বদনাম হবে। আপনি ওকে পছন্দ করেন না।

গগন বলল, চাঁদুদা আমাকে পছন্দ করে না, আমিও ওকে গুরুঠাকুর মনে করি না। সেটা অন্য ব্যাপার! আমি মশাই মাছের ব্যবসা করি, ছেলেচুরির ব্যবসা করি না।

কাকাবাবু বললেন, সুকোমলকে এ বাড়ির কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়নি?

গগন বলল, বাড়ি সার্চ করে দেখতে চান? আপনি কি পুলিশ?

কাকাবাবু বললেন, না, আমি পুলিশ নই। জোর করে সার্চ করার অধিকার আমার নেই। আমি আপনাকেই জিজ্ঞেস করছি।

গগন এবার হো হো করে হেসে উঠল।

তারপর বলল, আরে মশাই, থিয়েটার বন্ধ করার ব্যাপারে আমার কোনও হাত থাকলে সবচেয়ে বেশি কে রেগে যাবে জানেন? আমার বউ! সে আমাকেই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে।

কাকাবাবু বললেন, আপনার স্ত্রী বুঝি থিয়েটার খুব পছন্দ করেন?

গগন বলল, সে তো পছন্দ করে বটেই। আমি ওসব দেখি না। আপনাদের এই নাটকে তো আমার ছেলেও পার্ট করছে। আমার বউ দিনরাত তার পার্ট মুখস্থ করাচ্ছে।

তারপর সে হাঁক দিল, বিন্দু বিন্দু! ঘুমিয়ে পড়ল নাকি!

মোটেই ঘুমিয়ে পড়েনি, ভেতর দিকের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল সে।

বেরিয়ে এল ডাক শুনে। বারো-তেরো বছরের ছেলে।

তাকে দেখেই সন্তু বলে উঠল, এ তো আমাদের সুগ্রীব!

ছোটমামাও খুব অবাক হয়ে গগনকে বললেন, এ তোমার ছেলে? তোমার বড় ছেলেটিকে চিনি, একে আগে দেখিনি!

গগন বলল, আমার ছোট ছেলে। কী যেন বাঁদরটাঁদরের পার্ট করছে। এমনিতেও বেশ বাঁদর। মানাবে ভাল।

এই সময় বাইরে শোনা গেল একটা মোটরসাইকেলের শব্দ!