যোগজীবন যখন ফোনটা পেলেন সে সময় তিনি একা ছিলেন না। ঘরের মধ্যে দুজন ছিলেন। তিনি আর কিরীটী।
যোগজীবনের খুব ভোরে ওঠা অভ্যাস বরাবরই, লেকের কাছাকাছি বাড়ি তৈরি করার পর থেকে প্রত্যহ খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে বেড়াতে চলে যেতেন লেকে।
সারাটা লেক হেঁটে চক্কর দিতেন এবং সূর্যোদয়ের আগেই ফিরে আসতেন আবার। কি গ্রীষ্ম, কি শীত কখনও বড় একটা তাঁর ঐ রুটিনের ব্যতিক্রম হত না।
কিরীটীও তার নতুন বাড়ি গড়িয়াহাটায় চলে আসবার পর খুব ভোরে উঠে লেকে বেড়াতে যেতে শুরু করেছিল।
সেইখানেই অনেকের সঙ্গে আলাপ।
যোগেশবাবু, ধীরেনবাবু, মাস্টারমশাই প্রমোদবাবু, ফণীবাবু, দীনেশবাবু ও যোগজীবন— সবারই রিটায়ার্ড লাইফ।
অবসর জীবন যাপন করছেন। যোগজীবনের সঙ্গেই কিরীটীর একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা জমে ওঠে। মধ্যে মধ্যে যোগজীবন আসতেন কিরীটীর গৃহে, কিরীটীও যেত যোগজীবনের গৃহে। কিরীটীর মাথায় আবার নানা ধরনের ফুলের গাছের শখ চেপেছিল, যোগজীবনেরও ফুলগাছের শখ। যোগজীবন প্রায়ই গাড়ি নিয়ে এদিক-ওদিক কলকাতার বাইরে সব নারীতে যেতেন ফুলগাছের সন্ধানে।
কিছুদিন আগে ক্রোটন ফুলের একটা চারা এনেছিলেন যোগজীবন। তাতে প্রথম ফুল ধরেছে কথাটা–লেকে বেড়াতে বেড়াতে শুনে কিরীটী যোগজীবনের সঙ্গে তাঁর গৃহে এসেছিল দেখতে টবে ফোঁটা ফুলটা।
ফুল দেখার পর কিরীটী বললে, এটা ক্রোটন নয় যোগজীবনবাবু।
নয়! কিন্তু নারীর লোকটা যে বললে!
হয় সে ক্রোটন চেনে না, না হয় আপনাকে ঠকিয়েছে।
যোগজীবন হা হা করে হেসে ওঠেন, যাক গে, না জেনে ঠকেছি দুঃখ নেই।
ভৃত্য এসে ঐ সময় বললে, চা দেওয়া হয়েছে।
যোগজীবনের লেক থেকে বেড়িয়ে সর্বাগ্রে এক কাপ চায়ের প্রয়োজন হয়। তিনি কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, চলুন রায় সাহেব, চা খাওয়া যাক।
চলুন।
দুজনে বসে গল্প করতে করতে চা পান করছেন, ঐ সময় এল ফোন।
চাকর এসে ফোনের কথা বললে।
যোগজীবন শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
ফোনে গগনবিহারীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তো একেবারে থ যোগজীবন! তাও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়—খুন!
যোগজীবন মিনিট দশেক বাদে বসবার ঘরে ফিরে আসতেই কিরীটী যোগজীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন একটু বিস্মিতই হয়।
কি ব্যাপার যোগজীবনবাবু? ফোনে কোন দুঃসংবাদ ছিল নাকি? ইউ লুক ভেরী মাচ পেল পেল অ্যান্ড ডিসটার্বড়!
যোগজীবন চেয়ারটার ওপর বসতে বসতে বললেন, সত্যিই দুঃসংবাদ রায় সাহেব। আমার এক দীর্ঘদিনের বন্ধু, মাত্র কয়েক মাস আগে মিলিটারি থেকে রিটায়ার করে সাদার্ন অ্যাভিনুতে বাড়ি করে বসবাস করতে এসেছিল, সে—
কি হয়েছে তাঁর?
হি হ্যাজ বিন কিল্ড!
কিন্তু! মানে হত্যা করেছে তাঁকে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, স্ট্যাবড টু ডেথ!
কোথায়?
তার শোবার ঘরেই, আমাকে তার ভাইপো সুবীর এখুনি একবার যেতে বললে। আপনি বসুন, প্রস্তুত হয়ে আসি। ড্রাইভার তো এত তাড়াতাড়ি আসেনি, একটা ট্যাক্সি নিয়েই যাব ভাবছি।
যোগজীবন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী তার পকেট থেকে চুরুট ও দেশলাই বার করে চুরুটে অগ্নিসংযোগ করল।
যোগজীবন মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এলেন, চলুন।
রাস্তায় বের হয়ে কিন্তু ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। এমনিই হয়। দরকারের সময় হাতের কাছে কখনই একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায় না।
চলুন না, কাছেই তো। হেঁটেই যাওয়া যাক, কিরীটী বললে।
চলুন।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন।
রাস্তায় তখনও একটা বড় লোক-চলাচল শুরু হয়নি। খুব বেশি হলে সাড়ে-ছটা হবে।
আপনার বন্ধুর বাড়িতে কে কে ছিল যোগজীবনবাবু?
ওর স্ত্রীর আগেই মৃত্যু হয়েছে। একমাত্র ছেলে বিলেতে সেটেল্ড করেছে—ইঞ্জিনিয়ার। বাড়িতে এক ভাগ্নে আর এক ভাইপো তাদেরই এনে রেখেছিল।
ভাড়া দেননি বুঝি?
না।
ফোন করেছিল একটু আগে আপনাকে আপনার বন্ধুর ভাইপোই না?
হ্যাঁ।
কি করেন ভদ্রলোক?
আমিই কিছুদিন আগে এক মারোয়াড়ী ফার্মে ভাল চাকরি করে দিয়েছি।
বয়স কত?
ত্রিশ-বত্রিশ হবে। বিবাহিত?
না। বিয়ে-থা করেনি সুবীর আজও।
আর ভাগ্নে?
সুবিনয় সুবীর থেকে বছর দুই-তিনের বোধহয় ছোট। কোন একটা নামকরা ঔষধের প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, শুনেছি ভালই মাইনে পায়।
বাড়িতে চাকর-বাকর আছে কজন?
গগনের সঙ্গেই এসেছিল তার নেপালী ড্রাইভার বাহাদুর—ভৃত্য রামদেও। রামদেও লোকটা মিলিটারিতে চাকরি করত, খুব বিশ্বাসী এবং গগনের খুব প্রিয়। কেয়ারটেকার ও দারোয়ান জানাল সিং আর এদেশীয় ভৃত্য রতন ও কুক প্রিয়লাল। হ্যাঁ, আর একটি জীব আছে।
জীব?
একটি অ্যালসেসিয়ান কুকুর-জ্যাকি।
কুকুরটা কার?
গগনেরই। গগনের সঙ্গেই এসেছে। বাঘের মতন কুকুর।
আশ্চর্য!
কি বললেন?
বলছি অমন একটা কুকুর বাড়িতে, তবু ঐ রকম দুর্ঘটনা ঘটল!
আমিও তো তাই ভাবছি রায় সাহেব।
মানুষটি এমনিতে কেমন ছিলেন—মানে বলছি কোন রকমের ভাইস ছিল কি?
না। সে রকম কিছু আমি অন্ততঃ জানি না। অবিশ্যি এমনিতে একটু সেলফসেন্টার্ড, লোকজনের সঙ্গে বড় একটা মেশে না। তবে ইদানীং শুনতাম শমিতাদের ক্লাবে প্রত্যহ প্রায় যেত।
শমিতা কে?
আমার বোন।
বয়স কত?
বেশী নয়, বছর ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। ভবতারিণী কলেজে ইংলিশের প্রফেসার।
ক্লাবটার নাম কি?
মরালী সঙ্ঘ।
মরালী সঙ্ঘের নাম শুনে কিরীটী যোগজীবনের দিকে তাকাল, কারণ ক্লাবটার নাম সেও শুনেছিল। বালীগঞ্জ অঞ্চলেই ক্লাবটা। শহরের একদল ধনী প্রৌঢ় ও তথাকথিত অভিজাত পরিবারের যুবক-যুবতী মিলে ক্লাবটা গড়ে তুলেছে। ব্যারিস্টার, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সবাই। ক্লাবে কিরীটী শুনেছিল নানা ধরনের খেলাধূলার সঙ্গে সঙ্গে ঢালোয়া মদ্যপানও চলে। মধ্যে মধ্যে আবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করে।
সাধারণ স্তরের লোকেরা সেখানে প্রবেশ অধিকার পায় না।
আপনার বোন বুঝি ঐ ক্লাবের মেম্বার?
মেম্বার মানে একজন প্রধান পাণ্ডা। লেখাপড়া আর ক্লাব নিয়ে তো আছে হৈ-চৈ করে! আমিও আপত্তি করিনি। থাক।
বিয়ে-থা হয়নি?
হয়েছিল, কিন্তু বছর দুই হল ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।
আর বিয়ে-থা করলেন না?
না। ভালবেসে বিয়ে করেছিল কিন্তু তাও টিকল না দুবছরের বেশী।
কিরীটী কোন কথা আর বলে না। ইতিমধ্যে ওরা গগনবিহারীর বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল।
যোগজীবন বলেন, এই বাড়ি।
কিরীটী লক্ষ্য করল দুজন লাল পাগড়ি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। তারা ওদের প্রবেশে বাধা দিল না।
বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা করুণ দীঘায়ত কুকুরের ডাক ওদের কানে এল। কিরীটী বললে, কুকুরটা কাঁদছে।
যোগজীবন কিছু বললেন না।
দুজনে এগিয়ে গিয়ে গাড়িবারান্দায় উঠল।
ভৃত্য রতন ও বাহাদুর সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। যোগজীবনকে দেখে বাহাদুর সেলাম দিল, বাবুজী!
বাহাদুর?
সাব চলা গিয়া বাবুজী! বাহাদুরের গলায় কান্নার আভাস। চোখে জল।
কেইসে হুঁয়া কুছ পাতা মিলা বাহাদুর?
নেহি বাবুজী, আভিতক সমঝ মে নেহি আতা হ্যায় এইসা কেইসে হো সেকতা!
তুমি তো কাল রাত্রে বাড়িতে ছিলে?
জী।
রামদেও-ও কিছু জানে না? সেও কিছু বলতে পারছে না? যোগজীবন আবার প্রশ্ন করলেন।
রামদেকো পাতাই নেহি মিলতা বাবুজী সুবেসে!
কেন, সে কোথায় গিয়েছে?
কা জানে কিধার গিয়া, আভিতক নেহি লৌটা।
ওর বৌজেনানা কোথায়?
উপরমে হ্যায়।
ওর বৌ তো পাশের ঘরেই থাকত, সেও কিছু বলতে পারছে না?
নেহি বাবুর্জী, বেচারী রোতা হ্যায় শুনকর।
কিরীটী ঐ সময় প্রশ্ন করে, রামদেওর বৌ এখানে থাকত নাকি?
হ্যাঁ। বেটার তৃতীয় পক্ষের বৌ, কিছুদিন হল এসেছে এখানে।
বয়স তো তাহলে খুব অল্প?
হ্যাঁ, মোল-সতের হবে।
দেখতে কেমন?
দেখতে মোটামুটি ভালই।
চলুন উপরে যাওয়া যাক, কিরীটী বললে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বারান্দায় পৌঁছতেই সুবীরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
এই যে স্যার, আপনি এসে গিয়েছেন, যান ভিতরে গিয়ে দেখুন, কাকা কথাটা শেষ করতে পারে না সুবীর, কান্নায় যেন তার গলাটা বুজে আসে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুবীরকে দেখছিল।
বেশ সুন্দরই চেহারা, তবে রোগা। গায়ের রং সুবীর বংশের ধারা অনুযায়ীই পেয়েছিল। রীতিমত ফসা। মাথাভর্তি চুল ব্যাকব্রাস করা, তারই মধ্যে দু-একটা রূপালী চুল চোখে পড়ে। চোখ দুটি বড় বড়, টানা টানা। উন্নত নাসা। ধারালো চিবুক। চোখে সৌখীন ফ্রেমের চশমা।
পরনে পায়জামা ও পাঞ্জাবি। ইতিমধ্যে সুবীর বাইরের বেশ বদলে ফেলেছিল।
কিরীটীই প্রশ্ন করে, বাইরে পুলিস দেখলাম, থানার ওসি এসেছে বোধহয়?
হ্যাঁ, মিঃ মুখার্জী।
অরূপ, না?
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুবিনয় বাইরে এল ঐ সময় ঘর থেকে।
রায় সাহেব—এই সুবিনয়, গগনের ভাগ্নে।
কিরীটী তার অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একবার বুলিয়ে নেয় সুবিনয়ের সর্বাঙ্গে।
বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। গায়ের রংটা একটু চাপা। মাথার চুল রুক্ষ, বিস্রস্ত। চোখেমুখে একটা দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতার ছাপ পড়েছে যেন। পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত।
আপনি এসেছেন! যোগজীবনের দিকে তাকিয়ে বলে সুবিনয়, যান ভিতরে যান, থানা-অফিসার ভেতরেই আছেন। কথাটা বলে সুবিনয় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকায়।
কিরীটী যোগজীবনকে বললে, চলুন সান্যাল মশাই, ভেতরে যাওয়া যাক।
হ্যাঁ, চলুন।
দুজনে এগিয়ে গেল।