০৪. যাত্রা হলো শুরু
ঘুম ভাঙলো কাকামণির গলার শব্দে। তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। চোখেমুখে এসে পড়েছে সূর্যের সোনালি আলো। বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনতে পেলাম কাকামণি কার সঙ্গে যেন ঝড়ের মতো কথা বলে চলেছেন।
কথা চলছিলো দিনেমার ভাষায়। যে-লোকটির সঙ্গে কথা হচ্ছিলো, তার চেহারা দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মতো,-যেমন লম্বা-চওড়া, তেমনি স্বাস্থ্যবান। একটুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, সে গম্ভীর এবং স্বল্পবাক-কাজের কথা ছাড়া একটিও বাজে কথা বলে না।
লোকটি আইসল্যাণ্ডের। চওড়া বুকের উপর আড়াআড়িভাবে দুহাত রেখে চুপচাপ সে কাকামণির কথা শুনছিলো। নাম তার হান্স্ বিলকে। আইসল্যাণ্ডের এমন জায়গা নেই যা সে ঘুরতে বাকি রেখেছে। সে-ই আমাদের পথ দেখিয়ে স্নেফেলে নিয়ে যাবে বলে ঠিক হলো। পারিশ্রমিকটাও প্রথমে ঠিক করে নেয়া হলো। স্নেফেলের সানুদেশে স্ট্যাপি নামে যে ছোট্ট গ্রামটা আছে,-এখান থেকে একশো চুরাশি মাইল দূরে,-সেই পর্যন্তই সে আমাদের সঙ্গে যাবে বলে কথা হলো।
ফ্রিদিকসন আমাদের জন্য চারটে ঘোড়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। একটি কাকামণির জন্যে, একটি আমার আর বাকি দুটি মালপত্র বয়ে নিয়ে যাবে। হান্স্ বরাবর হেঁটেই যাবে।
পথ-ঘাট হাসের নখদর্পণে। এই পথে সে যে কতোবার যাওয়া আসা করেছে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। একথা শুনে কাকামণি তার সঙ্গে নতুন একটা বন্দোবস্ত করে নিলেন। আগেকার ব্যবস্থামত সে যে শুধু স্ট্যাপি পর্যন্তই যাবে তা নয়, কাকামণি তার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কাজে যতদুর যাবেন, হান্স্কেও সঙ্গে-সঙ্গে তততদূর যেতে হবে। পারিশ্রমিক ঠিক হলো সপ্তাহে বারো শিলিং করে। হান্স্ শুধু এইটুকুই বললে যে, আমাদের যা-ই ঘটুক না কেন, প্রতি শনিবার যদি তার সাতদিনের মাইনে চুকিয়ে দেয়া না হয়, তবে সে তক্ষুনি চাকরি ছেড়ে দেবে।
আমাদের রওনা হওয়ার সময় হয়ে এলো। জিনিশপত্র সব গুছিয়ে নেয়। হলো-গাইতি, কুঠার, রেশমের দড়ি, দড়ির সিঁড়ি, হাতুড়ি, পেরেক, যন্ত্রপাতি, এমন কি ফাস্ট এডের সরঞ্জাম পর্যন্ত। গুলি-বারুদ থেকে শুরু করে কাকামণির দেশলাই, চুরুট কিছুই বাদ গেলো না। টাকাকড়ি কতো আছে কাকামণি তা একবার হিশেব করে নিলেন। কয়েক জোড়া খুব ভালো রবারের জুতো, আর ছমাসের উপযোগী রসদও সঙ্গে নেবার ব্যবস্থা করা হলো।
ষোলোই জুন আজ। আকাশ মেঘলা থাকলেও বৃষ্টির নাম-গন্ধ নেই। কীরকম বিষণ্ণ একট। দিন যেন। ঘোড়ার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে দিয়ে আমরা রওনা হয়ে পড়লাম।
আস্তে-আস্তে রিজকিয়াভিক ছাড়িয়ে এলাম আমরা। সমুদ্রতীর ধরে সামনের দিকে চলতে লাগলাম।
সমুদ্রের ধারে মাঝে-মাঝে পাহাড় ছিলো বলে কখনো-কখনো আমাদের একটু ঘুরে যেতে হচ্ছিলো।
যেতে যেতে কাকামণি আইসল্যাণ্ডের ঘোড়া সম্পর্কে একটা লম্বাচওড়া বক্তৃতাও দিয়ে ফেললেন। এখানকার ঘোড়ার মতো এমন সুন্দর ঘোড়া নাকি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি পরিশ্রমী। পথ চলতে গিয়ে কোনো বাধাই এরা মানে না। বরফ পড়ুক, তুফান উঠুক, পাহাড়-পর্বত নদী-নালা যা-কিছু সামনে পড়ুক, কিছুতেই এরা দমবার পাত্র নয়, সব কিছু অবলীলাক্রমে অতিক্রম করে চলে যেতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বেচারি হান্স্ প্রত্যেক দিন অতো মাইল করে হাঁটবে কী করে, সে-কথা আমি কাকামণিকে একবার মনে করিয়ে দিতেই কাকামণি বললেন, ওর কথা ভাবিসনে! ও আমাদের চেয়ে আরো ভালো চলে যাবে হেঁটে। সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়ার লোক ও নয়। আর যদি কখনো ক্লান্তই হয়ে পড়ে, তখন না-হয় আমার ঘোড়ায় এসে উঠবে। একটানা ঘোড়ায় চড়ে যেতে আমারও তো আর খুব ভালো লাগবে না!
একটা নির্জন প্রান্তরের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছিলাম আমরা। জায়গাটা মরুভূমির মতো পরিত্যক্ত। কচিৎ কোথাও এক-আধটা ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছিল।
ঘণ্টা-দুয়েক বাদে প্রাতরাশ সেরে আবার আমরা চলতে লাগলাম। এবার পথ গেছে পাহাড়ের উপর দিয়ে। ভারি বিচ্ছিরি পথ। কবে কোন্ অতীতে আগ্নেয়গিরির লাভা এখানে এসে পড়েছিল,–এখন তা ক্রমে কঠিন হয়ে গেছে। অসমতল, ঢেউখেলানো রাস্তা দেখে সহজেই তা বোঝা যায়।
ক্রমশ বেলা বাড়তে লাগলো। একটানা চলে চারটের সময় হিশেব করে দেখা গেলো সবশুদ্ধ চব্বিশ মাইল পথ পেরোনো গেছে। এবার পথে একটা পার্বত্য নদী পড়লো। চওড়ায় নেহাৎ কম ছিলো না। নদীটা। তার দুই তীরে খাড়া পাথর মাথা তুলেছে শূন্যে। নদীর মাঝখানেও বড়ো-বড়ো পাথরের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে ছিলো। সেইজন্যে সেইসব পাথরের মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে ভীষণ স্রোত দেখা গেলো।
স্রোতের উদ্দামতা দেখে জলে নামতে সাহস হলো না আমার। কাকামণির মনে কিন্তু একটুও ভয়-ডর দেখা গেলো না। বরং বললেন : এইসব পার্বত্য নদীতে স্রোত ভীষণ হলেও জল সাধারণত কমই থাকে। সুতরাং ভয় কিসের? এই বলে ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষালেন কাকামণি। আইসল্যাণ্ডের অশ্ববরের যে প্রাণের মায়া আছে, এবার তা ভালো করেহ বোঝা গেলো। দু-পা এগিয়েই মাথা নিচু করে সে জল শুঁকতে লাগলো, আর একটুও নড়ানো গেলো না ওকে। ঘোড়ার এই বেয়াড়ারকম বেয়াদবি সহ্য হলো না কাকামণির। একধার থেকে চাবুক মারতে শুরু করলেন। কিন্তু তবু ঘোড়া একটুও নড়লো না। মাথা ঝাঁকাতে লাগলো শুধু।
ব্যাপার-স্যাপার দেখে কাকামণি দস্তুরমতো রেগে উঠলেন। ধমক দিতে শুরু করলেন ঘোড়াকে। তখন শ্রীমান অশ্ববর নিরুপায় হয়ে পেছনের পা দুটি মুড়ে নিচু হয়ে কাকামণির পায়ের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো। কাকামণি তো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি হাসবো কি কঁদবো বুঝতে পারলাম না।
তখন হান্স্ আমাদের বুঝিয়ে বললো : এখন জোয়ারের সময়। হাজার চেষ্টা করলেও এখন ও নদী কোনোমতেই পেয়োনো যাবে না। ভাঁটার সময় জল কমলে ভেলায় করে নদী পেরোতে হবে।
আর কোনো উপায় নেই দেখে অপেক্ষা করাই সাব্যস্ত করলেন কাকামণি। হান্স্ ইতিমধ্যে পাশের একটি গ্রাম থেকে দুটি লোক এবং প্রচুর কাঠ ও বাঁশ নিয়ে এসে ঐ লোকদুটির সাহায্যে মজবুত একটা ভেলা তৈরি করলো।
বিকেল ছটার সময়ে সেই ভেলায় করে আমরা নদী পেরোলাম। বলা নিষ্প্রয়োজন, ঘোড়াগুলিকেও এইভাবেই পার করে নেয়া হলো। তারপর আবার সামনের দিকে এগোনো শুরু হলো।
রাত তখন আটটা কি সাড়ে-আটটা। রাত অবশ্য ঘড়ির কথায়, আসলে রাতের কোনো চিহ্নই নেই, দিনের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। আইসল্যাণ্ডের মতো দেশে জুন ও জুলাই মাসে সূর্যাস্ত বলতে গেলে হয়ই না,–রাত বারোটার সময়েও দিনের মতোই দেখায়।
শীতটা কিন্তু এর মধ্যেই একটু বেশিরকমই পড়ে গিয়েছিলো। খিদেও পেয়েছিল সাংঘাতিক রকম। এমন সময় কাছেই একটা চাষীর বাড়ি দেখতে পেয়ে মন উল্লাসে নেচে উঠলো। তা-ই তখন আমার কাছে রীতিমতো রাজ প্রাসাদ। গৃহস্বামী তো আদরে আপ্যায়নে আমাদের একেবারে উদ্বস্ত করে তুললো প্রায়। রাতটা সেখানে খুব ভালোই কাটলো।
পরদিন ভোর পাঁচটার সময়ে সেই চাষী-পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। এখন থেকে পথ আরো খারাপ। দক্ষিণ দিকে অন্তহীন পাহাড়ের সারি ঠিক মেঘের মতো দেখাচ্ছিলো। পথ তো একেবারে নির্জন। কোনো জন-প্রাণীরই সাক্ষাৎ পাওয়া গেলো না পথে। সন্ধের সময় আরেকটা ছোটো নদী পেরিয়ে নির্জন প্রান্তরের একটি জনহীন পোড়ো বাড়িতে রাতটা কাটানো গেলো।
পরদিনও নির্জন প্রান্তরের মধ্য দিয়ে এগোনো চলল। মরুভূমির মতো পরিত্যক্ত যেন পথঘাট। আমার কিন্তু মোটেই ভালো লাগছিলো না। রাত্রিবেলা ক্রলব, নামে একটা গ্রামে এসে পৌঁছলাম আমরা। কাকামণি হিশেব করে জানালেন যে প্রায় অর্ধেক পথ আমরা অতিক্রম করেছি।
উনিশে জুন আমরা কঠিন লাভার এবড়ো-খেবড়ো পথ দিয়ে চললাম। মধ্যেমধ্যে দেখতে পেলাম উষ্ণ প্রস্রবণের বাষ্পধারা। কোথাও নুড়ি-পাথরে বোঝাই, কোথাও-বা পঙ্কিল জলাভূমি, আবার কোনোখানে ঝিলের জলে সূর্যের সোনা রোদ্দর। দূরে স্নেফেলের চুড়োগুলি শাদা মেঘের মতো দেখাচ্ছিলো।
পর-পর কয়েকদিন একটানা ঘোড়ায় চড়ে যেতে-যেতে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। কাকামণির কিন্তু এখনো উৎসাহের কমতি নেই। হাসের মুখ দেখে অব তার মনের অবস্থা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
বিশে জুন সন্ধ্যাবেলায় বুদির নামে একটা গ্রামে এসে হাজির হলাম। গ্রামটি একেবারে সমুদ্রের কোল ঘেসে। এখানেই হাসের বাড়ি। রাত্তিরে তার বাড়িতেই ওঠা গেলো। হাসের বুড়ো বাবা আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। আজ হাসের সাত দিনের মাইনে চুকিয়ে দিলেন কাকামণি।
একুশে জুন ভোরবেলাতেই আবার তাড়াহুড়ো করে যাত্রা শুরু করা হলো। স্নেফেল আর বেশিদুর নয়। পৌঁছে গেছি বললেও চলে। সেফেলের পূর্বাভাস হিসেবে পথ এবার তাই গ্রানাইট পাথরে ছাওয়া। কয়েক ঘণ্টা পরই স্নেফেলের আকাশ-ছোঁয়া বিরাট শরীর চোখে পড়লো। পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে চলা আরম্ভ হলো এবার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলেছি-কিন্তু স্নেফেলের সঙ্গে ব্যবধান যেন আর কমতেই চায় না। কাকামণি তো একদৃষ্টে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছেন, আর মাঝে-মাঝে ডন কুইকজোটের মতো মুঠো উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন : যে করেই হোক ঐ দৈত্যটাকে আমাদের জয় করতেই হবে।
পুরো চার ঘণ্টা চলবার পর স্নেফেলের সানুদেশের গণ্ডগ্রাম স্ট্যাপিতে পৌঁছননা গেলো। ছোটো গ্রাম। মোটে ত্রিশটি ঘর। ঘরগুলো আবার বাড়া দিয়ে তৈরি। গ্রামের সর্বত্রই হলুদ রঙের ব্যাসাল্ট পাথর তূপাকারে ছড়ানো।
স্ট্যাপিতে পৌঁছে আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। এবার সত্যিসত্যিই সেফেলের মধ্য দিয়ে নামতে হবে পাতালের দিকে? একবার পাতালে নামলে যে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না, সে-সম্বন্ধে আমি একরকম নিশ্চিতই ছিলাম। সেইজন্যেই মন কেমন করতে লাগলো শুধু।
হান্স্কে আমাদের আসল উদ্দেশ্যটা খুলে বললাম। আশ্চর্য! ওর কি একটুও ভয়-ডর নেই? তবে কি হাস্ও কাকামণির মতো পাগল হয়ে গেছে? একটুও ভীত বা অবাক না হয়ে সে শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হলো। বুঝতে পারলাম, রেহাই নেই এবারে। হ্যামবুর্গে জোর করে বোঝালে কাকামণি হয়তো না-ও আসতে পারতেন, কিন্তু স্নেফেলের নিচে দাঁড়িয়ে ওঁকে এ-কাজ থেকে নিবৃত্ত করা অসম্ভব। পাহাড়ে তো অনেকেই ওঠে। অগ্নিগিরির ক্রেটারও পরীক্ষা করে দেখে অনেকে। কিন্তু ঐ ক্রেটারের মধ্য দিয়ে একেবারে পৃথিবীর অভ্যন্তরে নেমে পড়া?—ভাবলেও শিউরে ওঠে শরীর।
একটা প্রশ্ন বারবার আমার মনের মধ্যে উকি মারছিলনা। সামউজমের কথা কি সত্যি? সত্যিই কি ক্রেটারের মধ্য দিয়ে একদম পৃথিবীর মধ্যখানে গিয়ে পৌঁছনো যাবে? ধরা গেলো যাওয়া যায়। কিন্তু সেই অন্ধকার পাতালের গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলাটা তো বিচিত্র নয়। তারপর, হয়তো ভিতরে নেমেছি, এমন সময়ে সাতশো বছরের ঘুম ভেঙে জাগলে আগ্নেয়গিরি, তখন? তখন কী হবে?
তেইশে জুন তারিখে হান্স্ দুজন লোক ঠিক করলো। লোকদুটি আমাদের মালপত্র নিয়ে পাহাড়ের উপর পর্যন্ত যাবে। কাঁধে বন্দুক নিয়ে, সঙ্গে পাহাড়ে ওঠার লোহা-বধানো লাঠি নিয়ে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। হান্স্ বুদ্ধিমানের মতো এক বোতল জল নিলো সঙ্গে। এই জলে আট দিন চলে যাবে আমাদের। সকাল নটার সময় স্ট্যাপির লোকজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা স্নেফেলে উঠতে শুরু করলাম।
স্নেফেলের উচ্চতা পাঁচ হাজার ফুট। প্রকাণ্ড দুটি চুড়ো তার। রিজকিয়াভিক থেকেও এই চুড়োদুটি মেঘের মতো দেখা গিয়েছিলো। এখন কাছ থেকে দেখে মনে হলো, বরফ-মোড় চুড়দুটি আকাশের নীল রঙ ছুঁয়েছে।
নীরবে আমাদের আরোহণের পালা চললো। পথ এত সরু যে একসঙ্গে একজনের বেশি ওঠা যায় না। হান্স্ যাচ্ছিলো আগে-আগে পথ দেখিয়ে। পেছনে আমরা। চারপাশে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে খনির আকর। জিওলজিক্যাল ইনষ্টিটিউটের মতে বরফের মধ্যে পাথর ও খনিজ আর নেই। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, আইসল্যাণ্ড আগে ছিলো সমুদ্রের তলায়, ভূমিকম্পের দরুন জলের অতল থেকে মাথা তুলেছে শূন্থে। তাই বলে অন্যান্য দেশের মতো পলিমাটির চাদর এখানে নেই, ভূ-ত্বক লাভায় ঢাকা। এখনো যে আইসল্যাণ্ডের মাটির নিচে ভীষণ রকম আগ্নেয় আলোড়ন চলেছে, আশপাশের পর্বতের ফাটল দিয়ে উষ্ণ বাষ্প বেরোতে দেখে তা সহজেই বোঝা যায়।
আমাদের পথ বড়ো-বড় পাথরে সাজানো। থাকগুলো লাভায় মোড়া। পথ ক্রমশই বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠলো। একেবারে খাড়াই। খুব সাবধানে লাঠি ঠুকে-ঠুকে পা টিপে-টিপে উপরে উঠতে লাগলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিলো উঠতে। হাস, কিন্তু দ্রুতপায়ে বেশ সাবলীল গতিতেই চলেছে। আমরা সবাই পিছিয়ে পড়ি বলে একটু দূর গিয়েই ওকে আমাদের জন্যে থামতে হচ্ছিলো। তখনো সত্যিকার পাহাড়ে চড়ার পালা শুরু হয়নি। সেটা শুরু হলো আরও ঘণ্টাতিনেক পরে। ভাগ্যিস হাসের কথামতো মধ্যে একটু জিরিয়ে প্রাতরাশ করে নিয়েছিলাম, নইলে আর এক পা-ও এগোতে পারতাম না।
খাড়াই বেয়ে-বেয়ে যতোই আমরা উঠতে লাগলাম, পথও যেন ততই বেড়ে চললো। ফুরোতেই চায় না কোনোমতে। মাটির চিহ্নমাত্র নেই কোনোখানে। শুধু পাথর আর পাথর। পায়ের ধাক্কায় কতো ছোটোখাটো পাথর যে নিচে গড়িয়ে পড়লো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এক-এক জায়গায় পথ এতে খাড়াই যে হান্স্ কোনোরকমে আমাদের লাঠির সাহায্যে টেনে তুললো। কাকামণিও আমাকে অনেকবার হাত ধরে টেনে তুললেন।
ভাগ্যিস অনেকক্ষণ ওঠার পরে আবার লাভার তৈরি পাথরের সিঁড়ির মতে সারি সারি থাকের নাগাল পাওয়া গিয়েছিল, নইলে আমার দ্বারা আর ওঠা হতো না।
সন্ধে সাতটার সময়ে হাজার-দুই সিঁড়ি পেরিয়ে একটি প্রশস্ত চত্বরের মতো জায়গায় এসে পৌঁছলাম। তাকিয়ে দেখি, দূরে-বহু দূরে, চার হাজার ফুট নিচে সমুদ্রের ঘন নীল রঙ। এইখানে অল্প একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার আমরা উঠতে লাগলাম।
রাত বারোটার সময়ে চুড়ায় এসে পৌঁছলাম আমরা। মধ্যরাত্রির সূর্যালোকে চারিদিক তখন আলোয় আলোকিত।
খিদেয় ঠাণ্ডায় তখন প্রাণ যেন প্রায় গলার কাছে এসে পৌঁছেছিলো। তবুও মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম মধ্যরাত্রির অপরূপ আলো। চারদিকে বরফের শাদা, মাথার উপরে পরিচ্ছন্ন আকাশের নীল রঙ, দূরে মধ্যরাত্রির সূর্যের উজ্জ্বল সোনালি।
আর সারা পৃথিবী তখন ঘুমের অথই তলায় অচেতন হয়ে পড়ে।