০৪. মিহিমুখ নামে একটা জায়গা

মিহিমুখ নামে একটা জায়গা থেকে হাতি নিতে হয়। এখনও ভোরের আলো পুরোপুরি ফোটেনি। আকাশের একদিক অন্ধকার, একদিক একটু লালচে-লালচে। শেষরাতে উঠে ব্ৰহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে আসতে চমৎকার লেগেছে, কিন্তু শীত বড্ড বেশি। সন্তু আর জোজো সোয়েটারের ওপর কোট, গলায় মাফলার, হাতে গ্লাভস পরে তৈরি হয়ে এসেছে।

গাড়িতে আসবার সময় জোজো অনবরত গান গেয়েছে। আর সন্তুকে বারবার খোঁচা মেরে বলেছে, তুইও গান কর, গান কর। যদি টপ্পা শিখতে চাস, তা হলে এই শীতেই খুব ভাল শেখা যায়। আপনি-আপনি গলা কাঁপবে। এই দ্যাখ না, যাব না, যাব না-আ-আ-আ-আ!

কাকাবাবু একসময় স্বীকার করেছিলেন, জোজো সত্যি গান জানে।

অন্য টুরিস্ট আজ বেশি নেই। কাকাবাবুদের জন্য মিহিমুখে দুটো হাতি আগে থেকে ঠিক করা আছে। তপন আসেনি, তার বদলে শচীন সইকিয়া নামে আর-এক জন অফিসার আজ ওদের দেখাশোনা করবে। লোকটি বেশ হাসিখুশি ধরনের।

জোজো বলেছিল বটে যে আফ্রিকায় তার পোষা হাতি ছিল, কিন্তু এখানে সে হাতির পিঠে চাপতে গিয়ে প্রথমবার গড়িয়েই পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। তাতে একটুও দমে না গিয়ে সে ঠোঁট উলটে বলল, আফ্রিকার হাতির সঙ্গে এখানকার হাতির তুলনাই হয় না। এখানকার হাতিগুলো ছোট-ছোট। এত ছোট হাতির পিঠে চড়া আমার অভ্যেস নেই। এ যেন ঘোড়ার বদলে গাধার পিঠে চড়া!

জোজো আর সন্তু বসল একটা হাতির পিঠে। আর-একটাতে কাকাবাবু আর শচীন সইকিয়ার ওঠার কথা, কিন্তু কাকাবাবু একটু দূরে একটা খড়ের ঘরের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। সেখানে একটা ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। সাধারণ গোড়া যেমন হয়।

কাকাবাবু শচীনকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই ঘোড়াটা কার?

শচীন বলল, রাধেশ্যাম বড়ুয়া এখানে কাজ করে, ওটা তার ঘোড়া। বিভাগের নয়, ওর নিজস্ব।

কাকাবাবু বললেন, সে কি ঘোড়াটা আমাকে ধার দেবে? আমি একটা কথা ভাবছিলাম। আমার এই দু বগলে ক্রাচ নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে খুব অসুবিধে হয়। উঁচুনিচু থাকলে আরও মুশকিল। কিন্তু ঘোড়ায় চেপে অনায়াসে ঘুরতে পারি।

শচীন বলল, এখন তো আমরা হাতির পিঠে যাচ্ছি। মাটিতে নামব না।

কাকাবাবু বললেন, কোথাও একটু নামার ইচ্ছেও তো হতে পারে। ওই রাধেশ্যাম বড়ুয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন না!

রাধেশ্যাম একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। একসময় সে বোধ হয় মিলিটারিতে ছিল, শচীনের সামনে এসে জুতোয় খটাখট শব্দ করে স্যালুট দিল।

শচীন বলল, রাধেশ্যাম, তোমার ঘোড়াটা এই স্যারকে ব্যবহার করতে দেবে? ইনি আমাদের কনজারভেটর সাহেবের অতিথি।

রাধেশ্যাম কাকাবাবুর আপাদমস্তক চেয়ে দেখল। তারপর সন্দেহের সুরে বলল, আপনি ঘোড়া চালাতে জানেন?

কাকাবাবু বললেন, এককালে তো ভালই পারতাম। অনেক দিন অভ্যেস নেই। চেষ্টা করে দেখি?

রাধেশ্যাম ঘোড়াটা আনার পর কাকাবাবু ক্রাচ দুটো শচীনের হাতে দিয়ে একটু কষ্ট করেই ঘোড়াটার পিঠে চাপলেন। অচেনা আরোহী পেয়ে ঘোড়াটা পিঠ ঝাঁকাতে লাগল, কাকাবাবু দু হাঁটু দিয়ে চেপে রইলেন তার পেট। প্রথমে আস্তে-আস্তে কয়েক কদম যাওয়ার পর তিনি জোরে ছুটিয়ে দিলেন, মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এলেন জঙ্গল থেকে।

হেসে বললেন, এই তো বেশ পারছি। ঘোড়াটাও আমাকে চিনে গেছে, আর ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে না।

রাধেশ্যাম বলল, হ্যাঁ, আপনি চালাতে জানেন, বোঝা যাচ্ছে! নিয়ে যান ওকে!

কাকাবাবু উৎফুল্লভাবে বললেন, কোনওই অসুবিধে হচ্ছে না। ভাবছি এবার কলকাতায় ফিরে গিয়েও ঘোড়ায় চড়ব। নিজের জন্য একটা ঘোড়া কিনে নেব।

শচীন অন্য হাতিটিতে চাপল, কাকাবাবু চললেন ওদের পাশে পাশে। আকাশ এখন ভরে গেছে নীল আলোয়। জঙ্গলের অন্ধকার মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মতন। শুরু হয়ে গেছে পাখির ডাক। প্রথমেই চোখে পড়ল দুটো বনমোরগ। সাধারণ মোরগের চেয়ে অনেক বড়, আর তাদের মাথায় আগুন রঙের ঝুঁটি। তীক্ষভাবে ডাকতে-ডাকতে উড়ে গেল এক গাছ থেকে আর-এক গাছে।

অনেক দূরে দেখা গেল গোটাকতক হরিণ। একটা সরু পথ তারা লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেল চোখের নিমেষে।

জোজো বলল, গণ্ডার দেখা যাবে না, গণ্ডার?

কাকাবাবু কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ব্যস্ত হয়ো না, দেখতে পাবে! একদম কথা বলা চলবে না। আর শোনো, কোনও একসময় যদি আমরা আলাদা হয়ে যাই, তা হলে ঠিক করা রইল, ঠিক দু ঘণ্টা বাদে আমরা আবার মিহিমুখে ফিরে আসব।

শচীন বলল, বাঘ সম্পর্কে সাবধান থাকবেন, স্যার। ঘোড়া দেখলে বাঘ আসে। হাতির পিঠে থাকলে সে-ভয় নেই।

হাতি চলেছে দুলকি চালে। মাঝে-মাঝে হাতি দুটো থেমে পড়ে কোনও গাছের ডাল ভাঙছে। ঘোড়া এত ধীর গতিতে চলতে পারে না। কয়েকবার কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন খানিকটা, আবার ফিরে এলেন।

তারপর এক সময় ওদের কিছু না জানিয়ে ইচ্ছে করেই তিনি চলে গেলেন অন্য দিকে।

এবার বেশ জোরে যেতে লাগলেন তিনি। অনেক দিন পর ঘোড়া চালিয়ে তাঁর খুব আনন্দ হচ্ছে। বয়সটা যেন কমে গেছে হঠাৎ। ঘোড়ার পিঠে একা-একা কিছুক্ষণ ছুটলেই নিজেকে যেন একজন যোদ্ধা মনে হয়। আগেকার আমলের যোদ্ধা। মাথায় পাগড়ি আর কোমরে তলোয়ার থাকলে মানায়।

প্রথম রাত্তিরে যেখানে গিয়েছিলেন কাকাবাবু, সেই জলাশয়টা খুঁজতে লাগলেন। খুব অসুবিধে হল না, মাঝে-মাঝে জিপ গাড়িটার চাকার দাগ চোখে পড়ছে। কোথাও-কোথাও গাছের ডাল কেটে জিপটাকে এগোতে হয়েছিল, সেই সব ডাল পড়ে আছে মাটিতে। এইসব চিহ্ন অনুসরণ করতে করতে ঝিলটার কাছে পৌঁছে গেলেন কাকাবাবু।

ক্রাচ দুটো আনেননি, তাই ঘোড়া থেকে নামলেন না।

সেই রাত্তিরে এই জায়গাটা কত রোমাঞ্চকর মনে হয়েছিল, এখন সকালের আলোয় আর সে রকম কিছু মনে হয় না। ঝিলটার জল বেশ কমে গেছে, মাঝখানে ফুটে আছে লাল শালুক। একঝাঁক বালিহাঁস জলে ভাসছিল, ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ পেয়েই সবাই মিলে ঝটপটিয়ে উড়ে গেল।

জলের ধারে ধারে নরম মাটিতে অনেক রকম জন্তুর পায়ের দাগ।

কাকাবাবু যে-জায়গাটায় পড়ে গিয়েছিলেন সে-জায়গাটাও খুঁজে পেলেন। সেখানকার মাটি ছেয়ে আছে কাঁটাঝোপে, বেশ বড়বড় কাঁটা। ভাগ্যিস, চোখে বিধে যায়নি। সেই কাঁটাঝোপে আবার ছোট্ট-ছোট্ট হলুদ ফুল ফুটেছে।

ঘোড়াটা নিয়ে কাকাবাবু ঘুরতে লাগলেন ঝিলটার চারপাশে। দিনের বেলা জন্তু-জানোয়াররা জল খেতে আসে না। সারাদিন কি ওদের তেষ্টা পায় না?

অনেকটা ঘোরার পর কাকাবাবু এক জায়গায় একটা কাচের বোতল দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। এত দূরে টুরিস্টদের আসতে দেওয়া হয় না। চোরাশিকারিরাই তা হলে এই বোতলটা ফেলে গেছে। কাছেই একটা পাথরের দেওয়ালের মতন। কোনও এক সময় কেউ এখানে একটা ঘর বানিয়েছিল মনে হয়, এখন এই একটা দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

সেই দেওয়ালের পেছন দিকটায় গিয়ে কাকাবাবু দেখলেন, সেখানে দু-একটা পাউরুটির টুকরো, মুরগির মাংসের হাড়, ছেঁড়া খবরের কাগজ পড়ে আছে। চোরাশিকারিরা এখানে অনেকক্ষণ সময় কাটায় বোঝা যাচ্ছে। এখানে বসে খাওয়াদাওয়া করে। দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যায়।

আবার ঝিলের দিকে এসে কাকাবাবু দেখলেন, সেই কাঁটা ঝোপের জায়গাটা থেকে এই দেওয়ালটা খুব দূরে নয়। তিনি এখন উলটো দিক দিয়ে ঝিল ঘুরে এসেছেন। সেই রাত্রে এই দেওয়ালটার বেশ কাছে এসে পড়েছিলেন। সেইজন্যই চোরাশিকারিরা তাঁর দিকে গুলি ছুড়েছিল। তাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, না ভয় দেখাতে চেয়েছিল শুধু?

কাকাবাবুর ঘোড়াটা ঝিলের কাছে গিয়ে চকচক করে জল খেয়ে নিল খানিকটা। ঘোলাটে জল, ভেতরে আবার শ্যাওলা জমে আছে। কাকাবাবু ভাবলেন, এই নোংরা জল খেতে মানুষের ঘেন্না হয়, জন্তু-জানোয়াররা তো দিব্যি খেয়ে নেয়। তাদের অসুখও করে না।

হঠাৎ ঝিলের অন্য পারে গাছপালার মধ্যে যেন তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল। কাকাবাবু তাড়াতাড়ি ঘোড়াটাকে পিছিয়ে নিয়ে কয়েকটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়ালেন। কারা যেন আসছে। একটু পরেই বোঝা গেল, মানুষ নয়, আসছে হাতির পাল। ঝোপঝাড় ভেদ করে বেরিয়ে এল তিনটে বড় হাতি আর একটা বাচ্চা। তারা হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল ঝিলে। এই শীতে জল খুবই ঠাণ্ডা,

ওদের কি শীত করে না?

বোঝা গেল, ওরা স্নান করতে এসেছে। শুড় দিয়ে জল তুলে ফোয়ারার মতন ছিটিয়ে দিচ্ছে এক জন আর-এক জনের গায়ে। কাকাবাবু এ রকম দৃশ্য আগে দেখেননি। বাচ্চাটাকে নিয়ে খেলছে তিনটে বড় হাতি।

অন্য জন্তু-জানোয়ার দিনের বেলা আড়াল ছেড়ে বেরোতে ভয় পায়, কিন্তু হাতির কোনও ভয়ডর নেই। বাঘও সব সময় আড়ালে থাকতেই পছন্দ করে। হাতি কাউকে গ্রাহ্য করে না।

কিছুক্ষণ হাতিদের জলকেলি দেখার পর কাকাবাবু আবার ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।

মিহিমুখে সন্তুরা তখনও ফিরে আসেনি। রাধেশ্যামকে ঘোড়াটা ফেরত দিয়ে কাকাবাবু তার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। রাধেশ্যাম তার এই ঘোড়াটার জন্য খুব গর্বিত। এর নাম রেখেছে সে রণজিৎ। এ ঘোড়া যে-কোনও লোককে তার পিঠে সওয়ার হতে দেয় না, ঝাঁকুনি দিয়ে ফেলে দেয়। কাকাবাবুকে রণজিতের নিশ্চয়ই পছন্দ হয়েছে।

কাকাবাবু রাধেশ্যামকে কিছু টাকা দিতে চাইলেন, সে কিছুতেই নিল না। সে বলল যে, কাকাবাবু ইচ্ছে হলে আবার রণজিৎকে নিতে পারেন যে-কোনও

দিন।

সন্তু আর জোজো ফিরে এল তর্ক করতে করতে।

সন্তু দেখতে পেয়েছে গোটা পাঁচেক গণ্ডার, একপাল বুনো শুয়োর, শম্বর আর বুনো মোষ। হরিণ তো অনেক।

জোজো বলল, সে আরও বেশি দেখেছে। সে ওগুলো ছাড়াও দেখেছে বাঘ আর পাইথন।

সন্তু বলল, মোটেই তুই বাঘ দেখিসনি। ওটা একটা হলদে মতন একটা ঝোপ।

জোজো বলল, আমি বাঘের মাথাটা দেখতে পেয়েছি, স্যাট করে ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল।

সন্তু বলল, তোর ক্যামেরায় ছবি তুললি না কেন?

জোজো বলল, ওরকম বাঘের ছবি আমাদের বাড়িতে কত আছে।

সন্তু বলল, তুই যেটা পাইথন বললি, সেটা একটা গাছের ভাঙা ডাল।

জোজো বলল, আমি বলছি, পাইথনটা চোখ পিটপিট করছিল।

কাকাবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, যাক, মোট কথা, তোদের সফর খুব সাকসেসফুল। অনেক কিছু দেখেছিস। সবচেয়ে কোন্টা ভাল লাগল?

জোজো সঙ্গে-সঙ্গে বলল, পাইথন। সন্তু ওটা দেখেনি!

সন্তু একটু ভেবে বলল, সবই ভাল লেগেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে ময়ূর। আমি আগে কখনও ময়ূরকে উড়তে দেখিনি। অতবড় লেজ নিয়ে উড়ে যায়, বেশ উঁচু গাছে বসে। রোদ্দুরে ওদের গায়ের রং ঝিলমিল করছিল।

দুপুরবেলা বাংলোতে ফিরে খাওয়াদাওয়া করেই ঘুম। আগের রাতে ভাল করে ঘুমই হয়নি। এখন সেটা পুষিয়ে নিতে হবে।

কাকাবাবু অবশ্য ঘুমোলেন না। দুপুরে তাঁর কিছুতেই ঘুম আসে না। তিনি বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে বসে রইলেন পা ছড়িয়ে। গায়ে রোদ লাগছে, তাতেও বেশ আরাম!

বিকেল হতেই কাকাবাবু ছেলে দুটিকে জাগিয়ে দিয়ে বললেন, চলো, চলো, এখন বেরুতে হবে। বেড়াতে এসে শুধু-শুধু ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয়!

টেলিফোন করতেই এ-বেলা স্টেশান ওয়াগনটা নিয়ে হাজির হল তপন। কাকাবাবু বললেন, চলল, ভালুকপং ঘুরে আসি।

তপন বলল, স্যার, ওদিকে তো যাওয়া যাবে না। ওদিকটা অরুণাচলে পড়ে যাচ্ছে। অসম ছেড়ে অরুণাচলে ঢুকতে হলে পারমিট লাগে। অবশ্য কালকেই আপনাদের জন্য পারমিট আনিয়ে দিতে পারি।

কাকাবাবু বললেন, অরুণাচলের ভেতরে ঢুকব না। ভালুকপং-এর নদীর ধার পর্যন্ত তো যাওয়া যায়। সেই জায়গাটাও খুব সুন্দর।

সন্তু বলল, ভালুকপং! ভালুকপং! নামটা বেশ মজার তো!

কাকাবাবু বললেন, ওখানকার নদীর নামটাও খুব সুন্দর, জিয়াভরলি। তার মানে হচ্ছে জীবন্ত নদী।

তেজপুর থেকে ভালুকপং প্রায় ষাট-সত্তর কিলোমিটার দূরে। পৌঁছতে-পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল।

নদীর ধারে পর্যটকদের থাকবার জন্য একটা নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে। পেছন দিকে জঙ্গল। সব মিলিয়ে বেশ ছবির মতন।

গাড়ি থেকে নেমে নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে তপন বলল, অন্ধকার হয়ে গেছে, তাই নদীর জলের রং বোঝা যাচ্ছে না। দিনের বেলায় এ-নদীর জল সমুদ্রের মতন, নীল রঙের বলে মনে হয়।

কাকাবাবু বললেন, বেশ স্রোত আছে। সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেইজন্য রাত্তিরবেলাতেও নদীটাকে জীবন্ত মনে হয়।

সন্তু বলল, এই নদীতে সাঁতার কাটা যায়?

তপন বলল, খুব বিপজ্জনক। স্রোতে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এইসব পাহাড়ি নদীর কখন যে জল বাড়ে, কিছু বলা যায় না।

জোজো বলল, তেজপুরের বাংলো থেকে এ-জায়গার বাংলোটা অনেক ভাল। আমরা এখানেই থাকতে পারি না?

তপন বলল, হ্যাঁ, ব্যবস্থা করা যায়। ভাগ্যে থাকলে বাংলোতে বসে বসেই দেখা যায় হাতির পাল নদীতে জল খেতে আসছে।

হঠাৎ নদীর জলে দারুণ জোর একটা শব্দ হল। এ-পার থেকে কে যেন জলে লাফিয়ে পড়েছে। ওরা দৌড়ে গেল সেই দিকটায়। আবছা আলোয় দেখা গেল, স্রোতের মধ্যে ঝপাঝপ শব্দ হচ্ছে, আর ঘোড়াসুন্ধু একজন মানুষ উঠছে আর নামছে। মানুষটি নিশ্চয়ই হঠাৎ পড়ে যায়নি, সে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে না। সে ঘোড়াসুদ্ধ নদী পার হতে চাইছে।

সন্তু বলল, বাবা, লোকটার তো দারুণ সাহস!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, লোকটা কে? চেনো নাকি, তপন?

তপন বলল, নাঃ! ঠিকমতন তো দেখতেও পাচ্ছি না!

কাকাবাবু বললেন, টিকেন্দ্রজিৎ নাকি?

তপন বলল, হতেও পারে। একমাত্র তারই এমন সাহস হতে পারে। কিন্তু টিকেন্দ্রজিৎ এখানে কেন আসবে?

কাকাবাবু বললেন, যদি আমাদের ফলো করে আসে, তা হলে এরকম অকারণ বীরত্ব দেখাবারই বা দরকার কী? অন্য কেউ হবে।

ওরা সবাই একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সেই স্রোতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অশ্বারোহীটি একসময় পৌঁছে গেল নদীর ওপারে। সেখানে একটুও অপেক্ষা করল না, ঘোড়া চালিয়ে দিল তীরবেগে।

কাকাবাবু বললেন, চলো, এবার ফেরা যাক। কাল আমরা ওরাং জঙ্গল দেখতে যাব।

গাড়িতে ওঠার পর কাকাবাবু বললেন, এখানে যেমন জিয়াভরলি নদী, তেমনই ওরাং-এর একটা নদীর নাম ধানসিঁড়ি। সন্তু, এই নদীটার নাম কেন বিখ্যাত বলতে পারিস?

জোজো বলল, আমি পারি। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? রবীন্দ্রনাথের সে লাইনটা কী শুনি?

জোজো সঙ্গে-সঙ্গে বলল :

সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে
ধানসিঁড়ি নদীতীরে
পাখিগুলি ডানা ঝাপটায়!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ বাঃ! তোমার তো বেশ মুখস্থ থাকে। তবে রবীন্দ্রনাথ যদি এরকম লাইন লিখে থাকেন, সেটা গবেষকদের কাছে একটা নতুন খবর হবে!

সন্তু বলল, কাকাবাবু, জোজো ওটা এইমাত্র বানাল, তুমি বুঝতে পারলে?

কাকাবাবু বললেন, তা হলেও তো বেশ ভালই বানিয়েছে! তুই এ রকম পারিস?

সন্তু বলল, আমি কবিতা বানাতে পারি না। কিন্তু আমি জানি, এই নদীর নাম আছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। কিন্তু চন্দ্রবিন্দু নেই, ধানসিড়ি।

আবার আসিব ফিরে
ধানসিড়িটির তীরে
এই বাংলায়।

কাকাবাবু বললেন, জোজোর কল্পনাশক্তি আছে বল? কল্পনাশক্তি না থাকলে কবি হওয়া যায় না!

সন্তু বলল, ওর সবটাই কল্পনাশক্তি।

তপন বলল, আমাদের পেছন পেছন কেউ ঘোড়ায় চেপে আসছে।

সবাই মুখ ফেরাল। আকাশে সামান্য জ্যোৎস্না, সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল খুব জোরে কেউ একজন ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে, কপাকপ শব্দ হচ্ছে।

একটু পরেই সেই ঘোড়সওয়ার এসে গেল গাড়ির পাশাপাশি। কালো রঙের ঘোড়া, কালো রঙের পোশাক-পরা সওয়ার, মুখ না দেখতে পেলেও বোঝা যায় যে, সে টিকেন্দ্রজিৎ!

যদি সে হঠাৎ গুলি চালায়, সেইজন্য কাকাবাবু সবাইকে বললেন, মাথা নিচু করো, শুয়ে পড়ো!

টিকেন্দ্রজিৎ কিন্তু গুলিটুলি চালাল না, গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দেওয়াই যেন তার উদ্দেশ্য। গাড়ির পাশে-পাশে সমান গতিতে ছুটতে লাগল সে।

তপন বলল, ঘোড়া ছুটিয়ে গাড়ির সঙ্গে পারবে? দেখাচ্ছি মজা।

তপন আরও গতি বাড়াবার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু বললেন, থামো, থামো, ওকে দাঁড় করাও। আমি টিকেন্দ্রজিতের সঙ্গে আলাপ করতে চাই। ও কী চায়, তা জানা দরকার।

তিনি জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, থামুন, থামুন, আমরাও থামছি!

তপন গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। টিকেন্দ্রজিৎ কাকাবাবুর কথা গ্রাহ্যই করল। একবার মাত্র মুখ ফিরিয়ে, সমান বেগে ছুটে গেল ধুলো উড়িয়ে। একটু পরে আর তাকে দেখা গেল না!

কাকাবাবু বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার তো! লোকটা আমাদের আশেপাশে ঘুরছে। অথচ কথা বলতে চায় না!

জোজো বলল, রহস্যময় কালো অশ্বারোহী!

সন্তু বলল, তুই এই নামে একটা গল্প লিখে ফেল জোজো।

বাংলোয় ফিরতে ফিরতে রাত নটা বেজে গেল।

বারান্দায় বসে আছেন দেবেন্দ্র বড়ঠাকুর আর রাজ সিং। দুজনেই উঠে দাঁড়ালেন ওদের দেখে।

কাকাবাবু বললেন, কী ব্যাপার, মিস্টার বড়ঠাকুর? আপনি গুয়াহাটিতে ফিরে যাননি?

বড়ঠাকুর বললেন, কাল চলে গিয়েছিলাম। আজই ফিরতে হল একটা জরুরি খবর পেয়ে। মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি আমাকে আসল কথাটাই বলেননি?

কাকাবাবু দেখলেন, বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে আছে এই বাংলোর কেয়ারটেকার মন্টা সিং, পেছনের খাবারের ঘরে বসে একজন একটা বেতের চেয়ার সারাচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, এখানে নয়। আমার ঘরে চলুন, কথা হবে।