০৪. মিসেস জোন্সকে দেখে

মিসেস জোনসকে দেখে পরিচারিকা বলে ভাবা কঠিন। কথায় বার্তায় হাবেভাবে তিনিই যেন এ বাড়ির গৃহিণী। স্বভাবটিও ভারী মিষ্টি। নরম গলায় বকাঝকা করে গোটা প্লেটটাই শেষ করতে বাধ্য করলেন টুপুরকে। বাক্যালাপ করছেন ইংরজিতে, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গিটি এমন, যেন মিতিন টুপুর তাঁর কতকালের চেনা।

চা শেষ করে মিতিন বলল, চলুন, তা হলে এবার ফার্নিচারের ঘরটা একবার দেখে আসি।

জোনাথন বললেন, কী দেখবে ও ঘরে? দেখে তো কিছুই বোঝা যাবে না। তিনি আসেন রাত্রে, রোজ মালুমও দেন না। যেদিন মেজাজ বিগড়ে যায় সেদিনই হয়তো একটু আধটু বিরক্তি প্রকাশ করেন।

উৎপল বলল, দেখছেন তো ম্যাডাম? ড্যাডি ভূত থিয়োরির বাইরে কিছুতেই বেরোবেন না।

ভূত বোলো না। ভূত নয়। মিসেস জোনস ঘোরতর আপত্তি জানালেন। চোখ বন্ধ করে দ্রুত ক্রস আঁকলেন বুকে, যিনি আসেন, তিনি হোলি স্পিরিট। কারণ এখনও পর্যন্ত তিনি কারুর ক্ষতি করেননি।

মিতিন জিজ্ঞেস করল, আপনি তাঁকে দেখেছেন?

তাঁকে কি দেখা যায়। তবে তিনি যে আছেন সে আমি বহুকাল আগেই টের পেয়েছি। সেই ন্যান্সির অসুখের সময়ে যখন রাত জাগতাম, তখন। শেষদিকে ন্যান্সি যখন ক্যান্সারের যন্ত্রণায় ছটফট করত, উনি নিঃশব্দে ন্যান্সির মাথার পাশে এসে দাঁড়াতেন। স্বর্গীয় এক সৌরভে ভরে যেত গোটা ঘর। তিনি হাত বোলাতেন ন্যান্সির মাথায়। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ত ন্যান্সি।

এখন কি গন্ধটা পাওয়া যায়?

সেটা মিস্টার মাইকেল বলতে পারবেন।

জোনাথন বললেন, তাঁর মুড ভাল না থাকলে গন্ধ বোধহয় পাওয়া যায় না। ও ঘর কতকাল ধরে পরিত্যক্ত, উনি ওখানে এক ধরনের ফার্নিচারে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন, সে জায়গায় এককাঁড়ি উটকো জিনিস ঢোকালে উনি সহ্য করবেন কেন?

উৎপল বলল, আর কোন ঘরে চেয়ার টেবিলগুলো ঢাকাতাম ড্যাডি? ইউজ হয় না বলেই তো ওই রুমে…

ভাল করোনি।

উৎপল কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেল। বসার ঘর থেকে অন্দরে যাওয়ার দুটো দরজা। বাঁ দরজায় পরদা ঝুলছে, সম্ভবত ওটা জোনাথনের বেডরুম। অন্য যে দরজা দিয়ে উৎপলরা খাবার নিয়ে ঢুকেছিল, সেই পথেই ভেতরে ঢুকল সকলে।

প্রথমেই একটা চওড়া প্যাসেজ। প্রায় ঘরের মতো জিনিসপত্র খুব বেশি নেই সেখানে, একটাই শুধু অতিকায় গোল শ্বেতপাথরের টেবিল মাঝখানটায় পাতা। টেবিলে ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজের স্তূপ। একধারে টানা জুতো রাখার র‍্যাক, অন্যধারে সাহেবি আমলের টুপি-ছাতা রাখার স্ট্যান্ড।

প্যাসেজের একদিকের দরজা দিয়ে বাইরের বারান্দায় পড়া যায়। অন্য দরজা দিয়ে বেরোলে প্রকাণ্ড হলের মতো ঢাকা বারান্দা। তার ওপারে বাঁধানো উঠোন। রোদ বৃষ্টি আটকানোর জন্য বারান্দার মাথায় ঝুলন্ত কাঠের শেড। সবুজ। ঢেউখেলানো। বারান্দার মাঝখানে খাবার টেবিল, দেওয়াল ঘেঁষে টানা কাচের আলমারিতে প্লেট গ্লাস কাঁটা চামচ ছুরি টিসেট কফিসেট। আলমারির মাথায় টোস্টার মিক্সি মাইক্রোওভেন। সাবেকি মডেলের ঢাউস রেফ্রিজারেটারও রয়েছে এক জায়গায়। দেওয়ালে রয়েছে। খানআষ্টেক ছোট ছোট বাঁধানো ছবি।

বারান্দার দুপাশে পর পর ঘর বাথরুম কিচেন। ডানপাশের শেষ ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে থামলেন জোনাথন। চাবির গোছা বার করে দরজা খুললেন।

মিতিন ঘুরে ঘুরে চারদিকটা দেখছিল। বলল, আপনার বাড়িখানা এত বড় বাইরে থেকে বোঝাই যায় না। কত জায়গা ভেতরটায়?

এ তো হালফ্যাশনের খুপরি খুপরি ফ্ল্যাট নয়। রবার্ট ম্যাকগ্রেগর ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট দিয়ে ডিজাইন করিয়েছিলেন। নিজে থাকতেন একেবারে শেষ প্রান্তে। এই ঘরটায়। বলতে বলতে ভারী দরজা ঠেললেন জোনাথন, এসো, দেখবে এসো।

ভেতরে পা রাখতেই ঝাং করে একটা ভাপসা গন্ধ ঝাপটা মারল টুপুরের নাকে। বোঝাই যাচ্ছে এ-ঘর রোজ খোলা হয় না। তবে ঘরে আলোর তেমন ঘাটতি নেই। বন্ধ জানলার মাথার রঙিন কাচ বেশির ভাগই ভাঙা, শেষ বিকেলের সূর্য ওই সব ফোকর দিয়ে দিব্যি উঁকি দিচ্ছে। সিলিং-এ বোধহয় টানাপাখা ছিল এককালে, তার দড়ি যাওয়ার রাস্তা দিয়েও আলো আসছে ঘরে।

ড্রয়িংরুমের চেয়েও এ-ঘর আরও বড়। গোটা ঘরখানাই পুরু কার্পেটে মোড়া। প্রচুর অ্যান্টিক ফার্নিচার ছড়িয়ে আছে চারদিকে। খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল, বিশাল একখানা দোল আয়না, পিয়ানো, কারুকাজ করা আলনা, কী আছে আর কী নেই। সদ্য ঢোকানো চেয়ার টেবিল ডাঁই হয়ে আছে মাঝখানে। আছে একখানা দেওয়াল জোড়া অয়েল পেন্টিং, দেওয়ালে গাঁথা কাঠের চ্যানেলের ওপর বসানো। ছবিটা একটা যুদ্ধজাহাজের। আরও কয়েকটা ছোটখাটো পেন্টিং ঝুলছে এপাশে ওপাশে, ফুলদানিতে একগোছা ফুল, নীলচোখ কিশোরীর নিস্পাপ মুখ, শীতের দেশের নিসর্গ দৃশ্য।

 টুপুর মন দিয়ে ছোট ছবিগুলো দেখছিল। ধুলো পড়ে বেশ মলিন দশা। প্রাচীন প্রাচীন ভাব এসে গেছে, তবু দেখতে বেশ লাগে।

মিতিন নিরীক্ষণ করছে যুদ্ধজাহাজ। ঝুঁকে ছবির কোণটা দেখতে দেখতে বিস্ময়ের সুরে বলল, এ যে দেখি রবীন্দ্রনাথের জন্মের বছরে আঁকা। আঠেরোশো একষট্টি!

জোনাথন বললেন, হ্যাঁ। বাড়িটাও ওই বছরই তৈরি হয়েছিল। দ্যাখো, আর্টিস্টের নামও লেখা আছে। পিটার ড়ুভাল। ব্রিটিশ পেন্টার।

ছবিটার তলায় বসানো কাঠের চ্যানেলে আলগা হাত বোলল মিতিন। ঘুরে ফিরে অন্য আসবাবগুলোও দেখল ভাল করে। একটা চেয়ারে আঙুল ছুঁইয়ে নাক কুঁচকে বলল, এহ্, খুব ধুলো জমেছে তো!

উৎপল বলল, মিসেস জোনস এখন এ ঘরে ঢুকতেই চাইছেন না।

মিসেস জোনস বুকে ক্রস আঁকলেন, এক্সট্রা চেয়ার টেবিলগুলো বার করে দাও, আবার সব ঝকঝকে করে রাখব। ওগুলো থাকলে আমি এ ঘর ছোঁবই না।

মিতিন উৎপলকে বলল, সত্যি তো, চেয়ার টেবিল এখানে ঢোকালেনই বা কেন?

উঠোনে পড়ে থেকে থেকে সব নষ্ট হচ্ছিল ম্যাডাম। দামি কাঠ রোদে পুড়ছে, জলে ভিজছে, কারুর কোনও গা নেই…

তো বেচে দিতে পারতেন।

ড্যাডি এ বাড়ির একটা কুটোও বেচতে দেবেন না।

টুপুর অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল। দুম করে জিজ্ঞেস করল, এ ঘরের কোন কোন জিনিসগুলো নড়ে? চেয়ার টেবিল ছাড়া?

উৎপল বলল, মাই ডিয়ার ইয়াং লেডি, বাইরে থেকে বুঝব কী করে কী কী নড়ানো হচ্ছে? তবে মাঝে মাঝে শব্দটা বেশ জোরেই হয়। ঢকঢক ঢকাঢক।

মিতিন বলল, আপনি বলছেন ব্যাপারটা বাইরের কারুর কারসাজি। কেন এরকম ভাবছেন?

ওই যে দেখুন না, জানলার মাথায় অর্ধেক কাচ নেই। তা ছাড়া পাঙ্খাপুলারের দড়ি যাওয়ার গ্যাপটাও…

ওইসব ফাঁক দিয়ে কোনও মানুষ গলতে পারে? জোনাথনের গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ল, কী যে পাগলের মতো বারবার একই কথা বলো উৎপল!

কাচ বসানোর ফ্রেম খুলে নিলেই ফাঁক বড় হয়ে যায় ড্যাডি। আমি দেখেছি অন্তত খান দুতিন ফ্ৰেম একেবারেই আলগা।

তাও অসম্ভব।

 ড্যাডি, আমি জিমনাস্টিক্সের লোক। জানি শরীরকে কতটা নমনীয় করা যায়। কতটুকু জায়গা দিয়ে একটা বাচ্চা তার শরীর গলিয়ে দিতে পারে। যদি কেউ ভয় দেখানোর ছক সাজায়, সে কোনও বাচ্চাকে কাজে লাগাতেই পারে।

ভুলে যেয়ো না উৎপল, শব্দ পাওয়ার পর পরই কিন্তু দরজা খোলা হয়েছে। মাঝে কত টাইম গেছে? বড়জোর পাঁচ মিনিট। ওইটুকু সময়ের মধ্যে মানুষই হোক, কি বাচ্চাই হোক, তার পক্ষে কি আবার ওই ফাঁক দিয়ে গলে পালানো সম্ভব?

ওইটাই তো আমায় ভাবাচ্ছে ড্যাডি। তাই তো ম্যাডামকে ডেকে আনা। উনি দেখেশুনে বলুন, রহস্য উদ্ধার হয়ে গেলে আমরাও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হই।

মিতিন স্থির চোখে শ্বশুর-জামাইয়ের চাপান উতোর শুনছিল। বলল, এ ঘর দেখা শেষ। চলুন, এবার অন্য রুমগুলো দেখে নিই।

জোনাথন যেন একটু অবাক হয়েছেন। বললেন, অন্য ঘরে কী দেখবে?

কিছু না। এমনি। এত সব অ্যান্টিক ফার্নিচার দিয়ে সাজানো ঘর, দেখলেও তো চোখ জুড়োয়।

ভূতুড়ে ঘর তালাবন্ধ করে সদলবলে বেরিয়ে এলেন জোনাথন। পাশের ঘরে ঢুকতে যাবে, হাঁপাতে হাঁপাতে মির্নার আবির্ভাব। উত্তেজিত মুখে বলল, কী আশ্চর্য, তোমরা বাইরের দরজা খুলে রেখে এসেছ?

জোনাথন কাঁধ ঝাঁকালেন, তাতে হয়েছেটা কী? বিকেলবেলা.. বাড়িতে এত লোক রয়েছে. এখন কে ঢুকবে?

এই তো একটা বাচ্চা ছেলে কম্পাউন্ডে ঘুরঘুর করছিল। আমাকে দেখেই পাঁচিল গলে ভোঁ দৌড়।

জোনাথন আমল দিলেন না, ও তো প্রায়ই আসে। পেছনের পেয়ারা গাছটাই ওদের টার্গেট।

ওফ ড্যাডি, তুমি দেখছি বড়সড় একটা বিপদ না বাধিয়ে ছাড়বে না। কতদিন ধরে বলছি, সাবধানে থাকো, সাবধানে থাকো….

থাম তো। তোরা আবার বেশি বেশি ভাবিস।

দেখলেন তো ড্যাডির অ্যাটিচিউড? মির্না মিতিনের দিকে তাকাল।

মিতিন বলল, হুম।

 ফার্নিচার রুম দেখা হল? কী বুঝলেন?

 ভাবছি। …আপনি চলে এলেন যে? ক্লাস শেষ?

 না। চলছে। আমার খুব টেনশান হচ্ছিল, তাই..

মিতিন আর কিছু বলল না। ঘুরে ঘুরে দেখল ঘরগুলো। মির্না উৎপল যে ঘরে এসে থাকে সেই ঘরটা, ডিকের ঘর, জোনাথনের বেডরুম, রান্নাঘর, বাথরুম, স্টোররুম…। উঠোনের বন্ধু সারভেন্টস কোয়ার্টারটাও খুলিয়ে দেখে নিল। বাড়ির পিছনটাও। জায়গাটায় আগাছার জঙ্গল। মাটিও উঁচু নিচু বেশ। ঘাসে ঢাকা এক লোহার আংটায় হোঁচট খেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল টুপুর, মিতিন ছুটে এসে ধরল তাকে। নিচু হয়ে একবার দেখে নিল আংটাটা। পিছনের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে পর্যবেক্ষণ করে এল স্যান্ডকাস্টিং-এর রেলিং-এ ঘেরা ছাদখানাও।

পরিক্রমা শেষ করে সকলে মিলে ফিরেছে ড্ৰয়িংরুমে। মিসেস জোনসকে ফের এক রাউন্ড কফির অর্ডার দিলেন জোনাথন। মৃদু কৌতুকের ভাব ফুটিয়ে মিতিনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হে। ডিটেকটিভ, রসহ্য ভেদ হল?

উহুঁ। এখনও তিমিরে।

তিমিরেই থাকবে। ম্যাকগ্রেগরের আত্মা তিমিরেই আসেন।

হুম…আচ্ছা মিস্টার মাইকেল, একটা কথা বলতে পারেন? ম্যাকগ্রেগর সাহেবের অমন একটা যুদ্ধজাহাজ আঁকানোর শখ হয়েছিল কেন?

কারণ তিনি নিজে একসময়ে যুদ্ধজাহাজে ছিলেন। মার মুখে শুনেছি তিনি ছিলেন রয়্যাল আর্টিলারিতে। সিপাই বিদ্রোহের সময়ে তিনি একটি গানবোট থেকে যুদ্ধ করেছিলেন। সেই গানবোটটার নামেই বাড়ির নামও মেগনা।

ও। ওটা মেগনার ছবি? তার মানে মেগনা ম্যাকগ্রেগর সাহেবের জীবনের একটা ইম্পর্ট্যান্ট ফ্যাক্টর ছিল?

শুধু ইম্পর্ট্যান্ট নয়। মা বলতেন ওই মেগনাই নাকি তাঁর। জীবন-মৃত্যুর নিয়ামক। তোমায় বললাম না, সিপাই বিদ্রোহের এক নেতাকে তিনি মেরেছিলেন? সে ওই মেগনা থেকেই। কিন্তু তার পরিণাম ভাল হয়নি। বিদ্রোহ শেষ হওয়ার পরই মিলিটারির চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ঘোড়ার গাড়ি তৈরির। সেই সময়ে পর পর বেশ কয়েকটা অঘটন ঘটে যায় তাঁর জীবনে। দুই ছেলে মাত্র দুদিনের তফাতে কলেরায় মারা যায়। একমাত্র ভাই ড়ুয়েল লড়তে গিয়ে নিহত হন। এবং তার পরেই তাঁর মনে ধারণা। হতে শুরু করে, যাকে তিনি সিপাই বিদ্রোহের সময়ে মেরেছেন, তাঁর অভিশাপেই এই সর্বনাশগুলো ঘটছে। তীব্র মানসিক অবসাদ থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি…। তাঁর স্ত্রী আর মেয়ে, মানে আমার মার দিদিমা আর তাঁর মা অবশ্য থাকতেন এবাড়িতে। তবে তাঁরা ওই ঘরটি আর কেউ ব্যবহার করতেন না।

মির্না হতবাক মুখে বলল, আমাদের তো এত গল্প কখনও বলোনি ড্যাডি?

তোমরা জানতে চেয়েছ কোনওদিন? জানার উৎসাহ দেখিয়েছ?

মিতিন মুচকি হেসে বলল, একটা খবর কিন্তু মির্না জানেন।

কী খবর?

 ম্যাকগ্রেগর সাহেবের এক মহামূল্যবান সম্পদ নাকি এবাড়িতে লুকোনো আছে।

হ্যাঁ, ওই খবরটুকুই শুধু জানে। তবে ও জিনিস খোঁজার চেষ্টা করে লাভ নেই। পেতে গেলে মরতে হবে।

মিতিন বলল, মির্না-উৎপলবাবুর মুখে সেরকমই একটা কথা শুনছিলাম বটে। ব্যাপারখানা কী বলুন তো?

মৃত্যুর আগে ম্যাকগ্রেগর বাড়িটা স্ত্রী আর মেয়ের নামে উইল করে গেছিলেন। উইলের শেষে অদ্ভুত একটা কথা লেখা ছিল।

কীরকম?

চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন জোনাথন। তারপর বললেন, এক সেকেন্ড।

বলেই মিতিনদের চমকে দিয়ে উঠে গেছেন নিজের ঘরে। ফিরে এলেন মিনিট পাঁচেক পর, হাতে একখানা মলিন কাগজ। মিতিনকে কাগজখানা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার মা অরিজিনাল উইলটা দেখেছিলেন। ছোটবেলায়। এই দিদিমার বাড়িতেই। উইলের পিকিউলিয়ার লাইনদুটো মা লিখে রেখেছিলেন আলাদা করে। কাগজে। পড়ো, পড়ে দ্যাখো।

মিতিন জোরে জোরে পড়ল, লিভিং বিহাইন্ড দা মোস্ট প্রেশাস পজেশান অফ মাই লাইফ। হুভার লস ফর ইট শ্যাল গো টু গ্রেভ। আমেন।

টুপুর বলল, সত্যিই কী স্ট্রেঞ্জ! বলে যাচ্ছেন জিনিসটা রইল, অথচ যে চাইবে তাকেই…

জোনাথন বললেন, উনি নিশ্চয়ই চাননি কেউ জিনিসটা পাক।

তাই হবে।

কফি খেয়ে উঠে পড়ল টুপুররা। সার্কুলার রোডের মোড় পর্যন্ত সঙ্গে এল উৎপল, ট্যাক্সিও ধরে দিল। ট্যাক্সি স্টার্ট দেওয়ার আগে সুরজমলের ঠিকানাটা দিতেও ভুলল না।

চোরা কৌতূহলে ফুটছিল টুপুর। আড়ে আড়ে দেখছিল মিতিনমাসিকে। পার্ক স্ট্রিট ক্রসিং-এ জ্যামে আটকে আছে ট্যাক্সি। সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে মিতিনমাসি, দৃষ্টি জানলার বাইরে। বাঁদিকের বড় কবরখানায়। চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে মিতিনমাসিকে।

উসখুস করতে করতে টুপুর জিজ্ঞেসই করে ফেলল, কী এত ভাবছ গো?

মনে মনে অঙ্ক কষছি। মিতিন ঘুরে বসেছে, তা ঐন্দ্ৰিলা, কেমন লাগল আজকের অভিযান?

ঠিকই আছে। একটা অন্য রকম বাড়ি দেখা হল। একজন ফার্স্ট জেনারেশান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানকেও মিট করলাম।

বাড়িটা কেমন লাগল?

দারুণ। সর্বাঙ্গে ইতিহাসের গন্ধ।

আর জোনাথন মাইকেল…?

মনে হল বেশ ভালমানুষ টাইপ। ভূতের ব্যাপারটা জেনুইনলি বিশ্বাস করেন। মিসেস জোনসও। যেভাবে বার বার বুকে ক্রস আঁকছিলেন।

জোনাথন মাইকেলের আর কী অবজার্ভ করলি?

ভূতের ভয়ে ভেঙে পড়েছেন বলে তো মনে হল না। দিব্যি হাসিখুশি মেজাজেই তো গল্প করছিলেন।

আর?

মেয়ে জামাইয়ের ওপর দুর্বলতা বেশি। বাড়ি বিক্রি করার সময়ে মেয়ে জামাইকে নিয়ে গেছিলেন, ছেলেকে নয়।

হয়তো ছেলে যেতে চায়নি।

হতে পারে।

ডিককে কেমন দেখলি?

দেখলাম কোথায়, সে তো উড়ে গেল। তবে ডিক বেশ টিপটপ। ঘরটাও বেশ সাজানোগোছানো। টেপরেকর্ডারের ক্যাসেটগুলো পর্যন্ত কী সুন্দর করে রাখা।

উৎপল মির্নার জিমনাসিয়ামটা কেমন?

খুব ছোট নয়।

হুম। বরং একটু বেশিই বড়। অনেক টাকা ঢালতে হয়েছে।

সে তো বটেই।…আচ্ছা মিতিনমাসি, একটা খটকা কিন্তু আমার যাচ্ছে না।

কী?

উইলে লেখা আছে, যে খুঁজবে সেই মরবে! অথচ উৎপলবাবু সেদিন বলছিলেন অনেকেই নাকি খুঁজেছে!।

ওরে বোকা, মৃত্যুভয়ে কি আর গুপ্তধন খোঁজা বন্ধ থাকে? জোনাথন মুখে যাই বলুন, উনিও অবশ্যই বিস্তর সন্ধান চালিয়েছেন।

আবার মিতিনের ব্যাগে বাজনা শুরু! কথা থামিয়ে তড়িঘড়ি মোবাইল বার করল মিতিন চোখ কুঁচকে নম্বর পড়ে ক্ষুদে যন্ত্রটা বাড়িয়ে দিল টুপুরকে, নে, আবার তোর মেসো।

তুমিই কথা বলো না।

জানতে তো চাইবে আমরা কী কী খেলাম। তুইই বলে দে।

মিতিনমাসির কথা একদম ঠিক। টুপুরের সাড়া পেয়েই পার্থমেসোর প্রথম প্রশ্ন, কী রে, খুব সাঁটাচ্ছিস বুঝি বসে বসে?

আমরা ফিরছি। ট্যাক্সিতে আছি।

কী খাওয়াল?

অনেক কিছু। পিৎজা পেস্ট্রি কাজুবাদাম কোল্ড ড্রিংকস…

থাম থাম। আর বেদনা জাগাস না। আমি এখন মুড়ি চিবোচ্ছি। উইথ মিয়োনো চিনেবাদাম।… তোদের কাজ কিছু হল?

ভূতুড়ে ঘরটা দেখলাম।

 মাসি ধরতে পারল কেসটা কী?

এক দিনেই কি বোঝা যায়? আবার হয়তো যেতে হবে।

মিতিন পাশ থেকে বলে উঠল, না-ও যেতে হতে পারে, টুপুর। হয়তো বেড়ালটেড়াল গোছের কিছু ফাঁক দিয়ে ঢুকে উৎপাত চালাচ্ছে।

পার্থ শুনতে পেয়ে গেছে। চেঁচিয়ে বলল, বলে কী তোর মাসি? ভূত নয়, মানুষ নয়, বেড়াল? তা উৎপলের কাছ থেকে ফিজটা নিয়ে নিয়েছে তো?

টুপুর ফিসফিস করে বলল, মেসো টাকার কথা জিজ্ঞেস করছে।

মিতিন ভারিক্কি গলায় বলল, তোর মেসোকে বলে দে, বেড়াল লাফানোর মতো পেটিকেসে পয়সা নিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি হাতে গন্ধ করে না।

পার্থ বিরস গলায় বলল, বুঝলাম। উৎপলটা ফালতু ফালতু এসে জ্বালিয়ে গেল।

হুঁ।

 ফিরে কথা হবে। ছাড়ছি।

ফোন অফ করে টুপুর প্রবল বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠল, তুমি শিওর, বেড়ালই আওয়াজ করছে?

আর কী হতে পারে বল? ভূত বলে কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, উৎপল যতই বোঝাক, ওইটুকু ফাঁক দিয়ে একটা বাচ্চাছেলের পক্ষেও কি আসা-যাওয়া করা সম্ভব? তা হলে থার্ড অলটারনেটিভ একটাই পড়ে থাকে। বেড়ালই চেয়ার-টেবিলের ওপর নৃত্য করে, পায়ের চাপে পিয়ানো বাজায়, আর মানুষের সাড়া পেলে টুক করে পালায়।

এ ছাড়া কিছুই হতে পারে না?

চান্স কম। তবে…

তবে কী?

একটা ধন্দ আছে। বেড়ালই যদি হবে তা হলে কার্পেটে নয় নাই পড়ল, চেয়ার টেবিলের ধুলোয় তার পায়ের ছাপ থাকত। দাগ আছে কিছু, কিন্তু ছাপ নেই। তা ছাড়া ছবি বসানোর কাঠের চ্যানেলটায় ধুলোই নেই তেমন…

টুপুর নড়ে বসল, তার মানে মিষ্ট্রি একটা আছে?

ধীরে বৎস, ধীরে। মিতিন ফিক করে হাসল, রহু ধৈর্যং, বহু ধৈর্যং।