০৪. মানুষ ও অমানুষ

মানুষ ও অমানুষ

লাইনা সুহানকে কোয়ারেন্টাইন ঘরে রেখে কিরির কাছে এসেছে। কিরি তার সামনের স্ক্রিনটি সুইচ টিপে বন্ধ করে শান্ত গলায় বলল, ছেলেটি এখন কী করছে লাইনা?

কিছু করছে না। মিডি রবোট তাকে পরীক্ষা করে দেখছে। একটু রক্ত নেবে, টিস্য নেবে, পরীক্ষা করে দেখবে।

ও।

কী আশ্চর্য একটা ব্যাপার কিরি! তুমি চিন্তা করতে পার একজন সত্যিকার মানুষ থাকে এই গ্রহে!

হ্যাঁ।

তার মহাকাশযান যখন বিধ্বস্ত হয়েছিল তখন তাকে মায়ের গর্ভ থেকে ট্রিনি—

জানি।

লাইনা একটু অবাক হয়ে বলল, কেমন করে জান?

আমি এখানে বসে তোমাদের দেখছিলাম।

লাইনা চমকে কিরির দিকে তাকাল। হঠাৎ অনুভব করে তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। কোনোরকমে নিজেকে সংযত করে বলল, এই ছেলেটি একা একা ষোলো বছর এই গ্রহে কাটিয়েছে। তুমি চিন্তা করতে পার?

কিরি কেমন জানি রুক্ষ গলায় বলল, পারি। তোমরা যখন শীতলঘরে ঘুমিয়েছিলে তখন পঞ্চাশ বছর আমি একা একা ছিলাম।

কিন্তু—

কিন্তু কী?

প্রথমত, তুমি সত্যিকার অর্থে একা ছিলে না। তুমি জানতে এই মহাকাশযানে আরো অনেক মানুষ আছে। দ্বিতীয়ত–

দ্বিতীয়ত?

দ্বিতীয়ত, তুমি মানুষের মতো কিন্তু নও। তোমাকে এ ধরনের পরিস্থিতির জন্যে তৈরি করা হয়েছে।

কিরি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছেলেটা যে এখানে আছে সেটা কতজন জানে?

আমি আর তুমি।

চমৎকার। আমি চাই সেটা যেন আর কেউ না জানে।

লাইনা জিজ্ঞাসু চোখে বলল, কেন?

ছেলেটা আমাদের জন্যে অনেক বড় সৌভাগ্য বয়ে এনেছে লাইনা। তাকে আমাদের দরকার।

কিরি ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে পারল না। লাইনা অনিশ্চিতের মতো বলল, হ্যাঁ। সুহানেরও আমাদের দরকার। মানুষের সঙ্গ পাবার জন্যে সে একেবারে খ্যাপার মতো হয়ে আছে।

কিরি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক কী বলছি তুমি বুঝতে পার নি লাইনা।

হঠাৎ করে লাইনার বুক কেঁপে ওঠে। কিরির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ কিরি?

আমি বলতে চাইছি ছেলেটাকে আমাদের দরকার। তার শরীরটাকে।

মানে?

আমরা এই গ্রহে বসতি স্থাপন করতে এসেছি। আমাদের কাছে রয়েছে প্রায় তিন হাজার মানুষের জ্বণ। তারা এই গ্রহে বাঁচতে পারবে কিনা সেটা নির্ভর করবে কিছু তথ্যের ওপর। এই ছেলেটা না হলে সেই তথ্য বের করতে আমাদের এক যুগ লেগে যেত। এখানে আর আমাদের এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে না। ছেলেটার দেহ ব্যবচ্ছেদ করে কয়েক ঘণ্টার মাঝে সব তথ্য পেয়ে যাব।

তুমি—তুমি বলছ দেহ ব্যবচ্ছেদ করে?

হ্যাঁ। তার শরীরের প্রত্যেকটা কোষ মূল্যবান লাইনা। তার প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মূল্যবান।

লাইনার হঠাৎ কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে। পিছনে সরে এসে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি সুহানকে মেরে ফেলার কথা বলছ?

হ্যাঁ, লাইনা।

লাইনা বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরির ভাবলেশহীন মুখ, স্থির চোখ দেখে হঠাৎ তার মনে হতে থাকে সে বুঝি একটি দানবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটি অমানুষ পিশাচের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই সত্যি সত্যি তাকে মেরে ফেলার কথা বলছ না?

কিরি তার প্রত্যেকটা শব্দে জোর দিয়ে বলল, আমি তাকে সত্যি মেরে ফেলার কথা বলছি লাইনা।

কিন্তু সে একজন মানুষ।

কিরি একটু অবাক হয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, জৈবিক হিসেবে সে মানুষ হতে পারে কিন্তু সত্যিকার অর্থে সে তো মানুষ নয়। পৃথিবীর কোনো তথ্যকেন্দ্রে তার নাম নেই, এই গ্রহের একটি বন্যপ্রাণীর সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই।

লাইনা চিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি? কী বলছ?

এখন তুমি সম্ভবত বুঝতে পারছ, আমাকে একজন রবোটকে কেন মহাকাশযানের দলপতি করা হয়েছে।

না। লাইনা দাতে দাত ঘষে বলল, বুঝতে পারছি না।

তুমি বুঝতে পারছ কিন্তু স্বীকার করতে চাইছ না। সুহান ছেলেটির জন্যে তোমার মতো আমারও মমতা আছে লাইনা। কিন্তু আমি আমার মমতাকে পাশে সরিয়ে আমার দায়িত্বে ফিরে যেতে পারি। আমার দায়িত্ব মানুষের জন্যে একটা নতুন বসতি তৈরি করা। রবোটের জন্যে নয়—মানুষের জন্যে। এই গ্রহে সেটি সম্ভব কি না কেউ জানত না। কিন্তু এখন আমি জানি সেটা সম্ভব হবে। সুহানের শরীর থেকে আমরা অমূল্য সব তথ্য পাব। জণগুলো বিকাশের সময় আমরা সেই তথ্য ব্যবহার করব

লাইনা দুই হাতে তার কান চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, তুমি চুপ কর। আমি আর শুনতে চাই না।

কিরি থেমে গেল। তার মুখে হঠাৎ এক ধরনের বিষাদের ছায়া পড়ে। প্রায় শোনা যায়

এ রকম স্বরে বলল, রবোটকে আসলে রবোটের মতোই তৈরি করতে হয়। রবোর্টকে মানুষের মতো তৈরি করা খুব বড় ভুল। তাহলে রবোর্টকে মানুষের দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, কিন্তু মানুষ তবুও কখনো রবোটকে বুঝতে পারে না। কখনো না।

লাইনা হিংস্র গলায় বলল, দুঃখ-কষ্ট? যন্ত্রণা? কপোট্রনে ভোল্টেজের অসামঞ্জস্য আর দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা এক জিনিস নয়। তুমি মানুষের অনুভূতির কথা এনো না কিরি। মানুষের অনুভূতির কথা বলে তুমি মানুষকে অপমান কোরো না।

আমি দশম প্রজাতির বোট। আমি মানুষের এত কাছাকাছি যে–

মানুষের কাছাকাছি? লাইনার মুখ বিদ্রুপে বিকৃত হয়ে যায়, বাচ্চা একটা ছেলে তোমার মুখের প্রথম কথাটি শুনে বুঝে ফেলেছে তুমি রবোট, আর তুমি দাবি কর তুমি মানুষের কাছাকাছি? লজ্জা করে না কথাটি মুখে আনতে?

কিরির মুখ অপমানে লাল হয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি আমাকে ঘৃণা কর লাইনা?

না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি না। তুমি মানুষ হলে করতাম। কিন্তু একটা যন্ত্রকে ঘৃণা। করা যায় না।

তুমি—তুমি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ?

না–যন্ত্রকে অপমান করা যায় না।

কিরির চেহারা হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে শান্ত করে বলল, লাইনা, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। যাবার আগে শুধু একটি জিনিস শুনে যাও। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, আমি একটা যন্ত্র। পৃথিবীর মানুষের জন্যে এই বসতি তৈরি করায় আমার কোনো স্বার্থ নেই। আমাকে তুমি ঘৃণা করবে, আমি জানি শুধু তুমি নও, এই মহাকাশযানের প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে ঘৃণা করবে। কিন্তু এই গ্রহে মানুষের বসতি যদি গড়ে ওঠে সেটি সম্ভব হবে আমার জন্যে। কারণ আমি আবেগকে পাশে সরিয়ে একটি প্রাণীকে হত্যা করে তার কাছ থেকে অমূল্য তথ্য বের করব। সেই প্রাণীটি তোমাদের কাছে মানুষ মনে হলেও সে আসলে মানুষ নয়। মূল তথ্যকেন্দ্রে যার সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই সে পৃথিবীর মানুষ নয়, পৃথিবীর তার জন্যে কোনো দায়িত্ব নেই। এই সহজ এবং আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ঠুর একটি সত্যকে তোমরা গ্রহণ করতে পার না বলে তোমাদের এই মহাকাশযানের দলপতি করা হয় নি। এই মহাকাশযানের দলপতি করা হয়েছে আমাকে—

লাইনা বাধা দিয়ে শ্লেষের সাথে বলল, মহাকাশযানের দলপতি মহামান্য কিরি—

কিরি লাইনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। লাইনা চাপা স্বরে বলল, সম্মানিত দলপতি, আমি কি যেতে পারি?

কিরি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যেতে পার।

লাইনা ঝড়ের মতো ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

 

০২.

লাইনা মাথা নিচু করে মহাকাশযানের করিডোর ধরে হাঁটছে। দুই চোখ অশ্রুরুদ্ধ, ভয়ঙ্কর এক ধরনের আক্রোশে তার সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। করিডোরের শেষ মাথায় তার ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপের সাথে দেখা হল। লাইনাকে থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, লাইনা, তোমার কী হয়েছে?

কিছু হয় নি।

নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। বল আমাকে।

গ্রুসো। মহাকাশযানের দলপতির ক্ষমতা কতটুকু?

গ্রুসো অবাক হয়ে বলল, তুমি এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছ?

আমি জানতে চাই। কতটুকু?

অনেক।

সে কি মানুষ হত্যা করতে পারে?

গ্রুসসা চমকে উঠে লাইনার দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না। লাইনা আবার জিজ্ঞেস করল, পারে?

আমি যতদূর জানি, পারে। মহাকাশযানের দলপতির সেই ক্ষমতা আছে। তাকে পরে সে জন্যে জবাবদিহি করতে পারে কিন্তু প্রয়োজনে তার প্রাণদণ্ড দেয়ার অধিকার আছে। কিন্তু লাইনা, তুমি কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছ?

কারণ আছে গ্রুসো।

কী কারণ?

আমি তোমাকে বলতে পারব না গ্রুসো। তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তোমার ভালোর জন্যে বলছি।

লাইনা গ্রুসোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, সে তার হাত ধরে বলল, আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি, লাইনা?

লাইনা গ্রুসোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ম্লানমুখে বলল, না, সো। আমাকে এখন আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না।

লাইনা কোয়ারেন্টাইন ঘরটির সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়াল। একটু আগে সে যখন তাকে এই ঘরে রেখে গিয়েছিল তখন সে ভেবেছিল, সুহান তাদের অতিথি। এখন সে জানে সুহান অতিথি নয়, সুহান তাদের বন্দি।

লাইনা হাতলে হাত দিতেই ঘরের দরজাটি খুলে গেল। সে মহাকাশযানের দ্বিতীয় অধিপতি, তার যে কোনো ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি রয়েছে। লাইনা ভিতরে ঢুকে সুহানকে না দেখে চাপা গলায় ডাকল, সুহান—

বল।

তুমি কোথায়?

এই তো এখানে। সুহান একটা পর্যবেক্ষণ টেবিলের নিচে অসংখ্য যন্ত্রপাতির ভেতর থেকে বের হয়ে এল। তার হাতে চৌকোনো একটা বাক্স, সেখান থেকে নানা ধরনের তার এবং অপটিক্যাল ফাইবার ঝুলছে। লাইনা চিৎকার করে বলল, সাবধান! হাই ভোল্টেজ–

ভয় নেই। আমি অফ করে দিয়েছি।

অফ করে দিয়েছ? লাইনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সুহানের দিকে তাকাল, মনে হল সে ঠিক বুঝতে পারছে না সুহান কী বলছে। অবাক হয়ে বলল, কেমন করে করলে?

ভিতরে দুটি মাইক্রো সুইচ আছে। দেখেই বোঝা যায় হাই ভোল্টেজের জন্যে তৈরী, বিদ্যুৎ অপরিবাহী আস্তরণ খুব বড়। প্রথমটার তিন নম্বর পিন—

তুমি—তুমি কেমন করে জান?

দেখলেই তো বোঝা যায়। টেবিলটা উপরে উঠছিল না, নিশ্চয়ই স্টেপিং মোটরে গোলমাল। একা বসেছিলাম, তাই ভাবলাম ঠিক করে দিই।

ঠিক করে দিই? লাইনা তখনো বুঝতে পারছিল না, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তুমি পর্যবেক্ষণ টেবিলের কন্ট্রোল ঠিক করে দিয়েছ?

পুরোটা এখনো ঠিক হয় নি। একটা বিদ্যুৎ পরিবাহী তার হলে—

তুমি বলতে চাও, কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রের কোনো সাহায্য ছাড়া তুমি জিনিস ঠিক করতে পার?

সুহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি জানি সেভাবে ঠিক করার কথা নয়, অযথা সময় নষ্ট হয়। ট্ৰিনি আমাকে বলেছে। মানুষদের অন্যভাবে কাজ করার কথা। কিন্তু আমার এভাবে কাজ করতে ভালো লাগে। একটা কৌতূহল হয়—

লাইনা তখনো ব্যাপারটি ধরতে পারছিল না। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তুমি বলতে চাও কোন জিনিস কীয়ে কাজ করে তুমি জান?

মহাকাশযানের যেসব জিনিসপত্র আছে সেগুলো মোটামুটি জানি। আমার সময়ের অভাব ছিল না। তাই শিখেছি–

কিন্তু সেটা তো অবিশ্বাস্য! সেটা অসম্ভব।

আর আমাকে করতে হবে না। সুহান এক গাল হেসে বলল, এখন আমি মানুষের সাথে থাকব, মানুষের মতো ব্যবহার করব। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে, কিন্তু

লাইনার মুখ হঠাৎ রক্তহীন হয়ে যায়। কাতর গলায় বলল, সুহান–

কী? আমি তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি সুহান। কী কথা?

আমি কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। খুব জরুরি কথা। বেশি সময় নেই, খুব তাড়াতাড়ি বলতে হবে।

সুহান লাইনার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন একটি অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে থাকে।

তুমি জান, আমাদের দলপতি একটি রবোট?

জানি। দশম প্রজাতির রবোট। আমাদের ধারণা ছিল দশম প্রজাতির রবোট ঠিক মানুষের মতো। কিন্তু একটু আগে আমি আবিষ্কার করেছি দশম প্রজাতির রবোটে একটি খুব বড় ত্রুটি আছে।

কী ত্রুটি?

যে মানুষ সম্পর্কে তথ্য মূল তথ্যকেন্দ্রে নেই তাকে সে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না।

তার মানে আমি–

হ্যাঁ, তোমাকে সে মানুষ হিসেবে মেনে নেয় নি। সে এখন তোমাকে তোমাকে লাইনা মুখ ফুটে কথাটি উচ্চারণ করতে পারে না।

আমাকে কী?

তোমাকে মেরে ফেলতে চায়।

মেরে ফেলতে চায়? সুহান এমনভাবে লাইনার দিকে তাকাল যেন লাইনার কোনো কথা বুঝতে পারছে না। অনেকটা অন্যমনস্কর মতো বলল, আমাকে মেরে ফেলতে চায়? আমাকে?

হা। তোমার শরীরে নাকি অনেক মূল্যবান তথ্য আছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে এই গ্রহে মানুষের বসতি হবে।

সুহান আবার বিড়বিড় করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে?

হ্যাঁ, সুহান। তোমার খুব বড় বিপদ।

সুহানের মুখে খুব ধীরে ধীরে এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা এসে ভর করে। তার চোখ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে আসে। সে কেমন এক ধরনের অপ্রকৃতিস্থ দৃষ্টিতে লাইনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, তোমরা, মানুষেরা সেই রবোটের কথা মেনে নিয়েছ।

লাইনা সুহানের কাঁধে হাত রেখে বলল, না সুহান, আমরা মেনে নিই নি। আমি তাই তোমার কাছে এসেছি। তোমাকে এক্ষুনি পালিয়ে যেতে হবে।

পালিয়ে যেতে হবে?

হ্যাঁ, যেভাবে পার। যত দূরে পার। কিরি দশম প্রজাতির রবোট। তার ভয়ঙ্কর ক্ষমতা সুহান। আমরা এখন তার হাতের মুঠোয়। আমাদের একটু সময় দাও। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করে আমরা কিছু একটা ব্যবস্থা করব। যতদিন সেটা করতে না পারছি তুমি লুকিয়ে থাকবে। তুমি এখানে আসবে না–

আমি এখানে আসব না? আমি মানুষ কিন্তু আমি মানুষের কাছে আসতে পারব না?

আমি—আমি খুব দুঃখিত সুহান।

সুহান কেমন জানি হাহাকার করে বলল, আমি একজন মানুষ, তবু একটি রবোটের জন্যে আমি মানুষের কাছে আসতে পারব না?

আমি খুব দুঃখিত সুহান। খুব দুঃখিত। কিন্তু এখন আমাদের কিছু করার নেই। তোমাকে এক্ষুনি পালিয়ে যেতে হবে। এক্ষুনি। আমি তোমাকে এখন মহাকাশযানের দরজা খুলে বের হয়ে চলে যেতে দিতে পারব। কিন্তু পরে কী হবে আমি জানি না। তুমি এক্ষুনি আমার সাথে আস। এই মুহূর্তে–

সুহান লাইনার দিকে ঘুরে তাকাল। হঠাৎ তাকে আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, তুমি যাবে আমার সাথে?

আমি?

হ্যাঁ। তুমি। যাবে?

লাইনার মুখ গভীর বিষাদে ঢেকে যায়। সে এই অনিন্দ্যসুন্দর কিশোরটির মুখ নিজের কাছে টেনে এনে তার ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল, সুহান, বিশ্বাস কর, যদি সম্ভব হত আমি তোমার সাথে যেতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকে নিরাপদে এখান থেকে বের করে। দিতে পারব শুধু আমি। সেটা আমি শুধু করতে পারি ভিতরে থেকে–

তাহলে আমিও যাব না। রবোর্টটাকে আমি–

না সুহান, তুমি যাবে। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। যেভাবে হোক তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। একটা রবোটের হাতে আমি তোমাকে মরতে দেব না। কিছুতেই মরতে দেব না–

সুহান লাইনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে পানি টলটল করছে। সে আগে কখনো মানুষকে কাঁদতে দেখে নি কিন্তু দেখেই সে বুঝতে পারল।

মহাকাশযানের দরজায় লাইনা তার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করে দরজা খুলে দিল। মহাকাশযানের দ্বিতীয় অধিপতি হিসেবে তার দুবার এই সংখ্যা ব্যবহার করার অনুমতি আছে। বিথ কাউন্সিলে তাকে এর জন্যে জবাবদিহি করতে হবে। যদি জবাবদিহি তাদের মনঃপূত না হয়, তার সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে চিরদিনের জন্যে কোনো একটি ভূগর্ভস্থ শীতলঘরে সরিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই মুহুর্তে লাইনার সেসব কথা মনে পড়ল না। সে মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, প্রচও ঝড়ো বাতাসে সুহান হেঁটে যাচ্ছে। তার চুল উড়ছে, কাপড় উড়ছে বাতাসে। সুহান মুখ নিচু করে হাঁটছে। লাইনা দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু সে নিশ্চিতভাবে জানে সুহানের দুই চোখে পানি।

 

০৩.

নিজের ঘরে ফিরে এসে লাইনা আবিষ্কার করে সেখানে কিরি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। লাইনাকে দেখে সে ক্রুদ্ধ গলায় হিসহিস করে বলল, সুহান কোথায়?

নেই।

কোথায়?

আমি তাকে তার গ্রহে ফিরে যেতে দিয়েছি।

কেমন করে যেতে দিয়েছ?

আমি আমার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করেছি।

গোপন সংখ্যা ব্যবহার করেছ? কিরি মাথা নেড়ে বলল, তার ফল কী হতে পারে তুমি জান?

জানি।

আমি তোমাকে কী বলেছিলাম তোমার মনে আছে?

মনে আছে।

তুমি শুধু গোপন সংখ্যা ব্যবহার কর নি, সেটা ব্যবহার করেছ আমার আদেশ অমান্য করার জন্যে। তুমি জান আমার আদেশ অমান্য করা প্রথম মাত্রার অপরাধ?

সম্ভবত।

তুমি জান প্রথম মাত্রার অপরাধের শাস্তি কী?

লাইনা স্থির চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে শাস্তি দেবার ভয় দেখিয়ো না।

আমার কথার উত্তর দাও। তুমি জান?

জানি।

তুমি জান তোমাকে সেই শাস্তি দিতে আমার কপোট্রনের একটি ফ্রিকোয়েন্সিও এতটুকু নড়বে না? একটি সাইকেল বিচ্যুত হবে না?

আমি জানি কিরি।

কিরি এক পা এগিয়ে এসে লাইনার দিকে তাকায়। ঘরের আলো তির্যকভাবে তার মুখে পড়ছে। ভয়ঙ্কর ভাবলেশহীন একটা মুখ। হঠাৎ তার চোখ থেকে সবুজ এক ধরনের আলো বের হতে ব্রু করে। তাকে দেখাতে থাকে অশরীরী একটা প্রাণীর মতো। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ লাইনা এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করে।

কিরি লাইনার কাছে এসে এক হাতে লাইনার মাথার পিছনে ধরে এক ধরনের অপার্থিব শক্তি প্রয়োগ করে নিজের কাছে টেনে আনে। তার মুখের কাছে নিজের মুখ নামিয়ে এনে হিসহিস করে বলল, আমার শরীর ইস্পাত, ক্রোমিয়াম আর ঝিলনিয়ামের একটা সঙ্কর ধাতুর তৈরী। উপরে বায়োপলিমারের একটা পাতলা আবরণ আছে। আমি ইচ্ছে করলে এক হাতে একটা লোহার বিম ভেঙে দু টুকরা করে ফেলতে পারি। তোমার খুলি ইচ্ছে করলে আমি ডিমের খোসার মতো দাঁড়িয়ে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে আমার আঙুল থেকে কয়েক মিলিয়ন ভোল্ট বের করে তোমার এই সুন্দর শরীরকে দূষিত অঙ্গারে পাল্টে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে তোমার শরীর আমি ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে দিতে পারি। সে জন্যে আমাকে কারো কাছে জবাবদিহি পর্যন্ত করতে হবে না। সেটা করতে আমার কপোট্রনে একটি সাইকেলও বিচ্যুত হবে না।

লাইনা ভয়ার্ত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না।

কিন্তু আমি তোমাকে এই মুহূর্তে শেষ করব না। কেন জান?

লাইনা মাথা নাড়ল, সে জানে না।

আমি তোমার হৃদয়হরণকারী সুহানের শরীরে একটি পালসার প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি। প্রতি তিন মিলি সেকেন্ডে একবার সেই পালসার বার মেগা হার্টজের একটা সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। আমি জানি সে কোথায় যাচ্ছে। আমি যখন ইচ্ছে তাকে ধরে আনতে পারব। আমি চাই যখন তাকে আমি ধরে আনি তুমি যেন কাছাকাছি থাক।

লাইনা ফিসফিস করে বলল, কেন সেটা তুমি চাও?

তুমি জানতে চাও কেন?

হ্যাঁ।

কারণ দশম প্রজাতির রবোট মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষের যেরকম ক্রোধ হয়, ভয়ঙ্কর ঈর্ষা হয়, আমারও সেরকম ভয়ঙ্কর ক্রোধ হয়, ঈর্ষা হয়। মানুষ যেরকম প্রতিশোধ নেয় সেরকম প্রতিশোধ নিই–

কিসের প্রতিশোধ?

কিরি ক্রোধে চিৎকার করে বলল, তুমি জান না কিসের প্রতিশোধ? তুমি অবহেলায় আমাকে ছুড়ে ফেলে ছুটে গেলে একটি বাচ্চাছেলের কাছে?

অমানুষিক আতঙ্কে লাইনার হৃৎপিও থেমে যেতে চায়। হঠাৎ করে অনেক কিছু সে বুঝতে পারে, কিছু একটা বলতে যায়, কিন্তু তার আগেই কিরির শরীর থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি বের হয়ে আসে। লাইনা সমস্ত শরীরে এক ধরনের অশরীরী ঝাকুনি অনুভব করে, চামড়া পোড়ার একটি গন্ধ বের হয়, নীল আলো আর কালো ধোয়ার মাঝে তার সমস্ত শরীর একটি জড়বস্তুর মতো ছিটকে গিয়ে দেয়ালকে আঘাত করে। জ্ঞান হারানোর আগে সে দেখতে পায় কিরি উদ্যত হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার আঙুলের মাথা থেকে বিদ্যুতের নীলাভ স্ফুলিঙ্গ তার পাশের বাতাসকে আয়নিত করতে করতে ছুটে যাচ্ছে।

 

০৪.

মহাকাশযানের মূল চত্বরটির একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে কিরি দাঁড়িয়ে আছে। তার একটি পা টেবিলের উপর। নিজের হাত দুটি সে অন্যমনস্কভাবে নাড়ছে, মাঝে মাঝেই সেখান থেকে নীলাভ বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসছে। কিরির মুখ ভাবলেশহীন, তার চোখ থেকে সবুজ এক ধরনের আলো বের হচ্ছে। সেই আলোটি হঠাৎ তাকে একটা অশরীরী রূপ দিয়েছে।

কিরির সামনে মহাকাশযানের সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও তাদের কাছে কিরি ছিল একজন ঘনিষ্ঠ মানুষ। এখন আর নয়। হঠাৎ করে মনে হচ্ছে তারা কিরিকে জানে না।

কিরি মুখ তুলে বলল, আমি তোমাদের একটি জরুরি কথা বলার জন্যে ডেকেছি। সবাই এসেছ বলে অনেক ধন্যবাদ। মাত্র সেদিন আমি এখানে দাঁড়িয়ে তোমাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি একজন রবোট, মানুষ হয়ে তোমরা আমাকে তোমাদের দলপতি হিসেবে মেনে নেবে কি না। তোমরা একবাক্যে আমাকে দলপতি হিসেবে মেনে নিয়েছিলে।

আমি মানুষ নই। আমি মানুষের জন্যে একটি কাজ করার দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। এই গ্রহে মানুষকে তাদের বসতি স্থাপনে সাহায্য করতে এসেছি। পৃথিবীর সাথে অনেক মিল থাকলেও এই গ্রহে কিছু বড় ধরনের তারতম্য রয়েছে। তাই মানুষকে এই গ্রহে সুস্থ দেহে বেঁচে থাকতে হলে তাদের শরীরে কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন করতে হবে। মানুষের জ্বণগুলোকে ঠিকভাবে বিকাশ করতে হবে। কাজটি দুঃসাধ্য, সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি নয়। কিন্তু আমাদের হাতে একটি অভাবনীয় সুযোগ এসেছে। এই গ্রহে একজন জীবন্ত মানুষকে পাওয়া গেছে যে মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে একা এই গ্রহের প্রাকৃতিক অবস্থায় বড় হয়েছে। সেই মানুষটি থেকে আমরা এমন কিছু তথ্য পেতে পারি যেটা ব্যবহার করা হলে এই বসতি স্থাপনের সাফল্যের সম্ভাবনা হবে শতকরা নিরানব্বই দশমিক নয় ভাগ।

এই মহাকাশযানের দলপতি হিসেবে আমি সেই সুযোগ ছেড়ে দিতে পারি না, তার জন্যে আমাকে এমন একটি কাজ করার প্রয়োজন হল যেটি তোমাদের কাছে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। কাজটি হচ্ছে, সেই মানুষের দেহটি ব্যবচ্ছেদ করে দেখা। কাজটি সবচেয়ে সুচারুভাবে করা যেত যদি তোমরা সেটি কেউ না জানতে। কিন্তু লাইনা সেটি জেনেছিল এবং লাইনার কাছ থেকে তোমরা সবাই জেনেছ। লাইনা আমার সিদ্ধান্তটি সমর্থন করে নি এবং আমি জানি তোমরাও নিশ্চয়ই আমার সিদ্ধান্তটি সমর্থন করবে না। সে কারণে এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছি আমি একা। এর জন্যে কোনো মানুষকে কখনো কোনো অপরাধবোধে ভুগতে হবে না। কিন্তু আমি জানি, তোমরা কখনো আমাকে ক্ষমা করবে না, তোমাদের সাথে আমার যে চমৎকার একটি সম্পর্ক ছিল সেটি শেষ হয়ে গেল। তোমাদের সামনে আমি এখন একটি হৃদয়হীন দানব ছাড়া আর কিছু নেই।

আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমার অনুভূতি মানুষের কাছাকাছি। আমি তোমাদের ঘৃণা অনুভব করতে পারি। আমার বুকের ভিতরে সেটা নিয়ে তীব্র একটি ব্যথা কিন্তু তোমরা—মানুষেরা সেটি কখনো সহানুভূতি নিয়ে দেখবে না। তোমাদের কাছে আমি অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর একটি রবোট।

আমি সেটা স্বীকার করে নিয়েছি। আমার চেহারায় খানিকটা রবোটের রূপ দেয়া হয়েছে। ব্যাপারটি ইচ্ছাকৃত। আমার আচরণে খানিকটা নিষ্ঠুরতা আনা হয়েছে, সেটাও ইচ্ছাকৃত। আমি জানি, তোমাদের বন্ধুত্ব সম্ভবত আমি আর পাব না। অতীতে পেয়েছি, সেটাই আমি গভীর ভালবাসা নিয়ে মনে রাখব।

এর মাঝে অবস্থার একটু পরিবর্তন হয়েছে। লাইনা আমার কথা অমান্য করে সেই মানুষটিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমি মানুষটিকে তোমাদের সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিলাম, সে অপূর্ব রূপবান একটি কিশোর, তার আচার-আচরণে এক ধরনের আশ্চর্য সারল্য রয়েছে। তাকে দেখামাত্র লাইনার মতো তোমাদের বুকেও গভীর মমতার জন্ম হত। তখন তাকে হত্যা করা হলে তোমরা আরো গভীরভাবে দুঃখ পেতে। সে। কারণে আমি তোমাদের মানুষটিকে দেখতে দিই নি। এখন মমতার সময় নয়, এখন সময় দায়িত্ব পালনের।

এই গ্রহটি বড়। মানুষটি এই গ্রহে দীর্ঘদিন থেকে রয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, তোমরা জান সে আমার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। সে যখন আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল, আমার নির্দেশে মিডি রবোট গোপনে তার শরীরে বার মেগা হার্টজের একটি পালসার প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। মানুষটির শরীর থেকে নির্দিষ্ট তরঙ্গের একটি সঙ্কেত বের হচ্ছে, সে কোথায় আছে বের করা আমার জন্যে কোনো সমস্যাই নয়। আমি আগামী চব্বিশ ঘন্টার মাঝে তাকে ধরে আনব। এবং অত্যন্ত দুঃখের সাথে তার দেহ ব্যবচ্ছেদ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সগ্রহ করব, যেন তোমরা–মানুষেরা এই গ্রহে একটি সাফল্যজনক বসতির গোড়াপত্তন করতে পার।

এখন কাজ করার সময়। তোমাদের সবার নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে, নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। আমি আশা করব, তোমরা তোমার্দের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করবে। মহাকাশযানের স্কাউট রবোট ইতিমধ্যে এই গ্রহ থেকে অসংখ্য নমুনা তুলে এনেছে। এই গ্রহে বিচিত্র এক ধরনের প্রাণের বিকাশ হয়েছে। সেটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। সেটার তালিকা করায় আমার তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন। ভ্রূণগুলো ক্রোমোজৈনিক চেম্বার থেকে বের করে আনার সময় হয়েছে। প্রথমবার কত জন শিশু, কী রকম শিশু বিকাশ করানো হবে সে সম্পর্কেও তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই গ্রহে কী ধরনের প্রাণী, কী ধরনের গাছ জন্ম দেয়া দরকার সেই ব্যাপারটি আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। গ্রহের কোন অংশে বসতি স্থাপন করা যায় সেটিও তোমাদের ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আমি তোমাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করব। তোমাদের দুঃখবোধ এবং অপরাধবোধকে তীব্রতর না করার জন্যে পালিয়ে যাওয়া কিশোরটিকে ধরে আনা এবং তাকে হত্যা করার পুরো কাজটি করা হবে তোমাদের অজান্তে। তোমরা কোনোদিন নিশ্চিতভাবে জানতেও পারবে না সত্যিই এই গ্রহে কোনো কিশোের ছিল কি না, সত্যিই তার দেহ ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল কি না।

কিরির গলার স্বর আশ্চর্য রকম শান্ত। সেখানে এক ধরনের অশরীরী শীতলতা রয়েছে, যেটি শুনে সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে খানিকক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে থেকে কোমল গলায় বলল, তোমাদের কারো কোনো প্রশ্ন আছে?

কেউ কোনো কথা বলল না।

কিরি শান্ত গলায় বলল, তোমরা এখন যেতে পার।

ঘরের সব মানুষ এক জন এক জন করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে থাকে। গ্রুসো বের হবার আগে হঠাৎ একবার কিরির দিকে ঘুরে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে কিরিকে। যাকে মাত্র এক দিন আগেও সে নিজের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে জেনেছে।

কিরি হঠাৎ বলল, গ্রুসো।

গ্রুসো থমকে দাঁড়াল।

লাইনা কেমন আছে?

ভালো আছে। করোটিতে আঘাত পেয়েছিল। কিন্তু বিপদ কেটে গেছে।

লাইনাকে বোলো আমি খুব দুঃখিত।

বলব।

গ্রুসো ঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। কিরি বলল, তুমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?

হ্যাঁ।

কী?

আমি কি তোমাকে হত্যা করার চেষ্টা করতে পারি?

কিরি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, না গ্রুসো। সেটা খুব অবিবেচকের মতো কাজ হবে। আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমাকে ধ্বংস করার কোনো পদ্ধতি আমার জানা নেই।

ও।

শুভ রাত্রি গ্রুসো।

শুভ রাত্রি।