০৪. মানুষের ভিড় একটুখানি কমতেই

মানুষের ভিড় একটুখানি কমতেই টিশা আমাকে নিয়ে যাযাবর মানুষটার কাছে গেল। যাযাবর মানুষটি তখন একটা ভাঙা দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার অনেকগুলো পকেটের একটা পকেট থেকে ছোট এক টুকরো গাছের ডাল বের করেছে। অন্য পকেট থেকে একটা ছোট চাকু, তারপর চাকু দিয়ে কাঠের ডালটা চেঁছে চেঁছে একটা দাবার গুটি তৈরি করার চেষ্টা করতে থাকে।

আমাদের দেখে মানুষটা মাথা তুলে তাকিয়ে একটু হাসল। দাড়ি গোঁফের ফাঁক দিয়ে ভালো দেখা যায় না, কিন্তু যেটুকু দেখা গেল মনে হলো মানুষটির দাঁতগুলো খুবই সুন্দর। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুভ বিকেল।”

আমি বললাম, “শুভ বিকেল।”

টিশা বলল “তোমার নাম কী?”

মানুষটা একটু অবাক হয়ে টিশার দিকে তাকাল, বলল, “নাম? আমার নাম?”

“হ্যাঁ।”

“কী আশ্চর্য! আমার যে একটা নাম ছিল আমি ভুলেই গেছি! কত দিন হয়ে গেল, কেউ আমাকে আমার নাম ধরে ডাকে না! আমি একা থাকি, একা ঘুরে বেড়াই, কে আমাকে আমার নাম ধরে ডাকবে!”

টিশা কী বলবে বুঝতে পারল না, একটা সহজ প্রশ্নের একরকম জটিল উত্তর হবে সে আশা করেনি। ইতস্তত করে বলল, “তোমার নিশ্চয়ই একটা নাম ছিল!”

“হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমার একটা নাম ছিল। আমার মা আমাকে ডাকত জিরন। এখন নিশ্চয়ই আমার নাম হবে যাযাবর জিরন। ছোট করে বলতে পার যাযারন!” মানুষটা নিজেই তার নতুন নামটা কয়েকবার উচ্চারণ করল, মনে হলো তার বেশ পছন্দ হলো। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আমাকে তুমি যাযারন ডাকতে পার।”

টিশা বলল, “ঠিক আছে যাযারন, আমি তোমার কাছে জানতে চাই, তুমি যে বাইরে ঘুরে বেড়াও, তোমার কোনো বিপদ হয় না? বাইরে দস্যুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, বন্য পশু আছে, মাটিতে এতো রেডিয়েশান।”

যাযাবর জিরন যার নতুন নাম হয়েছে যাযারন, মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ আমার নানারকম বিপদ হয়, কিন্তু আমি বিপদের মাঝে টিকে থাকা শিখে গেছি।”

“দস্যুরা যখন তোমাকে আক্রমণ করে তখন তুমি কী কর?”

“আমি কখনো দস্যুদের সামনে পড়ি না। তারা অনেক বড় কনভয় নিয়ে ভয়ংকর বাজনা বাজাতে বাজাতে দল বেঁধে আসে। আমি তখন আমার গাড়ি ফেলে সরে পড়ি।”

“তারা কী খুব ভয়ানক?”

যাযারন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

“তারা কী ডাকাতি করে?”

“মানুষ।”

 আমি অবাক হয়ে বললাম, “মানুষ?”

“হ্যাঁ, তাদের দল বড় করার জন্য তাদের মানুষ দরকার।”

টিশা জিজ্ঞেস করল, “বনের পশু যখন তোমাকে আক্রমণ করে তখন তুমি কী কর?”

“বনের পশু আমাকে আক্রমণ করে না।”

“কেন আক্রমণ করে না?”

“বনের পশু মানুষের মতো না। প্রয়োজন না হলে তারা কখনো আক্রমণ করে না। আমাকে বনের পশুর কোনো প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া–”

“তা ছাড়া কী?”

“তা ছাড়া আমি মানুষ। আমার বুদ্ধিমত্তা বনের পশু থেকে অনেক বেশি। আমি যদি সামান্য একটা পশুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারি তাহলে আমার বেঁচে থাকার দরকার কী?”

টিশা কিছুক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “বাইরে যে ভয়ংকর রেডিয়েশান সেটা থেকে তুমি নিজেকে কীভাবে রক্ষা কর?”

“করি না।”

“কর না?”

“তার মানে বাইরে রেডিয়েশান নেই?”

“হয়তো আছে, কিন্তু আমি হয়তো সেখানে যাইনি। যেখানে গাছ বেঁচে থাকে পশু পাখি বেঁচে থাকে সেখানে মানুষও বেঁচে থাকে।”

যাযারন একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার আর কোনো প্রশ্ন আছে মেয়ে?”

“হ্যাঁ। আমার শেষ প্রশ্ন। তুমি কী খাও?”

“এই পৃথিবী এক সময় দশ বিলিয়ন মানুষকে খাওয়াত। এখন পৃথিবীতে কত মানুষ বেঁচে আছে? কয়েক হাজার? কয়েক লক্ষ? এদের খাওয়া নিয়ে সমস্যা?”

“তুমি কী খাও?”

“আমি সব খাই। হাতের কাছে কোনো খাবার না থাকলে পোকা ভাজা করে খেয়েছি! পোকা খুব পুষ্টিকর খাবার। “

যাযারনের কথা শুনে টিশা হেসে ফেলল। আমি এতক্ষণ দুজনের কথা শুনছিলাম, এবারে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি যে একা একা ঘুরে বেড়াও কখনো নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় না?”

এই প্রথম যাযারন উত্তর দেবার আগে কী যেন ভাবল, তারপর বলল, “হ্যাঁ। মাঝে মাঝে আমার একাকী লাগে। সে জন্য আমি দুটো কুকুর পুষেছি। আমার সাথে একটা বাজপাখি থাকে। যাযারন আকাশের দিকে তাকাল, আমরা দেখলাম আকাশে তার বাজপাখিটি ডানা মেলে উড়ছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি সত্যিই যে কোনো নষ্ট গাড়ি ঠিক করতে পার?”

“বড় কোনো সমস্যা না থাকলে পারি।”

টিশা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি একটা নষ্ট মোটর বাইক নিয়ে আসি তুমি ঠিক করে দিতে পারবে?”

“নিয়ে এসো, দেখি পারি কি না।”

ঘণ্টা খানেক পর টিশা যন্ত্রপাতির জঞ্জাল থেকে একটা অচল মোটর বাইক ঠেলে ঠেলে নিয়ে এল। যাযারন খানিকক্ষণ সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলল, “আমার সাথে তো যন্ত্রপাতি নেই, সব আমার গাড়িতে রয়ে গেছে। তুমি কি আমার জন্য এক টুকরো তার নিয়ে আসতে পারবে?”

টিশা মাথা নাড়ল, তারপর আমরা দুজন যন্ত্রপাতির জঞ্জাল ঘেঁটে নানা আকারের ছোট-বড় তার নিয়ে হাজির হলাম। যাযারন মোটর বাইকের কোথা থেকে টেনে একটা টিউব বের করে তার ভেতর সরু তার ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ টানাটানি করে তারপর আবার টিউবটা আগের জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে মোটর বাইকটা স্টার্ট করার চেষ্টা করল, দুবার বন্ধ হয়ে গিয়ে তৃতীয়বার পুরোপুরি স্টার্ট হয়ে গেল। যাযারন মোটর বাইকটা টিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও, তুমি এখন একটি মোটর বাইকের মালিক।”

আমরা অবাক হয়ে যাযারনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। টিশা বলল, “তুমি কীভাবে এত সহজে এটা ঠিক করে ফেললে?”

“কীভাবে ঠিক করতে হবে জানলে তুমিও পারবে।”

টিশা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আমাকে শেখাবে তুমি?”

যাযারন তার দাড়িগোঁফের ফাঁক দিয়ে একটু হেসে টিশার মাথায় হাত রেখে বলল, “চব্বিশ ঘণ্টায় আমি তোমাকে আর কতটুকু শেখাব? তোমার আগ্রহ থাকলে তুমি নিজেই শিখে নেবে। শিখতে হয় গোড়া থেকে, উপর থেকে নয়। ক্রেনিয়ালের এটা হচ্ছে সমস্যা, তারা উপর থেকে শেখায়।”

এতক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে, আমাদের মতো আরো কিছু মানুষ যারনকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মতো তাদেরও নানা ধরনের কৌতূহল। আমি আর টিশা তাই সরে দাঁড়ালাম। যাবার আগে টিশা বলল, “যাযারন, কাল খুব ভোরে আমি চলে আসব। তোমার

কাছে আমার আরো অনেক কিছু জানার আছে।”

যাযারন বলল, “চলে এসো। যদি পার এক মগ গরম কফি নিয়ে এসো।”

টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “আনব।”

টিশার মোটর বাইকের পেছনে বসে আমরা দুজন শহরের ভেতরে ফিরে এলাম।

.

পরদিন খুব ভোরে কাজে ফাঁকি দিয়ে এক মগ গরম কফি নিয়ে টিশার সাথে সাথে আমিও শহরের গেটে যাযারনের সাথে দেখা করতে এলাম। এসে দেখি কেউ নেই। কাছাকাছি কমবয়সী একজন সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে ছিল, সে বলল, “ঐ পাগলটাকে খুঁজছ?”

“হ্যাঁ। কোথায় সে?”

“কাল রাতে তাকে শহর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”

টিশা অবাক হয়ে বলল, “সে কী! কেন?”

“বসে বসে গুজব ছড়াচ্ছিল সে জন্য।”

“কী গুজব ছড়াচ্ছিল?”

“জানি না। নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব ছিল।”

মাঝবয়সী আরেকজন সেন্ট্রি এসে বলল, “তাড়িয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। অ্যারেস্ট করে ডিটিউন করে রেখে দেওয়া উচিত ছিল।”

কমবয়সী সেন্ট্রি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, ডিটিউন করে রেখে দেওয়া উচিত ছিল।”

টিশা কোনো কথা বলল না, খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।