মানিক চাটুয্যেই প্রথমে কথা বলে।
আলী সাহেবের সর্বকনিষ্ঠা বেগম–জাহানারা।
জাহানারা?
হ্যাঁ। বয়স বেশী বলে তো মনে হচ্ছে না!
না।
হুঁ। ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছেন? কখন ব্যাপারটা ঘটেছে বা কে প্রথম জানতে পারল
মোটামুটি যা জানতে পেরেছি–নাসির হোসেনের কাছে–
নাসির হোসেন?
হ্যাঁ—আলী সাহেবের ভাগ্নে। ওঁর বোনের—সুলতানা বেগমের একমাত্র ছেলে—
নাসির হোসেন সাহেব এখানেই থাকেন তো?
হ্যাঁ।
নাসির হোসেন যা বলেছিল মানিক চাটুয্যেকে, অতঃপর সেই কাহিনী বিবৃত করে মানিক চাটুষ্যে।
আলী সাহেবের তিন বেগম।
রৌশনারা বেগমমাণিক বেগম ও সর্বকনিষ্ঠা জাহানারা বেগম।
বড় বেগম রৌশনারার বয়স বাহান্ন-পঞ্চান্নর উর্ধেই হবে—
মধ্যমা মাণিক বেগম-মুসলমানেরা ঘরের মেয়ে নয়—হিন্দুর কন্যা আগেই বলা হয়েছে।
মুসলিম ধর্ম গ্রহণের পর মণিকার নাম বদলে আলী সাহেব তার নাম রাখেন মাণিক। মাণিক আলী সাহেবের দেওয়া আদরের নাম।
নবাব আলী সাহেবের এক হিন্দু কর্মচারী ছিল যতীন চাটুয্যে—তারই কন্যা ঐ মণিকা।
সর্বকনিষ্ঠা জাহানারাকে আলী সাহেব মাত্র বছর দুই আগে সাদী করেছিলেন।
আসগর আলী সাহেবের বয়স এখন প্রায় বাহাত্তর-তিয়াত্তর হবে। বৃদ্ধ হলেও কিন্তু দেখে সেটা বুঝবার উপায় নেই। দীর্ঘ লম্বা পাতলা চেহারা। টকটকে গৌর গাত্রবর্ণ। এখনো সোজা হয়ে হাঁটা-চলা করেন। মাথার চুল ও দাড়ি পেকে অবশ্য সাদা হয়ে গিয়েছে। খুব আমুদে রাশভারী মানুষ।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, শুধু তাই বলুন শক্তিমান পুরুষও–
মানিক চাটুয্যে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, নচেৎ তৃতীয়বার বেগম সংগ্রহ করেন ঐ বয়সে!
মানিক চাটুয্যেও হাসে।
বলুন তারপর–
জাহানারা গরিবের ঘরের মেয়ে হলেও অত্যন্ত মেধাবী ছিল বলে বি.এ. পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল নিজের চেষ্টায়। এবং সেই সঙ্গে গানবাজনাও। সংগীতে অপূর্ব মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ ছিল তার।
নিজের চেষ্টাতেই গান শিখেছিলো লেখাপড়ার মতই।
জাহানারার সঙ্গে আসগর আলী সাহেবের বিবাহের ব্যাপারটাও নাকি বিচিত্রজাহানারা নাকি ইচ্ছে করেই আসগর আলী সাহেবকে সাদী করেছে।
অনেকেই ব্যাপারটায় যে বিস্মিত হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই।
আসগর আলী সাহেব চিরদিনই একজন সংগীত-রসগ্রাহী। সংগীতকে তিনি বরাবরই ভালবাসতেন বলে প্রায়ই তাঁর গৃহের জলসাঘরে গানের জলসা বসত। বহু গুণী জ্ঞানী সংগীতশিল্পীরা ঐ জলসাঘরে এসে মাইফেলে যোগ দিয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়াও মধ্যে মধ্যে জাহানারা একাই সংগীতের আসর বসাত। এবং সে আসরে শ্রোতা থাকতেন তার স্বামীই—আসগর আলী সাহেব।
গত রাত্রেও তেমনি সংগীতের আসর বসেছিল ঐ জলসাঘরে। দুটি মাত্র প্রাণী।
জাহানারা বেগম ও নবাব আসগর আলী সাহেব।
আলী সাহেবের শরীরটা নাকি গত রাত্রে তেমন ভাল ছিল না—তাই রাত দশটার পর তিনি উঠে চলে যান জলসাঘর থেকে।
তারপর একাই নাকি জাহানারা বেগম বসে বসে জলসাঘরে গান গাইছিল।
জাহানারার নিজস্ব দাসী মোতি—জলসাঘরের দরজার বাইরে বসেছিল—অন্যান্য রাত্রে রাত বারোটার বেশী থাকত না জাহানারা জলসাঘরে।
কিন্তু গত রাত্রে সাড়ে বারোটা বেজে গেল তখনো সংগীতের বিরাম নেই তা ছাড়া বাইরে ঝড়জল বসে থাকতে থাকতে দাসী মোতি একসময় নাকি ঘুমিয়ে পড়ে। এবং কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছিল বলতে পারে না।
হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙে যায়।
সংগীত তখন আর শোনা যাচ্ছে না কেবল ঝড়জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর ঝাউগাছগুলোর সোঁ সোঁ করুণ কান্না।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে মোতি।
জলসাঘরের দরজা খোলা-পুঁতির ভারী পদাটা হাওয়ায় দুলছে আর মৃদু ঝিম্ ঝিম্ শব্দ তুলছে।
বেগম সাহেবা কি চলে গেলেন নাকি? কিন্তু তাকে ডাকেন নি কেন? জলসাঘরে আলো জ্বলছে না তো—তবে কি সত্যি চলে গিয়েছেন শয়নঘরে বেগম সাহেবা?
পুঁতির পর্দা সরিয়ে মোতি ঘরের মধ্যে পা দেয়।
ঘরটা অন্ধকার।
একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা—সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে।
কেমন যেন আতঙ্কে সর্বাঙ্গ সিরসির করে ওঠে মোতির।
কয়েকটা মুহূর্ত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
তারপর সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই তার ঐ বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়ে-সঙ্গে সঙ্গে মোতি চিৎকার করে উঁচচিয়ে ওঠে।
ঘর থেকে পাগলের মত ছুটে বের হয়ে যায়।