৪. মউল, ভালপারইসো
মাঝিমাল্লার কাজে কন্গ্রের হাত ছিলো পাকা। ওস্তাদ নাবিকই বলা যাবে তাকে। তবে কোন-কোন জাহাজ তার দখলে ছিলো, কোন-কোন সাগরে সে পাড়ি দিয়েছে, সেটা শুধু তার মতোই ওস্তাদ জাহাজি, আর তার দস্যু জীবনের ডানহাত, সের্সান্তেই সম্ভবত জানে। কিন্তু সের্সান্তে কখনও এ-বিষয়ে কাউকেই কিছু বলেনি।
যখনকার কাহিনী তখন সলোমন আইল্যাণ্ড আর নিউ-হেব্রাইডিস অঞ্চলে বোম্বেটেদের সাংঘাতিক উৎপাত ছিলো। সন্দেহ নেই, জলদস্যু হিশেবে দুজনেরই হাতেখড়ি হয়েছিলো ঐ অঞ্চলে। তাদের দলের অন্যান্যরা মাছ ধরার জাহাজে বা মাল বওয়ার জাহাজে সাগর পাড়ি দিয়েছে ব’লে সমুদ্রের হালচাল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। স্কুনারটা দখল করতে পারলে এদের দিয়েই খালাশির কাজ চালানো যাবে। স্কুনারটার তো এখানে থামবার কোনো কথা ছিলো না, হয়তো কালকের ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে যুঝতে না-পেরে এখানে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিলো, সন্ধেবেলায় যদি হাওয়ার গতি পালটে যায়, তাহ’লে তক্ষুনি ফের বারদরিয়ায় পাড়ি জমাবে। স্কুনারটির মাঝিমাল্লারা নিশ্চয়ই বিস্তর চেষ্টা করেছে, তবু স্কুনারটি বালির চড়াতেই আটকে আছে।
জাহাজের কাপ্তেন আর অন্যান্য নাবিকদের কী অবস্থা সে-সম্বন্ধে শুধু অনুমান করা যাচ্ছিলো, কিন্তু সঠিক কিছু বোঝা যাচ্ছিলো না। খুব সম্ভব হাওয়ার টানে জাহাজটাকে সোজা খাড়াই পাহাড়ের দিকে ছুটে যেতে দেখে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে নৌকোয় ক’রে তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে। তা যদি হয়, তাহলে তাকে নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়। যদি তারা জাহাজে থাকতো, তবে তারা নিরাপদেই থেকে যেতে পারতো, জাহাজটারও দেখাশুনা করতে পারতো। উত্তর-পুবদিকে দু-মাইল দূরে তাদের নৌকোকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে যুঝতে দেখা গেলো। হাওয়ার দাপটে প্রায় উলটে-যেতে যেতে ফ্রাঙ্কলিন উপসাগরের দিকে ছুটে যাচ্ছিলো নৌকোটা। অন্তত এটা জানা গেলো যে তারা এখনও মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি।
ভরা জোয়ারের সময়ও স্কুনারে পৌঁছুনো কনগ্রেদের কাছে কোনো কঠিন কাজ ছিলো না। আধমাইল দূরের ওই স্কুনারে পৌঁছুতে তাদের শুধু কয়েকটা টিলা আর বালিয়াড়ি পেরুতে হবে। কন্গ্রের দল তা-ই করলে।
কন্গ্রে তার দলবল নিয়ে বেলাভূমিতে পৌঁছে স্কুনারটাকে একটা উঁচু বালির চূড়ায় আটকে থাকতে দেখলে। জোয়ারের সময় যখন সাত-আট হাত ফুলে উঠবে, তখন জাহাজটা চালিয়ে-আনা মোটেই কঠিন হবে না। স্কুনারটি সত্যি একশো-ষাট টনের, কন্গ্রের আন্দাজে ভুল হয়নি। স্কুনারটা চারপাশে একবার ঘুরে দেখলে কন্গ্রে, তারপর নাম-লেখা পাতটার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলে, ‘মউল, ভালপারাইসো।’
তার মানে, ২২শে ডিসেম্বর রাত্রে ঝোড়ো হাওয়ায় ভেসে এসে চিলের একটি জাহাজ স্টটেন আইল্যাণ্ডে ভিড়েছে!
সের্সান্তে বললে, ‘এটাতেই আমাদের কাজ চ’লে যাবে!’
‘অবশ্য যদি এখনও এর তলায় কোনো ফুটো না-হ’য়ে থাকে,’ কে-একজন ফোড়ন কাটলে।
কন্গ্রে অমনি জানিয়ে দিলে, ‘এক-আধটা ফুটো-টুটো হয়ে থাকলে মেরামত ক’রে নেয়া যাবে!’ জাহাজটাকে সে মোটেই হাতছাড়া করতে চায় না। ভালো ক’রে, খুঁটিয়ে, সে জাহাজটা দেখতে লাগলো। না, কোথাও কোনো চোটের চিহ্ন তো চোখে পড়লো না।
বেশ-খানিকটা কসরৎ করে ঐ কাৎ-হাওয়া জাহাজটায় তারা উঠে পড়লো। দেখা গেলো, জাহাজের সবকিছুই লেফাফাদুরস্ত। কন্গ্রে কাপ্তেনের কামরায় ঢুকে প’ড়ে নানান দেরাজ হাড়ে জাহাজ সম্পর্কিত জাহাজগুলো বার ক’রে নিলে—লগবুক শুদ্ধু। তখনই সে আর সের্সান্তে জাহাজ সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য জানতে পেলে।
চিলের ভালপারাইসো বন্দরের স্কুনার এই মউল। একশো সাতান্ন টন ওজন বইতে পারে। কাপ্তেন, সারেঙ আর দুজন নাবিক ২৩শে নভেম্বর ফকল্যাণ্ড আইল্যাণ্ডের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলো। শৃঙ্গ অন্তরীপের বাঁকটা ভালোভাবেই পাশ কাটিয়েছিলো মউল, কিন্তু লেময়র প্রণালীতে ঢোকবার সময়ে স্টটেন আইল্যাণ্ডের বালিয়াড়িতে ধাক্কা খেয়ে জাহাজটা তাদের আয়ত্তের বাইরে চ’লে যায়।
জাহাজটা ফাকাই, কোনো মালপত্র নেই। কন্গ্রে তা চায়ওনি। এই দ্বীপ থেকে সটকে পড়ার উপযোগী কোনো জাহাজ পেলেই সে খুশি। মউলকে কাজে লাগাতে পারলেই তার অ্যাদ্দিনের স্বপ্ন সার্থক হবে। এখন তার প্রথম কাজ হলো, এই বালিয়াড়ি থেকে জাহাজটা উদ্ধার ক’রে কোনোরকমে সমুদ্রে নিয়ে-যাওয়া। শিগগিরই জোয়ার শুরু হবে। কন্গ্রে সের্সান্তেকে বললে, ‘জোয়ার আসার আগেই এটাকে সাগর পাড়ি দেবার জন্যে তৈরি ক’রে নিতে হবে। মনে তো হচ্ছে জাহাজটার তেমন-কোনো চোট লাগেনি। সুতরাং ডুবে মরার সম্ভাবনা নেই। ‘
সের্সান্তে খুশ মেজাজে বললে, ‘শিগগিরই তা জানা যাবে, ওস্তাদ, জোয়ার শুরু হ’লো ব’লে। তারপরে কী করতে হবে, সেটাই বরং বলো।’
‘প্রথমেই এটাকে আমাদের গুহার কাছে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে জল বেশ গভীর। সুতরাং আটকে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ এই জাহাজ মাত্র দশ-বারো ফুট জলেও ভেসে থাকতে পারবে।’
‘তারপরে?’
তারপর আমাদের এতদিনকার জমানো ধনরত্ন তুলতে হবে জাহাজে।’
‘এবং?’
‘এবং কী করা হবে সেটা পরে দেখা যাবে।’ কন্গ্রে আপাতত তার মৎলবটা সরাসরি ফাঁস করে দিতে চাইলে না।
জোয়ার শুরু হবার আগেই জাহাজটিকে সাগর পাড়ি দেবার উপযোগী ক’রে তোলবার জন্যে তারা ব্যস্তসমস্তভাবে কাজে মেতে গেলো। জলের প্রথম তোড়টা আসবার আগেই তারা সব কাজ সেরে ফেললে। আর কয়েক লহমা পরেই এই বালিয়াড়ি জলের তলায় ডুবে যাবে। কন্গ্রে, সের্সান্তে আর আরো জনা ছয় বোম্বেটে জাহাজেই থেকে গেলো, বাকি সবাই হাঁটা পথে গুহার দিকে রওনা দিলে।
এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর-কিছু করবার নেই। ঘটনাচক্র করেই সৌভাগ্য সূচনা করেছে। অবশেষে তার ফন্দি মতন কাজ শেষ হ’তে চলেছে। বালিয়াড়ির ফাঁদ থেকে রেহাই পেতেই যেন মউলের পালে হঠাৎ হাওয়া লাগলো। জলও ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠছে। এর চেয়ে ভালো অবস্থা কে স্বপ্নেও ভাবেনি।
কিন্তু তবু উদ্বেগ থেকেই গেলো। যদি স্কুনারের নিচে কোনো ফুটো হ’য়ে গিয়ে থাকে, তাহ’লে সাগর পাড়ি দেয়া তো দূরের কথা, তাদের তবে এখানেই ডুবে মরতে হবে। অধীর হ’য়ে কন্গ্রে সদলবলে ধীরে-ধীরে তোড়-বাড়তে- থাকা জোয়ারের জলের দিকে তাকিয়ে রইলো। জোয়ারের জোর যত বাড়ছে, তার আশা আর বিশ্বাসও ততই বাড়ছে। জল ফুলে ফেঁপে নাচানাচি ক’রে ছুটে চলেছে। কাৎ-হওয়া জাহাজটা আস্তে-আস্তে খাড়া হ’য়ে উঠছে দেখে, সের্সান্তে তার গলার খুশি চেপে রাখতে পারলে না, ‘না, জাহাজে কোনো ফুটো নেই। ‘
কন্গ্রে সবাইকে তৈরি হ’য়ে নিতে হুকুম দিলে। সব ঠিকঠাক। তার দলের লোকেরা পরের হুকুমটার জন্যে অপেক্ষা ক’রে আছে। আড়াই ঘণ্টা হ’লো জোয়ার শুরু হয়েছে। রেলিঙ ধরে জলের দিকে ঝুঁকে প’ড়ে কে জোয়ারের গতি লক্ষ ক’রে চলেছে। আর আধঘণ্টার মধ্যেই বালুকাশয্যা থেকে পুরোপুরি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মউল।
কন্গ্রের গলার স্বর কি-রকম তীক্ষ্ণ হ’য়ে গেলো, যখন সে হুকুম করলে নোঙর তুলতে—সম্ভবত অ্যাদ্দিন বাদে তার স্বপ্ন সফল হ’তে চলেছে ব’লেই। নোঙর তোলা হ’লো, কিন্তু জাহাজ নড়লো না। সের্সান্তে তখন কী ব্যাপার বোঝবার জন্যে চারপাশে খুব ভালো ক’রে চোখ বুলিয়ে নিলে। ও-হো, তখনও তো সম্পূর্ণ ভেসে উঠতে পারেনি জাহাজ, সামান্য-একটু অংশ তখনও বালিয়াড়িতে আটকে আছে। খানিকক্ষণ বাদে সেই অংশটুকুও যখন ভেসে উঠলো, তখন আচমকা একটা ঘুরপাক খেয়ে জাহাজটির মুখ আপনা থেকেই সমুদ্রের দিকে চ’লে গেলো। কন্গ্রের হুকুমে সব্বাই চটপট কাজে হাত লাগালে, এমনকী সের্সান্তে শুদ্ধু। শুধু কন্গ্রে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
প্রাণপণেই চেষ্টা করছিলো সবাই। দুনিয়ার কোনো অপকর্ম করতেই যারা পেছ-পা নয়, তারা সামান্য একটা বালিয়াড়ি থেকে কোনো জাহাজ নড়াতে পারবে না, এ কী কোনো কথা হ’লো! সুতরাং, ‘মারো জোয়ান হেঁইয়ো, আউর ভি থোড়া হেঁইয়ে’, এই জাতীয় চীৎকার ক’রে তারা কাজে লেগে গেলো।
উত্তর-পুব দিকে তখন আস্তে-আস্তে মেঘ ক’রে আসছে। যদি চটপট জাহাজটিকে দ্বীপের পশ্চিমদিকে নিয়ে যাওয়া না-যায়, তবে সাংঘাতিক এক ঝড়তুফানের পাল্লায় পড়তে হবে তাদের। তাছাড়া ওদিক থেকে যদি জোরালো হাওয়া বইতে শুরু করে দেয়, তবে কিছুতেই প্রণালীর মধ্যে জাহাজ চালানো সহজ হবে না। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক সুবিধের নয়।
একটু পরেই তো ভাটা শুরু হবে। ফের দেখা দেবে বালিয়াড়ি, ফের খাঁচার মধ্যে বন্দী হ’য়ে পড়বে মউল।
এতক্ষণ ধরে একটানা খেটে সবাই ক্লান্ত হ’য়ে পড়ছে। এতদিনকার অনভ্যাসের ফল। তাদের চেষ্টা অন্তত এবার সফল হবে না ব’লেই তখন মনে হচ্ছিলো।
কন্গ্রে সকলের কাছে ছুটে-ছুটে যাচ্ছিলো। ব্যর্থ আক্রোশ আর রাগে তার মুখটা কী-রকম ভয়ংকর দেখাচ্ছে, বীভৎস। চোখ দুটো ঝকঝক ক’রে উঠেছে উত্তেজনায়। একটা কুড়ুল উঁচিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে সে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘কাজে একটু ঢিলে দিলে কারুরই আজ রেহাই নেই।’
তার অনুচরেরা তাকে যতটা জানে, তাতে এটা বুঝতে পারলে এ কেবল নিছক চোখ রাঙিয়ে শাসানো নয়, কন্গ্রে সম্ভবত তার কথা রাখতে একটুও দ্বিধা করবে না।
তাই, প্রাণপণে, গায়ের যত জোর আছে প্রয়োগ ক’রে সম্মিলিত ভাবে তারা চেষ্টা করতে লাগলো। সামান্য নড়লো জাহাজ। ‘আউর-ভি থোড়া, হেইয়া!’ আর তারপরেই আচমকা বালিয়াড়ি থেকে জাহাজটি ছিটকে বেরিয়ে এলো।
হর্ষ আর উল্লাসের চীৎকার উঠলো তৎক্ষণাৎ। এবার জাহাজটাকে শুধু গুহার সামনে নিয়ে যাবার ওয়াস্তা—তাহ’লেই কিস্তিমাৎ।
কন্গ্রে নিজেই জাহাজ চালাবার দায়িত্ব নিলে। আর, আধঘণ্টার মধ্যেই মউল তাদের গুহার সামনে পেঙ্গুয়িন টিলার কাছে এসে নোঙর ফেললো।