ভুলতে বারণ করেছিলেন কাপিন সানসেদো।
জাহাজ স্পেনে পৌঁছোবার অনেক আগেই সোরাবিয়া তা ভুলে গেছে।
শুধু ভোলেনি, ঘনরামের বিরুদ্ধে হিংসায় আক্রোশে সে প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।
তা হলেই বা ক্ষিপ্ত, শুধু সোরাবিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে কতখানি ক্ষতি আর করতে পারত ঘনরামের! বড়জোর একদিন খোলা তলোয়ার নিয়ে এ বিরোধের মীমাংসা করতে হত, তার বেশি কিছু নয়।
কিন্তু ঘনরামের ভাগ্যাকাশের কুগ্রহ তার চরম লাঞ্ছনার জন্যে অনেক বেশি জটিল ফাঁসের রশি তখন গোপনে টানছে।
সেদিন রাত্রে একসঙ্গে বসে খাওয়ার সময় কাপিন সানসেদো তাঁর গণনায় সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।
খেতে বসে বিশেষ কিছু ভূমিকা না করে সানসেদো সোজাসুজি সোরাবিয়ার আংটির কথাটা তুলেছিলেন। বলেছিলেন, আংটিটা আমায় দেখতে দিলেন না কেন বলুন তো!
কী আর দেখতেন ওই একটা সাধারণ আংটিতে! ঘনরাম প্রসঙ্গটা চাপা দিতে চেয়েছিলেন।
কী দেখতাম! সানসেদো চাপা দিতে না দিয়ে বলেছিলেন, দেখতাম হয়তো পাথর নয়, আংটিটায় একটা ঈষৎ রঙিন আয়নার কাচই কৌশলে বসানো। আংটিটা যার আঙুলে থাকে, তাস বিলোবার সময় চেষ্টা করলে বিলোনো তাস এই কাঁচের ছায়া থেকে সে চিনে নিতে পারে।
ঘনরাম কাপিতানের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বেশ একটু কৌতুকের সুরে বলেছিলেন, যে-আংটি সমুদ্রের জলে ড়ুবে গেছে তা নিয়ে আর জল্পনা কল্পনায় লাভ কী, কাপিন! আংটি ড়ুবলে হয়তো মানুষটা ভাসতে পারে।
এবার কাপিনও হেসে উঠে বলেছিলেন, ঠিকই বলেছেন, সেনর দাস।
তারপর হঠাৎ ঘনরামের ডান হাতটা টেনে নিয়ে টেবিলের ওপর চিত করে রেখে বলেছিলেন, মাপ করবেন, সেনর দাস! মানুষ সম্বন্ধে অন্যায় অশোভন কৌতূহল আমার নেই, কিন্তু দু-একজনকে দেখলে তাদের ভাগ্য জানবার আগ্রহ আমি চাপতে পারি না। আপনার সঙ্গে পরিচয় হবার পর কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন আমি যে করিনি তা আপনি ভাল করেই জানেন। ও সব বিবরণে আমার প্রয়োজন নেই। আপনাকে দেখা মাত্র কিন্তু আমার মনে হয়েছে আপনার ভাগ্যলিপি অদ্ভুত কিছু হতে বাধ্য। আপনার হাতটা তাই একটু দেখতে চাই।
হাতের রেখার ভাষা আপনি জানেন? ঘনরামের কথায় কৌতূহলের চেয়ে কৌতুকই বেশি প্রকাশ পেয়েছিল।
কিন্তু সানসেদোর প্রথম কথাতেই তিনি চমকে উঠেছিলেন। যেটুকু পড়তে পারি, মনে করতাম, বেশ গম্ভীরভাবে বলেছিলেন সানসেদো, তা তো এখন ভুল মনে হচ্ছে!
তার মানে? সত্যি কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন ঘনরাম।
মানে, আমার বিচার ঠিক হলে বুঝতে হয় যে তিন সমুদ্র পার হয়ে চতুর্থ সমুদ্রও আপনি দেখবেন। সবিস্ময়ে ঘনরামের দিকে চেয়ে বলেছিলেন সানসেদো।
পুরোপুরি না বুঝলেও যেটুকু বুঝেছেন তাতেই ভেতরে ভেতরে চমকে উঠেছিলেন ঘনরাম। মনে মনে তখন তিনি শিশুকালের কালাপানি থেকে আরবসাগর আর তারপর লিসবনে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হতে আসার সময় আফ্রিকার উপকূলের সেই অসীম সাগর, পরে যা আতলান্তিক বলে জেনেছেন, তা গুনে ফেলায় বিস্মিত হয়ে উঠেছেন সানসেদের গণনা শক্তিতে। কিন্তু সে বিস্ময় গোপন করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এ তো হেঁয়ালির মতো শোনাচ্ছে। অর্থ কী এ কথার?
অর্থ কী আমিও তা জানি না। সরলভাবে স্বীকার করেছিলেন কাপিন সানসেদো। সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া যাদের নিয়তি তাদের হাতে যে চিহ্ন থাকে তাই দেখেই যা বলবার বলেছি।
এ গণনা আপনি শিখলেন কোথায়? বিশেষ আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ঘনরাম।
শিখেছি আমাদের এসপানিয়াতেই। তবে সুদুর এক দেশের আশ্চর্য এক জ্যোতিষীর কাছে।
সুদূর দেশের আশ্চর্য এক জ্যোতিষী! ঘনরাম অবাক হয়ে সে দেশের নাম জানতে চেয়েছিলেন।
নাম তার ইন্ডিয়া! গর্বভরে বলেছিলেন সানসেদো, একদিন অ্যাডমিরাল কলম্বাস এই দেশ খুঁজতেই অকূল সাগরে পাড়ি দিয়েছিলেন এবং এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন যে ইন্ডিয়া যার অংশ সেই এশিয়া মহাদেশের পূর্ব উপকূলই তিনি আবিষ্কার করেছেন। সে দেশ আবিষ্কারের গৌরব কিন্তু তাঁর বা আমাদের দেশের কারও অর্থাৎ কোনও এসপানিওল-এর প্রাপ্য হয়নি। সে গৌরব পেয়েছে পোর্তুগিজ ভাস্কো-দা-গামা। সেই ভাস্কো-দা-গামার আবিষ্কৃত সমুদ্রপথে সে দেশ থেকে আশ্চর্য এক মানুষকে পোর্তুগিজদের জাহাজে এদেশে ক্রীতদাস হিসাবে এনে বিক্রি করা হয়। ভাগ্যক্রমে এক ক্রীতদাসের বাজারে তাঁকে দেখে আমার গভীর কৌতূহল ও শ্রদ্ধা জাগে। বৃদ্ধ দুর্বল মানুষ। ক্রীতদাস হিসাবে তাঁকে খাটিয়ে নেবার সুযোগ নেই বললেই হয়। অত্যন্ত সুলভেই তাই তাঁকে কিনে আমি মুক্তি দিই।
ক্রীতদাসকে আপনি মুক্তি দেন। ভেতরে ভেতরে অভিভূত হলেও বাইরে একটু অপ্রসন্ন বিস্ময়ের ভান করেছিলেন ঘনরাম।
পারলে দিই। কিন্তু কতটুকু আর আমার ক্ষমতা! কোনওরকম আস্ফালন না। করেই বলেছিলেন কাপিন সানসেদো, স্বাধীনভাবে তাঁকে নিজের দেশেই ফেরত পাঠাতে পারব এই আশা করেছিলাম। কিন্তু তিনি নিজেই আমায় সে চেষ্টা করতে মানা করেছিলেন। বলেছিলেন, এই দেশেই তাঁর মাটি কেনা আছে। সে নিয়তি খণ্ডাবার চেষ্টা বৃথা। জীবনের শেষ কটা দিন আমার মেদেলিন শহরের বাড়িতেই তিনি কাটান। তাঁর আশ্চর্য গণনার বিদ্যা সামান্য একটুমাত্র শেখবার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। তাঁর কাছেই শুনি তাঁদের দেশে জ্যোতিষের নামও সামুদ্রিক বিদ্যা।
সানসেদোর প্রতি প্রথম থেকেই ঘনরামের মনে একটা শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জেগেছিল। আরও বর্ধিত শ্রদ্ধা নিয়ে ঘনরাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, নিজের সম্বন্ধে কিছু কি তিনি বলে গিয়েছেন।
না, কিছুই বলেননি। শুধু দুটি নির্দেশ তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম, তাঁর মৃত্যুর পর শবদেহ আমি যেন দাহ করবার ব্যবস্থা করি। আর তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে সমুদ্রের জলে যেন তা ভাসিয়ে দিই। প্রতিবেশীদের সংস্কারের বিরুদ্ধে শহর বা গ্রামাঞ্চলে দাহ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমি এসপানিয়া থেকে ফার্নানদিনা যাবার পথে এই জাহাজ থেকেই তাঁর দেহ সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিই। তাঁর দ্বিতীয় নির্দেশ ছিল তাঁর একটি নিজের হাতে লেখা লিপি তাঁর দেশে পৌঁছে দেওয়া। পৌঁছে দেবার জন্যে আমায় উদ্বিগ্ন বা ব্যস্ত হতে নিষেধ করে তিনি শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর এ অন্তিম লিপি যথাস্থানে পৌঁছে দেবার ভার নিতে একদিন একজন নিজে থেকেই এসে দেখা দেবে। আজ পর্যন্ত কেউ অবশ্য আসেনি।
কিছুটা সান্ত্বনার সুরে, ভবিষ্যতে হয়তো আসবে–বলে অতি কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ঘনরাম নিজের পূর্বের প্রশ্নেই ফিরে গিয়েছিলেন।
জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এখন আমার ভাগ্যলিপিতে আর কী দেখছেন, বলুন।
আর—বলতে গিয়ে নীরব হয়ে সানসেদোর মুখ হঠাৎ অত্যন্ত বিষগ্ন গম্ভীর হয়ে উঠেছিল।
কী? চুপ করে গেলেন কেন? বলুন! দাবি করেছিলেন ঘনরাম।
কোনও গণনাই নির্ভুল হতে পারে না। একটু যেন মাপ চেয়ে নেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিলেন সানসেদো, আমার তো নয়ই। তাই যা বলছি তা ধ্রুব সত্য বলে ধরে নেবেন না। আমার নিজেরই শোনাতে মন চাইছে না।
তবু অসংকোচে বলুন। জেদ ধরে বলেছিলেন ঘনরাম, ভাগ্যের সঙ্গে আমার অনেক দিনের লড়াই। তার চোরা চক্রান্তগুলো আগে থাকতে জানলে বরং কিছু সুবিধেই হতে পারে।
আপনার সমস্ত ভবিষ্যৎ স্পষ্ট করে দেখা আমার বিদ্যার বাইরে। ধীরে ধীরে বলেছিলেন সানসেদো, আমি আবছা আলোছায়ায় সেখানে যা দেখতে পাচ্ছি তাতে চোখ ধাঁধাবার মতো আশ্চর্য সাফল্যই বেশি। অন্ধকার খাদে আর উজ্জ্বল চূড়ায়। নামাওঠার হতাশায় উল্লাসে দোলানো বিচিত্র আপনার জীবন। অজানা নিরুদ্দেশে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে, রক্তের নদী বইবে আপনার সামনে, সোনায় বাঁধানো পথ দিয়ে আপনি হাঁটবেন, আপনাকে বরমাল্য দেবে এক রাজকুমারী এমন এক অচিন রহস্যের দেশে পৃথিবীর কেউ আজও যা জানে না, কিন্তু তার আগে, তার আগে
সানসেদো আবার দ্বিধাভরে থেমেছিলেন। কিন্তু ঘনরাম তাঁকে থামতে দেননি।
তার আগে কী বলুন।ঈষৎ তীব্র দাবি করেছিলেন।
তার আগে আমার গণনায় ভাগ্যের অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতম আঘাতে আপনাকে একেবারে অতলে তলিয়ে যেতে দেখছি। দেখছি অমঙ্গলের একটা ভয়ংকর কালো ছায়া গাঢ় হয়ে আপনার জীবনে নামছে।
সানসেদো আর কিছু বলতে পারেননি। একটা চাপা হাসির হিল্লোল দমকা হাওয়ার মতো কামরাটার ভারি আবহাওয়ার গাম্ভীর্যে একটা ঝাপটা দিয়েই থেমে গেছল।
ও, তিয়েন-এর পর সিয়েন্তো মুচো শুনে ঘনরাম মুখ ফিরিয়ে দেখেছিলেন, সেনোরা আনা যেন ভুল করে ঘরে ঢুকে পড়ার লজ্জায় থমকে থেমে গেছে।
খুব যেন একটা জরুরি একটা কথা বলতে এসে বাইরের লোকের উপস্থিতিতে তিয়েন বলে যাঁকে কাকার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে তাঁকে বলবে কি না ঠিক করতে পারছে না।
একবার সানসেদো আর একবার তাঁর নিজের দিকে আনাকে চঞ্চলভাবে তাকাতে দেখে ঘনরাম নিজেই উঠে পড়ে ঘর থেকে বিদায় নিতে চেয়েছেন।
না, না, সে কী! আপনার তো এখনও খাওয়াই হয়নি! আপত্তি করতে বাধ্য হয়েছেন সানসেদো।
এর পরও সেনোরা আনা ঘরে দাঁড়িয়ে থাকাতে পরিচয় না করিয়ে দিয়েও পারেননি।
এটি আমার সাব্রিনা সেনোরা আনা, বলেছেন সানসেদো, নিজের ভাগ্নী না হলেও তার চেয়ে কম কিছু নয়। আর ইনি হলেন সেনর দাস।
আনা শুধু এইটুকুর জন্যেই অপেক্ষা করছিল বোধহয়। পরিচয়ের পর প্রথম যথাবিহিত সৌজন্য বিনিময়টুকু সারতে না সারতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছে, ওঁর নাম আমি জানি। আজ ওঁর খেলাও দুবার উঁকি দিয়ে দেখেছি, তিয়েন! জাহাজে এখন সকলের মুখে তো শুধু ওঁরই কথা!
ঘনরাম সত্যিই একটু অস্বস্তি বোধ করেছেন এ উচ্ছ্বাসে। সেটা কাটাবার জন্যে ঠাট্টার সুরে বলেছেন জুয়াখেলায় বাহাদুরি দেখিয়ে একটা মস্ত কীর্তি রেখেছি তাহলে!
জুয়াখেলায় বাহাদুরি কেন! আনা প্রতিবাদ করেছে, তিয়েনই বলুন না, হারজিৎ এমন সমানভাবে নেওয়ার মতো জুয়াড়ি ক-জন উনি জীবনে দেখেছেন।
তা বেশি দেখিনি বটে! স্বীকার করেছেন সানসেদো।
এ প্রসঙ্গ তাঁর সামনে চলতে দিতে ঘনরাম আর চাননি। এবার খাবার প্লেট সরিয়ে রেখে উঠে পড়ে বলেছেন, আমার খাওয়া হয়ে গেছে কাপিন। আপনারা যদি অনুমতি করেন, আমি যেতে পারি এখন।
কেন, আপনি যাবেন কেন! আনা এর মধ্যেই সহজ হয়ে গেছে বহুদিনের পরিচিতের মতো।
কিছু একটা কথা তিয়েনকে বোধহয় আপনার বলবার ছিল। স্মরণ করিয়ে। দিয়েছেন ঘনরাম, আপনাকে ঘরে ঢুকতে দেখে অন্তত তা-ই মনে হয়েছিল।
হ্যাঁ, কী বলতে এসেছিলে, আনা? সানসেদোও জিজ্ঞাসা করেছেন, এঁর সামনে। বলতে যদি বাধা না থাকে তো বলো।
না, ওঁর সামনে বাধা কী! আনা ঘনরামকে যেন অন্তরঙ্গের মধ্যে ধরে বলেছে, আমি একটা ষড়যন্ত্রের কথা ভেবেছি। তাই হাসতে হাসতে ঢুকছিলাম।
ষড়যন্ত্রের কথা ভেবে হাসতে হাসতে আসছিলে! সানসেদো বিমূঢ়ভাবে আনার দিকে তাকিয়েছেন।
হ্যাঁ, ষড়যন্ত্র।আনা উচ্ছ্বসিত ভাবে বলেছে, শোনোই না ষড়যন্ত্রটা—তুমিও খুশি হয়ে হাসবে।
সেনোরা আনা কৌতুক হিসেবেই ষড়যন্ত্র কথাটা ব্যবহার করেছিল। ঘনরামের জীবনে সেটা কৌতুক নয়, সত্যিকার ষড়যন্ত্রই হয়ে দাঁড়াবে কে আর তখন পেরেছিল ভাবতে!
এ ষড়যন্ত্র কিন্তু কোনও মানুষের নয়। ঘনরামের বিরুদ্ধে যত হিংস্র আক্রোশই মনের ভেতর পুষে রাখুক, সোরাবিয়া এ ষড়যন্ত্রের একটা অসহায় যুঁটি মাত্র।
এ ষড়যন্ত্র স্বয়ং নিয়তির।
কৌতুক হিসাবে সাজানো একটা ছেলেখেলার চক্রান্ত নিয়তির নির্মম শঠতা ছাড়া অমন বিফল বিকৃত হয়ে ঘনরামের জীবনকে চরম অপমান লাঞ্ছনা গ্লানিতে জর্জর করে আবার অকূলে ভাসিয়ে দিতে পারত না।
ঘনরামকে আর যেখানেই হোক ১৫২১-এ নতুন মহাদেশের সবচেয়ে জঘন্য অস্বাস্থ্যকর উপনিবেশে অন্তত দেখা যাবার কথা নয়। সানসেদোর ভবিষ্যৎ গণনার প্রথম দিকটা অন্তত হাতে হাতে তাঁর ফলেছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
শেষের দিকটা ফলবার কথা এ উপনিবেশেই বন্দি থেকে এটা ভাবাও বাতুলতা।
এ উপনিবেশের জমকালো ও গালভরা নাম কিন্তু কাস্তিল্লা-দেল-অরো অর্থাৎ সোনার কাস্তিল। এ উপনিবেশের শাসনকর্তা হলেন ডন পেড্রো আরিয়াস দে আভিলা, ওরফে পেড্রারিয়াস।
যেমন নীচ স্বার্থপর তেমনই হিংসুক পরশ্রীকাতর মানুষটা। যে যুগে এসপানিয়াতে সবচেয়ে যাতে কাজ হত সেই খানদানি বংশে বিয়ের জোরেই তিনি একটা নতুন উপনিবেশের শাসকের মতো সম্মান ও দায়িত্বের পদ পেয়েছিলেন। যাকে তাকে তো আর তিনি বিয়ে করেননি, ক্যাথলিক ইসাবেলা বলে সারা ইউরোপ যাঁকে জানে, তাঁরই বান্ধবী মোআ-র মারনেস, বিখ্যাত ডোনা বিয়াত্রিজ দে বোবাদিল্লার মেয়ে তাঁর ঘরনি। এসপানিয়ায় সম্মান প্রতিপত্তির চূড়ায় ওঠবার সিঁড়িই হল এই। মেক্সিকো বিজেতা কর্টেজ যৌবনে নিচু ঘরে বিয়ে করে যত সুখীই হয়ে থাকুন এই সিঁড়ির সুবিধা না পাওয়ার দরুনই তাঁর যোগ্য সম্মানশিখরে উঠতে পারেননি। তার জন্যে কর্টেজ-এর মনে দারুণ আফগোশ ছিল বলেও অনেক ঐতিহাসিকের ধারণা। মেক্সিকো বিজয়ের শেষে স্পেনের শাসন যখন সেখানে বিস্তৃত তখন সে দেশের হর্তাকর্তা কর্টেজ-এর পাশে তাঁর সহধর্মিণীরূপে অংশ নিতে এসে কর্টেজ-এর স্ত্রী যখন তিন মাসের মধ্যেই মারা যান তখন কর্টেজ নিজের সামাজিক উন্নতির পথ পরিষ্কার করবার জন্যে তাঁকে সরিয়েছেন এমন গুজবও শোনা গেছল।
সামাজিক সম্পর্কের জোরেই অত বড় উচ্চপদ পেলেও এবং স্বভাবচরিত্রে নীচ স্বার্থপর ঈর্ষাকাতর হলেও তখনকার এসপানিওল অর্থাৎ স্পেনের মানুষের বিশেষ চরিত্র লক্ষণটি পেড্রারিয়াস-এর মধ্যেও ছিল।
নতুন মহাদেশ আবিষ্কৃত হবার পর থেকে সমস্ত ইউরোপের যৌবনই তখন অস্থির চঞ্চল। স্পেন ও পোর্তুগালে উদ্দাম বেপরোয়া উদ্দীপনা আর চাঞ্চল্য সবচেয়ে বেশি।
পোর্তুগাল আর স্পেনই নৌবিদ্যায় তখন অন্যদের তুলনায় বেশি অগ্রসর। সময়ের মাপ আরও সূক্ষ্ম হয়েছে তখন, তার ওপর চুম্বক কম্পাস নির্ভুল দিকনির্ণয়ের শক্তি দিয়ে নাবিকদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ধুকধুকে প্রাণ হাতে নিয়ে সমুদ্রের কূল ঘেঁষে যারা জাহাজ চালাত অকূল দরিয়ায় পাড়ি দেবার মতো তাদের এখন বুকের পাটা।
পোর্তুগাল ও স্পেন এ অগ্রগতির পুরোভাগে থেকেও কিছুকাল আগেও যা কল্পনাতীত ছিল সেই অসাধ্য সাধন করেছে।
আফ্রিকার কূল ধরে ধরে গুটি গুটি এগিয়ে দক্ষিণের দিকে একটা অন্তরীপ থেকে আর-একটা অন্তরীপ পর্যন্ত নিজেদের দৌড় বাড়াতে যাদের প্রায় গোটা শতাব্দীটা লেগে গিয়েছিল, সেই পোর্তুগালের এক দুঃসাহসী নাবিক ডিয়াজ প্রথম আফ্রিকার দক্ষিণের শেষ অন্তরীপ ঘুরে নতুন সমুদ্রে পৌছোবার কীর্তি রাখলেন। আমরা সে অন্তরীপের নাম উত্তমাশা বলে জানি! কিন্তু ডিয়াজ এ অন্তরীপে উত্তম আশা করবার মত কিছু পাননি। ঝড়-তুফানে নাজেহাল হয়ে তিনি এর নাম ঝোড়ো অন্তরীপই রেখেছিলেন। পোর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন-এর কিন্তু দূরদৃষ্টি ছিল অনেক বেশি। তিনিই অন্তরীপের নতুন নামকরণ করেছিলেন উত্তমাশা। তাঁর নামকরণ যে সার্থক ভাস্কো-দা-গামার আফ্রিকার দক্ষিণ অন্তরীপ ঘুরে ইউরোপের আকুল স্বপ্নের ইন্ডিয়া অর্থাৎ আমাদের ভারতবর্ষে পৌঁছোনোতেই তা প্রমাণ হয়।
যে লক্ষ্যের দিকে একাগ্র হয়ে পোর্তুগ্যাল আফ্রিকার দক্ষিণ দিকে দুঃসাহসভরে এগিয়ে গেছে, সেই একই লক্ষ্যের টানে কলম্বাস স্পেনের হয়ে নতুন এক মহাদেশ আবিষ্কার করে ফেলেছেন পোর্তুগালের আগেই।
সে লক্ষ্য হল ইন্ডিয়া। প্রাচ্য দেশ বলতে তখন ইন্ডিয়াই আগে বোঝায়। সেই ইন্ডিয়াই কল্পনাতীত ঐশ্বর্যের দেশ—-সোনা রুপা হিরে মুক্তো সুগন্ধী আতর আর চন্দন, অপরূপ সব মশলা আর তার চেয়ে অপরূপ সব বয়নশিল্পের নিদর্শন।
এই ইন্ডিয়ায় পৌঁছোবার পথ আবিষ্কার করতে পারাতেই জীবনের চরম সার্থকতা। তার চেয়ে বড় আকাঙক্ষা স্পেন পোর্তুগালের কোনও ভদ্রসন্তান। কাবালিয়েরোর তখন নেই।
কিন্তু পোর্তুগাল যেখানে যাবার পথ খুঁজছে আফ্রিকার দক্ষিণ দিয়ে, পৃথিবী গোলাকার জেনে কলম্বাস তাকে বেড় দিয়ে উলটো দিক থেকে সেখানে পৌঁছোবার চেষ্টা করেছেন কেন?
আর কি পথ ছিল না ইন্ডিয়ায় যাবার?
ছিল আরও সহজ সংক্ষিপ্ত পথ, কিন্তু মেয়ার-ইনসট্রম অর্থাৎ মধ্যোপসাগরে সে। পথে ধনপ্রাণ বাঁচানো অনিশ্চিত করে তুলেছে মরক্কো আর আলজিরিয়ার মূর বোম্বেটেরা। সে সমুদ্রের পূর্বদিকের মুখও আবার মিশর আরবের যোজক সুয়েজ দিয়ে বন্ধ। তারপরও আছে দুরন্ত আরব সাগর-সদাগরেরা, যারা একহাতে বাণিজ্য করে আর-এক হাতে লুঠতরাজ!
তাই ইন্ডিয়ায় পৌঁছোবার নিরাপদ রাস্তা চাই।
সে রাস্তার খোঁজে বেরিয়ে কলম্বাস মাঝপথে যা পেয়েছেন সে দেশের সঠিক পরিচয় তখনও গাঢ় রহস্যে ঢাকা।
বিরাট একটা অজানা বিস্তৃতির ওপরকার দুর্ভেদ্য যবনিকা এখানে সেখানে সামান্য একটু উঁকি দেবার মতো ওঠানো গেছে মাত্র।
কিন্তু যবনিকা যেটুকু উঠেছে তাতেই উত্তেজনার বন্যা বইয়ে দিয়েছে। দুঃসাহসীদের রক্তে।
স্পেনে নিজেকে পুরুষ বলে যারা গর্ব করে তারা সবাই তখন দুঃসাহসী, সবারই মন অবিশ্বাস্য যশ আর ঐশ্বর্য জয়ের স্বপ্নে বিভোর। তাদের এ স্বপ্ন দেখবার কারণ যে নেই তা নয়।
আবিষ্কারের পর জয় করে প্রথম উপনিবেশ পাতা হয়েছে হিসপানিওলায়, ফার্নানদিনায়, মানে কিউবায়।
তারপর হার্নান্দেজ দে কর্ডোভা বাহামা দ্বীপ থেকে সেখানকার আদিবাসী ক্রীতদাস ধরে আনতে গিয়ে ঝড় তুফানে ছিটকে আশাতীত এক অজানা রাজ্যে পোঁছে তাদের বাড়িঘর চাষবাস মিহি কাপড়ের শৌখিন বেশভূষা আর গয়নার সোনাদানা দেখে অবাক হয়েছেন। কান শুনতে ধান শুনে সেখানকার লোকের মুখের টেকটেটানকে য়ুকাটান নাম দিয়ে তিনি কিউবায় ফিরে নতুন দেশের ঐশ্বর্যের চোখ কপালে-তোলা গল্প করেছেন।
এক আবিষ্কার আর-এক অভিযানকে ঠেলা দিয়েছে। য়ুকাটানের পর কর্টেজ-এর কীর্তি মেক্সিকো জয়।
উদ্দাম উত্তেজনার ঢেউ তখন এই সব দৃষ্টান্তে নতুন মহাদেশের সমস্ত পূর্ব উপকূলের তীরে ধাক্কা দিচ্ছে।
সামনে অজানা মহাদেশ প্রসারিত। কিন্তু তারই ভেতর কোথাও আছে সেই প্রণালী যা আতলান্তিক থেকে ইন্ডিয়ার পশ্চিম তীরে গিয়ে নামবার সমুদ্রে পৌঁছে দেবে—এই ছিল সব অভিযাত্রীর দৃঢ় বিশ্বাস।
মেক্সিকো স্পেনের পদানত হয়েছে ১৫২৩-এ। তার অনেক আগেই ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো নুনিয়েজ-দেবালবোয়া আশ্চর্য এক দেশের কিংবদন্তি শুনেছেন।
এসপানিওলরা সবাই সোনা বলতে পাগল—এ ব্যাপারটা তখনও নতুন মহাদেশের নিজস্ব অধিবাসীদের কাছে অদ্ভুত লাগে। তাদেরই একজন বালবোয়াকে সে অবিশ্বাস্য দেশের কথা শুনিয়েছে।
আগে যে জঘন্য অস্বাস্থ্যকর উপনিবেশের কথা বলেছি বালবোয়া তখন পেড্রারিয়াস-এর অধীন সেই কাস্তিস্লা-দে-অরো মানে সোনার কাস্তিলের নরকে থাকেন।
কাস্তিল-দে-অরো যে উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকার যোজক মাত্র তা তখনও। ঔপনিবেশিকদের অজানা!
শাসক পেড্রারিয়াস-এর প্রতিনিধি হিসেবে বালবোয়া আদিম অধিবাসীদের কাছে সংগ্রহ করা কিছু সোনা ওজন করাচ্ছিলেন। সেখানে স্থানীয় একজন সর্দার ছিল। উপস্থিত। বিস্ময়ে কৌতুকে সোনা ওজনের এ অনুষ্ঠানে দেখতে দেখতে হেসে উঠে দাঁড়িপাল্লায় একটা চাপড় দিয়ে সে সমস্ত সোনা মাটিতে ছড়িয়ে দেয়। তারপর মুখ বেঁকিয়ে বলে, এই জিনিসের ওপর তোমাদের এমন লোভ যে হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞান। পর্যন্ত খুইয়ে পাগলের মতো হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছ! এমন দেশের খোঁজ আমি দিতে পারি যেখানে সোনার থালা বাটিতে ছাড়া কেউ খায় না, তোমাদের কাছে লোহা যা সেখানে সোনা তারই মতো সস্তা। সেখানে সূর্য কাঁদলে সোনা ঝরে।
সূর্য কাঁদলে সোনা ঝরার দেশ হয়তো আজগুবি কিংবদন্তি মাত্র। অমন অনেক আজগুবি কল্পনাই তো তখনকার অভিযাত্রীরা এই রহস্যময় মহাদেশ সম্বন্ধে করেছে, অল্পবিস্তর বিশ্বাসও করেছে অদ্ভুত অবিশ্বাস্য সব আরব্যোপন্যাসকে হার-মানানো কাহিনী।
মেয়েরাই যেখানে যোদ্ধা সেই বীরনারী আমাজনদের কথায় তারা খুব অবিশ্বাসের কিছু পায়নি, শুনেছে পাটাগোনিয়ার দানব জাতির কথা, আর সেই এল ডোরাডো-র বিবরণ শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে যেখানে সোনার কণা সমুদ্রের বালির মতো ছড়িয়ে থাকে, আর নদীতে জাল ফেললে পাখির ডিমের মতো সোনার ঢেলার ভারে জাল টেনে তোলা শক্ত হয়।
সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ সত্যে মিথ্যায় বাস্তবে কল্পনায় মেশানো তেমনই কিছু হওয়া অসম্ভব নয়।
কিন্তু কাহিনী যারা শোনায় তারাও সে দেশের সঠিক হদিস দিতে পারে কই!
রহস্য-যবনিকার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে বিহ্বল করা একটা অস্পষ্ট হাতছানি। শুধু অস্থির করে তোলে।
এই হাতছানির ডাকেই বালবোয়া সূর্য কাঁদলে সোনা ঝরার দেশের কাহিনী শোনার কিছু পরেই কাস্তি দে অরো-র পচা জলাবাদার সাপখোপ মশা পোকামাকড়ের ভ্যাপসা নরক থেকে ডারিয়েন যোজকের মেরুদণ্ডের মতো
পর্বতপ্রাকার ডিঙিয়ে গেছলেন পরম দুঃসাহসে।
পাহাড় ডিঙিয়ে যা তিনি দেখেছিলেন তা তাঁর সমস্ত কল্পনার অতীত।
সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রসমেত যোদ্ধার পোশাকেই তিনি ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়েছিলেন সামনে। ফেনায়িত তরঙ্গ-ফনা-তোলা নীল জলের বিস্তৃতিতে। পাগলের মতো চিৎকার করে বলেছিলেন, যতদূর এ অজানা সমুদ্র ছড়িয়ে আছে ততদূর পর্যন্ত দেশ মহাদেশ থেকে দ্বীপবিন্দু সমেত সব কিছুর ওপর কাস্তিল-এর মহামান্য নৃপতির একছত্র অধিকার আমি ঘোষণা করলাম।
দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত দেখেও সে নীল জলধির বিরাটত্ব তিনি তখন বোধহয় অনুমান করতে পারেননি।
সেই অসীম জলরাশি প্রশান্ত মহাসাগরের। সময়টা বোধহয় ১৫১৪র কিছু পূর্বে।
মানুষের সভ্যজগৎ সমবেত ও সচেতাভাবে সেই প্রথম এক অজানা মহাসমুদ্রের সন্ধান পেল।
যোজকের অপর পারে এই মহাসমুদ্রের তীরেই বালবোয়া রূপকথার মতো অবিশ্বাস্য সোনার দেশের আরও কিছু কিছু বিবরণ পান। সে দেশের পশু পাখি ফল ফসলও নাকি অদ্ভুত। সেখানকার প্রধান একটি প্রাণীর ছবি তাঁকে এঁকে কেউ দেখায়। ইউরোপ এশিয়ার কোনও প্রাণীর সঙ্গে মিল তার কিছু হয়তো থাকলেও তা একেবারে স্বতন্ত্র।
এ দেশ কি শুধু এখানকার অজ্ঞ অধিবাসীদের কল্পনাতেই আছে!
যদি কল্পনারই হয় তবু বালবোয়া নিজে একবার তা যাচাই করে দেখবেন।
সুদৃঢ় সংকল্প আর গভীর আশা নিয়ে বালবোয়া তাঁর হর্তাকর্তা সোনার কাস্তিল-এর শাসক পেড্রারিয়াস-এর রাজধানী ডারিয়েন-এ ফিরে যান। তাঁর সব সংকল্প ব্যর্থ, সব আশা চূর্ণ হয়ে যায় পেড্রারিয়াস-এর নীচ পরশ্রীকাতরতায় আর সংকীর্ণতায়। পেড্রারিয়াস নতুন রাজ্য আবিষ্কারের গৌরব নিতে চায়, নিতে চায় সেখানে যা পাওয়া যায় সে সম্পদের সিংহভাগ, কিন্তু আর কারও, এমনকী অভিযানের সমস্ত দুর্ভোগ দায়িত্ব নিয়ে নির্বাসন বন্দিত্ব মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে যে প্রস্তুত তার, বিন্দুমাত্র সাধুবাদ সহ্য করতে পারবে না।
শাসকের সমর্থন ও অনুমতি ছাড়া কোনও অভিযান পরিচালনা করা অসম্ভব। এসপানিয়ার সম্রাট অনেক দূর অস্ত। ডারিয়েন-এ তাঁর প্রতিনিধি পেড্রারিয়াস।
বালবোয়া দিনের পর দিন বৃথাই তাঁর অনুমতির জন্য অপেক্ষা করেছেন। ইতিমধ্যে বালবোয়ার যুগান্তকারী আবিষ্কারের মূল্য পেড্রারিয়াস যে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন তা নয়। নতুন মহাসমুদ্রে আবিষ্কারের অভিযান চালাবার সুবিধার জন্যেই ১৫১৯-এ বালবোয়ারই পরামর্শ অনুসারে ডারিয়েন থেকে রাজধানী পশ্চিমের সমুদ্রকূলে পানামায় সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখান থেকে নতুন অজানা দেশ, বিশেষ করে সেই ভারতমুখী প্রণালী খোঁজার উদ্দেশ্যে জাহাজ সাজিয়েও বেরিয়েছেন অভিযাত্রীরা, কিন্তু সব অভিযানেরই মুখ উত্তরে। উত্তরে যোজকের ভেরাগুয়া, কোস্টারিকা, নাইকারগুয়া প্রভৃতি পর পর আবিষ্কৃত ও অধিকৃত হয়েছে।
শুধু দক্ষিণে কোনও অভিযান যায়নি।
বালবোয়া অন্যায়ে অবিচারে আশাভঙ্গের বেদনায় নিরুপায় হতাশায় ভেতরে ভেতরে জর্জর হয়ে একদিন মৃত্যুবরণ করেছেন।
সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ আবিষ্কারের ভাগ্য তাঁর হয়নি।
সে সৌভাগ্য হয়েছে তিনজনের মিলিত একটি দলের।
এ তিনজনের দু-জন রাস্তায় কুড়িয়া পাওয়া অনাথ শিশু হিসেবে বেশির ভাগ ইগ্নেসিয়া অর্থাৎ স্থানীয় গির্জার কৃপা করুণাতেই মানুষ। দু-জনেই এঁরা নিরক্ষর মূখ। একজন দেশে গাঁয়ে শুয়োর চরাতেন, আর-একজন কী করতেন সঠিক জানা না গেলেও ওর চেয়ে সম্মানের কিছু যে করতেন না সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
অজানা দেশ আবিষ্কারের অভিযাত্রী হওয়া জোয়ান তরুণদেরই কাজ। কিন্তু যাঁদের কথা বলেছি তাঁরা দু-জনে যখন প্রথম অভিযানে রওনা হন তখন দু-জনেরই বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে।
আধবুড়ো এই দুই নিরক্ষর ভাগ্যান্বেষীর পয়সার জোরও ছিল না। তাঁদের অভিযানের খরচ বইবার ভার দলের তৃতীয় যে জন নিয়েছেন তিনি হলেন একজন এসপানিওল ধর্মযাজক-পানামায় ভাইকার-এর কাজ করেন। তার আগে ডারিয়েন-এর গির্জায় গুরুমশাই ছিলেন ছাত্র পড়াবার।
এত টাকা তিনি পেলেন কোথায়?
আসলে টাকা তাঁরও নিজের নয়। তিনি আর-একজনের প্রতিনিধি হয়ে টাকাটা দিয়েছেন মাত্র।
কী নামে এঁরা সবাই পরিচিত? তখনকার সেই ছোট উপনিবেশের জগতেও গ্রাহ্য করবার মতো নাম কারও নয়। নেপথ্য থেকে যিনি সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে টাকা দিয়েছেন সেই আসল মহাজনের নাম লাইসেনসিয়েট গাসপের দে এসপিনা। যাঁর মারফত টাকাটা দেওয়া হয়েছে তিনি হলেন হার্নারেমন্ডো দে লুকে, দুই দুঃসাহসী আধবুড়ো অভিযাত্রীদের মধ্যে একজনের নাম দিয়েগো দে আলমিগরো আর অন্যজনের ফ্রানসিসকো পিজারো। মূর্খ নিরক্ষর অনাথ গির্জার দয়ায় মানুষ পিজারোই যেখানে তাঁর জন্ম স্পেনের সেই টুকসিল্লো শহরে যৌবন পর্যন্ত শুয়োর চরাতেন।
১৫২২ সালে তিনি পানামার রাস্তায় ঘাটে যাদের ছড়াছড়ি নতুন মহাদেশে ভাগ্যান্বেষে আসা সেই বাউণ্ডুলেদের একজন।
তাদেরই একজন বটে, কিন্তু কিছু বিশেষত্বের পরিচয় ইতিমধ্যেই তিনি দিয়েছেন। ১৫১০-এ নতুন মহাদেশের পথেঘাটে সোনা ছড়ানো গুজব শুনে ও বিশ্বাস করে আরও অনেকের মতো দেশ ছেড়ে তিনি অকূলে ঝাঁপ দিয়ে প্রথম হিসপানিওলায় এসে ঠেকেছিলেন। সেখান থেকে সোনার কাস্তিল-এর নরকে। কিন্তু এখানে অসামান্য অথচ একান্ত হতভাগ্য বালবেয়ার সঙ্গে পিজারোর যোগাযোগ হয়। বালবোয়ার সঙ্গেই ইউরোপের মানুষ হিসেবে প্রথম প্রশান্ত মহাসাগর দেখার সুযোগ তিনি পান। তারপর বালবোয়ার অকাল মৃত্যুর পর ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে আর একবার যোজকের পর্বতপ্রাকার ডিঙিয়ে মোরালেস নামে একজন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি সমুদ্রকূলের আদিম অধিবাসীদের কাছে দক্ষিণের রহস্যরাজ্যের আরও কিছু খবর সংগ্রহ করে আনেন।
১৫২২-এ পাসকুয়াল দে আন্দাগোয়া নামে আর-একজন অধিনায়কের নেতৃত্বে একটি অভিযান বালবোয়া যতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন সেই পুয়েরতো দে পিলিয়াস-এর বেশি অগ্রসর হতে না পারলেও সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের আরও বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে এসে প্রচার করে।
পানামা শহরের হাওয়ায় তখন সেই আশ্চর্য দেশ খুঁজতে বার হওয়ার ব্যাকুল উত্তেজনা। পথেঘাটে সকলের মুখে ওই বিষয়ে ছাড়া আলোচনা নেই।
কিন্তু ঘনরামও তো তখন ওই সোনার কাস্তিল-এর নরকে কোথাও না কোথাও আছেন!
হ্যাঁ, আছেন। ১৫২১-এ ভাগ্য ও সত্যিকার সমুদ্রের ঝড় তুফানের প্রচণ্ড ঢেউ তাঁকে নিয়ে কিছুকাল লোফালুফি করে এই পানামা যোজকেই আছড়ে ফেলে দিয়ে গেছল।
এখানে পানামায় যার বাড়িতে তিনি আশ্রয় পেয়েছেন তাঁর নাম আমরা একবার শুনেছি। তিনি মোরালেস। পিজারোর সঙ্গে ১৫১৫-তে তিনি পশ্চিমের অসীম মহাসমুদ্র দেখে এসেছেন।
তাঁর কাছে কাজ করতে করতে ঘনরাম সেই নতুন আবিষ্কৃত মহাসমুদ্র আর তার কূলে কোথাও যা এখনও নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে সেই বাস্তব স্বর্ণলঙ্কার কথা শুনেছেন।
১৫২২-এ পিজারো যখন তাঁর অভিযানের স্বপ্ন সার্থক হওয়া সম্বন্ধে কোনও আশাই রাখেন না, ঘনরাম তখনও ওই পানামা শহরেই আছেন।
পিজারোর সঙ্গে পথেঘাটে তাঁর দেখা হয়। দেখা হয় মোরালেস-এর বাড়িতেও।
পিজারো সেখানে যান। তাঁর সঙ্গে একটু বেঁটেখাটো শক্তসমর্থ আর-একজন আসেন। তখনও একটা চোখ অসাধ্য সাধনের ব্রতে তাঁকে নৈবেদ্য দিতে হয়নি। দেখতে পিজারোর মতো সুপুরুষ না হলেও কিছুক্ষণ লক্ষ করলেই তাঁর প্রাণখোলা চরিত্র ভাল লাগে। ইনিই পিজারোর বন্ধু দিয়েগো দে আলমিগরো।
পিজারো আর আলমাগরো মোরালেস-এর সঙ্গে একত্র হলেই অবশ্য যে দেশের রাস্তাঘাট সোনায় বাঁধানো, আর সোনার বাসন ছাড়া কেউ যেখানে অন্য কিছু ব্যবহার করে না, সেই দেশে অভিযানের আয়োজন কেমন করে করা যায় তারই আলোচনা করেন।
কিন্তু সে আলোচনা যেন বামন হয়ে চাঁদ পাড়বার ফন্দির আলোচনার মতো।
এ অভিযান সাজানো মানে চারটিখানি তো কথা নয়। ছোটখাটো হলেও অন্তত দুটো জাহাজ নিয়ে পাড়ি দিতেই হবে। কোথায় পাবেন সে জাহাজ কেনবার বা তৈরি করাবার খরচ? দুটি জাহাজের রসদ জোগাড় করার সমস্যা আছে তারপর, আর সেই সঙ্গে প্রায় শ-খানেক মাঝিমাল্লা সৈনিক।
এমনিতেই দেনার দায়ে তাঁদের চুলের টিকি পর্যন্ত বাঁধা। এত খরচের টাকা সুতরাং তাঁদের বেচলেও জুটবে না।
পিজারো তবু বলেন যে যেমন করে তোক অস্ত্রশস্ত্র গুলিবারুদ বন্দুকের খরচটা তিনি দিতে পারবেন। আলমাগরো জানান যে দুটি জাহাজে প্রয়োজনীয় রসদ বোঝাই করবার ভার নিতে প্রস্তুত।
কিন্তু লাগাম যাতে লাগাবেন সে ঘোড়া কোথায়? আসল যা দরকার সেই জাহাজ আসছে কোথা থেকে!
হঠাৎ পিজারো একদিন তাঁর বাসায় একটা চিঠি পান। অজানা কে একজন। লিখেছে তাঁকে উদ্দেশ করে।
পিজারো পড়তে জানেন না। চিঠি পড়তে তাঁকে মারলেস-এর কাছেই আসতে হয়েছে।
মোরালেস চিঠি পড়ে যা জানিয়েছেন তাতে অবাক হবারই কথা।
কে একজন অপরিচিত হিতৈষী পিজারোকে জানিয়েছে যে পানামার বন্দরে একটা জাহাজ খুলে রাখা অবস্থায় আছে। ভাস্কো নুনিয়েজ দে বালবোয়া নিজের ব্যবহারের জন্য এ জাহাজটি তৈরি করিয়েছিলেন। সূর্য কাঁদলে সোনার দেশেই এ জাহাজ নিয়ে অভিযান করার বাসনা তাঁর ছিল। সে বাসনা তাঁর পূর্ণ হয়নি। খুলে রাখা জাহাজটা বেশ সস্তা দরে পাওয়া যেতে পারে। সেটা জুড়ে নিয়ে ব্যবহারের যোগ্য করাও শক্ত নয়। পিজারো ও তাঁর বন্ধু এ জাহাজটার খোঁজ নিয়ে দেখুন না!
চিঠির তলায় কোনও নাম সই নেই। কে লিখল তাহলে এ চিঠি?
তাঁদের ভাবনা ভাববার এত মাথাব্যথা কার? ভেতরকার এত কথা আর কেউ জানলই বা কী করে?
তার ওপর বালবোয়া-র নিজের জন্যে তৈরি জাহাজটার ওই অবস্থার খবর তো তাঁরা নিজেরাই রাখেন না! কাস্তিল কি মাদ্রিদের মতো একটা বিরাট কিছু শহর নয়। অল্পবিস্তর সকলকেই সকলে এখানে চেনে। এত হুশিয়ার এবং তাঁদের হিতৈষী কারও কথা পিজারো কি আলমিগরো কি মোরালেস কেউই মনে করতে পারেন না।
তাজ্জবের ওপর তাজ্জব। খানিক বাদে মোরালেস-এর খোঁজে যিনি সেখানে এসে উপস্থিত হন, তাঁকে দেখে পিজারো ও মোরালেস দুজনেই একেবারে হতভম্ব।
স্বয়ং পানামার ভাইকার হার্নারেমন্ডো দে লুকে তাঁদের খোঁজে এখানে এসেছেন। তিনিও এসেছেন এক অচেনা বন্ধুর চিঠি পেয়ে। চিঠিতে তাঁকে মোরালেস-এর বাড়িতে অতি অবশ্য সেদিন সকালে একবার দেখা করতে অনুরোধ করা হয়েছে। দেখা করলে তাঁর নিজের যাতে বিশেষ উৎসাহ হতে পারে এমন একটি ব্যাপারের কথা তিনি জানতে পারবেন। অত্যন্ত দুঃসাধ্য ও দুঃসাহসিক একটি উদ্যোগ হয়তো তাঁরই সাহায্যে সার্থক হয়ে উঠতে পারে।
কী সে ব্যাপার আর উদ্যোগ দে লুকে-কে জিজ্ঞাসা করে তা জানতে হয়নি।
দুটি চিঠির লেখা মিলিয়ে দেখতে গিয়ে দুটি যে এক হাতের লেখা তা বোঝা। গেছে। ভাইকার দে লুকে-কে পিজারোর সঙ্গে দেখা করানোর চেষ্টার উদ্দেশ্যটাও বোঝা গেছে।
তাঁদের বিস্মিত উত্তেজিত আলোচনার মধ্যে আলামাগরো এসে পড়েছেন। তিনিও সব শুনে এ-চিঠি কে পাঠাতে পারে, ঠিক করতে পারেননি।
চিঠি যে-ই পাঠিয়ে থাক তার উদ্দেশ্য সফলই হয়েছে। মোরালেস-এর বাড়িতে ভবিষ্যতের তিন অংশীদারের যোগাযোগ ও আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে সেদিন থেকেই।
মোরালেস খুশি মনে সকলের জন্যে পানীয় আনবার হুকুম দিয়েছেন।
পানীয় এনে যে সসম্রমে সকলকে পরিবেশন করেছে তার দিকে কে আর নজর। দিয়েছে?
নজর এক-আধবার পড়লেও তাকে ঘনরাম বলে চিনবে কে? যে অচেনা হিতৈষীর চিঠি তাঁদের এইভাবে একত্র করেছে তা যে তাঁদের সামনে যথাবিহিত মাথা নুইয়ে দাঁড়ানো একজন ক্রীতদাসের লেখা, তাঁরা আর কী করে কল্পনা করবেন!
ক্রীতদাস! ঘনরাম দাস ক্রীতদাস! এবার শ্রীঘনশ্যামকে বাধা দিয়ে মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবুই তীক্ষ্ণ স্বরে তাঁর সংশয় প্রকাশ করেছেন, তা কী করে হয়?
হ্যাঁ, মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবুও তাঁকে সমর্থন করে বলেছেন, সেই সেনোরা আনা মজা করে ষড়যন্ত্রের মতলব নিয়ে আসার পর কোথায় কী যে হল কিছুই তো জানতে পারলাম না। সেনোরা আনা কীসের ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিল, তাতে হলই বা কী, কী এমন ভাগ্যের কারসাজিতে কীভাবে ঘনরাম আবার সেই ক্রীতদাস হয়ে পানামার মতো জায়গায় এসে ছিটকে পড়ল কিছুই তো জানতে পারলাম না।
পারবেন। সবই জানতে পারবেন। দাসমশাই উদারভাবে আশ্বাস দিলেন, কিন্তু তার জন্যে ধৈর্য ধরে একটু অপেক্ষা করতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের গৌরবের মধ্যাহ্নে হঠাৎ অবিশ্বাস্য কালরাত্রি যখন নেমে আসে তখন। অনাঘ্রাতা স্বর্গীয় কুসুমের মতো রহস্য-মাধুর্যমণ্ডিত সূর্য-সমর্পিতা এক অসূর্যম্পশ্যা রাজকুমারীর আশ্চর্য উদ্ধারের পর থেকে নারীমাংস লোলুপ নরপশুদের শাস্তি দিতে দুগ্ধ-ধবল তুরঙ্গবাহনে দেবাদিদেব ভীরাকোচারই যেন অলৌকিক আবির্ভাব পর্যন্ত শুধু নয়, ঘনরামের জীবনের হিংস্র পরম শনি মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর কুজকো শহরে বিচিত্র প্রেত-দর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে পানামা যোজকের পূর্ব উপকূলে নোৱে দে দিয়স বন্দরের অন্ধকার সমুদ্রে সেই অভাবিত চরম নাটকীয় হিসাবনিকাশ অবধি।
এর পর কারও মুখে কিছুক্ষণ আর কোনও কথা নেই। মর্মর-মসৃণ শিরোদেশের শিবপদবাবু পর্যন্ত তাঁর ঘূর্ণায়মান মাথাটাকে স্থির করবার চেষ্টা করেছেন। কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত সেই ভোজনবিলাসী রামশরণবাবু তো আগেই হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে বললেন, না মশাই, আমি ধৈর্য ধরে থাকতেই প্রস্তুত। এক চক্কর যা ঠেলা পেয়েছি তাতেই মাথাটার মধ্যে একটা ঘূর্ণি চলছে। এর ওপর আর এক পাক দিলে একেবারে কাত হয়ে পড়ব।
শিবপদবাবু সামান্য একটু প্রতিবাদের চেষ্টা করলেন তবু। বললেন, এত যে লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে গেলেন উনি, তা মনে করে কেউ রাখতে পারে!
মনে রাখবার আপনার খুব প্রয়োজন আছে কি! হেসে বললেন দাসমশাই, আমিই তো আছি তার জন্যে। যথাসময়ে সবই ঠিক মনে করিয়ে দেব। আর তাতে যদি শান্তি না পান, একটা খাতা-পেন্সিল নিয়ে আসবেন টুকে রাখার জন্যে।
খোঁচাটা হয়তো ইচ্ছে করে দেওয়া নয়। কিন্তু শিবপদবাবু একটু পালটা খোঁচাই দিলেন, টুকে রাখব? কেন আমাদের কি পরীক্ষা দিতে হবে নাকি!
না, দিতে হবে কেন, তার বদলে নিতেও তো পারেন! একটু হেসেই বললেন দাসমশাই, ঘনরাম দাসকে একটু বেকায়দায় যদি চেপে ধরতে পারেন তাই বা মন্দ কী? সোরাবিয়া থেকে মার্কুইস দে সোলিস, এমনকী স্বয়ং পিজারো পর্যন্ত, সেই চেষ্টাই করেছিল। কিন্তু সে পরের কথা। আপাতত তাঁকে মোরালেস-এর বাড়িতে ক্রীতদাস হিসেবে দেখেই আমাদের উঠতে হয়।
শ্রীঘনশ্যাম দাস আসর ভেঙে উঠলেন। তাঁর সঙ্গে আর সবাই।
রাত বেশ হয়েছে। সরোবরের তীরে তীরে মশলামুড়ির মাহাত্ম্য আর তেমন ঘন-ঘন ঘঘাষিত হচ্ছে না। আইসক্রিম ফেরিওয়ালারাও অদৃশ্য।
আমাদের পরিচিত সরোবর-সভা ভাঙবার পরই একটা ঝিঝি হঠাৎ একটানা তীব্র ঘর্ষণ ধ্বনিতে সকলকে চমকে দিলে।
এতক্ষণ দাসমশাই-এর জন্যেই সে যেন সাড়া দিতে সাহস করেনি।