[Historical Evolution of India—প্রবন্ধের অনবাদ ]
ওঁ তৎ সৎ।
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়।
নাসতো সদ্ জায়েত।
অনস্তিত্ব হইতে কোন অস্তিত্বের উদ্ভব সম্ভব নহে। যাহা ‘অসৎ’, তাহা কোন সদ্বস্তুর হেতুও হইতে পারে না। শূন্যতা হইতে কোন বস্তু জাত হয় না।
কার্য-কারণ-নিয়ম আর্যজাতিরই মত সুপ্রাচীন। এই নিয়ম সর্বশক্তিমান্, কোন দেশ বা কালের সীমায় ইহা আবদ্ধ নয়। প্রাচীন ঋষি-কবিগণ ইহার মহিমা কীর্তন করিয়াছেন, দার্শনিকগণ ইহা প্রণয়ন করিয়াছেন, এবং ইহাকেই ভিত্তিরপ্রস্তররূপে স্বীকার করিয়া আজ পর্যন্ত হিন্দুজাতি তাহার জীবন-দর্শন রচনা করিয়া চলিয়াছে। …
যুগ-প্রারম্ভে জাতির মনে ছিল কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা। অল্পকাল মধ্যে সেই জিজ্ঞাসাই বলিষ্ঠ বিশ্লেষণে পরিণতি লাভ করে এবং যদিও আদিযুগের প্রথম-প্রয়াসের মধ্যে কাঁচা-হাতের অপরিণত স্বাক্ষর ছিল—যেমন থাকে সুদক্ষ স্থপতির প্রাথমিক সৃষ্টির মধ্যে, তথাপি নির্ভীক উদ্যম ও নিখুঁত বৈজ্ঞানিক প্রণালীর মধ্য দিয়া সে এক বিস্ময়কর ফল প্রসব করিয়াছিল।
এই জিজ্ঞাসার সাহস আর্য-ঋষিদিগকে নিয়োজিত করিয়াছিল যজ্ঞবেদীর প্রতিটি ইষ্টকখণ্ডের স্বরূপ-অনুসন্ধানে, উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল শাস্ত্রের প্রতিটি শব্দের মাত্রানির্ণয়ে ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে কিংবা ঐগুলির পুনর্বিন্যাসে। ইহারই প্রেরণায় পূজা-উৎসবাদির তাৎপর্য সম্পর্কে কখনও তাঁহারা সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন, কখনও ঐগুলির ব্যাখ্যায় বা বিশ্লেষণে অগ্রসর হইয়াছিলেন, কখনও বা সেগুলি একেবারে বর্জন করিয়াছিলেন।
এই অনুসন্ধিৎসার ফলে প্রচলিত দেবতাবর্গকে নূতন করিয়া ঢালিয়া সাজা হইয়াছিল এবং সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান্ বিশ্বস্রষ্টারূপে যিনি কীর্তিত, যিনি পিতৃপুরুষের স্বর্গীয় পিতা—তাঁহার জন্য হয় একটি দ্বিতীয় পর্যায়ের স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছিল, অথবা এককালে অপ্রয়োজনীয় বোধে তাঁহাকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া, তাঁহাকে বাদ দিয়াই এক সার্বভৌম ধর্ম প্রবর্তিত হইয়াছিল, সকল ধর্ম অপেক্ষা সেই ধর্মের অনুগামীর সংখ্যা আজও সর্বাধিক।
ইহারই অনুপ্রেরণায় যজ্ঞবেদীর ইষ্টকস্থাপন-ব্যবস্থা হইতে জ্যামিতি-বিজ্ঞানের উদ্ভব হইয়াছিল। আবার পূজা-উপাসনার যথাযথ কাল-নির্ণয়ের চেষ্টা হইতেই উদ্ভূত হইয়াছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান, যাহা সকলকে বিস্মিত করিয়াছিল।
ঐ অনুসন্ধিৎসা হইতেই অঙ্কশাস্ত্রে তাঁহাদের দান প্রাচীন অথবা আধুনিক যে-কোন জাতির দান অপেক্ষা অধিকতর হইয়াছিল এবং রসায়নশাস্ত্রে ধাতুঘটিত ঔষধ প্রস্তুত করিবার অভিজ্ঞতায়, সঙ্গীতের সুরগ্রাম-নির্ধারণে, বেহালা-জাতীয় তারযন্ত্রের উদ্ভাবন প্রভৃতিতে তাঁহাদের যে-প্রতিভা, তাহাই আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা গড়িয়া তুলিতে প্রভূত সাহায্য করিয়াছিল। এই অনুসন্ধিৎসা হইতেই বিচিত্র গল্প ও উপাখ্যানের সাহায্যে অপরিণত শিশুমন গড়িয়া তুলিবার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হইয়াছিল এবং আজও পৃথিবীর সর্বদেশে শৈশবের শিক্ষায়তনে শিশুগণ ঐ-সকল গল্পই শিখিয়া থাকে, আর ঐগুলির মধ্য দিয়াই জীবনের পটে সুস্পষ্ট ছাপ গ্রহণ করে।
এই তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ-শক্তির সম্মুখে এবং পশ্চাতে যেন একটি কোমল ও মসৃণ আচ্ছাদন ছিল এবং তাহারই মধ্যে সুরক্ষিত ছিল এই জাতির অপর একটি মানসিক বৈশিষ্ট্য—যাহাকে ‘কবির অন্তর্দৃষ্টি’ বলিয়া অভিহিত করা যাইতে পারে। এই জাতির ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, নীতিশাস্ত্র, পৌরবিজ্ঞান প্রভৃতি সব কিছুই যেন কবিকল্পনার পুষ্পবেদীতে স্থাপিত ছিল এবং সেগুলিকে অন্য যে-কোন ভাষা অপেক্ষা সুন্দরভাবে প্রকাশ করিয়াছিল এক বিচিত্র ভাষা—যাহার নাম ‘সংস্কৃত’ বা ‘পূর্ণাঙ্গ’ ভাষা। এমন কি গণিতের কঠিন সংখ্যাতত্ত্বসমূহ প্রকাশ করিতেও ছন্দোবদ্ধ শ্লোক ব্যবহৃত হইয়াছিল।
সেই বিশ্লেষণশক্তি এবং নির্ভীক কবিকল্পনা, যাহা ঐ শক্তিকে প্রেরণা দিত—এই দুইটি অভ্যন্তরীণ কারণই হিন্দুর জাতীয় চরিত্রের প্রধান সুর, ঐ দুইটি সমন্বিত শক্তির বলেই আর্যজাতি চিরদিন ইন্দ্রিয়-স্তর হইতে অতীন্দ্রিয় স্তরের দিকে গতিশীল, এবং ইহাই এই জাতির দার্শনিক চিন্তাধারার গোপন রহস্য; ইহা দক্ষকারিগর-নির্মিত ইস্পাত-ফলকের ন্যায়, যাহা লৌহদণ্ডকে ছেদন করিতে পারে, আবার বৃত্তাকারে রূপায়িত হইবার মত নমনীয়ও বটে।
স্বর্ণ ও রৌপ্যপাত্রে তাহারা ছন্দ-গাথা উৎকীর্ণ করিয়াছিল। মণি-মাণিক্যের ঐক্যতানে, মর্মর-প্রস্তরের বহু বিচিত্র স্থাপত্যে, বর্ণ-সুষমার সঙ্গীতে এবং সূক্ষ্ম বস্ত্রশিল্পের সৃষ্টিতে—যে-সৃষ্টি এই জগতের বাহিরে অন্য এক রূপকথার জগতের বলিয়া মনে হইত, সব কিছুর পশ্চাতে এই জাতির চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের সহস্রবর্ষব্যাপী সাধনা নিহিত ছিল।
কলা, বিজ্ঞান, এমন কি প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা পর্যন্ত—সব কিছু এমন ছন্দোময় ভাবদ্বারা মণ্ডিত ছিল যে, চরমে ইন্দিয়ানুভূতি অতীন্দ্রিয় স্তরে উত্তীর্ণ হইত, স্থূল বাস্তবতা সূক্ষ্ম অবাস্তবতার রঙিন আভায় অনুরঞ্জিত হইয়া উঠিত।
এ-জাতির দূর-অতীত ইতিহাসের যতটুকু আভাস পাওয়া যায়, তাহা হইতে বুঝা যায়, সেই আদিমযুগেই—ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োগ করিবার যন্ত্র-হিসাবে এই বৈশিষ্ট্য তাহাদের আয়ত্তে ছিল। বেদ-গ্রন্থে এই জাতির জীবনাখ্যায়িকা চিত্রিত হইবার পূর্বে চলার পথে বহু প্রকারের ধর্ম ও সমাজ পশ্চাতের পথরেখায় নিশ্চয়ই বিলুপ্ত হইয়াছিল।
সেখানে দেখা যায়—এক সুসংবদ্ধ দেবতামণ্ডলী, উৎসবাদির বিস্তারিত ব্যবস্থা, ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তির তাগিদে গঠিত বংশানুক্রমিক একটি সমাজ। সেখানে ইতিমধ্যেই অনেক প্রয়োজনীয় ও বিলাসের সামগ্রী বর্তমান।
আধুনিক পণ্ডিতগণের প্রায় সকলেই এ-বিষয়ে একমত যে, ভারতীয় জলবায়ু এবং ভারতে প্রচলিত রীতিনীতি তখনও এই জাতির উপর তেমন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই।
আরও কয়েক শতাব্দী অতিক্রান্ত হইল। তখন দেখা গেল এক মানবগোষ্ঠী, তাহাদের উত্তরে তুষারাচ্ছন্ন হিমালয়, দক্ষিণে দক্ষিণাপথের উষ্ণতা—মধ্যে দিগন্তবিস্তীর্ণ সমতল, সীমাহীন অরণ্য-অঞ্চল, আর তাহাদেরই মধ্য দিয়া দুর্বারগতি নদীসমূহ প্রচণ্ড স্রোতে প্রবাহিত। তাতার, দ্রাবিড়, আদিবাসী প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির ক্ষণিক আভাস পাওয়া যায়; শেষে দেখা যায় ইহাদেরই শোণিতধারা, ভাষা ধর্ম ও আচার-পদ্ধতির নির্ধারিত অংশ-সংযোগে ধীরে ধীরে আর্যদেরই অনুরূপ আর এক মহান্ জাতির উদ্ভব হইয়াছে, যাহারা আরও শক্তিশালী—উদার অঙ্গীভূত-করণের ফলে অধিকতর সম্বদ্ধ।
আরও দেখা যায়, এই কেন্দ্রীয় গোষ্ঠী গ্রহণ-শক্তির প্রভাবে সমগ্র দেশের জনসাধারণের উপর স্বকীয় চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের ছাপ অঙ্কিত করিয়াও বিশেষ গর্বের সঙ্গে নিজেদের ‘আর্য’-পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছে এবং অপরাপর জাতিকে নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতির সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করিতে সম্মত হইয়াও আর্যজাতির অন্তরঙ্গ-গোষ্ঠীর মধ্যে কাহাকেও গ্রহণ করিতে সম্মত নয়।
ভারতীয় আবহাওয়া এই জাতির প্রতিভাকে উন্নততর লক্ষ্যে চালিত করিয়াছিল। এ দেশের প্রকৃতি ছিল কল্যাণময়ী, পরিবেশ ছিল আশু ফলপ্রসূ। সুতরাং জাতির সমষ্টি-মন সহজেই উন্নত চিন্তাক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইয়া জীবনের বৃহত্তম সমস্যাসমূহের মুখোমুখি দাঁড়াইয়াছিল এবং সেইগুলিকে জয় করিতে সচেষ্ট হইয়াছিল। ফলে দার্শনিক এবং পুরোহিত ভারতীয় সমাজে সর্বোচ্চ আসন লাভ করিয়াছিলেন, অস্ত্রধারী ক্ষত্রিয় নয়।
পুরোহিতগণ আবার ইতিহাসের সেই আদিমযুগেই পূজা-অর্চনার বিস্তারিত বিধিনিয়ম-প্রণয়নে নিজেদের শক্তি নিয়োজিত করিয়াছিল। পরে কালক্রমে, যখন সে-সকল প্রাণহীন অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকর্মের বোঝা জাতির পক্ষে অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছিল, তখনই দার্শনিক চিন্তা দেখা দিল, এবং ক্ষত্রিয়েরাই প্রথম মারাত্মক আচার-অনুষ্ঠানের বেড়াজাল ছিন্ন করিয়াছিল।
সে এক দ্বন্দ্বের কাল। …
একদিকে পুরোহিতকুলের অধিকাংশ আর্থিক প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হইয়াই শুধু সেই ক্রিয়াকর্মকেই সমর্থন করিত, যেগুলির জন্য সমাজব্যবস্থায় তাহারা অপরিহার্য এবং সর্বোচ্চ মর্যাদা তাহাদের প্রাপ্য। আবার অন্যদিকে যে রাজন্যবর্গের শক্তি ও শৌর্যই জাতিকে রক্ষা করিত—পরিচালিত করিত এবং যাঁহাদের নেতৃত্ব তখন উচ্চ মননক্ষেত্রেও প্রসারিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে, তাঁহারা শুধু ক্রিয়ানুষ্ঠানদক্ষ পুরোহিতবর্গকে সমাজের সর্বোচ্চ স্থান ছাড়িয়া দিতে আর সম্মত ছিলেন না। আরও একদল ছিল, পুরোহিতকুল ও রাজকুল—উভয় হইতে যাহারা উদ্ভূত, তাহারা পুরোহিত এবং দার্শনিক দুই শ্রেণীকেই বিদ্রূপ করিত, অধ্যত্মবাদকে ধাপ্পাবাজি ও বুজরুকি বলিয়া অভিহিত করিত এবং জাগতিক সম্ভোগকেই জীবনের সর্বোত্তম কাম্যবস্তু বলিয়া ঘোষণা করিত। ইহারাই জড়বাদী।
সাধারণত মানুষ তখন ধর্মের প্রাণহীন আচার-অনুষ্ঠানে ক্লান্ত এবং দার্শনিক ব্যাখ্যার জটিলতায় বিভ্রান্ত; কাজেই তাহারা দলে দলে এই জড়বাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়াছিল। শ্রেণীগত সমস্যার সূচনা তখন হইতেই, এবং ভারতভূখণ্ডে আনুষ্ঠানিক ধর্ম, দার্শনিকতা ও জড়বাদের মধ্যে যে ত্রিমুখী বিরোধ আরম্ভ হইয়াছিল, তাহা আজ পর্যন্ত অমীমাংসিত রহিয়া গিয়াছে।
এ বিরোধের প্রথম সমাধান-প্রচেষ্টা শুরু হয় ভাব-সমীকরণের সূত্র অনুসরণ করিয়া, ইহাই স্মরণাতীত কাল হইতে জনসাধারণকে একই সত্য বিভিন্নভাবে দেখিতে শিখাইয়াছিল।
এই চিন্তাধারার মহান্ নেতা ক্ষত্রিয় শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। তাঁহারই উপদেশ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। জৈন, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য বহু সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থানের ও বিপর্যয়ের পর অবশেষে শ্রীকৃষ্ণ অবতাররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন এবং যথার্থ জীবনদর্শন-রূপে ‘গীতা’ স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল।
বর্ণাধিকারে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করিবার জন্য রাজন্যবর্গের যে দাবী এবং পুরোহিতকুলের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বিরুদ্ধে জনসাধারণের বিক্ষোভ-জনিত যে উত্তেজনা, তাহা সাময়িকভাবে প্রশমিত হইলেও তাহার মূলীভূত হেতু যে সামাজিক বৈষম্য, তাহা তখনও দূর হইল না, রহিয়াই গেল। শ্রীকৃষ্ণ জাতিনির্বিশেষে সকলের সম্মুখে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে অনুরূপ সমস্যা তিনি স্পর্শ করেন নাই। সকলের সামাজিক সাম্যের জন্য বৌদ্ধ বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বিপুল সংগ্রাম সত্ত্বেও সেই অমীমাংসিত সমস্যা আমাদের কাল পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছিয়াছে।
তাই দেখা যায়, বর্তমান কালের ভারতবর্ষে মানুষের আধ্যাত্মিক সমতা স্বীকৃত হইলেও সামাজিক বৈষম্য দৃঢ়ভাবে রক্ষিত হইতেছে। আমরা দেখিতে পাই, সেই সামাজিক বৈষম্যের বিরোধ খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে নূতন শক্তি লইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে শাক্যমুনি বুদ্ধদেবের নেতৃত্ব প্রাচীন আচার-ব্যবস্থাদি একেবারে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছিল। সেই সময় বিশেষ-অধিকারভোগী পুরোহিতবর্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধগণ প্রাচীন বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি পর্যন্ত দূরে নিক্ষেপ করিয়াছিল, বৈদিক দেবতাদিগকে বৌদ্বাচার্যগণের ভৃত্যশ্রেণীতে অবনমিত করিয়াছিল; সেইসঙ্গে এই কথা ঘোষণা করিয়াছিল যে, ‘স্রষ্টা’ বা ‘সর্বনিয়ন্তা’ বলিয়া কিছু নাই, উহা পুরোহিতগণের আবিষ্কার অথবা কুসংস্কার মাত্র।
পূজানুষ্ঠানে পশুবলি নিবারণ করিয়া, বংশগত জাতিভেদ ও পুরোহিতকুলের আধিপত্য লুপ্ত করিয়া এবং আত্মার নিত্যত্বে অবিশ্বাস করিয়া বৌদ্ধধর্মের লক্ষ্য ছিল বৈদিক ধর্মের সংস্কার করা। বৌদ্ধধর্ম কখনও হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করিতে চাহে নাই, প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত করিতে চাহে নাই। বৌদ্ধগণ একদল ত্যাগী সাধুকে একটি সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ে সুগঠিত করিয়াছিল, কতিপয় ব্রহ্মবাদিনী নারীকে সন্ন্যাসিনীরূপে গড়িয়া তুলিয়াছিল, আর যজ্ঞবেদীর স্থানে সিদ্ধ মহাপুরুষের প্রতিমূর্তি স্থাপন করিয়াছিল। এই ভাবেই প্রাণশক্তিসম্পন্ন একটি পদ্ধতি প্রবর্তিত হইয়াছিল। …
খুব সম্ভব এই সংস্কারকগণ দীর্ঘকাল ধরিয়া ভারতের জনসাধারণের আনুগত্য লাভ করিয়াছিলেন, এবং যদিও প্রাচীন শক্তিসমূহ কখনই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়ে নাই, তথাপি বৌদ্ধপ্রাধান্যের কালে তাহাদের মধ্যে প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হইয়াছিল।
প্রাচীন ভারতবর্ষের সর্বযুগেই মননশীলতা ও আধ্যাত্মিকতা জাতির প্রাণকেন্দ্র ছিল, রাজনীতি নয়। বস্তুতঃ আধুনিক কালের মত প্রাচীনকালেও রাজনীতিক ও সামাজিক ক্ষমতা—আধ্যাত্মিক সাধনা ও বিদ্যাবুদ্ধি-চর্চার নিম্নে স্থান পাইত। মুনি-ঋষি এবং আচার্যগণ যে-সকল শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করিতেন, সেগুলিকে অবলম্বন করিয়াই জাতীয় জীবন উচ্ছ্বসিত হইত।
সেইজন্য দেখা যায়, পাঞ্চাল বারাণসী ও মিথিলাবাসীদের সমিতিগুলি অধ্যাত্ম-সাধনা ও দার্শনিক উৎকর্ষের মহান্ কেন্দ্ররূপে গড়িয়া উঠিয়াছিল। কালক্রমে আবার এগুলিই আর্যসমাজের বিভিন্ন দল-উপদলের পক্ষে রাজনীতিক উচ্চাভিলাষ-পূরণের কর্মকেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল।
আধিপত্য লাভের জন্য কুরু-পাঞ্চাল যে-যুদ্ধে পরস্পরকে ধ্বংস করিয়াছিল, সে-যুদ্ধের ইতিহাস প্রাচীন মহাকাব্য ‘মহাভারতের’ মাধ্যমে আমরা পাইয়াছি। পূর্বাঞ্চলে মগধ ও মিথিলাকে ঘিরিয়াই আধ্যাত্মিক প্রাধ্যান্য আবর্তিত হইয়াছিল এবং কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধের অবসানে মগধের রাজশক্তি কতকটা প্রাধান্য লাভ করে।
এই পূর্বাঞ্চলই বৌদ্ধদিগের প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল এবং সেখানেই তাহাদের সংস্কারমূলক কার্যাবলী অনুষ্ঠিত হয়। আবার যখন মৌর্য নরপতিগণ সম্ভবতঃ নিজেদের ক্ষতিকর কুলকলঙ্কচিহ্ন স্খালন করিবার জন্য বাধ্য হইয়া ঐ নূতন আন্দোলনকে—শুধু সমর্থন নয়—পরিচালিতও করিয়াছিলেন, তখন নূতন পুরোহিত-শক্তি পাটলিপুত্রের রাজশক্তির সহিত হাত মিলাইয়াছিল।
একদিকে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা এবং নূতন প্রাণশক্তি যেমন মৌর্য রাজন্যবর্গকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সম্রাট্রূপে গৌরবান্বিত করিয়াছিল, অন্যদিকে তেমনি মৌর্যরাজশক্তির সাহায্যেই বৌদ্ধধর্ম সমগ্র বিশ্বে প্রসার লাভ করিয়াছিল এবং আজ পর্যন্ত তাহার চিহ্ন আমরা দেখিতে পাইতেছি। …
এ কথা অবশ্য সত্য যে, প্রাচীন বৈদিক ধর্মের বর্জনশীলতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ বাহিরের কোন সাহায্য গ্রহণে তাহাকে নিবৃত্ত করিয়াছিল। ইহারই ফলে বৈদিক ধর্ম যেমন শুচিতা রক্ষা করিতে পারিয়াছিল, তেমনি অনেক হীন প্রভাব হইতেও নিজেকে মুক্ত রাখিতে সমর্থ হইয়াছিল। কিন্তু প্রচারের অতি উৎসাহে বৌদ্ধধর্মের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় নাই।
অত্যধিক গ্রহণ প্রবণতার জন্য বৌদ্ধধর্ম কালক্রমে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবটুকুই হারাইয়া ফেলে, এবং জনপ্রিয়তার চরম আগ্রহে কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই মূল বৈদিক ধর্মের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা আর তাহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বৈদিক সম্প্রদায় ইতিমধ্যে পশুবলি প্রভৃতি বহু অবাঞ্ছিত আচার-অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করিয়াছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বৌদ্ধধর্মের উদাহরণ হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিয়া, বিশেষ বিবেচনার সহিত মূর্তি-উপাসনা, মন্দিরে শোভাযাত্রা প্রভৃতি জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবাদির প্রভূত পরিবর্তন সাধন করিয়া যথাসময়ে পতনোন্মুখ ভারতীয় বৌদ্ধধর্মকে এককালে নিজ আবেষ্টনীর মধ্যে গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল।
সীথিয়ানদের ভারতাক্রমণ এবং পাটলিপুত্র-সাম্রাজ্যের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সব যেন হুড়মুড় করিয়া ভাঙিয়া গেল। এই আক্রমণকারীর দল নিজেদের বাসভূমি মধ্য-এশিয়ায় বৌদ্ধ প্রচারকদের আক্রমণে ইতঃপূর্বে ক্রোধদীপ্ত হইয়াছিল। এখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের সূর্যোপাসনার সহিত নিজেদের সৌরধর্মের প্রভূত সাদৃশ্য তাহারা লক্ষ্য করিল এবং যখন ব্রাহ্মণগণ তাহাদের বহু আচারপদ্ধতি নিজেদের ধর্মের অঙ্গীভূত করিয়া গ্রহণ করিতে সম্মত হইল, তখন সহজেই তাহারা ব্রাহ্মণদের পক্ষ অবলম্বন করিল।
তারপরই এক অন্ধকারময় যুগের কৃষ্ণ যবনিকা নামিয়া আসিল—যাহার দীর্ঘ ছায়া ক্ষণে ক্ষণে ইতস্ততঃ প্রসারিত। কখনও যুদ্ধের কোলাহল ও আর্তনাদ, কখনও ব্যাপক নরহত্যার জনশ্রুতি—এই ছিল সে-কালের পরিস্থিতি, আর তাহার অবসানে এক নূতন অবস্থায় নূতন দৃশ্যের সূচনা হইয়াছিল।
তখন আর মগধ-সাম্রাজ্য নাই। প্রায় সমগ্র উত্তর-ভারত পরস্পর-বিবদমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্তরাজ কর্তৃক শাসিত হইতেছে। পূর্বাঞ্চলে ও হিমালয়ের সন্নিহিত কোন কোন প্রদেশে এবং সুদূর দক্ষিণে ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম তখন লুপ্তপ্রায়। আর সেই পরিস্থিতির মধ্যেই বংশানুক্রমিক পুরোহিত-শক্তির সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রামের পর জাতি জাগিতেছে; জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, জাতির জীবন একদিকে বংশগত ব্রাহ্মণের, অন্যদিকে নবযুগের বর্জনশীল সন্ন্যাসীর—এই দ্বিবিধ পৌরোহিত্যের কবলে; এই সন্ন্যাসি-সম্প্রদায় বৌদ্ধসংগঠনী-শক্তির অধিকারী হইলেও বৌদ্ধদের মত জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল না।
ইহার পর প্রাচীনের ধ্বংসস্তূপ হইতেই নবজাগ্রত ভারতবর্ষের অভ্যুত্থান হইয়াছিল। নির্ভীক রাজপুত-জাতির বীর্যে ও শোণিতের বিনিময়ে সে ভারতবর্ষের জন্ম, মিথিলার সেই ঐতিহাসিক জ্ঞানকেন্দ্রের নির্মম ক্ষুরধারবুদ্ধি জনৈক ব্রাহ্মণ কর্তৃক সেই নবভারতের স্বরূপ ব্যাখ্যাত; আচার্য শঙ্কর এবং তাঁহার সন্ন্যাসিসম্প্রদায়-প্রবর্তিত এক নূতন দার্শনিক ভাবের দ্বারা সেই ভারত পরিচালিত এবং মালবের সভাকবি ও সভাশিল্পিবৃন্দের সাহিত্য ও শিল্পদ্বারা সে-ভারত সৌন্দর্যমণ্ডিত।
নবজাগ্রত ভারতের সম্মুখে দায়িত্ব ছিল গুরুতর, সমস্যা ছিল বিরাট, যে-সমস্যা পূর্বপুরুষদের সম্মুখেও কখনও উপস্থিত হয় নাই।
তুলনীয় অবস্থাটি ছিল এইরূপঃ প্রথম যুগের একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও সংহত জাতি; একই রক্তস্রোত যাহাদের মধ্যে প্রবাহিত, যাহাদের ভাষা এবং সামাজিক আকাঙ্ক্ষা-অভিলাষ এবং দুর্লঙ্ঘ্য প্রাকারবেষ্টনীর অন্তরালে নিজেদের ঐক্য-সংরক্ষণে যাহারা নিয়ত যত্নশীল—সেই জাতিই বৌদ্ধপ্রাধান্যের কালে বহু সংযোজন ও বিস্তারের ফলে এক বিপুল আয়তন লাভ করিয়াছিল। আবার বর্ণ, ভাষা, ধর্মসংস্কার, সামাজিক উচ্চাভিলাষ প্রভৃতি বিপরীত প্রভাবে সেই জাতিই বহু বিবদমান গোষ্ঠীতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল। এখন সেইগুলিকে একটি বিরাট সঙ্ঘবদ্ধ জাতিতে গড়িয়া তোলাই এক প্রকৃত সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। বৌদ্ধগণও অবশ্য এই সমস্যার সমাধানে অগ্রসর হইয়াছিলেন, কিন্তু তখন তাহার আয়তন ও গুরুত্ব এত বিস্তৃত ছিল না। তখন পর্যন্ত প্রশ্ন ছিল—আর্যজাতিভুক্ত হইবার জন্য যে-সকল মানবগোষ্ঠী আগ্রহান্বিত, তাহাদিগকে স্বকীয় সংস্কৃতিতে অনুপ্রাণিত করিয়া বহুবিচিত্র উপাদান-সমন্বিত এক বিরাট আর্যদেহ গড়িয়া তোলা। … বিশেষ সুবিধাদানের এবং আপসের মনোভাব সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম প্রভূত সাফল্য অর্জন করিয়াছিল, এবং ভারতবর্ষের জাতীয় ধর্মরূপে বিরাজিত ছিল। কিন্তু কালক্রমে তাহাদের ইতরজাতি-সুলভ ইন্দ্রিয়াসক্তিবহুল উপাসনার প্রলোভন আর্যগোষ্ঠীর অস্তিত্বের পক্ষেই মারাত্মক হইয়া উঠিয়াছিল, এবং সে সংযোগ দীর্ঘতর কালের জন্য স্থায়ী হইলে আর্যসভ্যতা নিঃসন্দেহে বিনষ্ট হইত। ইহার পর স্বভাবতই আত্মরক্ষার একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এবং নিজবাসভূমিতে স্বতন্ত্র ধর্মসম্প্রদায়রূপে বৌদ্ধধর্ম আর টিকিয়া থাকিতে পারে নাই।
সেই প্রতিক্রিয়া-আন্দোলন উত্তরে কুমারিল ভট্ট এবং দক্ষিণ আচার্য শঙ্কর ও রামানুজ কর্তৃক পরিচালিত হইয়া বহু মত, বহু সম্প্রদায়, বহু পূজাপদ্ধতি পুঞ্জীভূত হইয়া হিন্দুধর্মে তাহার শেষ রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। বিগত সহস্র বৎসর কিংবা তদপেক্ষা অধিক কাল ধরিয়া এই অঙ্গীভূত করাই ছিল তাহার প্রধান কাজ। মাঝে মাঝে দেখা দিত সাময়িক সংস্কার-আন্দোলন।
এই প্রতিক্রিয়া প্রথমতঃ বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানগুলির পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা করিয়াছিল। পরে তাহাতে ব্যর্থ হইয়া বেদের দার্শনিক ভাগ বা উপনিষদসমূহকেই ভিত্তিরূপে স্থাপন করিয়াছিল।
এই আন্দোলন ব্যাসদেবের মীমাংসা-দর্শন এবং শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ গীতাকে পুরোভাগে স্থাপন করে এবং পরবর্তী কালের যাবতীয় আন্দোলন ঐ পন্থা অবলম্বন করিয়াই অগ্রসর হইয়াছিল। শঙ্করাচার্যের আন্দোলন অতি উচ্চ জ্ঞানমার্গেই চালিত হইয়াছিল। কিন্তু জাতিভেদে অতিনিষ্ঠা, সহজ ভাবাবেগ সম্পর্কে ঔদাসীন্য এবং শুধু সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে প্রচার—এই ত্রিবিধ কারণে জনসাধারণের মধ্যে সে-আন্দোলন বিশেষ ফলপ্রসূ হয় নাই। অন্যদিকে রামানুজ একটি অত্যন্ত কার্যকর ও বাস্তব মতবাদের ভিত্তিতে এবং ভাব-ভক্তির বিরাট আবেদন লইয়া অগ্রসর হইয়াছিলেন। ধর্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে জন্মগত জাতিবিভাগ তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিলেন, সর্বসাধারণের কথ্যভাষাই ছিল তাঁহার প্রচারের ভাষা। ফলে জনসাধারণকে বৈদিক ধর্মের আবেষ্টনীতে ফিরাইয়া আনিতে রামানুজ সম্পূর্ণভাবে সফল হইয়াছিলেন। উত্তরাঞ্চলে সে প্রতিক্রিয়ার পরেই মালব সাম্রাজ্যের সাময়িক গৌরবদীপ্তি দেখা দিয়াছিল। কিন্তু অতি অল্পকাল মধ্যেই তাহার অবসান ঘটিলে উত্তর-ভারত যেন দীর্ঘকালের জন্য গাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন হইল। আর সে-নিদ্রা রূঢ়ভাবে ভাঙিয়াছিল আফগানিস্তানের গিরিবর্ত্ম দিয়া সবেগে সম্মুখে ধাবমান মুসলমান অশ্বারোহিদলের বজ্রনিনাদে।
যাহা হউক, দক্ষিণাঞ্চলে শঙ্কর ও রামানুজের অভ্যুদয়ের পরই এ-দেশের স্বাভাবিক নিয়মানুসারে একতাবদ্ধ জাতি ও শক্তিশালী সমাজ্রের উদ্ভব হইয়াছিল। কাজেই দক্ষিণ-ভারতই তখন ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির আশ্রয়ভূমি হইয়া উঠিয়াছিল; আর, এক সমুদ্রতীর হইতে অন্য সমুদ্রতীর পর্যন্ত বিস্তৃত সমগ্র উত্তর-ভারত—মধ্য-এশিয়ার বিজেতাদের পাদমূলে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল।
দক্ষিণ-ভারতকে পদানত করিবার জন্য মুসলমানগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু সে-অঞ্চলের কোথাও একটি শক্ত ঘাঁটিও স্থাপন করিতে পারে নাই। বস্তুতঃ সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী মোঘল সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-বিজয় যখন প্রায় সমাপ্তির মুখে, ঠিক তখনই সেই ভূখণ্ডের পার্বত্যপ্রদেশ হইতে, মালভূমির নানা প্রান্ত হইতে কৃষকগণ অশ্বারোহী যোদ্ধৃবেশে দলে দলে কাতারে কাতারে রণক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। রামদাস-প্রচারিত, তুকারাম-সমুদ্গীত ধর্মের জন্য তাহারা প্রাণ বিসর্জন দিতে কৃতসঙ্কল্প; এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল মোগল সাম্রাজ্য নামমাত্রে পর্যবসিত হইল।
মুসলমানযুগে উত্তর-ভারতে বিজয়ী জাতির ধর্মে দীক্ষা-গ্রহণ হইতে জনসাধারণকে নিবৃত্ত রাখাই ছিল সকল আন্দোলনের মুখ্য প্রয়াস; তাহারই ফলে সে-সময়ে ধর্মজগতে এবং সমাজ-ব্যবস্থায় সমানাধিকারের ভাব দেখা দিয়াছিল।
রামানন্দ, কবীর, দাদূ, শ্রীচৈতন্য বা নানক এবং তাঁহাদের সম্প্রদায়ভুক্ত সাধুসন্তগণ দার্শনিক বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী হইলেও মানুষের সম-অধিকার-প্রচারে সকলে একমত ছিলেন। সাধারণের মধ্যে ইসলামের অতি দ্রুত অনুপ্রবেশ রোধ করিতেই ইঁহাদের অধিকাংশ শক্তি ব্যয়িত হইয়াছে; কাজেই নূতন আকাঙ্ক্ষা বা আদর্শের উদ্ভাবন তখন তাঁহাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বস্তুতঃ যদিও জনসাধারণকে নিজ ধর্মের আবেষ্টনীতে ধরিয়া রাখিবার জন্য তাঁহাদের প্রয়াস অনেকটা ফলপ্রসূ হইয়াছিল, এবং মুসলমানদিগের উগ্র সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামিও কতকটা প্রশমিত করিতে তাঁহারা সক্ষম হইয়াছিলেন, তথাপি তাঁহারা ছিলেন নিছক আত্মসমর্থনকারী; কোনপ্রকারে শুধু বাঁচিয়া থাকার অধিকার লাভ করিবার জন্যই তাঁহারা প্রাণপণ সংগ্রাম করিতেছিলেন।
এইকালে উত্তর-ভারতে একজন শক্তিমান্ দিব্য পুরুষের আবির্ভাব হইয়াছিল। সৃজনী-প্রতিভাসম্পন্ন শেষ শিখগুরু—গুরু গোবিন্দসিংহের আধ্যাত্মিক কার্যাবলীর ফলেই শিখসম্প্রদায়ের সর্বজনবিদিত রাজনীতিক সংস্থা গড়িয়া উঠিয়াছিল। ভারতের ইতিহাসে বরাবর দেখা গিয়াছে, যে-কোন আধ্যাত্মিক অভ্যুত্থানের পরে, তাহারই অনুবর্তিভাবে একটি রাষ্ট্রনীতিক ঐক্যবোধ জাগ্রত হইয়া থাকে এবং ঐ বোধই আবার যথানিয়মে নিজ জনয়িত্রী যে বিশেষ আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা, তাহাকে শক্তিশালী করিয়া থাকে। কিন্তু মহারাষ্ট্র বা শিখ সাম্রাজ্যের উত্থানের প্রাক্কালে যে আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হইয়াছিল, তাহা ছিল সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল। মালব কিংবা বিদ্যানগরের কথা দূরে থাকুক, মোগল-দরবারেও তদানীন্তন কালে যে-প্রতিভা ও বুদ্ধিদীপ্তির গৌরব ছিল, পুনার রাজ-দরবার কিংবা লাহোরের রাজসভায় বৃথাই আমরা সে দীপ্তির অনুসন্ধান করিয়া থাকি। মানসিক উৎকর্ষের দিক্ হইতে এই যুগই ভারত-ইতিহাসের গাঢ়তম তমিস্রার যুগ এবং ঐ দুই ক্ষণপ্রভ সাম্রাজ্য—ধর্মান্ধ গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিনিধিস্বরূপ ছিল, সর্ববিধ সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের তাহারা একান্ত বিরোধী; উভয়েই মুসলমান রাজত্ব-ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের সকল প্রেরণা ও কর্মপ্রবৃত্তি হারাইয়া ফেলিয়াছিল। …
তারপর আবার এক বিশৃঙ্খলার যুগ উপস্থিত হইল। শত্রু ও মিত্র, মোগলশক্তি ও তাহার ধ্বংসকারীরা এবং তৎকাল পর্যন্ত শান্তিপ্রিয় ফরাসী, ইংরেজ-প্রমুখ বিদেশী বণিক্দল এক ব্যাপক হানাহানিতে লিপ্ত হইয়াছিল। প্রায় অর্ধ-শতাব্দীরও অধিক কাল যুদ্ধ লুণ্ঠন ও ধ্বংস ছাড়া দেশে আর কিছুই ছিল না। পরে সে তাণ্ডবের ধূমধূলি যখন অপসারিত হইল, তখন দেখা গেল সকলের উপর জয়লাভ করিয়া সদম্ভ পদবিক্ষেপে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে—ইংরেজশক্তি। সেই শক্তির শাসনাধীনেই অর্ধ-শতাব্দীকাল ধরিয়া দেশে শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা অব্যাহত। অবশ্য সে-শৃঙ্খলা যথার্থ উন্নতির দ্যোতক কিনা—কালের নিকষেই তাহা পরীক্ষিত হইবে।
দিল্লীর বাদশাহী আমলে উত্তর-ভারতীয় সম্প্রদায়গুলি যে-ধরনের ধর্ম-আন্দোলন করিত, ইংরেজ আমলেও ভারতের জনসাধারণের মধ্যে সে-ধরনের কিছু কিছু আন্দোলন দেখা গিয়াছে। কিন্তু সে-সব ছিল যেন মৃত বা মৃতকল্পের কণ্ঠধ্বনির মত—ভয়ার্ত এক জাতির শুধু বাঁচিয়া থাকার অধিকারের জন্য ক্ষীণ আবেদন। বিজেতাদের রুচি ও অভিপ্রায় অনুসারে নিজেদের ধর্মগত ও সমাজগত যে-কোন পরিবর্তন সাধন করিতে তাহারা একান্ত উদ্গ্রীব, বিনিময়ে শুধু বাঁচিয়া থাকার অধিকারটুকুই ছিল তাহাদের প্রার্থনা। আর ইংরেজ-শাসনে বিজেতাদিগের সহিত তাহাদের ধর্ম অপেক্ষা সামাজিক পার্থক্যই ছিল স্পষ্টতর।
মনে হয়, এ-শতকের হিন্দু-সম্প্রদায়গুলির একটি মাত্র আদর্শ ছিল—তাহাদের ইংরেজ প্রভুর সমর্থন-লাভ। কাজেই ইহাদের অস্তিত্ব যে ব্যাঙের ছাতার মত ক্ষণিক হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কি?
ভারতের বৃহৎ জনসমাজ অতি নিষ্ঠার সহিত এই সম্প্রদায়গুলিকে দূরে পরিহার করিয়া চলিত। জনসাধারণের কাছে ইহাদের স্বীকৃতি ছিল মৃত্যুর পরে, অর্থাৎ এগুলি লোপ পাইলেই যেন তাহারা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিত। সম্ভবতঃ আরও কিছুকাল এইরূপ চলিবে, অন্যরূপ হইতে পারে না।