দেহ মনেরই স্থূল রূপ মাত্র। মন কতকগুলি সূক্ষ্ম স্তর আর দেহ কতকগুলি স্থূল স্তরের দ্বারা গঠিত। মনের উপর পূর্ণ আধিপত্য লাভ করিতে সমর্থ হইলে মানুষ দেহও বশীভূত করিতে পারে। প্রত্যেক মনের যেমন বিশেষ দেহ থাকে, তেমনি প্রত্যেক শব্দের একটি বিশেষ চিন্তা বা ভাব আছে। ক্রুদ্ধ হইলে আমরা সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ ব্যবহার করি—‘আহাম্মক’, ‘মূর্খ’ ইত্যাদি; আবার দুঃখিত হইলে কোমল হ্রস্ব স্বরবর্ণ উচ্চারণ করি—‘আহা!’ এগুলি অবশ্য ক্ষণিক মনোভাব মাত্র; কিন্তু প্রেম, শান্তি, স্থৈর্য, আনন্দ, পবিত্রতা প্রভৃতি সকল ধর্মেই কতকগুলি চিরন্তন মনোভাব আছে। ঐ-সকল ভাব প্রকাশ করিবার বিশিষ্ট শব্দরাশি আছে। মানুষের উচ্চতম ভাবরাশির একমাত্র প্রতীক হইতেছে শব্দ। শব্দ চিন্তা হইতে জাত। আবার এই শব্দগুলি হইতে চিন্তারাশি বা ভাবরাশি জাত। এখানেই শব্দের সাহায্য প্রয়োজন। এরূপ শব্দগুলির প্রত্যেকটি শব্দ যেন এক-একটি প্রতীক। এ-সকল রহস্যপূর্ণ পবিত্র শব্দরাশি আমরা জানি এবং বুঝিতে পারি, কিন্তু কেবল গ্রন্থাদিতে পড়িলেই ঐগুলি আমাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে না। শব্দগুলি ভাবপূর্ণ হইলে এবং সাধনা করিয়া যিনি স্বয়ং ভগবানের স্পর্শ লাভ করিয়াছেন এবং এখনও ভাগবত জীবন যাপন করেন, এরূপ ব্যক্তির স্পর্শ থাকিলে ঐগুলি ফলপ্রদ হয়। একমাত্র তিনিই ঐ ভাব-প্রবাহকে গতিদান করিতে সমর্থ। খ্রীষ্ট-দ্বারা চালিত প্রবাহ-পথেই শক্তিসঞ্চারের কার্য চলিয়া আসিতেছে। যাঁহার মধ্যে এই শক্তি-সঞ্চারের ক্ষমতা আছে, তিনিই গুরু। উত্তম আচার্যদের ঐ শব্দপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় না, যেমন যীশুখ্রীষ্টের। সাধারণ আচার্যগণও শব্দের মাধ্যমে এই শক্তি সঞ্চার করিয়া থাকেন।
অপরের দোষ দেখিবে না। দোষ দেখিয়া কাহাকেও বিচার করা যায় না। এ যেন ভূমিতে পতিত পচা অপক্ব অপরিণত আপেলগুলি দেখিয়া গাছটির বিচার করা। এইভাবে মানুষের ত্রুটিবিচ্যুতি দ্বারা তাহার চরিত্রের বিচার হইতে পারে না। স্মরণ রাখিতে হইবে, দুষ্টলোক পৃথিবীর সর্বত্রই একরূপ। চোর এবং হত্যাকারী এশিয়া, আমেরিকা ও ইওরোপে সমভাবেই দেখা যায়। তাহারা নিজেদের লইয়া একটি স্বতন্ত্র জাতি সৃষ্টি করিয়াছে। সৎ, পবিত্র ও সরল ব্যক্তিদের মধ্যেই বৈচিত্র্য লক্ষিত হয়। অপরের মধ্যে অসাধুতা দেখিবার চেষ্টা করিও না। অজ্ঞতা ও দুর্বলতাই হইল অসাধুতা। মানুষকে দুর্বল বলিয়া লাভ কি? সমালোচনা আর ধ্বংসমূলক আলোচনা নিষ্ফল। মানুষকে উচ্চতর কিছু দিতে হইবে। তাহাকে তাহার মহৎ স্বভাব ও জন্মগত অধিকার সম্বন্ধে অবহিত কর। আরও অধিক লোক কেন ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট হয় না? কারণ খুব কম লোকই পঞ্চেন্দ্রিয়াতিরিক্ত কোন আনন্দের সংবাদ রাখে। অধিকাংশ ব্যক্তিই অন্তর্জগতের ব্যাপার—চক্ষু দ্বারা দেখিতে পায় না, কর্ণ দ্বারা শুনিতে পায় না।
এখন আমরা ‘প্রেমের মধ্য দিয়া উপাসনা’ সম্বন্ধে আলোচনা করিব। বলা হয় যে, ‘গির্জায় অর্থাৎ কোন সম্প্রদায়ে জন্মানো ভাল, কিন্তু সেখানে মরা ভাল নয়।’ চারাগাছ চারিপার্শ্বের বেড়া হইতে সহায়তা এবং আশ্রয় লাভ করে, কিন্তু কালে সেই বেড়া তুলিয়া না লইলে বৃক্ষটি সবল হইতে বা বাড়িতে পারিবে না। বাহ্য পূজা যে একটি প্রয়োজনীয় সোপান, তাহা আমরা দেখিয়াছি, কিন্তু ধীরে ধীরে ক্রমোন্নতির সঙ্গে সেই সোপান অতিক্রম করিয়া উচ্চতর অবস্থায় আরোহণ কর। ঈশ্বরে পরিপূর্ণ প্রেম হইলে তিনি যে সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান্—এ-সব বড় বড় বিশেষণের কথা আর চিন্তা করিও না। আমরা ঈশ্বরের নিকট কিছুই চাই না বলিয়া তাঁহার গুণাবলী লক্ষ্য করিবার প্রয়োজন বোধ করি না। ভগবানের প্রতি প্রেমই আমাদের একমাত্র কাম্য, কিন্তু তখনও সগুণ ঈশ্বরের ভাব আমাদিগকে অনুসরণ করিতে থাকে, আমরা মনুষ্যভাবের ঊর্ধ্বে উঠিতে পারি না, লাফ দিয়া দেহভাবের বাহিরে যাইতে পারি না; সুতরাং আমরা যেভাবে পরস্পরকে ভালবাসি, ঈশ্বরকেও সেইভাবে ভালবাসিব।
মানব-প্রেমের পাঁচটি স্তর আছেঃ
১. অতি সাধারণ এবং নিম্নতম হইল—‘শান্ত’ প্রেম, তখন আমরা আশ্রয়, আহার ও সর্ববিধ প্রয়োজনের জন্য পিতার উপর নির্ভর করি।
২. দাস্য-প্রেমঃ যে-প্রেম আমাদিগকে সেবার প্রেরণা দেয়। ভৃত্য যেমন প্রভুকে সেবা করে—মানুষ ভগবানকে সেইভাবে সেবা করিবার আকাঙ্ক্ষা করে। এই সেবার ভাব অন্যান্য ভাবের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করে; তখন প্রভু সৎ কি অসৎ, দয়ালু কি নির্দয়, সে সম্বন্ধে আমরা উদাসীন হইয়া যাই।
৩. সখ্য-প্রেমঃ বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালবাসা, সমানে সমানে ভালবাসা, সঙ্গীর প্রতি সঙ্গীর ভালবাসা, খেলার সাথীর প্রতি খেলার সাথীর ভালবাসা। মানুষ তখন ভগবানকে নিজ সহচর বলিয়া অনুভব করে।
৪. বাৎসল্য প্রেমঃ ভগবানকে সন্তানভাবে দেখা। ভারতে এই বাৎসল্য-ভাবটি পূর্বোক্ত সখ্য এবং শান্ত প্রেম হইতে উচ্চতর গণ্য হইয়া থাকে, কারণ ইহাতে ভয়ের বিন্দুমাত্র স্থান নাই।
৫. মধুর প্রেমঃ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে প্রেম; ভালবাসার জন্যই ভালবাসা—ভগবান্ই শ্রেষ্ঠ প্রেমাস্পদ।
এই মধুর-ভাবটি সুন্দররূপে ব্যক্ত হইয়াছেঃ চারিচক্ষুর মিলন হওয়ায় দুটি আত্মার মধ্যে পরিবর্তন ঘটিতে লাগিল; প্রেম দুই আত্মার মধ্যবর্তী হইয়া দুইকে এক করিয়া দিল।
যখন কোন ব্যক্তি শেষোক্ত পূর্ণ প্রেমের অধিকারী হয়, তখন তাহার সমস্ত বাসনা চলিয়া যায়। পূজাপদ্ধতি আচার-অনুষ্ঠান গির্জা—কোন কিছুরই সে অপেক্ষা রাখে না। সকল ধর্মের লক্ষ্য—মুক্তির বাসনা পর্যন্ত ত্যাগ, জন্ম মৃত্যু এবং অন্যান্য বন্ধন হইতে মুক্তির ভাবও ত্যাগ করিতে হয়। সেই উচ্চতম প্রেমে স্ত্রী-পুরুষ-ভেদ নাই, কারণ শ্রেষ্ঠ প্রেমে পরিপূর্ণ একত্ববোধ হয়; স্ত্রী-পুরুষ-জ্ঞানে শারীরিক ভেদবুদ্ধি থাকে। সুতরাং মিলন একমাত্র আত্মাতেই সম্ভব। আমাদের দেহবোধ যতই ক্ষীণ হইবে, প্রেম ততই পূর্ণ হইবে; অবশেষে যাবতীয় দেহজ্ঞান দূরীভুত হইয়া দুটি আত্মা এক হইয়া যাইবে। প্রেমকে আমরা চিরদিন ভালবাসি। রূপ অতিক্রম করিয়া প্রেম অরূপকে দর্শন করে। লোকে বলে—‘প্রেমিক ইথিওপের ললাটে হেলেনের সৌন্দর্য দেখিয়া থাকে।’১ ইথিওপ একটি ইঙ্গিত মাত্র। এই ইঙ্গিতেরই উপর মানুষ স্বীয় প্রেম অর্পণ করে। ভক্তি যখন উত্তেজক পদার্থগুলি পরিত্যাগ করে, তখন দেখিতে পায়, মধ্যে যে বস্তু রহিয়াছে, উহা উত্তেজক পদার্থগুলিকে সুন্দর মুক্তাতে পরিণত করে; মানুষও তেমনি প্রেমের বিস্তার করে; প্রেমই মানুষের সর্বোচ্চ আদর্শ এবং এই আদর্শই চিরদিন স্বার্থশূন্য, সুতরাং মানুষ প্রেমকেই ভালবাসে। ভগবান্ প্রেম-স্বরূপ। আমরা ভগবানকে ভালবাসি অর্থাৎ প্রেমকেই ভালবাসি। প্রেম আমরা প্রত্যক্ষ করি মাত্র। প্রেমকে ব্যক্ত করা যায় না। মূক ব্যক্তি মাখন আস্বাদন করিলেও মাখনের গুণাগুণ ব্যক্ত করিতে পারে না। মাখন মাখনই এবং যাহারা মাখন আস্বাদ করে নাই, তাহাদের নিকট ইহার গুণাবলী প্রকাশ করা যায় না। প্রেমের জন্যই প্রেম—যাহারা প্রেম অনুভব করে নাই, তাহাদিগের নিকট ইহা প্রকাশ করা যায় না।
প্রেমকে একটি ত্রিভুজের সহিত তুলনা করা যায়। উহার প্রথম কোণটি হইল—প্রেম কখনও কিছু চায় না, কোন কিছু প্রার্থনা করে না। দ্বিতীয় কোণ— প্রেমের মধ্যে ভয়ের স্থান নাই; তৃতীয় এবং চরম কোণ—প্রেমের জন্যই প্রেম। প্রেমের প্রভাবে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি সূক্ষ্মতর এবং উন্নততর হয়। জাগতিক সম্পর্কে চরম প্রেম দুর্লভ, কারণ মানবীয় প্রেম প্রায় সর্বদাই পারস্পরিক এবং সাপেক্ষ। কিন্তু ঈশ্বর-প্রেম এক অবিচ্ছিন্ন ধারার মত, উহাকে কোন কিছুই ব্যাহত বা রুদ্ধ করিতে পারে না। মানুষ যখন ঈশ্বরকে তাহার শ্রেষ্ঠ আদর্শরূপে ভালবাসে—ভিক্ষুকের মত নয় অথবা কোন আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য নয়, তখন সেই প্রেম চরম ক্রমবিকাশের স্তরে উপনীত হইয়া জগতে এক মহাশক্তিরূপে পরিণত হয়। এই-সকল অবস্থায় পৌঁছিতে দীর্ঘ সময় লাগে। আমাদের স্বভাবগত ভাবের সাহায্যেই আমাদিগকে প্রথমে অগ্রসর হইতে হইবে। কেহ সেবার ভাব লইয়া জন্মায়, কেহ বা মাতৃ-প্রেম লইয়া জন্মগ্রহণ করে। যে ভাবেই হউক, ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক-স্থাপনে আমাদের নিজ নিজ প্রকৃতির সুযোগ লইতে হইবে।