বড় রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢোকার পর এঁকেবেঁকে অনেকখানি গিয়ে তারপর চোখে পড়ল চাপড়ামারি বনবাংলো। বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, পড়ন্ত রোদ্দুরে একটু-একটু লালচে দেখাচ্ছে গাছের পাতা। একসঙ্গে অনেক পাখি ডাকছে। ওরা ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্রাণভরে ডেকে নেয়। দূরে শোনা গেল একটা ময়ূরের ডাক।
চৌকিদারকে আগেই খবর দেওয়া ছিল, গাড়ির শব্দ পেয়ে সে এসে গেট খুলে দিল। তেইশ-চব্বিশ বছর বয়েস, ছোটখাটো চেহারা, তার নাম যতীন। মুখোনা বেশ হাসিমাখা।
কাঠের বাড়ি। একতলায় খাবার ঘর, বসবার ঘর, সামনে চওড়া বারান্দা। ওপরে দুখানা শয়নকক্ষ, সেখানেও একটি বড় বারান্দা।
মিলিকাকিমা ওপরে এসে প্রথমেই বাথরুমে উঁকি দিয়ে বললেন, বাঃ, বেশ পরিষ্কার আছে। বিছানাও সুন্দর।
কাকাবাবু ক্রাচ বগলে নিয়ে দোতলায় উঠে বললেন, তোমার পছন্দ হয়েছে তো মিলি?
মিলিকাকিমা বললেন, খুব সুন্দর। কোনও আওয়াজ নেই। কলকাতায় বড় কান ঝালাপালা হয়ে যায়।
একটা চেয়ার টেনে বসে কাকাবাবু বললেন, ওহে যতীন, আমাদের আরও একটু চা খাওয়াও।
যতীন বলল, চা-চিনি-দুধ এনেছেন তো? আর চাল-ডাল? আমি রান্না করে দেব। কিন্তু আমার কাছে ওসব কিছু নেই।
কাকাবাবু বললেন, রণবীর কীসব দিয়ে দিয়েছে, দ্যাখো তো।
একটা প্যাকেটে রণবীর চা, চিনি, দুধ, পাউরুটি, মাখন, কেক, ডিম এইসব অনেক কিছুই দিয়ে দিয়েছে।
সব দেখে গৌতমকাকু বললেন, আজ আমরা ডিম-পাউরুটি খেয়ে নেব। কাল সকালে বাজার করে আনব। শুনেছি তো দশ-বারো মাইল দূরেই একটা বাজার আছে। সেখানে সবকিছু পাওয়া যায়?
যতীন বলল, হ্যাঁ স্যার। মাছ পাবেন, মুরগি পাবেন।
মিলিকাকিমা জিজ্ঞেস করলেন, কুমড়ো ফুল পাওয়া যায় না? অনেকদিন কুমড়ো ফুল ভাজা খাইনি।
যতীন বলল, তাও এক-একদিন পাওয়া যায়। ফুলকপি, বাঁধাকপি এসব পাবেন।
গৌতমকাকু বললেন, না, না, ওসব চাই না। আমেরিকাতে ওসব খেতে খেতে মুখ পচে গেছে। এখানে খুঁজব ভাল পটল, ঝিঙে, কলমিশাক, আর মুরগির বদলে কচি পাঁঠার মাংস!
কাকাবাবু বললেন, ওসব কলকাতায় গিয়ে খেয়ো। এখানে যা পাবে তাই-ই খেতে হবে।
বাংলোর সামনে একটা উঁচুমতন বাঁধ, তার ওপাশে একটা পুকুর। ঠিক গোল বা চৌকো নয়, অনেকখানি ছড়ানো, মাঝখানে একটা ছোট দ্বীপের মতন। তারপর শুধু জঙ্গল।
মিলিকাকিমা বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে বললেন, ওই পুকুরে বুঝি সবাই চান করে?
কাকাবাবু বলে উঠলেন, না, না, না, ওখানে যাওয়াই নিষেধ। তোমরা কেউ এই বাংলোর চৌহদ্দির বাইরে হেঁটে যাবে না। যে-কোনও সময় কোনও জন্তু-জানোয়ার এসে পড়তে পারে। সব সময় গাড়িতে যেতে হবে।
যতীন বলল, ওই পুকুরে জন্তু-জানোয়াররা জল খেতে আসে। হাতিরা জলে নেমে অনেকক্ষণ খেলা করে।
গৌতমকাকু বললেন, এই বারান্দায় বসেই হাতিদের জলক্রীড়া দেখা যাবে?
যতীন বলল, হ্যাঁ, স্যার, হাতি তো দেখতে পাবেনই, তা ছাড়া বাইসন, লেপার্ড, বুনো শুয়োর, হঠাৎ কখনও কখনও টাইগারও চলে আসে। ওই দেখুন না, এখনই দুটো পি-কাক দেখা যাচ্ছে।
গৌতমকাকু বললেন, পি-কাক? সেটা আবার কী ধরনের জন্তু?
কাকাবাবু বললেন, ও বলতে চাইছে পিকক, ময়ূর। কোথায় ময়ূর? যতীন বলল, ওই যে ঝোপটার পাশে।
সবাই ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এক মিনিট পরেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা ময়ূর, মস্ত বড় লেজ, আর কী সুন্দর গায়ের রং।
সন্তু পুরুকে জিজ্ঞেস করল, দেখতে পেয়েছ?
পুরু মাথা নেড়ে বলল, এই প্রঠম আমি বনের ময়ূর ডেকলাম।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, নিখুঁত বাংলা বলছে।
সন্তু বলল, প্রঠম নয় প্রথম। ডেকলাম না, দেখলাম।
যতীন বলল, পুকুরটার ওপারে দেখুন খানিকটা সাদা পাথরের মতন। ওটা সল্ট লিক।
কাকাবাবু বললেন, ওখানে অনেকটা করে নুন দিয়ে আসতে হয় মাঝে-মাঝে। জন্তুরা ওই নুন চাটতে আসে। মানুষের মতন জন্তু-জানোয়ারদেরও নুন খাওয়ার দরকার হয়।
মিলিকাকিমা বললেন, এত কাছে জন্তুরা আসে। ওরা এই বাংলোর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে না?
যতীন অম্লান বদনে বলল, হ্যাঁ মেমসাহেব, এই পরশুদিনই তো রাত্তিরে একটা লেপার্ড ঢুকে পড়েছিল।
মিলিকাকিমা বললেন, আমি মোটেই মেমসাহেব নই। আমাকে দিদি কিংবা বউদি বলবে। তা লেপার্ডটা ঢুকে পড়ার পর কী করল?
যতীন অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, কী আর করবে, কিছুক্ষণ হাউ হাউ করে ডেকে চলে গেল। ও আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, বেশিরভাগ জন্তুই সন্ধের পর বেরোয়। তখন এখানে দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখতে হয়। তা হলে তো ওরা আর কিছু করতে পারে না। ঘুরেটুরে চলে যায়। একমাত্র ভয় হাতির পালকে। ওরা ঘরবাড়ি ভেঙে দিতে পারে।
মিলিকাকিমা বললেন, ওরে বাবা, তা হলে যদি হাতি এসে পড়ে?
কাকাবাবু হেসে বললেন, ভাল করে দেখো, এই বাংলোর চার পাশে একটা পরিখা কাটা আছে।
মিলিকাকিমা বললেন, পরিখা কী?
কাকাবাবু বললেন, অনেকটা সরু খালের মতন। হাতি আর সব পারে, শুধু লাফাতে পারে না অত বড় শরীর নিয়ে। তাই হাতি ভেতরে আসতে পারে না।
যতীন বলল, গেটের কাছেও কাঠের পাটাতন। রাত্তিরবেলা ওটা কপিকল দিয়ে টেনে তোলা যায়। ওখান দিয়েও হাতি ঢুকতে পারে না।
পুরু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, ওই দ্যাকো, ওই দ্যাকো, কতকগুলো বাফেলো।
সন্তু বলল, বাফেলো নয়, বাইসন। বাফেলোর বাংলা মোষ। কিন্তু বাইসনের বাংলা নেই।
কাকাবাবু বললেন, মোষের মতন দেখতে হলেও বাইসন আলাদা। লক্ষ করে দেখো, ওদের পায়ের তলাটা সাদা, ঠিক যেন সাদা মোজা পরে আছে। ওরা খুবই হিংস্র প্রাণী। দল বেঁধে থাকলে বাঘও ভয় পায়। ধারালো শিং দিয়ে পেট ফুটো করে দেয়।
সন্তু বলল, এক, দুই..মোট সাতটা।
সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে বাইসন দেখতে লাগল। সন্তু আগে অনেক জঙ্গলে গেছে, কিন্তু পুরুর কাছে এসবই প্রথম, সবই নতুন।
সন্তু ভাবল, ইস, জোজো এবার এল না। জোজো থাকলে এতক্ষণে কত মজার মজার কথা বলত।
সন্ধে হতে-না-হতেই খুব তাড়াতাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। জঙ্গলের মতন এমন গাঢ় অন্ধকার শহরে দেখা যায় না। রাত্তির হলেই জঙ্গল রহস্যময় মনে হয়। কোনও শব্দ নেই, তবু যে-কোনও দিকে তাকালেই মনে হয় যেন কোনও হিংস্র জানোয়ার সেখানে লুকিয়ে আছে। মাঝে-মাঝে জোনাকি দেখা যাচ্ছে। সবগুলোই জোনাকি না কোনও পশুর চোখ, তা বোঝার উপায় নেই। সব পশুর চোখই রাত্তিরে জ্বলজ্বল করে।
বারান্দা ছেড়ে কেউ আর ঘরে গেল না। রাত্তিরের খাওয়াদাওয়াও হল ওখানে বসে। মাঝে-মাঝে জঙ্গলে নানারকম শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু অন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। দুটো বড়-বড় সার্চলাইট রয়েছে। সেগুলো জ্বাললে শুধু বাইসনদেরই দেখা যাচ্ছে, ওরা জায়গা ছেড়ে নড়ছে না।
হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে যেন তাণ্ডব শুরু হল। গাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতে হাজির হল একপাল হাতি। তারা হুড়মুড় করে নেমে গেল জলে। সার্চলাইটে স্পষ্ট দেখা গেল, ছটা বড় হাতি আর দুটো বাচ্চা। তারা গুঁড়ে করে জল ছেটাচ্ছে এ ওর গায়ে। যেন খেলা করছে।
হাতিরা আসার পর বাইসনগুলো সরে গেছে। কিন্তু দুটো হরিণ একটু দূরে এসে জল খেতে লাগল।
গৌতমকাকু বললেন, সত্যি, এরকম দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি। রাজা, ভাগ্যিস তুমি আমাদের এখানে নিয়ে এলে! আমাদের বাংলায় যে এরকম জঙ্গল আছে জানতুমই না। তোর কেমন লাগছে রে পুরু?
পুরু বলল, ফ্যানটাসটিক! মানে, সমৎকার!
সন্তু বলল, এক নম্বর। আর সমকার নয়, চমৎকার!
মিলিকাকিমা বললেন, যাই বলো, আমার একটু ভয় ভয় লাগছে।
গৌতমকাকু বললেন, চলো, বাংলার বাইরে গিয়ে একটু দাড়াই, তা হলে তোমার ভয় ভেঙে যাবে।
মিলিকাকিমা বললেন, মাথা খারাপ! পুরু বলল, মাতা কারাপ না, মাতা বালো! এই সময় যেন খুব কাছেই শোনা গেল বাঘের গর্জন! মিলিকাকিমা কেঁপে উঠে বললেন, ওরে বাবা রে! ওরে বাবা রে!