বিষয়বস্তু (অথর্ববেদ সংহিতা)
আনুষ্ঠানিক কারণে অথর্ববেদের বিষয়বস্তু অসংখ্য ‘গণ’-এ বিভক্ত হয়েছিল; যেমন–অভয়, রৌদ্র, বাস্তু, অভিষেক, অপরাজিত, কৃত্যা, স্বস্ত্যয়ন, দুঃস্বপ্ন-নাশন, আয়ুষ্য, মৃগার ইত্যাদি। স্পষ্টতই এ ধরনের বিভাজন কখনই সম্পূর্ণ কিংবা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে পারে না; তাই এক শ্রেণীর সঙ্গে অপর শ্রেণী প্রায়ই সংলগ্ন হয়ে থাকে এবং ফলস্বরূপ গণগুলিকে আমরা বিষয়বস্তুর সাধারণ বর্গীকরণ রূপেই গ্ৰহণ করতে পারি।
মোট কুড়িটি অধ্যায়ের মধ্যে প্ৰথম ছয়টি এবং অষ্টম ও নবম অধ্যায়ে বিবিধ বিষয়ের সূক্ত রয়েছে যাদের উপজীব্য বিষয়বস্তু হ’ল শত্ৰু, দানব ও রাক্ষসদের বিতাড়ন করা, বিভিন্ন ব্যাধির, নিরাময় করা, (যেমন রক্তপাত বন্ধ করা, শিরাবন্ধনী, কৃমি, গলগণ্ড, ক্ষয়রোগ, শ্লীপদ, পাণ্ডুরোগ, সৰ্পদংশন প্রভৃতি)। পিতৃগৃহ-নিবাসিনী বঞ্চিতা ও বয়স্কা অনুঢ়া নারীদের প্রায়শ্চিত্তের জন্য প্রার্থনা ছাড়াও অন্যান্য যে সমস্ত বিষয়ে প্রার্থনা নিবেদিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘজীবন এবং পর্যাপ্ত ও সময়মত বৃষ্টিপাত, সমৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, সামরিক অভিযানে রাজার বিজয়, রাজা ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর কল্যাণ, নিমীয়মাণ গৃহের মঙ্গলবিধান, কৃষিকাৰ্য, গোসম্পদ, বৃক্ষলতা, প্রভৃতি শ্ৰীবৃদ্ধি, বীরপুত্রের জন্ম, পারিবারিক শাস্তি, গূঢ় বিদ্যা ও পরমাত্মা সম্পর্কে জ্ঞান এবং সর্বোপরি জীবনের সর্বপ্রকার অমঙ্গল থেকে মুক্তি। সপ্তম অধ্যায়ে আধ্যাত্মিক কল্যাণ সম্পর্কেই অধিক আগ্রহ; এর বহু সূক্তে আত্মা, পরমাত্মা ও ব্রহ্মের মতো বিমূর্ত ভাবনা রূপায়িত হয়েছে।
নবম অধ্যায়ে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব–উভয়বিধ বিষয়ই রয়েছে। তাই, এখানে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়ে বহু সূক্ত দেখি–মধুবিদ্যা, অতিথিপরিচর্যা, পঞ্চৌদন অজ, গাৰ্হস্থ্য শ্ৰী-সম্পদের আকাঙক্ষা, ক্ষয়রোগ নিবারণের জন্য প্রার্থনা এবং উচ্চ আধ্যাত্মিক চিন্তাযুক্ত ‘অস্যবামীয়’ সূক্তটিও এখানে ঋগ্বেদ থেকে উৎকলিত হয়েছে। এছাড়া দশম ও একাদশ অধ্যায়ের সূক্তগুলির বিষয়বস্তু : খাদ্য, শত্রুবিনাশ, বিষের প্ৰতিষেধ, পাপের প্রায়শ্চিত্ত, জয়লাভের জন্য রক্ষা-কবচ-বন্ধন, ব্ৰহ্মচর্য, শতান্নদায়ী গোধন, ব্ৰাহ্মণের উদ্দেশে খাদ্যদান, বন্ধ্যা ধেনু, যজ্ঞদক্ষিণার গোধন এবং বিশ্বজগতের মূলাধার-স্বরূপ যে পরমাত্মা তাঁর বিষয়ে একটি ও ‘প্রথম ব্ৰহ্ম’ বিষয়ে আর একটি সূক্ত।
দ্বাদশ অধ্যায়ের দীর্ঘতম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূক্ত হ’ল মাতা পৃথিবীর প্রতি নিবেদিত ভূমিসূক্তটি এবং তা সমগ্ৰ অধ্যায়ের তিন-চতুর্থাংশের অধিকস্থান অধিকার করে রয়েছে। এই অধ্যায়ের অন্য তিনটি সূক্তের বিষয়বস্তু ক্ষয়রোগ, স্বৰ্গপ্রদ(?) খাদ্য, যজ্ঞদক্ষিণারূপে ব্ৰাহ্মণের প্রতি দাতব্য ধেনু এবং বশা গবী বা বন্ধ্যা গাভী। ত্রয়োদশ অধ্যায় থেকে আমরা ভিন্ন ধরনের সম্পাদনা কার্যের নিদর্শন পাই। বিষয়বস্তুর চরিত্রের দিক দিয়ে এইগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য বেশি–ত্রয়োদশ অধ্যায়টিতে অবশ্য সম্পূর্ণতই আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু। চতুর্দশ অধ্যায়টি প্রধানত বিবাহ সূক্তের সংকলন, যেগুলির অধিকাংশই ঋগ্বেদ থেকে গৃহীত। অষ্টাদশটি সূক্তের সমাহার পঞ্চদশ অধ্যায়টি ‘ব্রাত্যখণ্ড’ -রূপে পরিচিত। ষোড়শ অধ্যায়ে মুখ্যত দুঃস্বপ্ন বিনাশ করার জন্য যমদেবের প্রতি প্রার্থনা জানানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই অধ্যায়ে দুটি ভিন্নধ্যমী অংশ রয়েছে; গদ্যে রচিত প্ৰথম অনুবাকে রাজকীয় অভিষেক বিবৃত হয়েছে, অন্য দিকে পদ্যে বিন্যস্ত দ্বিতীয় অংশটি দুঃস্বপ্নের প্রতিরোধকল্পে প্ৰযুক্ত–অপটু সম্পাদনার ফলে একই অধ্যায়ে এই দুটি অংশ গ্রথিত হয়েছে।
সপ্তদশ অধ্যায়ে আদিত্যের উদ্দেশে একটি সূক্ত রয়েছে, অন্যগুলি সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় ইন্দ্রের প্রতি নিবেদিত। এছাড়া, ‘বৈষাসহি’র প্রতি একটি সূক্তে বেদবিদ্যা-শিক্ষার্থীদের অভ্যর্থনা, দীর্ঘ জীবনের জন্য প্রার্থনা এবং সূর্যগ্রহণের সময়ে সুরক্ষা রীতি বিবৃত হয়েছে। সমগ্ৰ অষ্টাদশ অধ্যায় পিতৃপুরুষদের জন্য নিবেদিত অনুষ্ঠানে পূৰ্ণ; ঋগ্বেদের একটি সূক্ত প্ৰায় সম্পূর্ণভাবে এবং দশম মণ্ডলের অন্তৰ্গত দশম থেকে সপ্তদশ সূক্ত সামান্য পরিবর্তন সহ এতে গৃহীত হয়েছে। ষষ্ঠ ও অষ্টম মণ্ডল থেকেও কিছু কিছু ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। আহুত দেবতাদের মধ্যে যম ও অগ্নিই প্ৰধান। ঋগ্বেদের সূক্ত ও মন্ত্র বিন্যাসক্রম এখানে মাঝেমাঝে পরিবর্তিত হয়েছে।
অথর্ববেদের উনবিংশতি ও বিংশতিতম অধ্যায় দুটি পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছিল। এদের মধ্যে উনবিংশতিতম অধ্যায়ে বিবিধ নূতন বিষয় ও নানা ভাববস্তু সন্নিবেশিত হয়েছে; যেমন-যজ্ঞ, সিন্ধুগণ, বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ডের অধিপতি, বিশ্বজগতের বীজ, পুরুষ, নক্ষত্রমণ্ডলী, বশিষ্ঠ, ‘একবীর’ বা প্রধান বীর, ছন্দসমূহ, অথর্বা, স্বর্ণময় রক্ষাকবচ-বন্ধন, ওষধি ও প্রস্তরনিমিত বিবিধ রক্ষাকবচ, রাত্রি, মহাকাল, বেদমাতা এবং পরমাত্মা। বিংশতিতম অধ্যায়টি প্রধানত ঋগ্বেদ থেকেই সংকলিত; প্রথম পনেরটি সুক্তে ঋগ্বেদের বিবিধ কবির দ্বারা ইন্দ্র আহূত হয়েছেন। আবার একশ সাতাশতম সূক্ত থেকে একশ ছত্রিশতম সূক্ত কুন্তাপসূক্তরূপে পরিচিত এবং এদের অধিকাংশই ঋগ্বেদ থেকে সংগৃহীত। বাকি সূক্তগুলি স্বভাববৈশিষ্ট্যে নিগুঢ় রহস্যে পূৰ্ণ; এগুলি শুধু শৌনকপাঠেই পাওয়া যায়, পৈল্পলাদ পাঠে এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।