গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

০৪. বিদ্যা দাও

ওদিকে রাজপ্রাসাদের বিশ্রান্তিগৃহে যুবরাজ মকরবর্মা এক খট্বার উপর পৃষ্ঠে বহু উপাধান দিয়া অর্ধশয়ানভাবে অবস্থান করিতেছিলেন। সবেমাত্র বিপুল পান ভোজন শেষ করিয়াছেন, তাঁহার চক্ষু মুদিত হইয়া আসিতেছে, ঘুমাইয়া পড়িতে বেশি বিলম্ব নাই। একটি কিঙ্করী শিয়রে দাঁড়াইয়া তাঁহার মস্তকে বীজন করিতেছে।

পুস্তপাল মহাশয় স্ফটিকপাত্রে দ্রাক্ষাসব ভরিয়া মকরবর্মার সম্মুখে ধরিলেন। মকরবর্মা এক চুমুকে পাত্র নিঃশেষ করিয়া পত্রটি দূরে নিক্ষেপ করিলেন এবং জড়িতস্বরে বলিলেন— ‘বিচার! জামাতাই হোক আর বিমাতাই হোক— শূলে দেওয়া চাই। নচেৎ—’

তিনি ঘুমাইয়া পড়িলেন। তাঁহার নাসিকা হঠাৎ ঘর্ঘর শব্দ করিয়া উঠিল।

পুস্তপাল কিঙ্করীকে ইঙ্গিতে হস্ত সঞ্চালন করিয়া জানাইলেন— আরো জোরে পাখা চালাও। তারপর কতক নিশ্চিন্ত হইয়া নিঃশব্দে বিড়ালগতিতে দ্বারের পানে চলিলেন। দ্বারের ঠিক বাহিরেই কুন্তলরাজ ও মহামন্ত্রী উৎকণ্ঠিতভাবে দাঁড়াইয়া ছিলেন, পুস্তপালের দিকে ভ্রূ তুলিয়া যুগপৎ প্রশ্ন করিলেন। পুস্তপালও অঙ্গভঙ্গি দ্বারা নিঃশব্দে বুঝাইয়া দিলেন যে যুবরাজ নিদ্রিত।

তিনজনে একত্র হইলে মৃদুস্বরে কথাবার্তা আরম্ভ হইল। কুন্তলরাজ বলিলেন— ‘আজ রাত্রির মত নিশ্চিন্ত। কিন্তু— তারপর?’

মহামন্ত্রী ভ্রূবদ্ধ ললাটে বলিলেন— ‘উভয় সঙ্কট। এক, রাজজামাতাকে শূলে দিতে হয়— নচেৎ—’

কুন্তলরাজ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— নচেৎ সৌরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ।’

তিনজন পরস্পর চাহিয়া ঘাড় নাড়িলেন। মহামন্ত্রী বলিলেন— ‘যদি যুদ্ধ হয়, সৌরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় আমাদের কোনো আশা নেই—’

রাজা বলিলেন— ‘অর্থাৎ রাজ্য ছারখার হবে।’

তিনজনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ রহিলেন। সহসা ঘরের ভিতর হইতে যুবরাজ মকরবর্মার কণ্ঠস্বর আসিল। তিনি নিদ্রাবশে বিকৃতকণ্ঠে বলিতেছেন— ‘প্রতিশোধ— শূল—’

পুস্তপাল গলা বাড়াইয়া দেখিলেন; যুবরাজ ঘুমন্ত পাশ ফিরিতেছেন; পুস্তপাল কিঙ্করীকে জোরে পাখা চালাইবার ইশারা করিলেন। যুবরাজের গলার মধ্যে বাকি কথাগুলা অস্পষ্ট রহিয়া গেল— ‘চোরের দণ্ড— শূলদণ্ড!’

কুন্তলরাজ এতক্ষণে লৌহবলে নিজেকে সংযত রাখিয়াছিলেন, এইবার তিনি ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম করিলেন, উদ্‌গত বাষ্পোচ্ছ্বাস কণ্ঠে রোধ করিয়া বলিলেন— ‘আমার কন্যা—’ তাঁহার দুই চক্ষু সহসা জলে ভরিয়া উঠিল।

মহামন্ত্রী ও পুস্তপাল অন্যদিকে চক্ষু ফিরাইয়া লইলেন। মহামন্ত্রীর মুখ দুরূহদ্রুত চিন্তায় ভ্রূকুটিকুটিল হইয়া উঠিল। একটা কিছু উপায় বাহির করিতেই হইবে— করিতেই হইবে—

সহসা তিনি রাজার দিকে ফিরিলেন, তাঁহার চোখের দৃষ্টি দেখিয়া রাজা ও পুস্তপাল সাগ্রহে আরো কাছাকাছি হইয়া দাঁড়াইলেন। মহামন্ত্রী বলিলেন— ‘রাজজামাতার প্রাণরক্ষার এক উপায় আছে—’ তিনি সচকিতে বিশ্রান্তিগৃহের দিকে তাকাইলেন, গলা আরো খাটো করিয়া বলিলেন— ‘আজ রাত্রেই তাঁকে চুপিচুপি রাজ্য থেকে—’ বাক্য অসমাপ্ত রাখিয়া তিনি এমনভাবে বাম হস্ত সঞ্চালন করিলেন যাহা হইতে বোঝা যায় যে তিনি রাজজামাতাকে বহু দূরে প্রেরণ করিতে চান। রাজা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া চিন্তা করিলেন, শেষে অস্ফুটস্বরে বলিলেন— ‘কিন্তু— বিবাহের রাত্রেই আমার কন্যা—’

মহামন্ত্রী দৃঢ়স্বরে বলিলেন— ‘অন্তত রাজদুহিতা বিধবা তো হবেন না।’

উভয়ে কিছুক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে পরস্পর চাহিয়া রহিলেন; তারপর রাজা ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িলেন।

ওদিকে শয়নমন্দিরে কালিদাস গল্প বলা শেষ করিতেছেন। রাজকুমারী শয্যাপাশে তেমনি নতজানু হইয়া আছেন; ক্ষোভে হতাশায় তাঁহার বক্ষে যে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলিতেছে তাহা কালিদাস দেখিয়াও দেখিতে পাইতেছেন না। তিনি হাসিতে হাসিতে কাহিনী শেষ করিলেন— ‘তারপর এখানে সকলে আমাকে সৌরাষ্ট্রের যুবরাজ বলে ভুল করল— ভারি মজা হল— না?’

রাজকুমারী বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইলেন— ‘মজা! হা অদৃষ্ট, আমার ললাটে বিধি এই লিখেছিলেন! একটা কাঠুরের সঙ্গে— তাতেও ক্ষতি ছিল না,— কিন্তু তুমি মূর্খ— মূর্খ! পৃথিবীতে যা আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি তুমি তাই—’

রাজকুমারী আবার শয্যায় মুখ লুকাইলেন।

হাস্যরত বালকের গণ্ডে অকস্মাৎ চপেটাঘাত করিলে তাহার মুখভাব যেরূপ হয় কালিদাসেরও সেইরূপ হইল। কোথায় কিভাবে তিনি কোন অপরাধ করিয়াছেন কিছুই ধারণা করিতে পারিলেন না। রাজকন্যার স্কন্ধ ও অংস ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছে; কালিদাস ব্যথিত স্বরে বলিলেন— ‘রাজকুমারি, তুমি আমার ওপর রাগ করলে? কিন্তু আমি তো কোনো দোষ করিনি। রাজকুমারি—’

তিনি সংকোচভরে কুমারীর স্কন্ধ স্পর্শ করিলেন। সেই স্পর্শে কুপিতা সর্পীর মত রাজকুমারী তড়িদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইলেন— ‘ছুঁয়ো না! কোন্‌ স্পর্ধায় তুমি আমার অঙ্গ স্পর্শ কর? মূর্খ নিরক্ষর গ্রামীণ!—’

প্রত্যেকটি শব্দ নিষ্ঠুর কশাঘাতের ন্যায় কালিদাসের মুখে পড়িল। এই সময় দ্বারের কাছে শব্দ শুনিয়া রাজকন্যা জ্বলন্ত চক্ষু সেইদিকে ফিরাইয়া বলিয়া উঠিলেন— ‘ওঃ! পিতা!’

বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে রাজা আসিতেছিলেন, কুমারী ছুটিয়া গিয়া তাঁহার পদপ্রান্তে পড়িলেন, জানু আলিঙ্গন করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন— ‘রাজাধিরাজ, আমাকে রক্ষা করুন, এই গ্রামীণের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করুন—’

রাজা বুঝিলেন হৈমশ্রী সত্য কথা জানিতে পারিয়াছেন, তিনি কন্যার মস্তকে হস্ত রাখিয়া কঠোর চক্ষে কালিদাসের পানে চাহিলেন— ‘এদিকে এস।’

কালিদাস কুন্ঠিত পদে কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। রাজা বলিলেন— ‘তুমি শঠতা দ্বারা কুমারীর পাণিগ্রহণ করেছ?’

কালিদাস বিমূঢ়ভাবে বলিলেন— ‘শঠতা!’

রাজার কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ মিশিল— ‘প্রিয়দর্শন বালক, তোমার এ দুর্বুদ্ধি কেন হল? তুমি চুরি করলে কেন?’

পাণ্ডুর মুখে কালিদাস বলিলেন— ‘চুরি! কিন্তু আমি তো চুরি করিনি—’

কুন্তলরাজ বলিলেন— ‘করেছ। শুধু তাই নয়, আমার রাজ্যের সর্বনাশ করতে বসেছ। কিন্তু সে তুমি বুঝবে না।’ কন্যার দিকে হেঁট হইয়া গাঢ়স্বরে বলিলেন— ‘কন্যা, অধীর হয়ো না। তুমি রাজদুহিতা, বিদুষী; ধৈর্য হারিও না।’ কন্যাকে ছাড়িয়া রাজা কালিদাসকে সংক্ষিপ্ত আদেশ করিলেন— ‘এস আমার সঙ্গে।’

রাজা ফিরিয়া চলিলেন। কালিদাস তন্দ্রাচ্ছন্নের মত তাঁহার অনুবর্তী হইলেন। দ্বার পর্যন্ত গিয়া কালিদাস একবার ফিরিয়া চাহিলেন; কুমারী হৈমশ্রী তেমনি নতজানু হইয়া বসিয়া আছেন, তাঁহার ক্ষোভ-বিধ্বস্ত মুখখানি বুকের উপর নামিয়া পড়িয়াছে।

রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছে, আকাশে পূর্ণচন্দ্র নীচাভিমুখী। নগর তোরণের দীপগুলি কতক নিভিয়া গিয়াছে, কতক নিব-নিব। নগরীর শব্দগুঞ্জন শান্ত হইয়াছে।

তিনটি অশ্ব পাশাপাশি তোরণ সম্মুখে দাঁড়াইয়া। দুই পার্শ্বের দুটি অশ্বের পৃষ্ঠে দুইজন রক্ষী, মধ্যে কালিদাস। প্রধান রক্ষী মস্তক সঞ্চালন দ্বারা ইঙ্গিত করিল; তিনটি অশ্ব একসঙ্গে চলিতে আরম্ভ করিল। তাহাদের গতি নগর হইতে বাহিরের দিকে। —

নিবিড় বনের উপান্ত। অশোকস্তম্ভের ন্যায় একটি স্তম্ভ নির্জনে দাঁড়াইয়া কুন্তলরাজ্যের সীমানা নির্দেশ করিতেছে। অস্তমান চন্দ্রের দূরপ্রসারী ছায়া ভূমির উপর সুকৃষ্ণ সীমারেখা টানিয়া দিয়াছে।

তিনটি অশ্ব স্তম্ভের ছায়ারেখার কিনারায় আসিয়া দাঁড়াইল। প্রধান রক্ষী নিঃশব্দে কালিদাসকে অশ্ব হইতে নামিবার ইঙ্গিত করিল; কালিদাস নামিলেন। প্রধান রক্ষী তখন সম্মুখের বনানীর দিকে বাহু প্রসারিত করিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলিল— ‘যাও, আর কখনো কুন্তলরাজ্যে পদার্পণ কোরো না। স্মরণ রেখো এ রাজ্যে প্রবেশ করলেই তোমার শূলদণ্ড—’

কালিদাস বাক্‌ নিষ্পত্তি করিলেন না, স্খলিত পদে বনের দিকে চলিলেন। যতক্ষণ তাঁহাকে দেখা গেল রক্ষীরা স্থিরভাবে অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়া রহিল। তারপর ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া, শূন্য-পৃষ্ঠ অশ্বটিকে মধ্যে লইয়া যো-পথে আসিয়াছিল সেই পথে ফিরিয়া চলিল।

প্রভাত হইয়াছে। বনের পাতায় পাতায় সোনালী সূর্যকিরণ লাগিয়াছে, মাকড়শার জালে শিশিরবিন্দু এখনো শুকায় নাই; পাখির কাকলি ও বানরের কিচিমিচিতে বনস্থলী পূর্ণ।

একটি বৃহৎ বটবৃক্ষ। তাহার স্থূল মূলগুলি স্থানে স্থানে মাটির গোপনতা ত্যাগ করিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছে; এইরূপ একটি মূলের উপর মাথা রাখিয়া কালিদাস ঘুমাইতেছেন। তাঁহার শয়নের ভঙ্গি দেখিয়া মনে হয়, রাত্রির অন্ধকারে যেখানে হোঁচট খাইয়া পড়িয়াছিলেন সেখানেই নিদ্রাভিভূত হইয়াছেন।

একটি বানরশিশু এই সময় এদিক ওদিক ঘুরিতে ঘুরিতে কালিদাসের কোল ঘেঁষিয়া বসিল এবং একটি বৃক্ষচ্যুত ফল তুলিয়া লইয়া পরম যত্নে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

ঘুমন্ত কালিদাসের অঙ্গে উষ্ণ স্পর্শ লাগিতেই তিনি একটি হাত দিয়া বানরশিশুটিকে জড়াইয়া লইলেন। বানরশিশু এই আলিঙ্গনের জন্য প্রস্তুত ছিল না, হঠাৎ ভয় পাইয়া কালিদাসের হাতে এক কামড় দিয়া দ্রুত পলায়ন করিল। কালিদাসের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।

এক হাতে ভর দিয়া কালিদাস ক্লান্তভাবে উঠিয়া বসিলেন। বেশবাস ছিন্ন, অঙ্গ ধূলিমলিন; চোখের কোলে ও গণ্ডে অশ্রুর চিহ্ন শুকাইয়া আছে। তিনি চক্ষু মার্জনা করিতে করিতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, তারপর একটি দীর্ঘ নিশ্বাস মোচন করিয়া শ্লথচরণে চলিতে আরম্ভ করিলেন।

বন শেষ হইয়া শুষ্ক মরুভূমি। দ্বিপ্রহরে কালিদাস এই মরুভূমির ভিতর দিয়া চলিয়াছেন। বালুকণা উড়িয়া আকাশ সমাচ্ছন্ন করিয়াছে; এই তপ্ত বালুঝটিকা উপেক্ষা করিয়া দিগ্‌ভ্রান্তের মত কালিদাস যাইতেছেন, তাঁহার চোখে মুখে এক দুর্লভ দুরাকাঙ্ক্ষা জ্বলিতেছে।

বালু-কুজ্ঝটিকার ভিতর দিয়া একটি ভগ্ন দেবায়তনের উচ্চ বহিঃপ্রাচীর দেখা গেল। কালিদাস সেই দিকে অগ্রসর হইয়া চলিলেন; প্রাচীরের নিকটবর্তী হইয়া তিনি একটি প্রস্তরখণ্ডে পা লাগিয়া পড়িয়া গেলেন।

প্রাচীর ধরিয়া কোনো ক্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া তিনি ক্ষণকাল ক্লান্তিভারে চক্ষু মুদিত করিয়া রহিলেন। তারপর চোখ খুলিয়া দেখিলেন তিনি প্রাচীরের যে-স্থানে বাহুর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া আছেন উহা একটি বিরাট মূর্তির ঊরুস্থল। কালিদাস ঊর্ধ্বে চাহিলেন; প্রাচীরের খোদিত বিশাল শঙ্কর-মূর্তি যেন এই বহ্নি শ্মশানে তপস্যারত। কালিদাস নতজানু হইয়া মূর্তির পদমূলে মাথা রাখিলেন, তারপর গলদশ্রু চক্ষু দেবতার মুখের পানে তুলিয়া ব্যাকুল প্রার্থনা করিলেন— ‘দেবতা, বিদ্যা দাও।’—

সূর্যাস্ত হইতেছে। দিগন্তহীন প্রান্তরে একাকী দাঁড়াইয়া কালিদাস যুক্তকরে বলিতেছেন— ‘সূর্যদেব, তুমি জগতের অন্ধকার দূর কর, আমার মনের অন্ধকার দূর করে দাও। বিদ্যা দাও।’

উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির। কৃষ্ণপ্রস্তরনির্মিত মন্দির আকাশে চূড়া তুলিয়াছে; চূড়ার স্বর্ণত্রিশূল দিনান্তের অস্তরাগ অঙ্গে মাখিয়া জ্বলিতেছে। সন্ধ্যারতির শঙ্খঘণ্টা ঘোর রবে বাজিতেছে। মন্দিরের বহিরঙ্গনে লোকারণ্য, স্ত্রী পুরুষ সকলে জোড়হস্তে তদ্‌গত-মুখে দাঁড়াইয়া আছে। আরতি শেষ হইলে সকলে অঙ্গনে সাষ্টাঙ্গে প্রণত হইল। অঙ্গনের এক কোণে এক বৃদ্ধ প্রণাম শেষ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, যুক্তকরে মন্দিরের পানে চাহিয়া প্রার্থনা করিল— ‘মহাকাল, আয়ু দাও।’

অনতিদূরে একটি নারী নতজানু অবস্থায় মন্দির উদ্দেশ করিয়া বলিল— ‘মহাকাল, পুত্র দাও।’

বর্মশিরস্ত্রাণধারী এক যোদ্ধা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— ‘মহাকাল, বিজয় দাও।’

বিনত ভুবনবিজয়ীনয়না একটি নবযুবতী লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলিল— ‘মহাকাল, মনোমত পতি দাও।’

দীনবেশী শীর্ণমুখ কালিদাস অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন— ‘মহাকাল, বিদ্যা দাও।’

পাতা-ঝরা একটি অরণ্য। নিষ্পত্র বৃক্ষ-শাখাগুলি আকাশে জাল রচনা করিয়াছে। নির্বিঘ্ন আলোক বনতলের কুন্ঠিত লজ্জা হরণ করিয়া ভূ-লুণ্ঠিত শুষ্ক পল্লবের মধ্যে সকৌতুক ক্রীড়া করিতেছে।

একটি আট-নয় বছরের গৌরাঙ্গী বালিকা এই বনভূমির উপর দিয়া নাচিতে নাচিতে গান গাহিয়া চলিয়াছে। তাহার পরিধানে শুভ্র বস্ত্র ও উত্তরীয়, কণ্ঠে কুন্তলে বাহুতে শ্বেত পুষ্পের আভরণ। বালিকা থাকিয়া থাকিয়া বঙ্কিম গ্রীবাভঙ্গি করিয়া পিছনে তাকাইতেছে, আবার গাহিতে গাহিতে আগে চলিয়াছে—

‘নীল সরসীজলে সিত কমলদলে

আমি নাচিয়া ফিরি আমি গাহিয়া ফিরি।’

লাস্যচপল চরণে বালিকা দৃষ্টি বহির্ভূত হইয়া গেল; তাহার গানের ধ্বনিও ক্রমশ ক্ষীণ হইয়া আসিতে লাগিল।

কালিদাস মোহগ্রস্তের ন্যায় বালিকার সঙ্গীতধ্বনি অনুসরণ করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার মুখ বিশীর্ণ, চক্ষু কোটর-প্রবিষ্ট। এক দুরন্ত উৎকণ্ঠা তাঁহাকে ওই অশরীরী সঙ্গীতের পিছনে টানিয়া লইয়া চলিয়াছে।

বনের অন্য অংশে বালিকা গাহিতে গাহিতে যাইতেছে—

‘হিম-তুষার-গলা আমি নির্ঝরিণী

মোর নূপুর বাজে রুম্‌ রিন্‌কি ঝিনি

আমি নাচিয়া ফিরি আমি গাহিয়া ফিরি।’

উপলবঙ্কিম গতি একটি সঙ্কীর্ণ জলধারা লঙ্ঘন করিয়া বালিকা নাচিতে নাচিতে চলিয়া গেল।

গানের রেশ মিলাইয়া যাইবার আগেই কালিদাস প্রবেশ করিলেন, ব্যগ্রচক্ষে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে তিনি অগ্রসর হইতেছেন। কোথায় গেল সেই সঙ্গীতময়ী! জলধারার তীরে দাঁড়াইয়া তিনি ক্ষণেক উৎকর্ণ হইয়া শুনিলেন, তারপর স্রোত উত্তীর্ণ হইয়া আবার চলিলেন।

দূরে একটি শ্বেতকমলপূর্ণ সরোবর। বালিকা সেইদিকে চলিয়াছে, তাহার কণ্ঠ-নিঃসৃত সঙ্গীত কাকলি চারিদিকে হিল্লোল তুলিয়াছে—

‘যেথা মরাল চাহে— ফিরি ফিরি

যেথা কপোত গাহে— ধীরি ধীরি

তীরে বন নিরজনে

আমি নাচিয়া ফিরি। আমি গাহিয়া ফিরি!’

বালিকা দূরে চলিয়া গেল, কালিদাস তাহাকে দেখিতে পাইয়া উন্মাদের মত তাহার পশ্চাতে চলিয়াছেন। বালিকা সরোবরের ঘাটে দাঁড়াইয়া একবার পিছু ফিরিয়া চাহিল, তারপর মৃদু হাসিয়া সোপান অবতরণ করিতে লাগিল।

কালিদাস যখন ঘাটে পৌঁছিলেন তখন বালিকা কোথায় অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে। ঘাটের সম্মুখে জলের উপর একদল কমল বায়ুভরে হেলিতেছে দুলিতেছে, যেন বালিকা এইমাত্র জলে ডুব দিয়া ওইখানে অন্তর্হিত হইয়াছে। ঘাটের নিম্নতন সোপানে নামিয়া কালিদাস পাগলের মত জলের পানে চাহিলেন; বাষ্পোচ্ছ্বাসে তাঁহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল। চঞ্চল পদ্মগুলির দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়া তিনি ভগ্নস্বরে বলিলেন— ‘কোথায় গেলে? দেবি, তুমি কোথায় গেলে?— শুনেছি তুমি পদ্মবনে থাক। আমাকে দয়া কর— বিদ্যা দাও— নইলে—’

তিনি মূর্ছিত হইয়া ঘাটের উপর পড়িয়া গেলেন।

মূর্ছিত অবস্থায় তিনি অনুভব করিলেন, সরসীর স্বচ্ছ জলতলে তিনি শুইয়া আছেন; দিক-আলো-করা এক পূর্ণযৌবনবতী দেবীমূর্তি শুচিস্মিত হাস্যে তাঁহার শিয়রে আসিয়া বসিলেন, তাঁহার মস্তকে হস্ত রাখিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিলেন— ‘কালিদাস!’

কালিদাসের ভাবাতুর নেত্র নিমীলিত, তিনি যুক্তকরে গদ্‌গদ কণ্ঠে বলিলেন— ‘মা!’

দেবী বলিলেন— ‘তুমি আমার বরপুত্র, তোমার কাব্য জগতে অমর হয়ে থাকবে। বারাণসী যাও, সেখানে আচার্য পাবে। ওঠ বৎস।’

হর্ষোৎফুল্ল মুখে কালিদাস উঠিবার চেষ্টা করিলেন, তাঁহার মুখ দিয়া কেবল বাহির হইল— ‘মা মা মা—!’

দেবী অবনত হইয়া কালিদাসের শিরশ্চুম্বন করিলেন, তারপর অপূর্ব জ্যোতিরুৎসবের মধ্যে দেবীমূর্তি মিলাইয়া গেল।