বাংলোর সামনে অনেকখানি বাগান। সেই বাগানে চেয়ার-টেবিল পেতে চা খেতে বসা হয়েছে। এখানে ঠাণ্ডা অনেক কম। দূরের পাহাড় রেখায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে, এক্ষুনি ড়ুব দেবে।
কাকাবাবু পট থেকে তৃতীয় কাপ চা ঢেলে নিলেন।
সন্তু ঘুরে ঘুরে ফুলের গাছগুলো দেখছে। জোজো আপনমনে একটা গান গাইছে গুনগুন করে।
নরেন্দ্র আর পুলিশের দলবল ফিরে গেছে একটু আগে। আবার ফিরে আসবে সন্ধের সময়।
সন্তু একটা ফুল হাতে নিয়ে টেবিলের কাছে এসে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, এটা কী ফুল বলো তো? অনেকটা গোলাপের মতন দেখতে, কিন্তু গোলাপ নয়।
কাকাবাবু বললেন, ক্যামেলিয়া। পাহাড়ি জায়গাতেই হয়। পাহাড়ি গোলাপেও গন্ধ থাকে না। গোলাপ তো আসলে শুকনো জায়গার ফুল।
সন্তু বলল, তা জানি। গোলাপ ফুল এসেছে আরব দেশ থেকে। আসল নাম তো গোলাপ নয়, জোলাপ!
জোজো গান থামিয়ে বলল, জোলাপ? অ্যাঁ, কী বাজে শুনতে লাগে!
সন্ত চেয়ারে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করল, তুই গান গাইছিলি রে জোজো?
জোজো বলল, কোনও গান নয়, এমনি একটা সুর।
সন্তু বলল, সেই অস্ট্রেলিয়ার নদীর গানটা আর একবার কর তো!
জোজো গেয়ে উঠল, লা হিলাহুল হামপা, গুলগুল কিরিকিরি, ডিংডাং হামপা —
সন্তু বলল, যাঃ, ঠিক হচ্ছে না। তুই নিজেই কথাগুলো ভুলে গেলি? আমার মনে আছে। এইরকম : লা হিলাহুলা হাম্পা, গুলগুল টরে টরে, ইয়াম্পু হামপা…
জোজো বলল, আমি পরের লাইনটা গাইলাম।
কাকাবাবু বললেন, বেশ সুরটা, আর-একবার গাও! সন্তু আর জোজো দুজনেই গাইল। তারপর
জোজো বলল, কাকাবাবু, এই যে লোকটা শুধু হুঁ হুঁ করছিল, সেটা শুনে আমার আর-একটা গান মনে পড়ে গেল। আফ্রিকায় ওরাকু নামে একটা ট্রাইব আছে, তারা গায়। শুনবেন?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
জোজো গাইল :
হুঁ হুঁ কিলা কিলা কিলা
হুঁ হুঁ গিলা গিলা গিলা
হুঁ হুঁ ইলা কিলা টিলা
টংগো রে, টংগো রে…
কাকাবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, বাঃ বাঃ, চমৎকার! জোজো, তুমি তো অনায়াসে আধুনিক বাংলা গানের সুরকার হয়ে যেতে পারো। অনেকরকম গানের। সুর নিয়েই তো আধুনিক গান হয়।
সন্তু বলল, তুই গানটা এইমাত্র বানালি, না রে জোজো?
জোজো বলল, বানাইনি। এইমাত্র মনে পড়ল।
কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা জোজো, তোমার কি মনে হয়, ওই হু হু করা লোকটা কি সত্যি পাগল?
জোজো বলল, মোটেই না। সেয়ানা পাগল!
সন্তু বলল, আমার ধারণা, লোকটা পাগলই। নইলে তো বলতেই পারত, এমনিই মন্দির দেখতে গিয়েছিল। পুরুতরা ঘুমোচ্ছে দেখে তাদের ডেকেছিল। এটা কিন্তু কিছু দোষের কাজ নয়। সাধারণ লোকেরাই তা করত। নিজের নাম, গ্রামের নামও বানিয়ে বলে দিতে পারত।
কাকাবাবু বললেন, আমরা যখন ডিটেকটিভ গল্প পড়ি, তাতে দেখা যায়, সব লোকেরই যেন কিছু না কিছু মতলব থাকে। সব লোককেই সন্দেহ করতে হয়। কিন্তু অনেক লোক তো এমনিই সাধারণ লোক হয়, অনেক পাগল সত্যিই ঘুরে বেড়ায়!
জোজো জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনি কখনও খুনের মামলায় ডিটেকটিভগিরি করেছেন?
কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, কোনওদিন না। সাধারণ চুরি, ডাকাতি, খুন এইসব ব্যাপার নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাইনি। ভাল বুঝিও না। এবারে দেখবি, আমি ঠিক হেরে যাব, এই মূর্তি উদ্ধার করা আমার দ্বারা হবে না।
জোজো বলল, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
কাকাবাবু উৎসাহের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চেষ্টা করে দেখো! যদি ওই পাগলটার পেট থেকে কথা বের করতে পারো।
সন্তু বলল, পাগলটা একটা উপকার করে গেছে। জোজো একটা নতুন গান বানিয়ে ফেলেছে।
সন্তু গানটা গাইবার চেষ্টা করল।
জোজো বলল, আমি একসময় আমার এক পিসেমশাইয়ের কাছ থেকে ধ্যান করা শিখেছিলাম। তিনি খুব বড় তান্ত্রিক। এক মনে ধ্যান করতে করতে কোনও জিনিসের কথা ভাবলে, সেটা দেখতে পাওয়া যায়। তবে ধ্যান করতে হয় রাত দুটোর সময়। আজ চেষ্টা করে দেখব।
সন্তু বলল, রাত দুটো পর্যন্ত জাগতে পারবি?
জোজো বলল, তুই ডেকে দিবি।
কাকাবাবুর কোটের পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল এই সময়।
ফোন করছেন নরেন্দ্র ভার্মা। তিনি বললেন, রাজা, যে-লোকটাকে ধরা হয়েছিল, থানায় এনে তার আঙুলে পিন ফুটিয়েও একটা কথা বের করা যায়নি। লোকটা বোধ হয় সত্যি পাগল। ওকে ছেড়ে দিতে বলেছি। এখনও পর্যন্ত আর কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি। তবে, এখানকার পুলিশ একটা খবর এনেছে। এখানকার শ্মশানে একজন সাধু থাকেন, তাঁর নাকি দূরদৃষ্টি আছে। খুব বড় যোগী। কোনও জিনিসের ছবি দেখালে তিনি বলে দিতে পারেন, সেই জিনিসটা কোথায় আছে। তাঁকে আনা হয়েছে এখানে। গাড়ি পাঠাচ্ছি। তোমরা চলে এসো।
ফোনটা অফ করে কাকাবাবু বললেন, জোজো, তোমার একজন প্রতিযোগী এসে গেছে। এখানকার একজন সাধু। তিনিও দূরের জিনিস দেখতে পান। তাঁকে দিয়ে চেষ্টা করানো হচ্ছে।
সন্তু বলল, এই রে জোজো, তোর চান্সটা ফসকে গেল!
জোজো বলল, ও পারবে না। অত সোজা নাকি? আমি আজ রাত দুটোর সময় ধ্যানে বসব। রাত্তিরে নিরামিষ খেতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, চলো সাধুর ব্যাপারটা দেখে আসা যাক।
একটু পরেই গাড়ি এসে গেল।
সাধুকে আনা হয়েছে ভূপিন্দার সিং-এর চেম্বারে। দরজা-জানলা সব বন্ধ। মেঝেতে এক বাঘছালের ওপর বসে আছেন সেই সাধুবাবা। বেশ বড়সড় চেহারা, মাথায় জটা, মুখভর্তি দাড়ি। এই শীতের মধ্যেও শুধু একটা নেংটি পরা, খালি গা। তাতে ছাই মাখা। তিনি চোখ বুজে ধ্যান করছেন।
সাধুবাবাকে ঘিরে কয়েকটি চেয়ার, তাতে নরেন্দ্র ভার্মা, ভূপিন্দার সিং ও দুজন বড় অফিসার বসে আছেন। একজন কনস্টেবল হাঁটু গেড়ে বসে আছে সাধুবাবার সামনে। কাকাবাবুরা চুপচাপ বসে পড়লেন।
তবু চেয়ার টানার সামান্য শব্দেই সাধুবাবা চোখ মেলে তাকালেন। একটা চোখ! আর-একটা চোখ একেবারে বন্ধ। বোঝা গেল, সে-চোখটা নষ্ট।
সামনের একটা ধুনিতে নারকেল ছোবড়ার আগুন জ্বলছে। কনস্টেবলটি তাতে একটু একটু ঘি দিচ্ছে আর ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে ঘর।
সন্তু জোজোকে ফিসফিস করে বলল, যাদের একটা চোখ কানা হয়, তাদের অন্য চোখটার দৃষ্টিশক্তি অনেক বেশি হয়, তাই না রে?
জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে ঠোঁট ওলটাল।
খানিক বাদে সাধুবাবা হুঙ্কার দিয়ে উঠল, বোম্! বোম্! জয় বাবা ভূতেশ্বর! জয় শঙ্কর!
আবার একটা চোখ খুললেন। জ্বলজ্বল করছে সেই চোখ। মনে হয় যেন, ওই চোখ দিয়ে একসময় আগুন বেরোবে। অনেক ছবিতে যেমন দেখা যায়।
কনস্টেবলটি ভূতেশ্বর মূর্তির ছবিখানা সাধুবাবার মুখের সামনে তুলে ধরল।
সেদিকে কয়েক পলক চেয়েই সাধুবাবা ছবিটা সরিয়ে দিলেন। তারপর আবার চোখ বুজে এক আঙুল দিয়ে নিজের কপালটা ঘষতে লাগলেন খুব জোরে জোরে। আর সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছেন, বোম, বোম! জয় বাবা ভূতেশ্বর!
মিনিটের পর মিনিট তিনি কপালটা ঘষতেই লাগলেন।
সন্তু কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, উনি ওরকম করছেন কেন?
কাকাবাবুর বদলে নরেন্দ্র বললেন, যোগীদের কপালের মাঝখানে একটা তিন নম্বর চোখ থাকে। সেই চোখ দিয়েই দূরের সবকিছু দেখা যায়। সেই চোখটা খোলার চেষ্টা করছেন।
একটু পরে থেমে গিয়ে সাধুবাবা কীসব যেন বলতে লাগলেন। পাহাড়ি ভাষা, ঠিক বোঝা গেল না।
কনস্টেবলটি বুঝিয়ে দিল, মরমদগাঁও আর কিষণপুর, এই দু জায়গায় মন্দির আছে, এই দুটোর মধ্যে কোনও একটাতে আছে ভূতেশ্বরের মূর্তি।
ভূপিন্দার সিং বললেন, মরমদগাঁও আর কিষণপুর নামে দুটো গ্রাম আছে ঠিকই। আর গ্রাম থাকলে মন্দির থাকবেই। কিন্তু দুটো দু দিকে।
নরেন্দ্র বললেন, দু দিকে মানে কতদূর?
ভূপিন্দার সিং বললেন, কিষণপুর পঁচিশ কিলোমিটার হবে। আর মরমদগাঁও প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার।
নরেন্দ্র বললেন, এমন কিছু দূর নয়। চলো, দুটোই দেখে আসা যাক। সাধুবাবাকে ভাল করে খাবারটাবার দাও! চলো, রাজা—
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে-আস্তে বললেন, দেখো নরেন্দ্র, এসব অলৌকিক ব্যাপারে আমার একটুও বিশ্বাস নেই। যা আমি বিশ্বাস করতে পারি না, তার পেছনে ছুটোছুটি করতে যাব কেন? তোমরা ঘুরে এসো, যদি পেয়ে যাও তো ভাল কথা, আমি ডাক বাংলোতে অপেক্ষা করব।
নরেন্দ্র বললেন, আমি যে খুব বিশ্বাস করি, তা নয়। তবে কী জানো, জলে ডোবার সময় মানুষ একটা তৃণখণ্ডও আঁকড়ে ধরে। অনেক সময় এইসব মিলেও যায়। তাই গিয়ে দেখতে চাই। পুরুত দুজনের কাছ থেকেও কিছু জানা গেল না। ওরা গাঁজা খেয়ে ঘুমোচ্ছিল। চোরকে দেখেনি।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আমরা যাব?
কাকাবাবু বললেন, যা না, ঘুরে আয়। খানিকটা বেড়ানোও তো হবে।
কাকাবাবুকে বাংলোতে নামিয়ে ওরা চলে গেল।
কাকাবাবু খানিকক্ষণ ক্রাচ বগলে নিয়ে বাগানে পায়চারি করলেন। কিন্তু এর মধ্যেই বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে, বাইরে থাকা যায় না। তিনি বারান্দায় উঠে এসে বসলেন একটা ইজিচেয়ারে।
একটু পরে নৃপেন এসে বলল, সার, আপনাকে চা কিংবা কফি বানিয়ে দেব?
কাকাবাবু বললেন, এক কাপ কফি পেলে মন্দ হয় না। কালো কফি, চিনি-দুধ ছাড়া।
নৃপেন কফি নিয়ে এসে দিল কাকাবাবুকে, তারপর দাঁড়িয়েই রইল সেখানে। সে কিছু কথা বলতে চায়।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর? রাত্তিরে কী খাওয়াবে?
নৃপেন বলল, ভাল খাসির মাংস পাওয়া গেছে। কোরমা বানিয়েছি। আর ছানার ডালনা। গরম গরম আলুভাজা করে দেব।
অত কিছুর দরকার নেই।
র, ভূতেশ্বরের মূর্তিটা পাওয়া গেল?
অ্যাঁ? তার মানে?
ভূতেশ্বরের মূর্তি চুরি গেছে। সেটা উদ্ধার করার জন্যই তো আপনাকে ডেকে আনা হয়েছে।
এসব কে বলো তোমাকে?
অনেকেই ভূতেশ্বর চুরির কথা জেনে গেছে।
কাকাবাবু হাসলেন। হাজার চেষ্টা করলেও এসব গোপন রাখা যায় না। হয়তো থানা থেকেই কেউ বাইরে বলে দিয়েছে। অনেক পুলিশও তো ঠাকুর-দেবতা মানে খুব।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, মূর্তিটা পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে। খুব। শেষ পর্যন্ত না পাওয়া গেলে বুঝি খুব গোলমাল হবে?
নৃপেন বলল, তা তো হবেই। শিবরাত্রির মেলা এখানকার সবচেয়ে বড় উৎসব। কত দূর দূর থেকে মানুষ আসে। প্রত্যেক গ্রামের দেবতাদের নিয়ে আসা হয়। কোনও গ্রামের দেবতা যদি মিছিলে না থাকে, তা হলে সেটা সে গ্রামের লোকদের পক্ষে দারুণ অপমানের ব্যাপার। তারা তুলকালাম বাধাবে।
এক সাধুবাবা কিছু একটা সন্ধান দিয়েছেন। সেখানে পুলিশের বড় অফিসাররা খোঁজ করতে গেছেন।
আপনি গেলেন না?
আমার খোঁড়া পা, পাহাড়ে উঠতে কষ্ট হয়। আচ্ছা ঠিক আছে, পরে আবার কথা হবে।
কাকাবাবু হাত তুলে একটা ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি এখন একা থাকতে চান।
নৃপেনের বোধ হয় বাংলা কথা বলার খুব ইচ্ছে হয়েছিল, সে খানিকটা নিরাশ হয়ে চলে গেল আস্তে-আস্তে।
কাকাবাবু চুপ করে সামনের দিকে চেয়ে বসে রইলেন।
সন্তু আর জোজো ফিরে এল রাত দশটার একটু পরে।
জোজো বলল, রাবিশ! আমি জানতাম, ওই সাধুটা কিছু বলতে পারবে না!
সন্তু বলল, একেবারে মেলেনি, তা বলা যায় না। কা
কাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, খানিকটা মিলেছে?
সন্তু বলল, আমরা দুটো গ্রামেই গেলাম। দুজায়গাতেই মন্দির আছে। দুটো মন্দিরই শিবের মন্দির। একটা মন্দিরের নামও ভূতেশ্বর মন্দির। সে ভূতেশ্বরের মূর্তি অন্য একটা, বেশ ছোট। চুরি যাওয়া মূর্তিটার সঙ্গে কোনও মিল নেই।
জোজো বলল, শিবমন্দির তো অনেক থাকতেই পারে। সাধুদের কাজই তো ঘুরে ঘুরে মন্দির দেখা। শুধু শুধু আমাদের ঘুরিয়ে মারল।
কাকাবাবু বললেন, খানিকটা বেড়ানো তো হল।
সন্তু বলল, মরমদগাঁও-এর রাস্তাটা খুব সুন্দর। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। একটা ঝরনাও দেখলাম।
জোজো বলল, আমার খুব খিদে পেয়েছে। শীতের দেশে এলে আমার বেশি বেশি খিদে পায়।
কাকাবাবু বললেন, খিদে পাওয়া তো ভাল স্বাস্থ্যের লক্ষণ। এসো, তা হলে খেয়ে নেওয়া যাক।
খাওয়ার টেবিলে বসার পর পরিবেশন করতে লাগল নৃপেন। একসময় সে জোজোকে জিজ্ঞেস করল, সন্তুবাবু, মূর্তিটা পাওয়া গেল না এখনও?
জোজো আঙুল দেখিয়ে বলল, সন্তু ওর নাম। মারামারিতে চ্যাম্পিয়ান। আমার নাম জোজো, আমি বুদ্ধি খাটাই।
সন্তু অবাক হয়ে একবার নৃপেনের দিকে, একবার কাকাবাবুর দিকে তাকাল।
কাকাবাবু বললেন, অনেকেই জেনে গেছে। না নৃপেন, এখনও হদিস করা যায়নি। তুমি এবার মাংসটা নিয়ে এসো।
নৃপেন চলে যেতেই সন্তু বলল, এই জোজো, তুই ওই কথা বললি কেন রে? আমি বুঝি সবসময় মারামারি করি?
তার কথার উত্তর না দিয়ে জোজো বলল, জানেন কাকাবাবু, কারও সঙ্গে মারামারি করতে হচ্ছে না বলে সন্তুর হাত নিশপিশ করছে!
সন্তু বলল, মোটেই না! আমার তো ইচ্ছে করছে, এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে। মানালিতে কত কী দেখার আছে, তারপর সেখান থেকে রোটাং পাস। আমরা তো হিমালয় দেখতেই এসেছি এবারে।
জোজো বলল, মূর্তিটা উদ্ধার না হলে কাকাবাবুকে এখান থেকে ছাড়বেই না। দেখি, আমি আজ রাত দুটোর সময় চেষ্টা করে। তখন ধ্যানে বসব।
সন্তু বলল, তা হলে এক্ষুনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
জোজো বলল, না, একবার ঘুমোলে উঠতে পারব না। বই পড়ব। জেগেই থাকব আজকের রাতটা।
খাওয়ায় পর আর বাইরে বসা গেল না। শীত বেড়েছে, কনকনে হাওয়া দিচ্ছে।
কাকাবাবু নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। সন্তু আর জোজো পাশের ঘরে।
খাওয়া শেষ করেই ঘুমনো অভ্যেস নেই কাকাবাবুর। কিছুক্ষণ অন্তত বই পড়েন। বই পড়তে-পড়তেই ঘুম এসে যায়।
তিনি একটা ভ্রমণকাহিনী খুলে বসলেন।
বেশিক্ষণ পড়তে পারলেন না। পাশেই বিছানাটা খুব লোভনীয় মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে গরম কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়তে।
যতই শীত হোক, কাকাবাবু সব দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমোতে পারেন না। একটা জানলা খুলে রাখলেন। পোশাক বদলে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর সেই জানলা দিয়ে দেখতে পেলেন চাঁদ। আকাশে একটুও মেঘ নেই, নীল আকাশে চাঁদটা ঝকঝক করছে।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় তাঁর চোখ বুজে এল।
কিছুক্ষণ পর তাঁর ঘুম ভেঙে গেল একটা শব্দ শুনে। তাঁর ঘুম খুব সতর্ক, সামান্য শব্দতেই জেগে ওঠেন। তাঁর শত্ৰুসংখ্যা অনেক, তাই রাত্তিরবেলা রিভলভারটা রেখে দেন বালিশের নীচে।
দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে।
কাকাবাবু শুয়ে-শুয়েই জিজ্ঞেস করলেন, কে?
কোনও উত্তর নেই। আবার সেই শব্দ।
কাকাবাবু দুবার জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পেলেন না। এত রাতে কে আসতে পারে? পুলিশের লোক হলে সাড়া দেবে না কেন?
কাকাবাবু উঠে পড়ে আলো জ্বাললেন। রিভলভারটা হাতে নিয়ে, ক্রাচ ছাড়াই লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন।
কেউ নেই সেখানে।
কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। এ আবার কী ব্যাপার? তিনি মোটেই ভুল শোনেননি। বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ঠক ঠক শব্দ হয়েছে।
কেউ কি লুকিয়ে আছে?
জ্যোৎস্নার রাত। কাছাকাছি কেউ থাকলে দেখা যাবেই। বারান্দা কিংবা সামনের বাগানটা ফাঁকা। শুনশান রাত, কোনও শব্দ নেই, শুধু আকাশের চাঁদ ছাড়া আর কেউ জেগে নেই মনে হয়। স্যুদের ঘরেও আলো নেভানো।
একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কাকাবাবু দরজাটা বন্ধ করতে যেতেই বারান্দার এক কোণে চোখ পড়ল। চাঁদের আলোয় ওখানে কী যেন একটা চকচক করছে।
কৌতূহলী হয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। তারপর চমকে উঠলেন দারুণ ভাবে। একটা বেশ বড় মূর্তি। ভূতেশ্বরের মূর্তি? হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই, ছবিতে দেখা সেই ভূতেশ্বরের মূর্তির সঙ্গে হুবহু মিল!
কাকাবাবু রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেলেন দেওয়ালের দিকে।
কে এখানে মূর্তিটা রেখে গেল?
কেউ ফাঁদ পেতেছে? মূর্তিটার লোভ দেখিয়ে কেউ কাকাবাবুকে বাইরে টেনে এনেছে, এবার গুলিটুলি চালাবে?
তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। সেরকম কিছুই ঘটল না। এবার তিনি নিজেই বারান্দা পেরিয়ে নেমে এলেন বাগানে।, কেউ নেই। মূর্তিটা যে বা যারাই আনুক, এর মধ্যে সরে পড়েছে।
আবার উঠে এসে কাকাবাবু বারান্দায় আলো জ্বালালেন। ভাল করে দেখলেন মূর্তিটাকে। বেশ পুরনো মূর্তি, দাঁড়িয়ে থাকা শিব, কপালে একটা চোখ, মাথার চুল যেন একটা কুণ্ডলী পাকানো সাপ।
কে এসে মূর্তিটা ফেরত দিয়ে গেল? চুরি করেছিল কেন, ফেরত দিলই বা কেন? মন্দিরে ফেরত না দিয়ে এখানে আনারই বা মানে কী? এটা কি তাঁকে উপহার?
তিনি এ পর্যন্ত চুরির কোনও সূত্র খুঁজে পাননি, কাউকে সন্দেহও করেননি। সুতরাং তাঁকে ভয় পাওয়ারও কোনও কারণ নেই। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি সন্তু আর জোজোকে ডেকে তুললেন। সন্তু চট করে উঠে পড়ে, জোজোকে ধাক্কা মেরে জাগাতে হয়।
কাকাবাবু বললেন, দ্যাখ সন্তু, কী কাণ্ড!
সন্তু কাছে গিয়ে মূর্তিটা ভাল করে পরীক্ষা করে বলল, এই সেই ভূতেশ্বর? এখানে কী করে এল?
কাকাবাবু বললেন, সেটাই তো রহস্য!
তারপর তিনি হা হা করে হেসে উঠলেন।
হাসতে হাসতে বললেন, আমার জীবনে এরকম কখনও হয়নি। আমি কোনও চেষ্টা করলাম না। কিছুই বুঝতেই পারলাম না। এমনি এমনি একটা রহস্য মিটে গেল! সন্তুকেও মারামারি করতে হল না।
জোজো বলল, বলেছিলাম কিনা, আমিই এই কেসটা সল্ভ করব!
সন্তু বলল, অ্যাঁ? তুই আবার কখন কী করলি?
জোজো বলল, ধ্যান করে লোকটাকে খুঁজে পেলাম। তারপর তাকে অ্যায়সা ভয় দেখালাম! তাকে বললাম, আজ রাত্তিরের মধ্যে মূর্তিটা ফেরত না দিয়ে গেলে তুই রক্ত আমাশায় মরবি! তাই তো ব্যাটা সুড়সুড় করে ফেরত দিয়ে গেল!
সন্তু বলল, তুই ধ্যান করলি কখন? তুই তো বইও পড়লি না, ঘুমিয়ে পড়লি সঙ্গে সঙ্গে। আমি কম্বল চাপা দিয়ে দিলাম তোর গায়ে।
বজোজো বলল, ওসব তুই বুঝবি না। শুয়ে শুয়েও ধ্যান করা যায়। সত্যিকারের ধ্যান আর গভীর ঘুমের মধ্যে কোনও তফাত নেই। ওই চোরটাও ঘুমোচ্ছিল। আমি ঘুমের মধ্যে সাঁতরে সাঁতরে তাকে ছুঁয়ে ফেললাম!
সন্তু বলল, তুই যে বললি, রাত দুটোর আগে তোর ধ্যানের ক্ষমতা আসে না? এখন তো মাত্র পৌনে একটা বাজে!
কাকাবাবু বললেন, শোনো জোজো, ওই ধ্যানের ব্যাপারটা লোকজনদের বোঝানো শক্ত হবে। ওটা এখন থাক। আর অকারণে মিথ্যে কথাও আমার মুখ দিয়ে বেরোয় না।
সন্তু বলল, কিন্তু নরেন্দ্রকাকা, অন্য পুলিশরা তো জানতে চাইবে, কী করে মূর্তিটা উদ্ধার করা হল। তখন তুমি কী বলবে?
কাকাবাবু বললেন, কিছুই বলব না, শুধু মুচকি মুচকি হাসব। তোরাও তাই করবি!