০৪. ফিহা গাড়ি থেকে নামলেন

ফিহা গাড়ি থেকে নামলেন সন্ধ্যাবেলা। স্টেশনে আলো জ্বলছিল না। চারদিক কেমন চুপচাপ থমথম করছে। যাত্রী বেশি নেই, যে কয়জন আছে তারা নিঃশব্দে চলাফেরা করছে। বছর পাঁচে<ৎ আগেও একবার এসেছিলেন ফিহা। তখন কেমন গমগম করত চারদিক। টুরিদ্ষ্টের দল হৈ হৈ করে নামত। অকারণ ছোটাছুটি, ব্যস্ততা, চেঁচামেচি–চমৎকার লাগত। এখন সব বদলে গেছে। ফিহার কিছুটা নিঃসঙ্গ মনে হল।

আমার আসতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল। ফিহা তাকিয়ে দেখলেন, নিকি পৌঁচেছে। নিকিকে তার করা হয়েছিল স্টেশনে থাকার জন্যে। ফিহা বললেন, এমন অন্ধকার যে?

কদিন ধরেই তো অন্ধকার।

কেন?

পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ। সমস্তই বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছেন। জানেন না?

না।

একটা উপগ্রহ ছাড়া হচ্ছে। এখানকার পৃথিবীর কিছু শিশুকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে, যাতে করে শেষ পর্যন্ত মানুষের অস্তিত্ব বেঁচে থাকে। স্রুরার পরিকল্পনা।

অ।

দু জনে নীরবে হাঁটতে লাগলেন। ফিহা বললেন, সমস্ত বদলে গেছে।

হ্যাঁ। সবাই হতাশ হয়ে গেছে। উৎপাদন বন্ধ, স্কুল-কলেজ বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ। খুব বাজে ব্যাপার।

হুঁ।

আপনি হঠাৎ করে এ সময়ে?

আমি কিছু ভাবতে এসেছি। নিরিবিলি জায়গা দরকার।

টাইফা গ্রহ নিয়ে?

হুঁ।

আপনার কী মনে হয়? কিছু করা যাবে?

জানি না, হয়তো যাবে না, হয়তো যাবে। ঘর ঠিক করেছ। আমার জন্যে?

জ্বি।

আমার একটা কম্পিউটার প্রয়োজন।

কম্পিউটার চালাবার মতো ইলেকটিসিটি কোথায় পাবেন?

ছোটখাটো হলেও চলবে। কিছু হিসাব-টিসাব করব। আছে সে রকম?

তা আছে।

বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দু কামরার ঘর একটা। ফিহার পছন্দ হল খুব। নিকি বড় দেখে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। ফিহা বসে বসে খবরের কাগজ দেখতে লাগলেন। এ কয়দিন তাঁর বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। অথচ ইতিমধ্যে বেশ পরিবর্তন হয়েছে পৃথিবীতে। সবচে আগে তাঁর চোখে পড়ল শীতলকক্ষের খবরটি। শীতলকক্ষ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শীতলকক্ষের সমস্ত ঘুমন্ত মানুষদের জাগান হয়েছে, তারা ফিরে গেছে আত্মীয়স্বজনদের কাছে। কী আশ্চর্য!

পৃথিবীতে শীতলকক্ষ স্থাপনের যুগান্তকারী পরিকল্পনা নিয়েছিলেন নেতেনটি। ভারি চমৎকার একটি ব্যবস্থা। নব্বুই বছর বয়স হওয়ামাত্র যেতে হবে শীতলকক্ষে। সেখানে তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে আরো এক শ বছর। এর ভেতর তারা মাত্র পাঁচবার কিছুদিনের জন্যে তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে ফিরে যেতে পারবেন। তারপর আবার ঘুম। ঘুমোতে ঘুমোতেই নিঃশব্দ মৃত্যু। নেতেনটির এই সিদ্ধান্তের খুব বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়েছিল প্রথম দিকে, পরে অবশ্য সবাই মেনে নিয়েছিলেন। তার কারণও ছিল। চিকিৎসা-বিজ্ঞান তখন এত উন্নত যে একটি মানুষ অনায়াসে দেড় শ বছর বাঁচতে পারে। অথচ নাবুই বছরের পর তার পৃথিবীকে দেবার মতো কিছুই থাকে না। বেঁচে থাকা সেই কারণেই অৰ্থহীন। কাজেই শীতলকক্ষের শীতলতায় নিশ্চিন্ত ঘুম। মানুষটি বেঁচে থাকলে তার পিছনে যে খরচটি হত তার লক্ষ ভাগের একভাগ মাত্র খরচ এখানে। হার্টের বিট সেখানে ঘণ্টায় দুটিতে নেমে আসে, দেহের তাপ নামে শূন্য ডিগ্ৰীীর কাছাকাছি। সেখানে শরীরের প্রোটোপ্লাজমকে বাঁচিয়ে রাখতে খুব কম শক্তির প্রয়োজন।

শীতলকক্ষের সব মানুষ জেগে উঠে তাদের প্রিয়জনদের কাছে ফিরে গেছে–এ খবর ফিহাকে খুব আলোড়িত করল। দু-তিন বার পড়লেন খবরটি। নিজের মনেই বললেন, সত্যিই কি মহাবিপদ? সমস্ত-নিয়ম কানুন ভেঙে পড়ছে এভাবে। না—তা কেন হবে–

যারা কোনো দিন পৃথিবীকে চোখেও দেখল না, তাদের কথা কি কখনও ভেবেছেন ফিহি?

নিকি চা নিয়ে কখন যে ফিহার সামনে এসে বসেছে এবং চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে, ফিহা তা লক্ষই করেন নি।

কাদের কথা বলছ নিকি?

মানুষদের কথা, যাদের জন্ম হয়েছে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে মহাকাশযানে কিংবা অন্য উপগ্রহে। জানেন ফিহা, পৃথিবীতে ফিরে এসে একবার শুধু পৃথিবীকে দেখবে, এই আশায় তারা পাগলের মতো।–

নিকি, তুমি জান আমি কবি নই। এসব বাজে সেন্টিমেন্ট আমার ভালো লাগে art!

আমি দুঃখিত। চায়ে চিনি হয়েছে?

হয়েছে।

আপনার আর কিছু লাগবে, কোনো সহকারী?

না, তার প্রয়োজন নেই। তুমি একটা কাজ করবে নিকি?

বলুন কি কাজ।

আমার বাবা-মা শীতলকক্ষ থেকে বেরিয়ে হয়তো আমাকে খুজছেন।

তাদের এখানে নিয়ে আসব?

না না। তাঁরা যেন আমার খোঁজ না পান। আমি একটা জটিল হিসাব করব। খুব জটিল!

ঠিক আছে।

রাতে বাতি নিভিয়ে ফিহা সকাল সকাল শুয়ে পড়লেন। মাথার কাছে মোমবাতি রেখে দিলেন। রাত-বিরেতে ঘুম ভেঙে গেলে আলো জ্বালিয়ে পড়তে ভালোবাসেন, এই জন্যে। চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে, এমন সময় একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল। ফিহার মনে হল ঘরের ভিতর কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারে আবছা মতো একটা মূর্তি দেখতে পেলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, কে?

আমি।

আমিটি কে?

বলছি। দয়া করে বাতি জ্বালাবেন না।

ফিহা নিঃশব্দে বাতি জ্বালালেন। আশ্চর্য। ঘরে কেউ নেই। তিনি বাতি হাতে বাইরের বারান্দায় দাঁড়ালেন। চাঁদ উঠেছে আকাশে। চমৎকার জ্যোৎস্না হয়েছে।

কাল সকালে ডাক্তারের কাছে যাব। আমি অসুস্থ, আরোল-তাবোল দেখছি। জটিল একটা অঙ্ক করতে হবে। আমাকে। এ সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। ফিহা মনে মনে বললেন।

বাকি রাতটা তাঁর বারান্দায় পায়চারি করে কাটল।

 

মাথুর ঘরের উজ্জ্বল আলো নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। সমস্ত বইটা পড়তে আমার এক ঘণ্টার বেশি লাগবে না। মনে মনে এই ভাবলেন। আসন্ন বিপদের হয়তো তাতে কোনো স্রুরাহা হবে না, তবু তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। ড়ুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। সে তুলনায় এ তো অনেক বড় অবলম্বন। স্বয়ং ফিহা বলে পাঠিয়েছেন যেখানে।

রাত জেগে জেগে মাথুরের মাথা ধরেছিল। চোখ কার্যকর করছিল। তবু তিনি পড়তে শুরু করলেন। বাইরে অনেক রাত। বারান্দায় খ্যাপার মতো হাঁটছেন স্রুরা। খটখট শব্দ হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকক্ষে। সমস্ত অগ্রাহ্য করে মাথুর পড়ে চললেন। মাঝে মাঝে অস্পষ্টভাবে বলতে লাগলেন, আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! তা কী করে হয়? না না অসম্ভব।

–আমি নিশ্চিত বলতে পারি যিনি এই বই পড়ছেন, রূপকথার গল্প ভেবেই পড়ছেন। অথচ এখানে যা যা লিখেছি একদিন আমি নিজেই তা প্রত্যক্ষ করেছি। মাঝে মাঝে আমারো সমস্ত ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। মনে হয়, হয়তো আমার মাথার দোষ হয়েছিল, বিকারের ঘোরে কত কী দেখেছি। কিন্তু আমি জানি মস্তিষ্ক বিকৃতিকালীন স্মৃতি পরবর্তী সময়ে এত স্পষ্ট মনে পড়ে না। তখনি সমস্ত ব্যাপারটাকে সত্য বলে মনে হয়। বড় রকমের হতাশা জাগে। ইচ্ছে করে মরে যাই! ঘুমুতে পারি না, খেতে পারি না, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। এই জাতীয় অস্থিরতা ও হতাশা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমি লিখতে শুরু করলাম এই আশায়, যে, কেউ একদিন আমার লেখা পড়ে সমস্তই ব্যাখ্যা করতে পারবে। অনেক সময়ই তো দেখা গেছে আজ যা রহস্য, কাল তা সহজ স্বাভাবিক সত্য। আজ যা বুদ্ধির অগম্য, কাল তা-ই সহজ সীমান্য ঘটনা।

আমার সে রাতে ঘুম আসছিল না। বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছি। ঘরে দ্বিতীয় প্রাণী নেই। আনা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে তার মার কাছে বেড়াতে গেছে। বিশেষ কাজ ছিল বলে আমি যেতে পারি নি। ফাঁকা বাড়ি বলেই হয়তো আমার বিষন্ন লািগছিল। সকাল সকাল শুয়েও পড়েছিলাম। ঘুম এল না–মাথা দপদপ করতে লাগল। এক সময় দুর ছাই বলে বাগানে চেয়ার টেনে বসলাম। এপ্রিল মাসের রাত। বিরবির করে বাতাস বইছে, খুব সুন্দর জ্যোৎস্না হয়েছে। এত পরিষ্কার আলো যে মনে হতে লাগল অনায়াসে এই আলোতে বই পড়া যাবে। মাঝে মাঝে মানুষের ভিতরে যে রকম ছেলেমানুষি জেগে ওঠে, আমারো তেমনি জেগে। উঠল। খুব ইচ্ছা হতে লাগল একটা বই এনে দেখেই ফেলি না পড়া যায়। কিনা। চারদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। নির্জনতায় কেমন ভয়ভয় লাগে, আবার ভালোও লাগে। চুপচাপ বসে আরোল-তাবোল কত কি ভাবছি, এমন সময় একটা হালকা গন্ধ নাকে এল, মিষ্টি গন্ধ। কিছু ভালো লাগে না, অস্বস্তি বোধ হয়। কিসের গন্ধ এটি? বের করতে চেষ্টা করতে লাগলাম এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, গন্ধের তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। হাত-পা অসাড় হয়ে উঠতে লাগল। যতই ভাবছি। এইবার উঠে দৌড়ে পালাব, ততই সমস্ত শরীর জমে যাচ্ছে। ভীষণ ভয় হল আমার। সেই সময় ঘুম পেতে লাগল। কিছুতেই ঘুমাব না, নিশ্চয়ই কোনো বিষাক্ত গ্যাসের খপ্পরে পড়েছি, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ছাড়া ছাড়া কাটা কাটা ঘুম। চোখ মেলতে পারছিলাম না, তবে মিষ্টি গন্ধটা নাকে আসছিল তখনও।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি মনে নেই। ঘুম ভাঙাল মাথায় তীর যন্ত্রণা নিয়ে। ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর ভেঙে যাচ্ছে, নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে, তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ। চোখ মেলে। আমি দিন কি রাত বুঝতে পারলাম না। কোথায় আছি, আশেপাশে কাদের ফিসফিস শব্দ শুনছি কে জানে? চোখের সামনে চোখ-ধাঁধানো হলুদ আলো। বমি করার আগের মুহূর্তে যে ধরনের অস্বস্তি বোধ হয়, সে ধরনের অস্বস্তি বোধ নিয়ে আমি জেগে রইলাম!

বুঝতে পারছি সময় বয়ে যাচ্ছে। আমি একটি অদ্ভূত অবস্থায় আছি। অচেতন নই, আবার ঠিক যে চেতনা আছে তাও নয়। কিছু ভাবতে পারছি না। আবার শারীরিক যাতনাগুলিও সুস্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে। আমার মনে হল দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। চোখের সামনে তীব্র হলুদ আলো নিয়ে আমি যেন অনন্তকাল ধরে জেগে আছি। মাঝে মাঝে একটা বিজবিজ শব্দ কানে আসে।–লক্ষ লক্ষ মৌমাছি এক সঙ্গে উড়ে গেলে যে রকম শব্দ হত, অনেকটা সেই রকম।

আমি কি মারা গেছি? আমি কি পাগল হয়ে গেছি? এই জাতীয় চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। হয়তো আরো কিছুক্ষণ এই অবস্থায় থাকলে সত্যি পাগল হয়ে যেতম। কিন্তু তার আগেই কে যেন মিষ্টি করে বলল, একটু ধৈর্য ধরুন, খুব অল্প সময়।

স্পষ্ট গলার স্বর, নিখুত উচ্চারণ। আমার শুনতে একটুও অসুবিধে হল না। সমস্ত মনপ্ৰাণ কেন্দ্রীভূত করে চেঁচিয়ে উঠলাম, আপনি কে? আমার কী হয়েছে?

গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না। কিন্তু তবুও শুনলাম। কেউ যেন আমাকে সান্তনা দিচ্ছে, সেই আগের মিষ্টি নরম গলা।

একটু কষ্ট করুন। অল্প সময়। খুব অল্প সময়। বলুন আমার সঙ্গে, এক—

এক।

বলুন, দুই।

আমি বললাম। সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকল। হাজার ছাড়িয়ে লক্ষ ছাড়িয়ে বাড়তেই থাকল, বাড়তেই থাকল। আমি নেশাগ্রস্তের মতো আওড়াতে থাকলাম। আমার চোখের উপর উজ্জ্বল হলুদ আলো, বুকের ভেতর হা হা করা তৃষ্ণা। অর্ধচেতন অবস্থায় একটি অচেনা অদেখা ভৌতিক কষ্ঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটির পর একটি সংখ্যা বলে চলছি। যেন কত যুগ কত কাল কেটে গেল। আমি বলেই চলেছি—বলেই চলেছি।

এক সময় মাথার ভিতর সব জট পাকিয়ে গেল। নিঃশ্বাস ফেলার মতো অতি সামান্যতম বাতাসও যেন আর নেই। বুক ফেটে গুড়িয়ে ধাচ্ছে। আমি প্ৰাণপণে বলতে চেষ্টা করলাম, আর নয়, আমাকে মুক্তি দিন। আমি মরে যেতে চাই–আমি মরে যেতে চাই।

আবার সেই গলা, এইবার ঘুমিয়ে পড়ুন।

কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম নেমে এল। আহা কী শান্তি! কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি। দ্রুত। হলুদ আলো ফিকে হয়ে আসছে। শারীরিক যন্ত্রণাগুলো ভোঁতা হয়ে আসছে।–শরীরের প্রতিটি কোষ যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। আহা, কী শান্তি!

জানি না কখন ঘুম ভাঙল। খুব স্বাভাবিকভাবে চোখ মেললাম। একটা ধাতব চেয়ারে বসে আছি। চেয়ারটি গোলাকার একটি ঘরের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে। ঠিক আমার মাথার কাছে ছোট্ট একটি নল দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ঘরের বাতাস যেন একটু ভারি। বাতাসের সঙ্গে লেবু ফুলের গন্ধ মিশে আছে। আমি ভালো করে চারদিক দেখতে চেষ্টা করতে লাগলাম। গোল ঘরটিতে কোনো দরজা-জানালা নেই। চারদিক নিশ্চিছদ্র। ঘরে কোনো বাতি নেই। তবু সমস্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে নীলাভ আলো আসছে হয়তো।

আমার তখন প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। কোথায় আছি, আমার কী হয়েছে–এ সমস্ত ছাড়িয়ে শুধুমাত্র একটি চিন্তাই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেটি হল ক্ষুধা। আমার ধারণা ছিল, হয়তো আগের মতো কথা বলতে পারব না, তবু বললাম, আমি কোথায় আছি?

সে শব্দ পরিষ্কার শোনা গেল। গোলাকার ঘরের জন্যই হয়তো সে শব্দ চমৎকার প্রতিধ্বনিত হল। এবং আশ্চৰ্য, সে শব্দ বাড়তেই থাকল।–

আমি কোথায় আছি? আমি কোথায় আছি? আমি কোথায় আছি–?

এক সময় যেন মনে হল লক্ষ লক্ষ মানুষ এক সঙ্গে চিৎকার করছে। আমি নিজের গায়ে চিমটি কাটলাম। দশ থেকে এক পর্যন্ত উল্টো দিকে গুণলাম, আমি কি অচেতন অবস্থায় এসব শুনছি, না। সত্যি কিছু জ্ঞান এখনো অবশিষ্ট আছে, তা জানার জন্যে।

এখন লিখতে খুব অবাক লাগছে, সেই অবস্থাতেও কী করে আমি এতটা স্বাভাবিক ছিলাম! অবশ্যি সে সময়ে আমার মনে হয়েছিল সম্ভবত আমার মাথায় চোট লেগে মস্তিকের কোনো এক অংশ অকেজো হয়ে পড়েছে। অবাস্তব দৃশ্যাবলী দেখছি। এক সময় প্রচন্ড খিদে সত্ত্বেও আমার ঘুম পেল। ঘুমিয়ে পড়বার আগের মুহূর্তেও শুনতে পেলাম সমুদ্রগর্জনের মতো কোলাহল।

আমি কোথায় আছি? আমি কোথায় আছি–?

কতক্ষণ এভাবে কাটিয়েছিলাম মনে নেই। এক সময় সমস্ত জড়তা কেটে গিয়ে শরীর ঝরঝরে হয়ে গেল। খিদে নেই, তৃষ্ণা নেই, আলস্য নেই। যেন ছুটির দুপুরবেলাটা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছি। চোখ মেলতে ভয় লাগছিল, কে জানে আবার হয়তো সেই সব আজগুবি ব্যাপার দেখতে থাকব। কান পেতে আছি। যদি কিছু শোনা যায়। না, কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারদিক সুনসান।

তোমার চা।

চমকে তাকিয়ে দেখি আনা, আমার স্ত্রী, দশ বৎসরের বিবাহিত জীবনের সঙ্গী হাতে চায়ের পেয়ালা নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে বাইরে। আমি শুয়ে আছি। আমার অতি পরিচিত বিছানায়। টেবিলের উপর আগের মতো আগোছাল বইপত্র পড়ে আছে। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! আমি প্রায় লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লাম। চেঁচিয়ে বললাম,

আনা আমার কী হয়েছে?

আনা চায়ের পেয়ালা হাতে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই মনে হল, এই মেয়েটি অন্য কেউ, এ আনা নয়। যদিও সেই চোখ, সেই ঢেউ খেলান বাদামী চুল, গালের মাঝামাঝি লাল রঙের কাটা দাগ। আমি ভয়ে কাতর গলায় বললাম, তুমি কে? তুমি কে?

আমি আনা।

না তুমি আনা নিও।

আমি কি দেখতে আনার মতো নাই?

দেখতে আনার মতো হলেও তুমি আনা নাও!

বেশ নাই-বা হলাম, চা নাও।

আমি আবার বললাম, দয়া করে বল তুমি কে?

বলছি। সমস্তই ধীরে ধীরে জানবে।

আমি কোথায় আছি?

তুমি তোমার পৃথিবী থেকে বহু দূরে। ভয় পেয়ো না, আবার ফিরে যাবে। তোমাকে আনা হয়েছে একটা বিশেষ প্রয়োজনে।

কারা আমাকে এখানে এনেছে?

এখানে যাদের বাস, তারা এনেছে। যারা আমাকে তৈরি করেছে তারা। চতুর্মাত্রিক জীবেরা।

তোমাকে তৈরি করা হয়েছে?

হ্যাঁ, আমাকে তৈরি করা হয়েছে তোমার সুখ ও সুবিধার জন্যে। তাছাড়া আমি তোমাকে অনেক কিছু শেখাব। আমার মাধ্যমেই তুমি এদের সঙ্গে কথা বলবে।

কাদের সঙ্গে কথা বলব?

যারা তোমাকে নিয়ে এসেছে।

যারা আমাকে নিয়ে এসেছে তারা কেমন? তারা কি মানুষের মতো?

তাদের তুমি দেখতে পাবে না। এরা চতুর্মাত্রিক জীব। পৃথিবীর মানুষ ত্রিমাত্রিক জিনিসই শুধু দেখতে পায় ও অনুভব করস্কে পারে। সেগুলি তাদের ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য। চতুমৰ্হত্রিক জগৎ তোমাদের কাছে ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য হবে না।

শুনতে শুনতে আমার গা ছমছম করতে লাগল। এসব কী বলছে সে! ভয় পেয়ে আমি মেয়েটির হাত ধরলাম। এই অদ্ভুত তৈরি পরিবেশে তাকেই আমার একান্ত আপন জন মনে হল। মেয়েটি বলল, আমাকে তুমি আনা বলেই ভাববে। আপনার সঙ্গে যেভাবে আলাপ করতে, সেইভাবেই আলাপ করবে। আমাকে ভয় পেয়ো দিন। তোমার যা জানতে ইচ্ছে হবে। আমার কাছ থেকে জেনে নেবে। আমি তো তোমাকে বলেছি, আবার তুমি ফিরে যাবে তোমার সত্যিকার আনার কাছে।

আমি বললাম, এই যে আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি, নিজের বইপত্র টেবিলে পড়ে আছে, এসবও কি আমার মতো পৃথিবী থেকে আনা হয়েছে?

এইগুলি আনতে হয় নি। তৈরি করা হয়েছে। ইলেকটন, প্রোটন এই সব জিনিস দিয়ে তৈরি হয় এটম। বিভিন্ন এটমের বিভিন্ন অনুপাতে তৈরি হয় এক একটি বস্তু। ঠিক তো?

হ্যাঁ, ঠিক।

কোনো বস্তুর প্রতিটি ইলেকট্রন, প্রোটন কী অবস্থায় আছে এবং এটমগুলি কীভাবে আছে, সেগুলি যদি জানা থাকে এবং ঠিক সেই অনুপাতে যদি ইলেকট্রন, প্রোটন এবং এটম রাখা যায়। তবেই সেই বস্তুটি তৈরি হবে। ঠিক তো?

হয়তো ঠিক।

কিছু শক্তি খরচ করলেই হল। এইভাবেই তোমার ঘর তৈরি হয়েছে। আমিও তৈরি হয়েছি। এখানকার জীবরা মহাশক্তিধর। এই হচ্ছে তোমার প্রথম পাঠ। হ্যাঁ, এবার চা খাও। দাও, চায়ে চুমুক দাও।

আমি চায়ে চুমুক দিলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আনা অল্প অল্প হাসছে। আমার সে মুহূর্তে এই মেয়েটিকে সত্যি সত্যি আনা বলেই ভাবতে ইচ্ছে হল।

 

আমার নিজের অনুভূতি কখনো খুব একটা চড়া সুরে বাধা ছিল না। সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপন করে এসেছি। হঠাৎ করেই যেন সব বদলে গেল। নিজেকে যদিও ঘটনাপ্রবাহের উপর সম্পূৰ্ণ সঁপে দিয়েছিলাম, তবু একটা ক্ষীণ আশা সব সময় লালন করেছি।–হয়তো এক সময় দেখব। আশেপাশে যা ঘটছে। সমস্তই মায়া, হয়তো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। এক্ষুণি স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠব। মেয়েটি বলল, কী তাবিছ?

কিছু ভাবছি না। আচ্ছা একটা কথা—

বল।

কী করে এসেছি আমি এখানে?

সেই জটিল প্রক্রিয়া বোঝবার উপায় নেই।

এটা কেমন জায়গা?

কেমন জায়গা তা তোমাকে কী করে বোঝাব? তুমি ত্রিমাত্রিক জগতের লোক, আর এটি হচ্ছে চতুর্মাত্রিক জগৎ।

কিছুই দেখা যাবে না?

চেষ্টা করে দেখা যাও, বাইরে পা দাও। দরজাটা আগে খোল। কী দেখছ?

আমার সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল। চারিদিকে ঘন ঘোলাটে হলুদ আলো। পেটের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা। মাথা ঘুরতে লাগল আমার।

থাক আর দেখবার কাজ নেই, এসে পড়া।

আমার মনে হল মেয়েটি যেন হাসছে আপন মনে। আমি চুপ করে রইলাম। মেয়েটি বলল, তুমি অল্প কিছুদিন থাকবে এখানে। তারপর তোমাকে পাঠান হবে একটা ত্রিমাত্রিক জগতে, সেখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।

আমি বললাম, তুমি থাকবে তো সঙ্গে?

নিশ্চয়ই। আমি তোমার এক জন শিক্ষক।

আচ্ছা একটা কথা–

বল।

এখানকার জীবদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ কী করে হয়?

আমি জানি না।

তাদের সম্বন্ধে কিছুই জানি না?

না।

তাদের সঙ্গে তোমার কথা হয় না?

না।

আমার সঙ্গে যে আলাপ আলোচনা হবে তা তাদের কী করে জানাবো?

তাদের জানাতে হবে না। আমি কি নিজের থেকে কিছু বলি তোমাকে? যা বলি সমস্তই ওদের কথা। চুপ করে আছ কেন? তোমাকে তো আগেই বলেছি, তুমি তোমার নিজের জায়গায় ফিরে যাবে।

তোমাকে ধন্যবাদ।

দিন-রাত্রির কোনো তফাৎ ছিল না বলেই আমি ঠিক বলতে পারব না, কদিন সেই ছোট্ট ঘরটিতে ছিলাম। ক্ষুধা—তৃষ্ণা আগের মতোই হয়। নিজের বাসায় যে ধরনের খাবার খাওয়া হত, সেই ধরনের খাবারই দেওয়া হয় এখানে, আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হল সেই মেয়েটি, যে দেখতে অবিকল আনার মতো, অথচ আনা নয়। খুবই আশ্চর্যের কথা, মেয়েটির সঙ্গে আমার ভারি ঘনিষ্ঠতা হল। মাঝে মাঝে আমার প্রচন্ড ভ্রম হত এ হয়তো সত্যি আনা। সে এমন অনেক কিছুই বলতে পারত, যা আনা ছাড়া অন্য কারো বলা সম্ভব নয়। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এসব কী করে জানলে?

মেয়েটি হেসে বলেছে, যে সমস্ত স্মৃতি আনার মেমরি সেলে আছে, সে সমস্ত স্মৃতি আমার ভেতরেও তৈরি করা হয়েছে। আনার অনেক কিছুই মনে নেই, কিন্তু আমার আছে।

আমি এসব কিছুই মেলাতে পারছিলাম না। এ কেমন করে হয়! একদিন নখ দিয়ে আচড়ে দিলাম মেয়েটির গালে, সত্যি সত্যি রক্ত বেরোয় কিনা দেখতে। সত্যিই রক্ত বেরিয়ে এল। সে অবাক হয়ে বলল, এসব কী ছেলেমানুষি কর?

দেখি, তুমি সত্যি মানুষ না অন্য কিছু।

এর ভেতর আমি অনেক কিছু শিখলাম। অনেক কিছুই বুঝতে পারি নি। আনার আন্তরিক চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু বিজ্ঞান এমনিতেই আমি কম বুঝি। চতুর্মাত্রিক সম্বন্ধে নিম্নলিখিত কথাবাত হল।

চতুর্মাত্রিক জীবরা কি কোনো খাদ্য গ্রহণ করে?

না, করে না।

এরা কেমন? অথাৎ ব্যাপারটি কী?

এরা হচ্ছে ছড়িয়ে থাকা শক্তির মতো? যেমন মনে কর এক গ্লাস পানি। পানির প্রতিটি অণু একই রকম। কোনো হেরফের নেই। সমস্ত অণু মিলিতভাবে তৈরি করেছে পানি। এরাও সে রকম। কারোর কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই। সম্মিলিতভাবেই তাদের পরিচয়। তাদের জ্ঞান সম্মিলিত জ্ঞান।

এদের জন্ম-মৃত্যু আছে?

শক্তি তো সব সময় অবিনশ্বর নয়। এরও বিনাশ আছে। তবে আমি ঠিক জানি না কী হয়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কী রকম হয়?

কী রকম হয় বলতে পারব না, তবে তারা দ্রুত সৃষ্টির মূল রহস্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।

একদিন আনা বলল, আজ তোমাকে ত্রিমাত্রিক গ্রহে নিয়ে যাওয়া হবে।

আমি বললাম, সেখানে আমি নিঃশ্বাস ফেলতে পারব তো? আনা হো হো করে হেসে বলল, নিশ্চয়ই। সেটি তোমার নিজের গ্রহ বলতে পোর। তোমার জন্মের প্রায় দু হাজার বৎসর পর পৃথিবীর মানুষের একটা ছোট্ট দল এখানে এসেছিল। তারপর আরো তিন হাজার বৎসর পার হয়েছে। মানুষেরা চমৎকার বসতি স্থাপন করেছে সেখানে। ভারি সুন্দর জায়গা।

আমার জন্মের পাঁচ হাজার বৎসর পরের মানুষদের কাছে আমি কী করে যাব?

তুমি ভুলে যাচ্ছ যে তুমি চতুর্মাত্রিক জগতে আছ। এখানে ত্ৰিশ হাজার বৎসর আগেও যা, ত্ৰিশ হাজার বৎসর পরেও তা।

তার মানে আমার বয়স কখনো বাড়বে না?

নিশ্চয়ই বাড়বে। শরীরবৃত্তির নিয়মে তুমি বুড়ো হবে।

কিন্তু ভবিষ্যতে যাওয়ার ব্যাপারটা কেমন?

তুমি কি একটি সহজ সত্য জান? কী সত্য? তুমি কি জান যে, কোনো যন্ত্রযানের গতি যদি আলোর গতির চেয়ে বেশি হয়, তবে সেই যন্ত্রযানে করে ভবিষ্যতে পাড়ি দেয়া যায়?

শুনেছি কিছুটা।

চতুর্মাত্রিক জগৎ একটা প্রচন্ড গতির জগৎ। সে গতি আলোর গতির চার গুণ বেশি। সে গতি হচ্ছে ঘৃণায়মান গতি। তুমি নিজে চতুর্মাত্রিক জগতে আছে। কাজেই অবিশ্বাস্য গতিতে ঘুরছ। যে গতি অনায়াসে সময়কে অতিক্রম করে।

কিন্তু আমি যতদূর জানি–কোনো বস্তুর গতি যখন আলোর গতির কাছাকাছি আসে, তখন তার ভর অসীম হয়ে যায়।

তা হয়।

তাহলে তুমি বলতে চাও আমার ভর এখন অসীম?

না। কারণ তুমি বস্তু নও, তুমি এখন শক্তি।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

তাতে বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। তুমি তৈরি হয়ে থাক। তোমাকে নিয়ে ত্ৰিমাত্রিক জগতে যাব এবং তার পরই তোমার কাজ শেষ।

 

ভিতরে ভিতরে আমি তীব্র কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। কী করে কী হচ্ছে? আমাকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত কী করা হবে, এতা জানার জন্যে আমি প্ৰায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, এত উদ্যোগ আয়োজন নিশ্চয়ই কোনো একটি অশুভ শক্তির জন্যে।

দাঁতের ডাক্তারের কাছে দাঁত তুলতে গেলে যেমন বুক-কোপান আতঙ্ক নিয়ে বসে থাকতে হয়, বিভিন্ন গ্রহে যাবার জন্যে আমি তেমনি আতঙ্ক নিয়ে প্রতীক্ষ্ণ করতে লাগলাম।

যদিও অন্য একটি গ্রহে যাবার কথা ভেবে আতঙ্কে আমার রক্ত জমে যাচ্ছিল, তবু যাত্ৰাটা কী করে হয়, তা জানার জন্যে প্রচন্ড কৌতূহলও অনুভব করছিলাম। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটি এত হঠাৎ করে হল যে, আমি ঠিক কী যে হচ্ছে তাই বুঝতে পারলাম না।

দেখলাম চোখের সামনে থেকে আচমকা পরিচিত ঘরটি অদৃশ্য হয়েছে। চারিদিকে চোখ-ধাঁধান হলুদ আলো–যার কথা আমি আগেও অনেক বার বলেছি। মাথার ভিতরে তীক্ষ্ণ তীব্র যন্ত্রণা। যেন কেউ সূক্ষ্ম তলোয়ার দিয়ে সাঁই করে মাথাটি দু, ফাঁক করে ফেলেছে। ঘুরঘুর করে উঠল পেটের ভিতর পা ও হাতের পাতাগুলি জ্বালা করতে লাগল। আগেই বলেছি সমস্ত ব্যাপারটি খুব অল্প সময়ের ভিতর ঘটে গেল। সমস্ত অনুভূতি উল্টেপান্টে যাবার আগেই দেখি চৌকোণা একটি ঘরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। একা, মেয়েটি পাশে নেই। যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি, তার চারপাশে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি। চকচকে ঘড়ির ডায়ালের মতো অজস্র ডায়াল। কোনোটির কাটা স্থির হয়ে আছে। বড় বড়। লিভার জাতীয় কিছু যন্ত্র। গঠনভঙ্গি দেখে মনে হয়। হাত দিয়ে চাপ দেবার জন্যে তৈরি। টাইপ রাইটারের কী-বোর্ডের মতো বোতামের রাশ। প্রতিটিতেই হালকা আলো জ্বলছে। মাথার ঠিক উপরে সা সাঁ করে পাখা ঘুরছে। পাখাটির আকৃতিও অদ্ভূত। ফুলের কুড়ি ফুটে উঠছে, আবার বুজে যাচ্ছে–এই রকম মনে হয়। কোনো বাতাস আসছে না। সেখান থেকে। পিপি। করে একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ হচ্ছে কেবল। হঠাৎ পরিষ্কার শুনলাম, দয়া করে অল্প কিছু সময় অপেক্ষা করুন। বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলুন। আলোর বেগে এসেছেন। আপনি এখানে। আপনার শরীরের প্রতিটি অণু থেকে গামা রশ্মি১৭ বিকিরণ হচ্ছে, আমরা এটি বন্ধ করছি। কিছুক্ষণের ভিতরেই আপনি আসবেন আমাদের মধ্যে। আপনি আমাদের সম্মানিত অতিথি।

আমি চুপ করে কথাগুলি শুনলাম। যেভাবে বলা হল সেভাবেই নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম। আবার তাদের গলা শোনা গেল, আপনি দয়া করে আমাদের কতগুলি প্রশ্নের জবাব দিন।

আমি বললাম, প্রশ্ন করুন, আমি জবাব দিচ্ছি।

আপনার কি ঘুম পাচ্ছে?

না।

আপনার কি মাথা ধরেছে?

কিছুক্ষণ আগে ধরেছিল, এখন নেই।

মুগা বলুন তো ঘরে কী রঙের আলো জ্বলছে?

নীল।

ভালো করে বলুন, সবুজ নয় তো?

না, সবুজ নয়।

হালকা নীল?

না, ঘন নীল। আমাদের পৃথিবীর মেঘশূন্য আকাশের মতো। উত্তর শুনে প্রশ্নকতা একটু যেন হকচাকিয়ে গেলেন। কারণ পরবর্তী কিছুক্ষণ আর কোনো প্রশ্ন 6siन्मा 65छ না!

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রশ্নকতা এবার থেমে থেমে বললেন, আপনি কি জানেন, আমাদের পূর্বপুরুষ একদিন পৃথিবী থেকেই এ গ্রহে এসেছিলেন?

আমি জানি।

আপনি আমাদের একান্ত আপন জন। আপনি এখানে এসেছেন, সেই উপলক্ষে আজ আমাদের জাতীয় ছুটির দিন।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কী আশ্চর্য আপনারা জানতেন আমি এসেছি?

নিশ্চয়ই।

আপনাদের এ গ্রহের নাম?

টাইফা।

আমি লক্ষ করলাম, ঘরের নীল আলো কখন চলে গেছে। সবুজাভ আলোয় ঘর ভরে গেছে। আমি বললাম, শুনুন, আমি এবার সবুজ আলো দেখছি।

বলবার সঙ্গে সঙ্গে একটি অংশ নিঃশব্দে ফাকি হয়ে যেতে লাগল। আমি দেখলাম অসংখ্য কৌতূহলী মানুষ অপেক্ষা করছে বাইরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সেই গ্রহ থেকে এসেছি, যেখান থেকে তাদের পূর্বপুরুষ একদিন রওয়ানা হয়েছিল। অজানা সেই গ্রহের জন্যে সমস্ত ভালোবাসা এখন হাত বাড়িয়েছে আমার দিকে।

যাঁরা আমার চার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা প্রত্যেকেই বেশ বয়স্ক। একটু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম দীর্ঘ পাঁচ হাজার বৎসর একটি সম্পূৰ্ণ ভিন্ন গ্রহে কাটিয়ে মানুষের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় নি। সাধারণ মানুষের চেয়ে শুধু একটু লম্বা, চেহারা একটু সবুজাভা–এই পরিবর্তনটাই চট করে চোখে পড়ে। চোখগুলি অবশ্য খুব উজ্জ্বল। মনে হয়। অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মতো আলো ছড়াবে।

আমার নাম ক্রিকি। বলেই তাদের একজন আমার ঘাড়ে হাত রাখলেন। অল্প হেসে বললেন, আপনি আমাদের কথা ঠিক বুঝতে পারছেন তো?

আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। লম্বাটে ধরনের মুখ, ঢেউ খেলান লম্বা চুল। মুখভর্তি দাড়ি গোঁফে একটা জজ্বলে চেহারা। আমি বললাম, খুব ভালো বুঝতে পারছি। আপনারা কি এই ভাষাতেই কথা বলেন?

না, আমরা আমাদের ভাষাতেই কথা বলছি। আমাদের সবার সঙ্গেই অনুবাদক যন্ত্র আছে। আসুন, আমার নিজের ঘরে আসুন।

আমার খুব ইচ্ছে করছিল, বাইরে ঘুরে ঘুরে সব দেখি। এখানকার আকাশ কী রকম? গাছপালাই—বা কেমন দেখতে। প্রথম দিকে আমার যে নিস্পৃহ ভাব ছিল এখন আর সেটি নেই। আমি তীব্র উত্তেজনা অনুভব করছিলাম, যা-ই দেখছি তাই আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে। ক্রিকি বললেন, আমাদের এই গবেষণাগারে চারটি ভাগ আছে। সবচেয়ে জটিল এবং সবচেয়ে জরুরী বিভাগ হচ্ছে সময় পরিভ্রমণ বিভাগ। জটিলতম কারিগরি বিদ্যা কাজে খাটান হয়েছে। এখান থেকেই সময়ের অনুকূলে ও প্রতিকূলে যাত্রা করান হয়। যেমন আপনি এলেন। তার পরই আছে। অনঅধীত গণিত বিভাগ। দুরকম গণিত আছে, একটি হচ্ছে ব্যবহারিক, অন্যটি অনঅধীত–অর্থাৎ যে গণিত এখনো কোনো কাজে খাটান যাচ্ছে না। আমাদের এখানকার গণিত বিভাগটি হচ্ছে অনঅধীত গণিত বিভাগ।

তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগটি কি?

তৃতীয়টি হচ্ছে পদার্থবিদ্যা বিভাগ, চতুর্থটি প্রতি-পদার্থ১৮ বিভাগ। এ দুটির কাজ হচ্ছে অনঅধীত গণিতকে ব্যবহারিক গণিতে পরিণত করা। আসুন আমি আপনাকে সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। আপনি ক্লান্ত নন তো?

না না, আমি ঠিক আছি। আমার সব দেখেশুনে বেড়াতে খুব ভালো লাগছে! প্রথমে আপনাকে নিয়ে যাব গণিত বিভাগে। অবশ্য সেটি আপনার ভালো লাগবে না।

গণিত বিভাগ দেখে আমি সত্যিই হকচকিয়ে গেলাম। হাসপাতালের লম্বা ঘরের মতো মস্তে লম্বা ঘর। রুগীদের যেমন সারি সারি বিছানা থাকে, তেমনি দুধারে বিছানা পাতা। তাদের মধ্যে অদ্ভুত সর বিকৃত শরীর শুয়ে আছে। সবারই বয়স পনের থেকে কুড়ির ভিতরে। আমাদের দেখতে পেয়ে তারা নড়েচড়ে বসল।

ক্রিকি বললেন, আপনি যে কয়দিন এখানে থাকবেন, সে কয়দিন আপনাকে গণিত বিভাগেই থাকতে হবে। গণিত বিভাগের প্রধান–যিনি এই গবেষণাগারের মহা পরিচালক, তার তাই ইচ্ছে।

আমি ক্রিকির কথায় কান না দিয়ে বললাম, এরা কারা? প্রশ্ন শুনে ক্রিকি যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। অবশ্যি আমি তখন খুব অবাক হয়ে সারবন্দী পড়ে থাকা এই সব অসুস্থ ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আছি। কারো হাত-পা শুকিয়ে সুতার মতো হয়ে গিয়েছে, কারো চোখ নেই, কেউ ধনুকের মতো বেঁকে পড়ে আছে। কারো শরীরে আবার দিগদগে ঘা। আমি আবার বললাম, এরা কারা বললেন না?

ক্রিকি থেমে থেমে বললেন, এরা গণিতবিদ। টাইফা গ্রহের গণিতের যে জয়জয়কার, তা এদের জন্যেই। কথা শেষ না হতেই শুয়ে-থাকা অন্ধ একটি ছেলে চেঁচিয়ে বলল, টাইফা গ্রহের উন্নত গণিতের মুখে আমি থুতু দিই। বলেই সে খুঃ করে একদলা থুতু ফেলল। ক্রিকি বললেন, এই ছেলেটার নাম নিনাষ। মহা প্রতিভাবান।

আমি বললাম, এরা এমন পঙ্গু কেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ক্রিকি বললেন, মায়ের পেটে থাকাকালীন এদের জীনে ১৯ কিছু অদলবদল করা হয়েছে। যার ফলে মস্তিকের একটি বিশেষ অংশের বিশ্লেষণী ক্ষমতা হাজার গুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু ওরা ঠিক মানবশিশু হয়ে গড়ে ওঠে নি। সুতীব্র গামা রশ্মির রেডিয়েশনের ফলে যে সমস্ত জ্বীন শরীরের অন্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করত, তা প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলস্বরূপ এই বিকলাঙ্গতা। বিজ্ঞান সব সময়ই কিছু পরিমাণে নিষ্ঠুর।

এরা কি জন্ম থেকেই অঙ্কবিদ?

না। বিশিষ্ট অঙ্কবিদরা এদের বেশ কিছুদিন ভুঙ্ক শেখান।

কিন্তু এ তো ভীষণ অন্যায়।

ক্রিকি বললেন, না, অন্যায় নয়। শারীরিক অসুবিধে ছাড়া এদের তো অন্য কোনো অসুবিধে নেই। তাছাড়া এরা মহা সম্মানিত। বৃহত্তর স্বার্থের জন্যে সব সময় কিছু ব্যক্তিগত ত্যাগের প্রয়োজন।

এ রকম কত জন আছে?

আছে বেশ কিছু। কারো কারো কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিযেছে। কেউ কেউ এখনো শিখছে।

কত দিন কর্মক্ষমতা থাকে?

পাঁচ থেকে ছবছর। অত্যধিক পরিশ্রমে এদের মস্তিষ্কের নিওরোন নষ্ট হয়ে যায়।।

তাদের দিয়ে কী করা হয় তখন?

সেটা নাই-বা শুনলেন।

কিন্তু আমি এদের সম্বন্ধে জানতে চাই। দয়া করে বলুন। বৎসরে কত জন এমন বিকলাঙ্গ শিশু আপনারা তৈরি করেন?

সরকারী নিয়মে প্রতিটি মেয়েকে তার জীবদ্দশায় একবার প্রতিভাবান শিশু তৈরির জন্য গামা রশ্মি বিকিরণের সামনে এসে দাঁড়াতে হয়। তবে সবগুলি তো আর সফল হয় না। চলুন যাই অন্য ঘরগুলো ঘুরে দেখি।

আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। আমি দেখলাম, হাতে একতাড়া কাগজ নিয়ে এক জন হিন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এল অন্ধ ছেলেটির কাছে। ব্যস্ত হয়ে ডাকল, নিনাষ, নিনাষ।

বলুন।

এই হিসাবটা একটু কর। নবম নৈরাশিক গতি ফলকে বৈদ্যুতিক আবেশ দ্বারা আয়নিত করা হয়েছে, পটেনশিয়ালের পার্থক্য ছয় দশমিক শূন্য তিন মাইক্রোভেন্ট। আউটপুটে কারেন্ট কতো হবে?

বারো এম্পিয়ার হবার কথা, কিন্তু হবে না।

লোকটি লাফিয়ে উঠে বলল, কেন হবে না?

কারণ নবম নৈরাশিক একটি ভেক্টর সংখ্যা। কাজেই গতির দিকনির্ভর। ভেক্টরের সঙ্গে স্কেলারের যোগ এভাবে করা যায় না।

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। ক্রিকিকে বললাম, আমি এই ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করতে পারি?

ক্রিকি একটু দোমনা ভাবে বললেন, নিশ্চয়ই।

আমি নিনাষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি তোমার বন্ধু! তোমার সঙ্গে আমি আলাপ করতে চাই।

আমার কোনো বন্ধু নেই। চলে যাও এখান থেকে, নয়তো তোমার গায়ে থুতু দেব।

ক্রিকি বললেন, আপনি চলে আসুন। এরা সবাই কিছু পরিমাণে অপ্রকৃতিস্থ। আসুন আমরা পদার্থবিদ্যা বিভাগে যাই।

আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, আমার বিশ্রাম প্রয়োজন, আমার মাথা ঘুরছে।

ফ্রিকি আমার হাত ধরে একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, আপনি বিশ্রাম করুন। আমি পরে এসে আপনাকে নিয়ে যাব। অবাক হয়ে দেখি আনার মতো দেখতে মেয়েটি সেই ঘরে হাসিমুখে বসে আছে! তাকে দেখে কেমন যেন ভরসা। হল। সে বলল, এই জায়গা কেমন লাগছে?

ভালো।

নাও, খাবার খাও। এখানকার খাবার ভালো লাগবে খেতে।

টেবিলে বিচিত্র ধরনের রকমারি খাবার ছিল। সমস্তই তরল। যেন বিভিন্ন বাটিতে ভিন্ন ভিন্ন রঙ গুলে রাখা হয়েছে। ঝাঁঝালো ধরনের টক টক লাগল। যা দিয়েই তৈরি হোক না কেন, খুবই সুস্বাদু খাবার। মেয়েটি বলল, তুমি খুব শিগগীরই দেশে ফিরবে।

কবে?

তোমার হিসাবে এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে!

কিন্তু কী জন্য আমাকে এখানে আনা হয়েছে? আমাকে দিয়ে তোমরা কী করতে চাও?

মেয়েটি বলল, গণিত বিভাগের প্রধানের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?

না হয় নি।

তিনি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবেন।

গণিত বিভাগের প্রধানের সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আলাপ হল। ফ্রি-কি। আমাকে নিয়ে গেল তাঁর কাছে। গোলাকার একটি ঘরের ঠিক মধ্যিখানে তিনি বসে ছিলেন। ঘরে আর দ্বিতীয় কোনো আসবাব নেই। সে ঘরে একটা জিনিস আমার খুব চোখে লাগল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত সমস্তই গাঢ় সবুজ রঙে রাঙান। এমন কি যে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন, তার রঙ ও গাঢ় সবুজ। আমাকে দেখে ভদ্রলোক অত্যন্ত মোটা গলায় বলে উঠলেন, আমি গণিত বিভাগের প্রধান মিহি। আশা করি আপনি ভালো আছেন।

আমি হকচাকিয়ে গেলাম। অত্যন্ত তীব্র ও তীক্ষ্ণ চোখের চাউনি। আমার ভেতরটা যেন কেটে কেটে দেখে নিচ্ছে। শক্ত সমর্থ চেহারা-সমস্ত চোখে-মুখে অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের ভাব। তিনি বললেন, ক্রিকি তুমি চলে যাও। আর আপনি বসুন।

আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, কোথায় বসব? মেঝেতে?

হ্যাঁ। কোনো আপত্তি আছে? আপত্তি থাকলে আমার চেয়ারে বসুন। বলে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

আমি বললাম, আমার বসবার তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি কী বলবেন বলুন।

আপনি কি জানেন, কী জন্যে আপনাকে এখানে আনা হয়েছে?

না, জানি না।

কোনো ধারণা আছে?

কোনো ধারণা নেই।

বলছি। তার আগে আমার দু-একটা প্রশ্নের জবাব দিন তো। আপনি যে ভবিষ্যতে পাঁচ হাজার বৎসর পাড়ি দিয়েছেন সে সঙ্গন্ধে আপনার কোনো ধারণা আছে?

না, আমার কোনো ধারণা নেই।

আপনি যে উপায়ে ভবিষ্যতে চলে এসেছেন সে উপায়ে অতীতেও চলে যেতে পারেন। নয় কি?

আমি ঠিক জানি না। আমাকে নিয়ে কী করা হচ্ছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি।

বুঝতে না পারলেও খুব অসুবিধে নেই। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মানুষের জ্ঞান খুব সীমাবদ্ধ।

আমি কিছুই জানি না। স্কুলে আমি সমাজবিদ্যা পড়াতাম। বিজ্ঞান সম্পর্কে আমি একেবারে অজ্ঞ!

আপনাকে বলছি।–মনি দিয়ে শুনুন। মানুষ কিছুই জানে না। তারা সময়কে অতিক্রম করতে পারে না। শূন্য ও অসীম–এই দুইয়ের প্রকৃত অর্থ জানে না। সৃষ্টির আদি রহস্যটা কী, তাও জানে না। পদার্থের সঙ্গে শক্তির সম্পর্ক তার জানা, কিন্তু তার সঙ্গে সময়ের সম্পৰ্কটা অজানা। প্রতি-পদাৰ্থ কী তা সে জানে, কিন্তু প্রতি-পদার্থে সময়ের ভূমিকা কী, তা সে জানে না। অথচ জ্ঞানের সত্যিকার লক্ষ্য হচ্ছে এই সমস্ত রহস্য ভেদ করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই সব রহস্য মানুষ কখনো ভেদ করতে পারবে না, তার ফলস্বরূপ একটি ক্ষুদ্র গন্ডিতে ক্রমাগত ঘুরপাক খাওয়া। আপনি বুঝতে পারছেন?

বুঝতে চেষ্টা করছি।

একটা সামান্য জিনিস ভেবে দেখুন, NGK১২৩ গ্রহটিতে মানুষ কখনো যেতে পারবে না। আলোর গতিতেও যদি সে যায়, তবু তাঁর সময় লাগবে এক লক্ষ বৎসর।

সেখানে যাওয়া কি এতই জরুরি?

নিশ্চয়ই জরুরি। অবিকল মানুষের মতো, একচুলও হেরফের নেই।–এ জাতীয় প্ৰাণের বিকাশ হয়েছে সেখানে। অপূর্ব সে গ্রহ। মানুষের সমস্ত কল্পনাকে অতিক্রম করেছে তার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য। অথচ মানুষ কখনো তার নাগাল পাবে না। তবে–

তবে কী?

যদি মানুষকে বদলে দেয়া যায়, যদি তাদের মুক্তি দেয়া হয় ত্রিমাত্রিক বন্ধন থেকে, যদি তাদের নিয়ে আসা যায় চতুর্মাত্রিক জগতে–তবেই অনেক কিছু তাদের আয়ত্তে এসে যাবে। তার জন্যে দরকার চতুর্মাত্রিক জগতের মহাজ্ঞানী শক্তিশালী জীবদের সাহায্য। মানুষ অবশ্যি ত্ৰিমাত্রা থেকে চতুমাত্রায় রূপান্তরের আদি সমীকরণের প্রথম পযায় শুরু করেছে। এবং তা সম্ভব হয়েছে একটি মাত্র মানুষের জন্যে। সে হচ্ছে ফিহা!

ফিহা?

হ্যাঁ, ফিহা। তার অসাধারণ মেধার তুলনা মেলা ভার। অথচ তিনি সঠিক পথে এগুচ্ছেন না। এই সমীকরণের দুটি সমাধান আছে। তিনি একটি বের করেছেন, অন্যটি বের করতে চেষ্টা করছেন না।

কিন্তু এখানে আমার ভূমিকাটি কী? আমি কী করতে পারি?

আপনি অনেক কিছুই করতে পারেন। চতুর্মাত্রিক জীবরা ফিহাকে চান। ফিহার অসামান্য মেধাকে তাঁরা কাজে লাগাবেন।

বেশ তো, আমাকে তাঁরা যে ভাবে এনেছেন, ফিহাকেও সেভাবে নিয়ে এলেই তো হয়।

সেই ভাবে নিয়ে আসা যাচ্ছে না বলেই তো আপনাকে আনা হয়েছে। সিরানরা পৃথিবীর মানুষদের ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মি ২১ থেকে বাঁচানর জন্যে পৃথিবীর চারদিকে শক্তিবলয় ২২ তৈরি করেছে। চতুর্মাত্রিক জীবরা শক্তিবিলয় ভেদ করতে পারেন না, মানুষ যা অনায়াসেই পারে। সেই কারণে ফিহাকে আনা যাচ্ছে না।

আমি সেখানে গিয়ে কী করব?

ফিাঁহাকে নিয়ে আসবেন আপনি সম্ভব না হলে ফিহাকে হত্যা করবেন।

আপনি এসব কী বলছেন!

যান বিশ্রাম করুন গিয়ে, এ নিয়ে পরে আলাপ হবে। যান যান। দাঁড়িয়ে থাকবেন না।

আমি উদভ্ৰান্তের মতো বেরিয়ে এলাম। এই মুহূর্তে আমার সেই মেয়েটিকে প্রয়োজন। সে হয়তো অনেক কিছু বুঝিয়ে বলবে আমাকে। গিয়ে দেখি মেয়েটি কীেচের উপর ঘুমিয়ে রয়েছে। শ্ৰান্ত মানুষেরা যেমন ঘুমোয়, অবিকল তেমনি।

এত নিখুত মানুষ যারা তৈরি করতে পারে তাদের আমার হঠাৎ দেখতে ইচ্ছে হল। এরাই কি ঈশ্বর? সৃষ্টি এবং ধ্বংসের অমোঘ ক্ষমতা হাতে নিয়ে বসে আছে? প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে মহাপুরুষদের কথা আছে, তাঁরা ইচ্ছেমতো মৃতকে জীবন দিতেন। ভূত-ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। কে জানে হয়তো মহাক্ষমতার অধিকারী চতুর্মাত্রিক জীবদের দ্বারাই এসব হয়েছে। নকল মানুষ তৈরি করে তাদের দিয়ে ভেলকি দেখিয়েছে। আনার মতো মানুষ যারা নিখুঁত ভাবে তৈরি করে, তাদের কাছে কিছুই অসম্ভব নয়।

আনাকে ঘুমন্ত রেখেই বেরিয়ে এলাম। উদভ্ৰান্তের মতো ঘুরে বেড়ালাম কিছু সময়। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় মনে হল পথ হারিয়েছি। আমার নিজের ঘরটিতে ফিরে যাব, তার পথ পাচ্ছি না। কাউকে জিজ্ঞেস করে নিই ভেবে একটা বদ্ধ দরজায় টোকা দিলাম। খুব অল্প বয়স্ক এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত, আসুন, আসুন। আপনার কাছে যাব বলে তৈরি হচ্ছিলাম। সত্যি বলছি।

আমি হাসিমুখে বললাম, কী করেন। আপনি?

আমি এক জন ডাক্তার।

এখানে ডাক্তারও আছেন নাকি?

নিশ্চয়ই। মস্ত বড় টীম আমাদের। আমি একজন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ। আমরা সবাই মিলে একটা ছোট্ট গবেষণাগার চালাই।

খুব অল্প বয়স তো আপনার!

না না, যত অল্প ভাবছেন তত অল্প নয়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ছাড়া কি বিশেষজ্ঞ হওয়া যায়? বলেই ভদ্রলোক হো হো করে হাসতে লাগলেন, যেন খুব একটা মজার কথা।

জানেন, আমার যখন পাঁচ বৎসর বয়স, তখন থেকেই আমি এখানে। একটি দিনের জন্যেও এর বাইরে যেতে পারি নি। সেই বয়স থেকে স্নায়ু নিয়ে কারবার আমার। বাজে ব্যাপার।

তার মানে এই দীর্ঘ সময়ে একবারও আপনি বাবা-মার কাছে যান নি?

না। এমনকি আমার নিজের গ্রহটি সত্যি দেখতে কেমন তাও জানি না। তবে শুনেছি সেটি নাকি অপূর্ব। বিশেষ করে রাতের বেলা। অপূর্ব সব রঙ তৈরি হয় বলে শুনেছি। তাছাড়া দিন-রাত্রি সব সময় নাকি হুঁ হুঁ করে বাতাস বইছে। আর সেখানকার ঘরবাড়ি এমনভাবে তৈরি যে একটু বাতাস পেলেই অপূর্ব বাজনার মতো আওয়াজ হয়।

আপনি কি কখনো যেতে পারেন না সেখানে?

ডাক্তার অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, কী করে যাব? আমাদের এই সম্পূর্ণ গবেষণাগারটি একটি চতুর্মাত্রিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা।

তার মানে?

একটা ডিম কল্পনা করুন। কুসুমটি যেন আমাদের গবেষণাগার, একটি ত্ৰিমাত্রিক জগৎ। ডিমের সাদা অংশটি হল চতুর্মাত্রিক জগৎ এবং শক্ত খোলটি হচ্ছে আমাদের প্রিয় গ্রহ টাইফা।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এরকম করা হল কেন?

চতুর্মাত্রিক জীবদের খেয়াল। তবে আপনাকে একটা ব্যাপার বলি শুনুন, ঐ সব মহাপুরুষ জীবদের একটি মাত্র উদ্দেশ্য, সমস্ত ত্রিমাত্রিক জগৎ বিলুপ্ত করা। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে এই গবেষণাগার। বুঝতে পারছেন?

না।

না পারলেই ভালো।

আপনি কি এসব সমর্থন করেন না?

না।

কেন করব? আমি বাইরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের খবর কিছু কিছু রাখি। আমি জানি ফিহা ত্রিমাত্রিক সময় সমীকরণের কাজে হাত দিয়েছেন। অসম্ভব মেধা তাঁর। সমীকরণের সমাধান হওয়ামাত্র চতুর্মাত্রিক জগতের রহস্যভেদ হয়ে যাবে মানুষের কাছে, বুঝলেন? আর এতেই মাথা ঘুরে গেছে সবার। ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তারা ফিহাকে নিয়ে আসবার জন্যে। কিন্তু কলা। কাঁচকলা! ফিহাকে আনতে গিয়ে কাঁচকলাটি খাও।

আমি লক্ষ করলাম ডাক্তার ভদ্রলোক ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। হাত নাড়তে নাড়তে বললেন, মানুষেরা পৃথিবীর চারিদিকে শক্তিবলয় তৈরি করেছে। কিন্তু চতুর্মাত্রিক জীবদেরও সাধ্য নেই, সেই বলয় ভেদ করে। হাঃ হাঃ হাঃ—

হাসি থামলে কাতর গলায় বললাম, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। দয়া করে। আমায় আমার ঘরটি দেখিয়ে দেবেন? আমার কিছুই ভালো লাগছে না।

তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। অবসান ভাবে হাঁটছি। কী হতে যাচ্ছে কে জানে। আবছা আলোয় রহস্যময় লম্বা করিডোর। দুই পাশের প্রকান্ড সব কামরা বিচিত্র সব যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। অথচ এদের কোনো কিছুর সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। আমি আমার জায়গায় ফিরে যেতে চাই, যেখানে আমার স্ত্রী আছে, আমার দুটি অবোধ শিশু আছে–দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে অবোধ ভালোবাসা আছে।

 

পরবর্তী দু দিন, অনুমানে বলছি–সেখানে পৃথিবীর মতো দিন-রাত্রি নেই, আমার ওপর বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা হল। একেক বার একেকটি ঘরে ঢুকি। বিকট সব যন্ত্রপাতি আমার চারপাশে বসান হয়। তারপর ক্লাস্তিকর প্রতীক্ষ্ণ। একটি পরীক্ষা শেষ না হতেই অন্যটি শুরু। বিশ্রাম নেই, নিঃশ্বাস ফেলার অবসর টুকু নেই। আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। কী হবে প্রশ্ন করে? নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি ভাগ্যের হাতে! ক্লান্তিতে যখন মরমর হয়েছি, তখন বলা হল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন চৰ্বিশ ঘণ্টা পূৰ্ণ বিশ্রাম। তারপর আমাকে পাঠান হবে পৃথিবীতে।

সমস্ত দিন ঘুমালাম। ঘুম ভাঙলি দরজায় মৃদু টোকার শব্দ শুনে। গণিত বিভাগের একটি ছেলে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। কিছু বলবে, খুব জরুরি। রোগামতো লোকটি খুব নিচু গলায় বলল কথাগুলি।

আমি বললাম,  কে সে?

নিনাষ। আপনি আসুন আমার সঙ্গে।

আমি নীরবে তাকে অনুসরণ করলাম। আমার মনে হল কিছু একটা হয়েছে, থমথমে ধর্মছে চারদিক। আনার মতো মেয়েটিও নেই কোথাও।

সবাই যেন অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। আমি যেতেই উৎসুক হয়ে নড়েচড়ে বসল। সবাই। তুমি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলে?

নিনাষ বলল, হ্যাঁ। আপনি জানেন কি, টাইফা গ্রহ অদৃশ্য হয়েছে?

আমি কিছুই জানি না।

তাহলে আমার কাছ থেকে জানুন। অল্প কিছুক্ষণ হল সমস্ত গ্রহটি চতুর্মাত্রিক গ্রহে পরিণত করা হয়েছে। কেমন করে জানলাম? ত্রিমাত্ৰিক গ্রহকে চতুমৰ্হত্রিক গ্রহে পরিণত করার নির্দিষ্ট হিসোব আমরা করেছি। আমরা সব জানি। শুধু যে টাইফা গ্রহই অদৃশ্য হয়েছে তাই নয়, একটি বৃত্তাকার স্থান ক্রমশই চতুর্মাত্রিক জগতে প্রবেশ করছে এবং আপনার পৃথিবী সেই বৃত্তের ভিতরে। বুঝলেন?

আমি বললাম, আমার তাহলে আর প্রয়োজন নেই?

এই মুহুর্তে আপনাকেই তাদের প্রয়োজন। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই চুপ করে বসে নেই। নিশ্চয় তারা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে চেষ্টা করবে।–ফিহার মতো বিজ্ঞানী যেখানে আছেন। আমি খুব ভালো করে জানি, মহাজ্ঞানী ফিহা একটা বুদ্ধি বের করবেনই। যাক, ওসব ছেড়ে দিন। আপনাকে কী জন্যে পাঠান হবে জানেন?

না।

আপনাকে পাঠান হবে, যেন ফিহা পৃথিবী রক্ষার কোনো পরিকল্পনা করতে না পারেন, তাই দেখতে। ফিহার যাবতীয় কাগজপত্র আপনাকে নষ্ট করে ফেলতে বলবে। এমন কি প্রয়োজন হলে আপনাকে বলবে ফিহাকে হত্যা করতে। কিন্তু শুনুন, তা করতে যাবেন না। বুঝতে পারলেন? টাইফা গ্রহ চলে গেছে–পৃথিবী যেন না যায়।

ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি আনা হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আমাকে বলল,

সুসংবাদ। তুমি অল্প কিছুক্ষণের ভিতর পৃথিবীতে যাবে। তোমাকে কী করতে হবে তা মিহি বুঝিয়ে বলবেন।

আনা, চতুর্মাত্রিক জীবরা যখন তোমার মতো মানুষ তৈরি করতে পারে, তখন ওদের পাঠালেই পারত। পৃথিবীতে, ওরাই করতে পারত যা করার।

তৈরি মানুষ শক্তিবিলয় ভেদ করতে পারে না।

কিন্তু আনা, তোমরা আমাকে যা করতে বলবে তা আমি করব না।

নিনাষ কিছু বলেছে তোমাকে, না? ঠিক সে জন্যে নয়।

আমার মন বলছে আমি যা করব তা অন্যায়।

বাজে কথা রাখ–তুমি করবেই।

আমি করবই? যদি না করি?

না করলে ফিরে যেতে পারবে না তোমার স্ত্রী-পুত্রের কাছে খুব সহজ সত্য। তুমি কি তোমার ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যেতে চাও না?

চাই।

তা ছাড়া আরেকটা দিক ভেবে দেখ! তোমার তো কিছু হচ্ছে না। তুমি তোমার কাজ শেষ করে পৃথিবীতে নিজের ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যাবে। তারও পাঁচ হাজার বছর পর পৃথিবীর পরিবর্তন হবে। তার আগে নয়। এস, মিহির কাছে যাই, তিনি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। ও কি, তুমি কাঁদছ নাকি?

না, আমি ঠিক আছি।