চতুর্থ পরিচ্ছেদ – প্রাসাদ শিখরে
আকাশে প্রায় পূর্ণবয়ব চন্দ্র। চন্দ্রালোকে কপোতকূট নগর অতি সুন্দর দেখাইতেছিল।
বিটঙ্ক রাজ্যটি পারিপার্শ্বিক ভূখণ্ড হইতে উচ্চে মালভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। মালভূমিও সমতল নয়, তরঙ্গায়িত হইয়া প্রান্ত হইতে যতই কেন্দ্রের দিকে গিয়াছে ততই উচ্চ হইয়াছে। কেন্দ্রস্থলে কপোতকূট নগর। রাজ্যের সর্বোচ্চ শিখরের উপর অধিষ্ঠিত বলিয়াই বোধহয় ইহার নাম কপোতকূট।
নগরটি রাজ্যের ক্ষুদ্র সংস্করণ; কোথাও সমভূমি নয়, চারিদিকে উচ্চ প্রাকারের দৃঢ় পরিবেষ্টনী; তন্মধ্যে মহেশ্বরের জটাজালবদ্ধ চন্দ্রকলার ন্যায় অপূর্ব সুন্দর নগর শোভা পাইতেছে।
বসন্ত রজনীতে চন্দ্রবাষ্পাচ্ছন্ন দীপালোকিত নগরের সৌন্দর্য শতগুণ বর্ধিত হইয়াছিল। পথগুলি আঁকাবাঁকা, দুই পার্শ্বে পাষাণনির্মিত হর্ম্য। মাঝে মাঝে প্রমোদ-বন; পথের সন্ধিস্থলে জলাধারের মধ্যবর্তী গোমুখ হইতে প্রস্রবণ ঝরিয়া পড়িতেছে। উল্কাধারিণী পাষাণ বনদেবীর মূর্তি রাজপথে আলোক বিকীর্ণ করিতেছে। বহু নাগরিক-নাগরিকা বিচিত্র বেশ প্রসাধনে সজ্জিত হইয়া ইতস্তত বিচরণ করিতেছে, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না-নিষিক্ত বায়ু সেবন করিয়া দিবসের তাপ-গ্লানি দূর করিতেছে। প্রমোদ-বন হইতে কখনও বংশীরব উঠিতেছে; কোথাও লতানিকুঞ্জ হইতে মৃদুজল্পিত প্রণয়কূজন ও অস্ফুট কলহাস্য উত্থিত হইতেছে; কঙ্কণ মঞ্জীরের ঝঙ্কার কখনও কৌতুকে উল্লসিত হইয়া উঠিতেছে, কখনও আবেশে মদালস হইয়া পড়িতেছে। কপোতকূটে কপোত-মিথুনের অভাব নাই।
নগরীর একটি পথ দীপমালায় উজ্জ্বল। বিলাসিনী নাগরিকার ন্যায় রাত্রিকালেই এই পথের শোভা অধিক, কারণ প্রধানত ইহা বিলাসের কেন্দ্র। পথের দুই পাশে অগণিত বিপণি; কোনও বিপণিতে কেশর সুরভিত তাম্বূল বিক্রয় হইতেছে, বিক্রেত্রী রক্তাধরা চঞ্চলাক্ষী যুবতী। ক্রেতার অপ্রতুল নাই, রূপশিখাকৃষ্ট নাগরিকগণ চারিদিকে ভিড় করিয়া আছে; চপল পরিহাস, সরস ইঙ্গিত, লোল কটাক্ষের বিনিময় চলিতেছে। যে পসারিণী যত সুন্দরী ও রসিকা, তাহার পণ্য তত অধিক বিক্রয় হইতেছে।
বিপণির ফাঁকে ফাঁকে মদিরাগৃহ। পিপাসু নাগরিকগণ সেখানে গিয়া নিজ নিজ রুচি অনুসারে গৌড়ী মাধবী পান করিতেছে। আসবে যাহাদের রুচি নাই তাহারা কপিত্থ সুবাসিত তক্র বা ফলাম্লরস সেবন করিয়া শরীর শীতল করিতেছে। মদিরাগৃহের অভ্যন্তরে বহু কক্ষ; কক্ষগুলি সুসজ্জিত, তাহাতে আস্তরণের উপর বসিয়া ধনী বণিকপুত্রগণ দ্যূতক্রীড়া করিতেছে। কোনও কক্ষে মৃদঙ্গ সপ্তস্বরা সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা হইতেছে। মদিরাগৃহের কিঙ্করীগণ চষক ও ভৃঙ্গার হস্তে সকলকে আসব যোগাইতেছে।
নগর-নারীদের গৃহদ্বারে পুষ্পমালা দুলিতেছে; অভ্যন্তর হইতে মৃদু রক্তাভ আলোক-রশ্মি ও যন্ত্রের স্বপ্নমন্দির নিক্কণ পথচারীকে উন্মান করিয়া তুলিতেছে। পথে সুখান্বেষী নাগরিকের মন্থর যাতায়াত, কুসুমের মদমোহিত গন্ধ, প্রসাধন ও ভূষণাদির বৈচিত্র্য, ক্বচিৎ কৌতুক-বিগলিত নারীর কণ্ঠ হইতে বিচ্ছুরিত হাস্য, ক্বচিৎ কলহের কর্কশ রূঢ়স্বর— এই সব মিলিয়া এক অপূর্ব সম্মোহন সৃষ্টি করিয়াছে।
বিলাস বিহ্বলতার আবর্ত হইতে দূরে নগরের আর একটি কেন্দ্র রাজপুরী। পূর্বেই বলিয়াছি— নগর সর্বত্র সমভূমি নয়, কোথাও উচ্চ কোথাও নীচ। যে ভূমির উপর রাজপুরী অবস্থিত তাহা নগরীর মধ্যে সর্বোচ্চ, নগরীতে প্রবেশ করিয়া চক্ষু তুলিলেই সর্বাগ্রে রাজপুরীর ভীমকান্তি আয়তন চোখে পড়ে, মনে হয় কপোতকূট দুর্গের মধ্যস্থলে আর একটি দুর্গ সগর্বে মাথা তুলিয়া আছে।
প্রথমে প্রাকার বেষ্টন; স্থূল চতুষ্কোণ প্রস্তরে নির্মিত— প্রস্থে দ্বাদশ হস্ত, দৈর্ঘ্যে প্রায় অর্ধ ক্রোশ— বলয়ের ন্যায় চক্রাকারে পুরভূমিকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। প্রাকারের অভ্যন্তরে সুড়ঙ্গ আছে; কিন্তু সে কথা পরে হইবে। নগরীর প্রধান পথ যেখানে আসিয়া প্রাকার স্পর্শ করিয়াছে সেইখানে উচ্চ তোরণদ্বার। ইহাই রাজপুরী হইতে আগম নিগমের একমাত্র পথ। শলাকা কণ্টকিত লৌহের বিশাল কবাট; দুই পাশে স্থূল বর্তুল তোরণ-স্তম্ভ; তোরণ-স্তম্ভের অভ্যন্তরে প্রতীহার-গৃহ। শূলহস্ত প্রতীহার দিবারাত্র তোরণ পাহারা দিতেছে।
তোরণ অতিক্রম করিয়া সম্মুখেই সভাগৃহ। তাহার পশ্চাতে মন্ত্রগৃহ। অতঃপর দক্ষিণে বামে বহু ভবন— কোষাগার আয়ুধগৃহ যন্ত্রভবন— কাছাকাছি হইলেও প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র দণ্ডায়মান। মধ্যস্থলে রাজ-অবরোধের মর্মরনির্মিত ত্রি-ভূমিক প্রাসাদ— সাত কৌটার মধ্যস্থিত মৌক্তিক, সাত শত রাক্ষসীর বিনিদ্র সতর্কতা যেন নিরন্তর তাহাকে ঘিরিয়া আছে। দ্বারে দ্বারে যবনী প্রতিহারীর পাহারা।
এই ত্রি-ভূমক প্রাসাদের উন্মুক্ত ছাদে পুষ্পাকীর্ণ কোমল পক্ষ্মল আস্তরণের উপর অর্ধশয়ান হইয়া রাজকুমারী রট্টা যশোধরা প্রিয়সখী সুগোপার সহিত কথা কহিতেছিলেন। কথা এমন কিছু নয়, আকাশের দিকে চাহিয়া অলসকণ্ঠে দু’একটি তুচ্ছ উক্তি, তারপর নীরবতা, আবার দু’একটি তুচ্ছ কথা। এমনিভাবে আলাপ চলিতেছিল। যেখানে মনের মধ্যে বিচ্ছেদ নাই, সেখানে অবিচ্ছেদ কথা বলার প্রয়োজন হয় না।
প্রপাপালিকা সুগোপার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় আছে। কুমারী রট্টা যশোধরাকেও তিনি দেখিয়াছেন, হয়তো চিনিতে পারেন নাই। যে কিশোর কার্তিকেয় বিদ্যুতের মত সুগোপার জলসত্রে দেখা দিয়াছিল, যাঁহার অশ্ব চুরি করিয়া চিত্রক পলায়ন করিয়াছিল, তিনি আর কেহ নহেন, মৃগয়াবেশধারিণী রাজনন্দিনী রট্টা। হূণদুহিতা পুরুষবেশে মৃগয়া করিতে ভালবাসিতেন।
কবি কালিদাস বলিয়াছেন, বল্কল পরিধান করিলে সুন্দরী তন্বীকে অধিক সুন্দর দেখায়। হয়তো দেখায়, আমরা কখনও পরীক্ষা করিয়া দেখি নাই। কিন্তু যোদ্ধৃবেশ ধারণ করিলে রূপসীর রূপ বর্ধিত হয় একথা স্বীকার করিতে পারিব না। ভাল দেখাইতে পারে, কিন্তু অধিক সুন্দর দেখায় না। আমরা বলিব, কুমারী রট্টার মত যিনি তন্বী ও সুন্দরী, যাঁহার বয়স আঠার বৎসর— তিনি অলকগুচ্ছ কুন্দকলি দ্বারা অনুবিদ্ধ করুন, লোধ্ররেণু দিয়া মুখের পাণ্ডুশ্রী আনয়ন করুন, চূড়াপাশে নব কুরুবক ধারণ করুন, কর্ণে শিরীষ পুষ্পের অবতংস দুলাইয়া দিন, হৃৎস্পন্দনের তালে যূথীকঞ্চুক নৃত্যু করিতে থাকুক, নীবিবন্ধে কর্ণিকার কাঞ্চী মূর্ছিত হইয়া থাক— লোভী পুরুষ তো দূরের কথা, অনসূয়া সখীরাও ফিরিয়া ফিরিয়া সে রূপ দেখিবে।
তেমনই, পুষ্পাভরণভূষিতা রট্টার পানে সখী সুগোপাও থাকিয়া থাকিয়া বিমুগ্ধ নেত্রে চাহিতেছিল। দুই সখীর মধ্যে গভীর ভালবাসা। রাজকন্যাও যখন সুগোপার পানে তাঁহার অলস নেত্র ফিরাইতেছিলেন, তখন তাঁহার হিমকরস্নিগ্ধ দৃষ্টি অকারণেই সখীকে প্রীতির রসে অভিষিক্ত করিয়া দিতেছিল। দুইজনে আশৈশব খেলার সাথী; যৌবনে এই প্রীতি আরও গাঢ় হইয়াছিল। সুগোপার স্বামী সংসার সবই ছিল, কিন্তু তাহার জীবন আবর্তিত হইত রট্টাকে কেন্দ্র করিয়া। আর, বিশাল রাজ-অবরোধের মধ্যে একাকিনী কুমারী রট্টা— তিনিও এই বাল্যসখীকে একান্ত আপনার জানিয়া বুকে টানিয়া লইয়াছিলেন।
তবু, রাজকন্যার সহিত প্রপাপালিকার ভালবাসা বিস্ময়কর মনে হইতে পারে। কিন্তু এতই কি বিস্ময়কর? রাজায় রাজায় কি প্রণয় হয়? রাজকুমারীর সহিত রাজকুমারীর প্রণয় হয়? হয়তো হয়, কিন্তু তাহা বড় দুর্লভ। যেখানে অবস্থার তারতম্য আছে সেইখানেই প্রকৃত ভালবাসা জন্মে। নির্ঝরের জল পর্বত শিখর হইতে গভীর খাদে ঝাঁপাইয়া পড়ে, উচ্চাভিলাষী ধূম নিম্ন হইতে ঊর্ধ্বে আকাশে উত্থিত হয়। ইহাই স্বাভাবিক। তাহা ছাড়া রট্টার ধমনীতে হূণ রক্ত আভিজাত্যের প্রভেদ স্বীকার করিত না। হূণ বর্বর হোক, সে আভিজাত্যের উপাসক নয়, শক্তির উপাসক।
রট্টা একমুঠি মল্লিকা ফুল আস্তরণ হইতে তুলিয়া লইয়া আঘ্রাণ গ্রহণ করিলেন, তারপর চাঁদের দিকে চাহিয়া বলিলেন— ‘মধুঋতু তো শেষ হইতে চলিল; এবার ফুলও ফুরাইবে। সুগোপা, তখন তুই কি করিবি?’
রট্টার বাম কর্ণ হইতে শিরীষ পুষ্পের ঝুমকা খুলিয়া গিয়াছিল, সুগোপা উঠিয়া সযত্নে সেটি পরাইয়া দিল। মুকুরের মত ললাট হইতে দু’একটি চূর্ণ কুন্তল সরাইয়া দিয়া বলিল— ‘ফুল যখন ফুরাইবে, তখন চন্দন দিয়া তামাকে সাজাইব। চুলে স্নিগ্ধ স্নানকষায় মাখিয়া কর্পূর সুবাসিত জলে ধারাযন্ত্রে তুমি স্নান করিবে, আমি তোমার মুখে চন্দনের তিলক, বুকে চন্দনের পত্রলেখা আঁকিয়া দিব; সিক্ত উশীরের পাখা দিয়া তোমাকে ব্যজন করিব। সখি, তবু কি তোমার দেহের তাপ জুড়াইবে না?’ সুগোপার মুখে একটু চাপা হাসি।
হাসির গূঢ় ইঙ্গিত রট্টা বুঝিলেন, পুষ্পমুষ্টি সুগোপার গায় ছুঁড়িয়া দিয়া বলিলেন— ‘তোর পাখার বাতাসে আমার দেহের তাপ জুড়াইবে কেন?’
সুগোপা বলিল— ‘যাঁহার পাখার বাতাসে অঙ্গ শীতল হইত, তিনি তো আসিয়াছিলেন, তুমি যে হাসিয়াই তাঁহাকে বিদায় করিয়া দিলে।’
রট্টা ক্ষণকাল নীরব রহিলেন, তারপর হঠাৎ হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন— ‘সুগোপা, সত্য বল দেখি, গুর্জরের রাজকুমারের গলায় বরমাল্য দিলে তুই সুখী হইতিস?’
এইখানে পূর্বতন প্রসঙ্গ কিছু বলা প্রয়োজন।
ইদানীং মহারাজ রোট্ট ধর্মাদিত্য ঐহিক বিষয়ে কিছু অধিক অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিলেন। রাজকার্যে তিনি বড় একটা হস্তক্ষেপ করিতেন না; কিন্তু কয়েক মাস পূর্বে একান্তমনে ধর্মচর্চা করিতে করিতে তিনি সহসা উদ্বিগ্ন হইয়া লক্ষ্য করিলেন যে তাঁহার কন্যার যৌবনকাল উপস্থিত হইয়াছে। এরূপ লক্ষ্য করিবার কারণ ঘটিয়াছিল।
রোট্ট যখন পঁচিশ বৎসর পূর্বে এই রাজ্য বিজয় করেন তখন তাঁহার এক সহকারী যোদ্ধা ছিল— তাহার নাম তুষ্ফাণ। তুষ্ফাণ তাহার বীর্য এবং বাহুবল দ্বারা রোট্টকে বহুপ্রকার সাহায্য করিয়াছিল; এমন কি ভূতপূর্ব রাজাকে ধৃত করিয়া সে-ই স্বহস্তে তাঁহার মুণ্ডচ্ছেদ করিয়াছিল। তাই, রাজ্য কবলীকৃত হইলে রোট্ট তুষ্ট হইয়া রাজ্যের সীমান্তস্থিত চষ্টন নামক প্রধান গিরিদুর্গ তাহাকে অর্পণ করেন। পদমর্যাদায় রাজার পরেই তাহার স্থান নির্দিষ্ট হয়।
তাহার পর বহু বর্ষ অতীত হইয়াছে, তুষ্ফাণের মৃত্যু হইয়াছে। তাহার পুত্র কিরাত এখন চষ্টন দুর্গের অধিপতি। কিরাত সুদর্শন যুবা— কিন্তু কুটিল ও নিষ্ঠুর বলিয়া তাহার কুখ্যাতি ছিল। লোকে বলিত, হূণ রক্তই তাহার দেহে প্রাধান্য লাভ করিয়াছে।
এই কিরাত একদা নবযৌবনা তেজস্বিনী রট্টাকে দেখিয়া মজিল। অন্য কেহ হইলে হয়তো নিজ স্পর্ধায় ভীত হইয়া পলায়ন করিত, কিন্তু কিরাত নিজ দুর্গ ছাড়িয়া কপোতকূটে আসিয়া বসিল। রাজসভায় নিত্য যাতায়াতে কুমারীর সহিত প্রত্যহই তাহার সাক্ষাৎ হয়। সুমিষ্ট ভাষণে কিরাত যেমন পটু, আবার মৃগয়াদি পুরুষোচিত ক্রীড়ায় তেমনই দক্ষ। মৃগয়ায় সে রাজকুমারীর নিত্য পার্শ্বচর হইয়া উঠিল।
তাহার অভিপ্রায় বুঝিতে রাজকুমারীর বাকি রহিল না। হূণকন্যা শিশুকাল হইতে অন্তঃপুরের নীড় ছাড়িয়া মুক্ত আকাশে বিচরণ করিতে অভ্যস্ত, তাই তাঁহার বুদ্ধিও একটি অনবগুণ্ঠিত স্বচ্ছতা লাভ করিয়াছিল। মৃগয়াকালে তিনি কিরাতের অব্যর্থ লক্ষ্যের প্রশংসা করিলেন, উদ্যান বাটিকায় তাহার সরস চাটু বচনে হাস্য করিলেন; কিন্তু তাঁহার প্রশংসাদৃষ্টি মোহমুক্ত হইয়াই রহিল, হাসিতে অধররাগ ভিন্ন অন্য কোনও রাগ-রক্তিমা ফুটিল না। কিরাত অনুভব করিল, রাজকন্যা সর্বদাই তাহাকে মনে মনে বিচার করিতেছেন, তুলাদণ্ডে ওজন করিতেছেন। তাহার দুর্দম অভীপ্সা আরও প্রবল ও ব্যক্ত হইয়া উঠিল।
নগরে এই কথা লইয়া লোফালুফি আরম্ভ হইল! সচিব ও সভাসদগণ পূর্বেই ইহা লক্ষ্য করিয়াছিলেন। সর্বশেষে রাজাও লক্ষ্য করিলেন।
রাজা প্রথমে বিস্মিত হইলেন; তারপর সচিবদের ডাকিয়া পরামর্শ করিলেন। উদ্ধতপ্রকৃতির কিরাতের প্রতি কেহই সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাঁহারা মত দিলেন, একজন সামন্তপুত্রের সহিত রাজকন্যার বিবাহ হইতে পারে না; বিশেষত যখন কুমারীই রাজ্যের উত্তরাধিকারিণী। তাহাতে রাজবংশের মর্যাদার হানি হইবে। বরং নিজ অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য অন্যান্য রাজবংশের সহিত সম্বন্ধ স্থাপন করা কর্তব্য। মিত্র যদি সম্বন্ধী হয়, তাহা হইলে বিপৎকালে সাহায্যপ্রাপ্তি বিষয়ে কোনও সংশয় থাকে না।
সচিবদের মন্ত্রণাই মহারাজের মনঃপূত হইল। তিনি রাজসভায় কিরাতকে মৃদু ভর্ৎসনা করিয়া জানাইলেন যে, নিজ দুর্গাধিকার ত্যাগ করিয়া দীর্ঘকাল রাজধানীতে বিলাস ব্যসনে কালক্ষেপ করা তাহার পক্ষে অশোভন। কিরাত কিছুক্ষণ স্থিরনেত্রে মহারাজের মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর বাঙ্নিষ্পত্তি না করিয়া সভা ত্যাগ করিল। অব্যবহিত পরে সে অশ্বপৃষ্ঠে কপোতকূট ছাড়িয়া নিজ দুর্গে ফিরিয়া গেল।
কিরাতকে বিদায় করিয়া মহারাজ প্রাপ্তযৌবন কন্যার বিবাহের কথা চিন্তা করিতে বসিলেন। জীবন অনিত্য; তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে রট্টার বিবাহ না হইলে সিংহাসনের উত্তরাধিকার লইয়া নিশ্চয় গণ্ডগোল বাধিবে। মন্ত্রীদের সহিত আলোচনার পর স্থির হইল, মিত্র গুর্জররাজের দ্বিতীয় পুত্র কুমার-ভট্টারক বারণ বর্মা মহাখ্যাতিমান বীরপুরুষ, তাঁহার নামে নিমন্ত্রণ পত্র প্রেরিত হোক, তিনি আসিয়া কিছুকাল বিটঙ্ক রাজ্যে অবস্থান করুন। তারপর রাজকন্যার সহিত সাক্ষাৎ ঘটিলে উভয়ের মনোভাব বুঝিয়া যথাকর্তব্য নিরূপণ করা যাইবে।
সাড়ম্বর নিমন্ত্রণ লিপি যথাকলে প্রেরিত হইল। অবশ্য তাহাতে বিবাহের কোনও উল্লেখ রহিল না; কিন্তু মনোগত অভিপ্রায় গুর্জররাজ বুঝিলেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিষ্কার করিয়া কথা বলিবার রীতি কোনও কালেই ছিল না।
অনতিকাল পরে গুর্জরের বারণ বর্মা মহাসমারোহে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রট্টার সহিত রাজসভায় তাঁহার সাক্ষাৎকার ঘটিল। প্রথম দর্শনে রট্টা স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। কুমার-ভট্টারক বারণ বর্মার মূর্তি বীরোচিত বটে, দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে প্রায় সমান; সম্মুখে উদর ও পশ্চাতে নিতম্ব রণভেরীর ন্যায় উচ্চ, মুখমণ্ডলে বিশাল গুম্ফ ও ভ্রূযুগল প্রায় তুল্য রোমশ। তাঁহাকে দেখিয়া গুর্জরদেশীয় খ্যাতনামা হস্তীর কথা স্মরণ হয়। রট্টা ক্ষণকাল বিস্ফারিত নয়নে তাঁহার পানে চাহিয়া থাকিয়া ছিন্ন বল্লরীর মত সভাস্থলেই লুটাইয়া পড়িলেন।
বিবাহের প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ হইল। ক্ষুণ্ণ বারণ বর্মা পরদিনই স্বরাজ্যে ফিরিয়া গেলেন।
সুগোপা সখীসুলভ চপলতায় রট্টাকে এই ঘটনার ইঙ্গিত করিয়া পরিহাস করিয়াছিল। এখন রট্টা প্রশ্নের উত্তরে সে বলিল— ‘আমার কথা ছাড়িয়া দাও, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের গলায় মালা দিলেও আমি সুখী হইব না। কিন্তু আমার কথা ভাবিলে তো চলিবে না।’
রট্টা বলিলেন— ‘তবে কাহার কথা ভাবিব?’
‘নিজের কথা। এই যে দেবভোগ্য যৌবন, এ কি ফুলচন্দন দিয়া সাজাইয়া শুধু আমিই দেখিব? দেবতার ভোগে লাগিবে না?’
‘আমার যৌবন আমি সঞ্চয় করিয়া রাখিব, কাহাকেও ভোগ করিতে দিব কেন?’
সুগোপা হাসিল।
‘সখি, বিধি-প্রেরিত ভোক্তা যেদিন আসিবে, সেদিন কিছুই সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পরিবে না, তনু-মন সমস্তই তাঁর পায়ে সমর্পণ করিবে।’
‘তুই না হয় মালাকরের পায়ে তনু-মন সমর্পণ করিয়াছিস, তাই বলিয়া কি সকলেরই একটি মালাকর চাই?’
‘চাই বৈকি সখি, মালাকর নহিলে নারীর যৌবন নিকুঞ্জে ফুল ফুটাইবে কে?’
রট্টা আর কোনও কথা না বলিয়া স্মিতমুখে আকাশের পানে চাহিলেন, চক্ষু দু’টি তন্দ্রাচ্ছন্ন, যেন কোন্ অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিতেছে। সুগোপা কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া শেষে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল— ‘মহারাজ যে কী করিতেছেন তিনিই জানেন। হঠাৎ কাহাকেও কিছু না বলিয়া চষ্টন দুর্গে গিয়া বসিয়া আছেন। এদিকে বসন্তঋতু নিঃশেষ হইয়া আসিল। কি জন্য গিয়াছেন তুমি কিছু জানো?’
রট্টা বলিলেন— ‘চষ্টনের দুর্গাধিপ কিরাত পত্র লিখিয়াছিল, কয়েকটি চৈনিক শ্রমণ বুদ্ধের পবিত্র বিহারভূমি দর্শন করিবার মানসে ভারতে আসিয়াছেন, তাঁহারা পাটলিপুত্র যাইবেন; পথে কয়েকদিনের জন্য চষ্টন দুর্গে বিশ্রাম করিতেছেন। তাই শুনিয়া মহারাজ অর্হৎ সন্দর্শনে গিয়াছেন।’
সুগোপা মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘বিশ্বাস হয় না, কিরাতটা মহা ধূর্ত, ছল করিয়া মহারাজকে নিজ দুর্গে লইয়া গিয়াছে— নিশ্চয় কোনও দুরভিসন্ধি আছে। হয়তো নিভৃতে পাইয়া চাটুবাক্যে মহারাজকে দ্রবীভূত করিয়া তোমার পাণিপ্রার্থনা করিবে।’
‘তুই কিরাতকে দেখিতে পারিস না।’
‘তা পারি না। শুনিয়াছি এই বয়সেই সে ঘোর অত্যাচারী— অতিশয় দুর্জন।’
‘শিকারে কিন্তু তার অব্যর্থ লক্ষ্য।’
‘অব্যর্থ লক্ষ্য হইলেই সজ্জন হয় না। বাজপাখি কি সজ্জন?’
‘কিরাত চমৎকার মিষ্ট কথা বলিতে পারে।’
‘যে পুরুষ মিষ্ট কথা বলে, তাহাকে বিশ্বাস করিতে নাই।’
‘তোর মালাকর বুঝি তোকে কেবলই গালি দেয়?’
সুগোপা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘পরিহাস নয়। কিরাত তোমার পায়ের দিকে তাকাইবার যোগ্য নয়, কিন্তু সে তোমাকে পাইবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। আমি জানি, তোমার জন্যে সে পাগল।’
রট্টা অল্প হাসিলেন, তারপর গম্ভীর হইয়া বলিলেন— ‘শুধু আমার জন্য নয় সুগোপা, এই বিটঙ্ক রাজ্যটার জন্যও সে পাগল। কিন্তু ও কথা যাক। রাত্রি গভীর হইয়াছে, তুই এবার গৃহে যা।’
‘তাই যাই, তুমিও ক্লান্ত হইয়াছ। একে সারাদিন বনে বনে মৃগয়া, তার উপর চোরের উৎপাত— জলসত্র হইতে এতটা পথ হাঁটিয়া আসিতে হইয়াছে। মানুষ ঘোড়া চুরি করে এমন কথা জন্মে শুনি নাই। আর কী স্পর্ধা— রাজকন্যার ঘোড়া চুরি! দেখিয়াই বুঝিয়েছিলাম লোকটা ভাল নয়।’ নিজের লাঞ্ছনার কথা স্মরণ করিয়া সুগোপার রাগ একটু বাড়িল— ‘দুর্বৃত্ত বিদেশী তস্কর। এখন যদি তাহাকে একবার পাই—’
‘কি করিস?’
‘শূলে দিই।’
‘আমিও। এখন যা, চোরের উপর রাগ করিয়া পতি-দেবতাকে আর কষ্ট দিস না। সে হয়তো হাঁ করিয়া তোর পথ চাহিয়া আছে, ভাবিতেছে তোকেও চোরে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে।’
‘মালাকরের সে ভয় নাই, তিনি জানেন আমাকে চুরি করিতে পারে এমন চোর জন্মায় নাই। তিনি এখন কোন শৌণ্ডিকালয়ে পড়িয়া অপ্সরী কিন্নরীর স্বপ্ন দেখিতেছেন। যাই, তাঁহাকে খুঁজিয়া লইয়া গৃহে ফিরিতে হইবে তো।’
‘প্রত্যহই বুঝি তাই করিতে হয়?’
‘হাঁ।’ সুগোপা মৃদু হাসিল— ‘মালাকর লোকটি মন্দ নয়, আমাকে ভালও বাসে। কিন্তু মদিরা-সুন্দরীর প্রতি প্রেম কিছু অধিক। যাই, সপত্নীগৃহ হইতে পতি-দেবতাকে উদ্ধার করিয়া নিজ গৃহে আনি গিয়া।’
হাসিতে হাসিতে সুগোপা বিদায় লইল। তখন মধ্যরাত্রি হইতে অধিক বিলম্ব নাই।