০৪. প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান রিওন

প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান রিওন শুতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার আঠার বছরের মেয়ে কাটুস্কার ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। এত রাত পর্যন্ত জেগে জেগে কাটুস্কা কী করছে দেখার জন্য রিওন তার মেয়ের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল। কাটুস্কা বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। রিওন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এত রাতে তুমি কী করছ কাটুস্কা?

দেখছি।

কী দেখছ?

টাইফুন। উপগ্রহের ছবিতেই এটা ভয়ঙ্কর। সত্যি সত্যি যদি দেখা যেত তা হলে না জানি কত ভয়ঙ্কর দেখাত।

রিওন হেসে বলল, তোমার কী হয়েছে কাটুস্কা, তুমি এত রাত জেগে মনিটরে উপগ্রহের তোলা টাইফুনের ছবি দেখছ কেন?

ইনস্টিটিউট থেকে আমাদের হোমওয়ার্ক দিয়েছে। কোয়াকম্প ব্যবহার করে এর গতিপথটা বের করতে হবে। তারপর দেখতে হবে আমাদের হিসাবের সঙ্গে মেলে কি না।

কী দেখলে? মিলেছে?

কাটুস্কা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ বাবা, মোটামুটি মিলে গেছে। টাইফুনটা যেদিক দিয়ে যাওয়ার কথা ঠিক সেদিক দিয়েই যাচ্ছে।

চমকার। এখন তা হলে ঘুমাও।

হ্যাঁ বাবা, ঘুমাব।

রিওন চলে যাচ্ছিল, কাটুস্কা তাকে থামাল, বলল, বাবা।

কী কাটুস্কা?

উপগ্রহের ছবিতে দেখেছিলাম সমুদ্রের ওপর ছোট ঘোট দ্বীপ। এগুলো কি জলমানবদের আস্তানা?

সম্ভবত।

ঠিক ওদের আস্তানার ওপর দিয়ে টাইফুনটা যাচ্ছে। জলমানবদের কী হবে, বাবা?

কী আর হবে? শেষ হয়ে যাবে।

তারা সরে যায় না কেন?

কেমন করে সরে যাবে? টাইফুন আসার ভবিষ্যদ্বাণীটাও তো তারা করতে পারে না। ওদের কাছে তো কোনো যন্ত্রপাতি নেই। রিওন মাথা নেড়ে বলল, কাটুস্কা তোমার হয়েছেটা কী? কদিন থেকে শুধু জলমানব, জলমানব করছ।

কাটুস্কা বলল, না বাবা, কৌতূহল।

উপগ্রহের ছবি কী বলে? আস্তানাটা আছে, না নেই?

নেই। একটু আগে ছোট ঘোট কয়টা ভাসমান দ্বীপের মতো ছিল। এখন সেখানে কিছু নেই।

রিওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সব ভেসে গেছে।

এমনকি হতে পারে যে তারা কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে?

রিওন শব্দ করে হেসে বলল, নিরাপদ আশ্রয়টা কোথায়? চারদিকে শুধু পানি আর পানি।

কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, তা ঠিক।

রিওন চলে যাচ্ছিল, কাটুস্কা আবার তাকে থামাল, বাবা।

কী কাটুস্কা?

তুমি কয় দিন আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আমি জন্মদিনে কী চাই। মনে আছে?

হ্যাঁ কাটুস্কা। মনে আছে। তুমি কী চাও?

দশ হাজার ইউনিট।

রিওন একটু অবাক হয়ে বলল, এত ইউনিট দিয়ে কী করবে তুমি?

সমুদ্রে একটা অ্যাডভেঞ্চার পার্টি যায়, দশ হাজার ইউনিট তার ফি। খুব নাকি মজা হয়।

তুমি কোথা থেকে তার খোঁজ পেলে?

মাজুর বলেছে। মাজুরের কথা মনে আছে? আমাদের ইনস্টিটিউটে পড়ে।

হ্যাঁ, মনে আছে।

দেবে তো দশ হাজার ইউনিট?

রিওন এক মুহূর্ত কী একটা ভেবে বলল, দেব। অবশ্যই দেব, কাটুস্কা।

.

ইনস্টিটিউটের ক্লাসঘরে জানালার পাশে কাটুস্কা তার নির্ধারিত সিটে বসে অন্যমনস্কভাবে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সামনে বড় ডেস্কে তাদের মধ্যবয়সী ইনস্ট্রাক্টর ছোট ব্যাগটি রেখে সেখান থেকে ইন্টারফেসের ছোট মডিউলটা বের করতে করতে বলল, তোমাদের অভিনন্দন। তোমরা সবাই টাইফুনের গতিপথটি সফলভাবে বের করতে পেরেছ। তোমাদের হিসাবের সঙ্গে প্রকৃত গতিপথের বিচ্যুতি মাত্র দশমিক শূন্য শূন্য তিন শতাংশ। তোমাদের সবাইকে অভিনন্দন।

ক্লাসঘরে বসে থাকা ছেলেমেয়েরা আনন্দের মতো এক ধরনের শব্দ করল। কাটুস্কা ভুরু কুঁচকে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা অভিনন্দন পাওয়ার মতো এমন কী কাজ করেছে সে এখনো বুঝতে পারে নি।

মধ্যবয়সী ইনস্ট্রাক্টর ডেস্কের সামনে কয়েকবার পায়চারি করে মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য নিয়ে এসে খানিকটা নাটকীয়ভাবে বলল, তোমরা কোয়াকম্প ব্যবহার করার একটা পর্যায় শেষ করেছ। এখন তোমরা তার পরের পর্যায়ে যাবে। এই পর্যায়ে যাওয়ার জন্য তোমরা নিশ্চয়ই অনেক দিন থেকে অপেক্ষা করছ, কারণ যারা এই পর্যায়ে পৌঁছায় তারা কোয়াকম্প ব্যবহার করে সিনথেসিস করতে পারে। এই সুযোগটি গ্রহণ করতে হলে তোমাদের নিজস্ব জিনেটিক কোডিং ব্যবহার করতে হয় নিরাপত্তার কারণে। তোমাদের অভিনন্দন। অনেক অভিনন্দন।

কাটুস্কার কী মনে হল কে জানে, হঠাৎ হাত তুলে বলল, তুমি একটু পরপর আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছ কেন? আমরা কী করেছি?

মধ্যবয়সী ইনস্ট্রাক্টর বলল, তোমরা কোয়াকম্প ব্যবহারের একটা নূতন স্তরে পৌঁছেছ। টাইফুনের গতিবিধি নিখুঁতভাবে বের করার জন্য তোমাদের এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

কাটুস্কা বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা বাচ্চা ছেলেও কোয়াকম্প ব্যবহার করতে পারবে। এখানে-সেখানে দুই-চারটা সুইচে চাপ দেওয়া, দুই-চারটা তথ্য খুঁজে বের করা-এর মধ্যে কোন কাজটা অভিনন্দন পাওয়ার মতো?

মধ্যবয়স্ক ইনস্ট্রাক্টর কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, কিন্তু তোমাদের মতো এই পর্যায়ে পৌঁছায় খুব অল্প কয়জন মানুষ।

তার কারণ আমাদের বাবাদের ক্ষমতা বেশি, তারা আমাদের এই ইনষ্টিটিউটে ভর্তি করিয়েছেন। আমাদের কোনো কৃতিত্ব নেই। সব কৃতিত্ব আমাদের বাবাদের।

ক্লাসরুমের মাঝামাঝি বসে থাকা মাজুর হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। কাটুস্কা চোখ পাকিয়ে বলল, কী হল, তুমি হাসছ কেন? আমি কি হাসির কথা বলেছি?

মাজুর মাথা নাড়ে, বলে, না, তুমি মোটেই হাসির কথা বল নাই।

তা হলে কেন হাসছ?

হাসছি, কারণ খুব সহজ একটা জিনিস তুমি বুঝেছ এত দেরিতে।

কাটুস্কা চোখ পাকিয়ে বলল, এটা তোমরা আগে থেকে জান?

হ্যাঁ। জানি। তবে আমরা তোমার মতো নাবালিকা না, তাই এটা নিয়ে চেঁচামেচি করি না।

কাটুস্কা রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মধ্যবয়স্ক ইনস্ট্রাক্টর তাকে থামিয়ে দিল। হাত তুলে বলল, অনেক হয়েছে। আমরা যে কাজ করতে এসেছি সেই কাজ করি।

কাটুস্কা একটা নিঃশ্বাস ফেলে তার টেবিলের মনিটরটি নিজের কাছে টেনে নেয়।

.

ক্লাসের শেষে ছোট করিডরে সবাই একত্র হয়েছে। মাজুর তার উত্তেজক পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা কাটুস্কা, তোমার হয়েছেটা কী? তুমি সব সময় এত রেগে থাক কেন?

দ্রীমান বলল, হ্যাঁ, কী হয়েছে তোমার?

কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, আমার কিছু হয় নি।

ক্রানা মাথা নেড়ে বলল, উঁহু, তোমার কিছু একটা হয়েছে, কিছু একটা তোমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।

কাটুস্কা মাথা নেড়ে বলল, আমাকে নূতন কিছু যন্ত্রণা দিচ্ছে না।

তা হলে? পুরোনো কিছু যন্ত্রণা দিচ্ছে?

কাটুস্কা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না না, এটা ঠিক যন্ত্রণা নয়। তবে

তবে কী?

তোমরা জান আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা এত বেশি আত্মহত্যা করে কেন? শতকরা প্রায় বারো ভাগ?

মাজুর গম্ভীর হয়ে বলল, আত্মহত্যা এক ধরনের রোগ।

কাটুস্কা বলল, তা হলে আমি অন্যভাবে প্রশ্ন করি, আমাদের মতো কমবয়সীদের মধ্যে এই রোগটি এত বেশি কেন?

দ্রীমান বলল, এ তো সব সময়ই ছিল।

না। ছিল না। যখন পৃথিবীটা স্বাভাবিক ছিল তখন আমাদের মতো কমবয়সীরা এত বেশি আত্মহত্যা করত না।

মাজুর তার উত্তেজক পানীয়ের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ কাটুস্কা?

কাটুস্কা গম্ভীর মুখে বলল, আমি বলতে চাইছি যে আমাদের জীবনে কোনো আনন্দ নেই। আমাদের জীবনের কোনো অর্থও নেই। আমরা ভান করি আমাদের জীবন খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের অনেক আনন্দ-আসলে এসব বাজে কথা। আনন্দ পাওয়ার জন্য সাইকাডোমে আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন দিয়ে রেজোনেন্স করাতে হয়।

মাজুর মুখ শক্ত করে বলল, তুমি কী বলছ এসব? আমাদের জীবনে আনন্দ নেই? আমাদের জীবনের কোনো অর্থ নেই?

কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, না, নেই। আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তার জন্য আমরা কোয়াকম্পের কাছে যাই। কোয়াকম্প হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সে আমাদের সবকিছুর সমাধান করে দেয়।

তা-ই তো দেবার কথা। দ্রীমান অধৈর্য হয়ে বলল, সেজন্যই তো কোয়াকম্প তৈরি করা হয়েছে।

কাটুস্কা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, কোয়াকম্পের একটা বোতাম টিপে একটা তথ্য বের করে আমি তোমাদের মতো আনন্দে লাফাতে পারি না।

মাজুর মুখ শক্ত করে বলল, তুমি তা হলে কী চাও?

কাটুস্কা বলল, আমি জানি না।

ক্ৰানা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, কাটুস্কা, তোমার কিসের অভাব? তোমার বাবা প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান। তোমার চেহারা অপূর্ব। তোমার জিনেটিক কোডিং একেবারে সবার ওপরে। তোমার আইকিউ অসাধারণ। তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করছ। তোমার এত কিছু থাকার পরও একেবারে সাধারণ রাস্তার একটা হতভাগা ছেলের মতো কথা বলছ কেন?

কাটুস্কা বিষণ্ণ গলায় বলল, আমি জানি না।

মাজুর একটু এগিয়ে এসে কাটুস্কার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, কাটুস্কা, মন ভালো কর। এ রকম গোমড়ামুখে থেকো না। তোমার এখন কী প্রয়োজন জান?

কী?

মাজুর গলায় একটু নাটকীয় ভাব এনে বলল, তোমার জীবনে এখন প্রয়োজন খানিকটা উত্তেজনা।

উত্তেজনা?

হ্যাঁ, তোমার জীবন একটু একঘেয়ে হয়ে গেছে।

 ক্ৰানা জিজ্ঞেস করল, সেই উত্তেজনাটুকু আসবে কীভাবে?

মাজুর চোখ বড় বড় করে বলল, খুব সহজে। আমরা কাটুস্কাকে নিয়ে যাব জলমানব শিকারে।

কাটুস্কা ভুরু কুঁচকে মাজুরের দিকে তাকিয়ে রইল। মাজুর বলল, মানুষের জীবনে এর চাইতে বড় উত্তেজনার কিছু নেই। যারা গিয়েছে তারা বলেছে এই অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই। একজন ভিতু মানুষ, দুর্বল মানুষ, আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ জলমানব শিকার করার পর সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যায়। তার কোনো দুর্বলতা থাকে না। ভয়-ভীতি থাকে না। রাতারাতি জীবনটা অন্য রকম হয়ে যায়।

কাটুস্কা জিজ্ঞেস করল, সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

কেন?

মনোবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। জলমানবেরা মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়, তাই। তাদের হত্যা করায় উত্তেজনা আছে, অপরাধবোধ নেই-এ রকম একটা ব্যাখ্যা পড়েছিলাম।

কাটুস্কা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, খুব বিচিত্র ব্যাখ্যা।

বিচিত্র হতে পারে, কিন্তু সত্যি। মাজুর কাটুস্কার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যেতে চাও?

কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, দেখি চেষ্টা করে।

দশ হাজার ইউনিট লাগবে।

সেটা হয়তো সমস্যা নয়। আমার বাবা আমাকে দশ হাজার ইউনিট দিতে রাজি হয়েছেন।

মাজুর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, চমৎকার।

দ্রীমান বলল, আমিও যাব।

মাজুর খুশি হয়ে বলল, তা হলে তো আরো ভালো। ক্রানা, তুমি যাবে না?

বলল, তোমরা সবাই যদি যাও তা হলে আমি একা পড়ে থাকব কেন?

চমৎকার। আনন্দে মাজুর তার উত্তেজক পানীয়টুকু এক ঢোকে শেষ করে বলল, তা হলে আমি ব্যবস্থা করে ফেলছি! ঠিক আছে?

 সবই মাথা নাড়ল। বলল, ঠিকু আছে।

.

মাজুর খুব কাজের ছেলে, এক সপ্তাহের ভেতর সে সব ব্যবস্থা শেষ করে ফেলল। নানা রকম নৌযানে যাওয়া যায়, তারা বেছে নিল সাধারণ একটা ইয়ট। সমুদ্রের নীল পানিতে ধবধবে সাদা একটা ইয়ট ভেসে যাচ্ছে বিষয়টা চিন্তা করেই সবার মন ভালো হয়ে যেতে শুরু করে। ইয়টে থাকা-খাওয়া-বিনোদন-সবকিছুর ব্যবস্থা রয়েছে, জুরা অভিজ্ঞ, তারা পুরো শিকারের বিষয়টা যেন নিরাপদে শেষ করা যায় তার ঘুঁটিনাটি ব্যবস্থা করে রাখল।

প্রথম দিনেই তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করা শেখানো হল। নূতন ব্রনের অস্ত্র, একটা ম্যাগাজিনে প্রায় এক শ বুলেট থাকে। ট্রিগার টেনে ধরে রাখলে মুহূর্তে ম্যাগাজিন খালি হয়ে যায়। ইয়টের ডেকে দাঁড়িয়ে চলন্ত টার্গেটের মধ্যে গুলি করতে করতে কাটুস্কা বিচিত্র এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটায় হাত বুলিয়ে সে মাজুরকে বলল, অস্ত্র কী বিচিত্র একটা জিনিস দেখেছ?

মাজুর দূরে ভাসমান একটা টার্গেটে এক পশলা গুলি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, কেন? তোমার কাছে এটা বিচিত্র কেন মনে হচ্ছে?

এটা তৈরিই করা হয়েছে মানুষকে হত্যা করার জন্য। মানুষ হয়ে মানুষকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র তৈরি করা যায়, বিষয়টা কেমন জানি অদ্ভুত মনে হয়।

দ্রীমান বলল, শুধু মানুষকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র তৈরি হয় নি। অন্য অনেক জন্তু জানোয়ার অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। জলমানবকে হত্যা করা হয়।

কাটুস্কা মাথা নাড়ল, আস্তে আস্তে বলল, অস্ত্র আসলেই খুব বিচিত্র একটা জিনিস। আমি কখনো ভাবি নি আমি কোনো জীবন্ত প্রাণীকে হত্যা করতে পারব। কিন্তু এটা হাতে নেওয়ার পরই আমার কেমন জানি হাত নিশপিশ করছে। কোনো একটা জীবন্ত প্রাণীকে গুলি করব, সেটা ছটফট করতে থাকবে সেই দৃশ্যটা দেখার জন্য ভেতরটা কেমন জানি আকুলি বিকুলি করছে।

ক্রানা একটু অবাক হয়ে কাটুঙ্কার দিকে তাকাল। বলল, ঠিকই বলেছ তুমি! অস্ত্র খুবই অবাক একটা জিনিস।

মাজুর তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়ে অনির্দিষ্টভাবে এক ঝক গুলি করে বলল, এক শ ভাগ সত্যি কথা, গুলি করতে কী ভালোই না লাগে। শব্দটা কী সুন্দর, হাতের নিচে যে ঝাঁকুনিটা দেয় সেটা অসাধারণ। মনে হয় এই অস্ত্রটা একটা জীবন্ত প্রাণী, তাই না?

দ্রীমান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ, অস্ত্র খুব চমৎকার একটা জিনিস। নার্ভকে শান্ত রাখার জন্য এর থেকে ভালো কিছু আর হতে পারে না।

কাটুস্কা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ইয়টের একজন ক্রুকে ঠিক এ রকম সময়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে থেমে গেল। মানুষটির রোদেপোড়া চেহারা, কঠিন মুখ এবং নীল চোখ। মাথার সামনের দিকে চুল হালকা হয়ে এসেছে। কাছাকাছি এসে বলল, তোমাদের অস্ত্র চালানো কেমন হচ্ছে?

মাজুর বলল, খুব ভালো। মোটামুটি টার্গেট ফেলে দিতে পারছি।

দ্রীমান বলল, যত কঠিন হবে ভেবেছিলাম মোটেও তত কঠিন নয়।

কঠিন চেহারার মানুষটি হা হা করে হেসে বলল, ইয়টের ডেক থেকে গুলি করছ, কঠিন মনে হবে কেন? যখন সাগর-স্কুটারে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে ছুটে যেতে যেতে গুলি করবে তখন বুঝবে কাজটা সহজ না কঠিন।

কাটুস্কা জানতে চাইল, সেটা আমরা কখন করব?

এখনই। আমি সেজন্য এসেছি।

মাজুর আনন্দের মতো একটা শব্দ করল, বলল, চমৎকার। চল তা হলে, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।

ক্রানা বলল, আমরা জলমানবদের দেখা পাব কখন?

সেজন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, জলমানবদের কাছাকাছি নেবার আগে তোমাদের সাগর-স্কুটারে চড়া শিখতে হবে। সেখান থেকে গুলি করা শিখতে হবে। এখনো অনেক কাজ বাকি। তোমাদের এত তাড়াহুড়ো কিসের?

কাটুস্কা হেসে বলল, নাই। আমাদের কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সব মিলিয়ে শিখতে কত দিন লাগবে?

কঠিন চেহারার মানুষটি একটু হাসল এবং হাসির কারণে তাকে হঠাৎ সহৃদয় একজন মানুষের মতো দেখায়, সে হাসতে হাসতে বলল, জলমানব শিকার হচ্ছে এক ধরনের স্পোর্টস। এটি কোনো নিষ্ঠুরতা নয়, কোনো যুদ্ধ নয়। জলমানব হচ্ছে মানুষের অপভ্রংশ, তাই তাদের আছে মানুষের বুদ্ধি। তারা পানিতে ভেসে থাকতে ব্যবহার করে ডলফিন, পানিতে ডলফিন থেকে সাবলীল কোনো প্রাণী নেই। মানুষ এবং ডলফিন এই দুই প্রাণী মিলে তৈরি হয় একটা অসাধারণ সমন্বয়। তাদের গুলি করা সোজা কথা নয়। তোমাদের সেটা সময় নিয়ে শিখতে হবে। সেজন্য তোমাদের পরিশ্রম করতে হবে।

কাজেই পরের কয়েকদিন তারা সমুদ্রের পানিতে সাগর-স্কুটার চালানো শিখল। হাইড্রোজেন সেলের শক্তিশালী ইঞ্জিন গর্জন করে উঠতে থাকে আর শুকনো এলাকার চারজন তরুণ তরুণী সাগর-স্কুটারে করে প্রচণ্ড গতিতে পানি কেটে ছুটে যেতে থাকে। একবার সাগর স্কুটারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেওয়ার পর তারা এক হাতে হ্যান্ডেলটা ধরে রেখে অন্য হাতে গুলি করা শিখতে রু করল। কাজটি কঠিন এবং বিপজ্জনক। বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে তারা তৃতীয় দিনের মাথায় ব্যাপারটা মোটামুটি শিখে নিল। চতুর্থ দিন। ইয়টের ক্রুরা তাদের একটা পরীক্ষা নিল। নানা ধরনের চলমান টার্গেটকে তাদের গুলি করতে হল, পানিতে না ডুবে তারা যখন সফলভাবে টার্গেটে গুলি করতে পারল তখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে তাদের ট্রেনিং সমাপ্ত করে দেওয়া হল।

সেই রাতে একটা বিশেষ ভোজর আয়োজন করা হয়েছে। ইয়টের ডেকে জ্বলন্ত আগুনে একটা সামুদ্রিক মাছ ঝলসে খেতে খেতে সবাই কথা বলছে। উত্তেজক পানীয় খাবার কারণে সবার ভেতরেই এক ধরনের ফুরফুরে আনন্দ। ইয়টের ক্রুদের পক্ষ থেকে একসময় একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাটুঙ্কা, কানা, দ্রীমান এবং মাজুর আমি আমার এই ইয়টের পক্ষ থেকে তোমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাময় স্পোর্টসের জন্য তোমরা এখন প্রস্তুত। তোমাদের অভিনন্দন।

মাজুর হাত উচিয়ে একটা আনন্দের মতো শব্দ করল, অন্যরাও তাতে যোগ দিল। মানুষটি বলল, আমি খুব আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমরা জলমানবের একটা আস্তানার খোঁজ পেয়েছি। আমাদের ইয়ট সেদিকে রওনা দিচ্ছে। আমরা আশা করছি আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছে যাব। আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তোমরা পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাময় স্পোর্টসে অংশ নেবে। তোমাদের অভিনন্দন।

কাটুস্কা তার উত্তেজক পানীয়ের গ্লাসটা ঊপরে তুলে আনন্দে একটা চিৎকার করে ওঠে, সাথে সাথে অন্য সবাই সেই চিৎকারে যোগ দেয়। ছেলেমানুষি আনন্দে তারা হিহি করে হাসতে থাকে, একজন আরেকজনের ওপর ঢলে পড়তে থাকে।

গভীর রাতে ইয়টের ডেকে শুয়ে শুয়ে আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কাটুস্কার মনে হয়, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে সত্যি এক ধরনের আনন্দ আছে। কাটুস্কার মনে হয় তার। কী সৌভাগ্য যে সে মানুষ হয়ে জন্মেছিল। তাই সে এই আনন্দ আর উত্তেজনা উপভোগ করতে পারছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ তার মনে হল তার জীবনের এই আনন্দ আর উত্তেজনা কি সত্যি? নাকি সেটা নিজের কাছে নিজের করা এক ধরনের অভিনয়? মানুষ কি কখনো নিজের কাছে নিজে অভিনয় করে? করতে পারে?