পাশের ঘরটিও ঠিক বলতে গেলে একই সাইজের।
একটি খাটের উপর রাহুল চোখ বুজে শুয়ে মধ্যে মধ্যে জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে ভুল বকছে।
কিরীটী শয্যায় শায়িত ছেলেটির দিকে তাকাল। ছেলেটি ভারী রুগ্ন। তার বাপের ফর্সা রং পায়নি। কালো। শয্যার একপাশে মিত্ৰাণী বসেছিল চুপচাপ। ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়।
কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে, না না, আপনাকে উঠতে হবে না, আপনি বসুন।
মিত্ৰাণী কিন্তু বসে না, দাঁড়িয়েই থাকে। কিরীটী চেয়ে দেখে মিত্ৰাণীর দিকে।
অবনীবাবু ঠিকই বর্ণনা দিয়েছিলেন মেয়েটির চেহারার।
রোগা, পাতলা এবং কালোর উপরে ভারি চমৎকার দেখতে। চোখে-মুখে যেন একটা অপূর্ব শ্রী।
মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয় কিরীটীর সঙ্গে।
মিত্ৰাণী সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ভূমিতলে নিবদ্ধ করে। কিন্তু সেই মুহূর্তের চাউনিতেই বুঝতে কষ্ট হয় না কিরীটীর, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দীপ্তি যেন চোখের মণি দুটো থেকে উঁকি দিচ্ছে মেয়েটির।
পরনে মলিন একটা রঙিন জলড়ুরে শাড়ি। বগল-কাটা ব্লাউস গায়ে। হাতে একগাছা করে সোনার রুলি। আর দেহের কোথাও কোন গহনা নেই।
মাথার চুল রুক্ষ, কিন্তু পর্যাপ্ত চুল মাথায়।
ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে একটি বড় সাইজের খাট, একটি দেরাজ এবং দেরাজের পাশেই একটি দরজা।
এ ঘরে তিনটি দরজা।
একটা দিয়ে তারা ঘরে এসেছে, একটা দুই ঘরের মধ্যবর্তী। সেটা এদিক থেকে বন্ধ। অন্যটা দক্ষিণ দেওয়ালে দেরাজের পাশে, সেটাও বন্ধ ছিল।
অন্য দিকের দেওয়ালে একটা আলনা ও ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল।
কিরীটী দক্ষিণের দরজাটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ঐ দরজাটা?
সুশান্ত বলে, ওটা হচ্ছে এ বাড়ির পিছনে যাবার। ওদিকে একটা ছোট বাগান মত আছে।
দরজাটা ব্যবহার হয় তাহলে বলুন?
সুশান্ত বলে, তা হয় বোধ হয় মধ্যে মধ্যে।
কে ব্যবহার করেন, আপনি?
না, আমি ওদিকে বড় একটা যাই না।
কিরীটী এবারে ঘুরে তাকাল মিত্ৰাণীর দিকে, আপনি?
আমি?
হ্যাঁ, আপনি ব্যবহার করেন ঐ দরজা?
তা মধ্যে মধ্যে করি।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ কিরীটী নীচু হয়ে খাটের নীচে থেকে একটা সিগারেটের টুকরোর শেষাংশ কুড়িয়ে গেল।
মিঃ চ্যাটার্জি।
বলুন?
আপনি তো সিগারেট খান, কি ব্র্যাণ্ড খান?
আমি-আমি তো স্মোক করি না!
করেন না?
না।
কখনও মধ্যে-সধ্যেও না?
না। তবে এককালে ছিল, এখন আর—
ড্রিংক করেন?
মধ্যে মধ্যে করি।
একটু যেন ইতস্তত করেই কথাটা বলেন সুশান্ত চ্যাটার্জি।
ঐসময় বিড়বিড় করে রাহুল বলে ওঠে, মাসীমণি, বড় অন্ধকার-আলোটা জ্বালো না। তারপরই চেচিয়ে ওঠে কেমন যেন ভয়ার্ত কণ্ঠে, কে-কে-কে ওখানে মাসীমণি? কে?
মিত্ৰাণী তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে রাহুলের সামনে, কই, কেউ তো নয় বাবা, কেউ নয়, তুমি ঘুমাও।
রাহুল আবার শান্ত হয়ে যায়।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে রাহুলের কপাল স্পর্শ করে, জুরে যেন একেবারে পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার গা। খুব কম হলেও একশো চার ডিগ্রীর নীচে নয়।
মিত্ৰাণী দেবী!
কিরীটীর ডাকে মিত্ৰাণী চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে।
রাহুলের গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিচ্ছিল মিত্ৰাণী।
এ ঘরটা ঝাঁট দেওয়া হয়নি কদিন?
অ্যাঁ! কি বললেন?
এ ঘরটা ঝট দেওয়া হয়নি কদিন?
পরশুও তো ঝাট দিয়েছি। আজ অবিশ্যি দেওয়া হয়নি এখনো পর্যন্ত।
তাহলে পরশুও ঝাট দিয়েছেন!
হ্যাঁ, বিকেলে।
আপনিই দেন বোধ হয়?
হ্যাঁ, আমিই দিই।
কেন, ঝি নেই?
হ্যাঁ, একজন ভোলা ঝি আছে। ইদানীং কিছুদিন হল আমাদের পুরনো ঝি ছুটি নিয়ে মাস-দুয়েকের জন্য দেশে গিয়েছে, নতুন বি ওসব করতে চায় না।
আচ্ছা মিত্ৰাণী দেবী, আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবনীবাবু ও সুশান্তবাবু ছাড়া আর কোন তৃতীয় ব্যক্তি এখানে এসেছিলেন?
কই না!
ভালো করে মনে করে দেখুন?
এবারে জবাব দিল সুশান্ত, কে আসবে এখানে মিঃ রায়? সকাল থেকে যা দুর্যোগ চলেছে-তাছাড়া আমার বাড়িতে কেউ এলেও এ ঘরে কেন আসবে?
কিন্তু আসতেও তো পারে মিঃ চ্যাটার্জি! শান্ত কণ্ঠে একটা পাইপ পকেট থেকে বের করে সেটায় তামাক ভরতে ভরতে বলে কিরীটী।
কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি মিঃ চ্যাটার্জি। আজ সারাদিন যদি কেউ না এসে থাকেনও, পরশু বিকেল থেকে রাতের মধ্যে অর্থাৎ ঐ বারো ঘণ্টার মধ্যে আপনার কোয়ার্টারের এই ঘরে কেউ যে এসেছিল সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ।
কিন্তু।
শুনুন মিঃ চ্যাটার্জি, আপনি হয়ত জানেন না, কিন্তু মিত্ৰাণী দেবী নিশ্চয়ই জানেন-তাই ওঁকেই তো কথাটা জিজ্ঞাসা করছি। কি মিত্ৰাণী দেবী, আসেননি কেউ?
শান্ত ধীর কণ্ঠে জবাব দেয় মিত্ৰাণী, না।
ঠিক বলছেন?
হ্যাঁ।
কেউ আসেননি তাহলে?
না।
কিরীটী ক্ষণকাল নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মিত্ৰাণীর দিকে। মনে হল ঈষৎ বাঁকা ঠোঁটের কোণে যেন একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ খেলছে।
তারপর ধীরে ধীরে আবার তাকাল সুশান্তর দিকে।
সুশান্তবাবু!
কিছু বলছেন?
হ্যাঁ। আজ শনিবার—আপনি তো বৃহস্পতিবার অর্থাৎ পরশু সকালেই ডিউটিতে বের হয়ে যান?
হাঁ।
বেলা তখন কটা হবে?
সকাল পৌনে নটা।
আপনার ডিউটি ছিল কটা থেকে?
দশটা থেকে।
ফিরেছেন আপনি আজ সকালে?
হ্যাঁ। কখন ডিউটি শেষ হল?
ডিউটি অবিশ্যি আমার সন্ধ্যাতেই শেষ হবার কথা, কিন্তু ট্রেনের লেটের জন্য ফিরেছি আমি রাত প্রায় আড়াইটায়–
তখন বাড়ি আসেননি?
না। কেন?
রেস্টিং রুমেই শুয়েছিলাম আমি, আর—আর একজন টি. টি. আই., অত রাত্রে আর বাড়ি আসতে ইচ্ছা করল না বলে। তাছাড়া–
তাছাড়া? বাড়িতে এলেই তো সেই অশান্তি। তাই—
তাই যতটা সম্ভব বাড়ি এড়িয়ে চলতেন?
তাই।
কিরীটী আর কোন কথা বলল না।
এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকের যে দরজাটা বন্ধ ছিল ভিতর থেকে, সেটা খুলে বাইরে পা বাড়াল।
ছোট একফালি জমি। সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া। তার ওদিকে সরু একটা রাস্ত। তারও ওদিকে রেলওয়ে ইয়ার্ড। কিছু ফুলের গাছ আছে। অরক্ষিত।
শুধু একটা টগর গাছে রাশি রাশি সাদা ফুল ফুটে আছে।
হঠাৎ নজরে পড়ল কিরীটীর, গতরাত্রে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়ে জমি নরম হয়ে গিয়েছিল, এখানে ওখানে কিছু জল জমে আছে আর নরম কাদা তখনও।
নরম কাদায় এলোমেলো কিছু জুতোর ছাপ রয়েছে। কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জুতোর ছাপগুলো পরীক্ষা করে দেখল। এক ধরনের জুতোর ছাপ নয়, দুরকমের জুতোর ছাপ পড়েছে।
তার মধ্যে একটা হালকা, অন্যটা যেন ভারী, চেপে বসেছে। একটা কিছু অস্পষ্ট, অন্যটা বেশ স্পষ্ট।
একটা মনে হয় চামড়ার সোলের, অন্যটা মনে হয় রবার সোলের কেডস্ জাতীয় কোন জুতোর ছাপ যেন।
কিরীটী ফিরে এল আবার ঘরে।
চলুন অবনীবাবু।
সকলে বের হয়ে এল অতঃপর ঘর থেকে।
বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে কয়েক জোড়া জুতোর উপরে নজর পড়ল কিরীটীর।
চার-পাঁচটা জেন্টস, লেডিস, ও বাচ্চার জুতো, তার মধ্যে একজোড়া ব্রাউন রঙের ভারী সোলের জুতোও রয়েছে।
মুহূর্তের জন্য থামল কিরীটী।
ভাল করে নজরে করে দেখল ভারী ব্রাউন জুতোজোড়া। জুতোর সোলে তখনও কাদা শুকিয়ে আছে। মিঃ চ্যাটার্জি।
বলুন?
ঐ ব্রাউন ভারী সোলের জুতোজোড়া নিশ্চয়ই আপনার?
হ্যাঁ।
পরশু ডিউটিতে কোন্ জুতো পরে গিয়েছিলেন? ঐ জুতোজাড়াই বোধ হয়?
হ্যাঁ।
বুঝতে পেরেছিলাম! চলুন অবনীবাবু।
কিছু বলছেন?
না। ভাল কথা, পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা কখন পাওয়া যাবে?
কাল পেতে পারি বিকেল নাগাদ। অবনী জবাব দেন।
রিপোর্ট পেলে একবার আমার ওখানে আসবেন?
নিশ্চয়ই।
চলুন রাত হল, এবারে ফেরা যাক।
কিরীটীর কথায় যেন মনে হল অবনী সাহা একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করেন না।
কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসেন।
অবনীর জীপেই ফিরছিল ওরা। অবনী জীপ চালাচ্ছিলেন, কিরীটী পাশে বসেছিল। রাত মন্দ হয়নি তখন—প্রায় পৌনে নটা। তাহলেও কলকাতা তখন রীতিমত প্রাণচঞ্চল। আলোকিত, শব্দ-মুখরিত, যানবাহন ও মানুষের ভিড়ে চঞ্চল শব্দময়ী কলকাতা।
অবনী সাহা মৃদুকণ্ঠে ডাকেন, কিরীটীবাবু!
উঁ?
কী মনে হল আপনার?