৩১
[বলরাম বাবুকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
গোরাবাজার, গাজীপুর
১৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার আপসোস-পত্র পাইয়াছি। আমি শীঘ্র এ স্থান পরিত্যাগ করিতেছি না, বাবাজীর অনুরোধ এড়াইবার যো নাই।
সাধুদের সেবা করিয়া কি হইল বলিয়া আপসোস করিয়াছেন। কথা ঠিক বটে, অথচ নহে বটে। Ideal bliss-এর (আদর্শ আনন্দ) দিকে চাহিতে গেলে এ কথা সত্য বটে, কিন্তু যে স্থান ছাড়িয়া আসিয়াছেন সে দিকে তাকাইলেই দেখিতে পাইবেন—ছিলেন গরু, হইয়াছেন মানুষ, হইবেন দেবতা এবং ঈশ্বর। পরন্তু ঐ প্রকার ‘কি হইল’, ‘কি হইল’ অতি ভাল—উন্নতির আশাস্বরূপ, নহিলে কেহ উঠিতে পারে না। ‘পাগড়ি বেঁধেই ভগবান্’ যে দেখে, তাহার ঐখানেই খতম। আপনার সর্বদাই যে মনে পড়ে ‘কি হইল’, আপনি ধন্য নিশ্চিত জানিবেন—আপনার মার নাই।
গিরিশবাবুর সহিত মাতাঠাকুরাণীকে আনিবার জন্য আপনার কি মতান্তর হইয়াছে, গিরিশবাবু লিখিয়াছেন—সে বিষয়ে আমার বলিবার কিছুই নাই। তবে আপনি অতি বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি, কার্যসিদ্ধির প্রধান উপায় যে ধৈর্য—এ আপনি ঠিক বুঝেন, সে বিষয়ে চপলমতি আমরা আপনার নিকট বহু শিক্ষার উপযুক্ত, সন্দেহ নাই। কাশীতে আমি—যোগীন-মাতার ঘাড় না ভাঙা যায় এবিষয়ে একদিন বাদানুবাদচ্ছলে কহিয়াছিলাম। তৎসওয়ায় আর আমি কোন খবর জানি না এবং জানিতে ইচ্ছাও রাখি না। মাতাঠাকুরাণীর যে প্রকার ইচ্ছা হইবে, সেই প্রকারই করিবেন। আমি কোন্ নরাধম, তাঁহার সম্বন্ধে কোন বিষয়ে কথা কহি? যোগীন-মাতাকে যে বারণ করিয়াছিলাম, তাহা যদি দোষের হইয়া থাকে, তজ্জন্য লক্ষ লক্ষ ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। আপনি সদ্বিবেচক—আপনাকে কি বলিব? কান দুটো, কিন্তু মুখ একটা; বিশেষতঃ আপনার মুখ বড় কড়া এবং ফস ফস করিয়া large promises (বেশী বেশী অঙ্গীকার-বাক্য) বাহির হয় না বলিয়া আপনার উপর অনেক সময় বিরক্ত হই, কিন্তু বিচার করিয়া দেখি যে, আপনিই সদ্বিবেচনার কার্য করেন।—’Slow but sure’ (ধীর, কিন্তু নিশ্চিত)।
What is lost in power, is gained in speed (শক্তি যে পরিমাণ ব্যয়িত হয়, গতিবৃদ্ধিতে তাহা পোষাইয়া যায়), যাহাই হউক, সংসারে কথা লইয়াই কাজ। কথার ছাল ছাড়াইয়া (তাতে আপনার কৃপণতার আবরণ—এত ছাড়াইয়া) অন্তর্দৃষ্টি সকলের হয় না এবং বহু সঙ্গ না করিলে কোন ব্যক্তিকে বুঝা যায় না। ইহা মনে করিয়া এবং শ্রীশ্রীগুরুদেব এবং মাতাঠাকুরাণীকে স্মরণ করিয়া—নিরঞ্জন যদি আপনাকে কিছু কটুকাটব্য বলিয়া থাকে ক্ষমা করিবেন। ‘ধর্ম—দলে নহে, হুজুগে নহে’, ৺গুরুদেবের এই সকল উপদেশ ভুলিয়া যান কেন? আপনার যা করিবার সাধ্য করুন, কিন্তু তাহার কি ব্যবহার হইল, কি না হইল, ভাল মন্দ বিচার করার অধিকার আমাদের বোধ হয় নাই। … গিরিশবাবু যে আঘাত পাইয়াছেন, তাহাতে এ সময়ে মাতাঠাকুরাণীর সেবায় তাঁহার বিশেষ শান্তিলাভ হইবে। তিনি অতি তীক্ষ্ণবুদ্ধি, তাঁহার সম্বন্ধে আমি কি বিচার করিব! আর ৺গুরুদেব আপনার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন। আপনার বাটী ভিন্ন কোথাও অন্নাদি গ্রহণ করিতেন না এবং শুনিয়াছি, মাতাঠাকুরাণীও আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন—এই সকল মনে করিয়া আমাদের ন্যায় চপলমতি বালকদিগের (নিজ পুত্রের কৃত অপরাধের ন্যায়) সকল অপরাধ সহ্য ও ক্ষমা করিবেন—অধিক কি লিখিব।
জন্মোৎসব কবে হইবে পত্রপাঠ লিখিবেন। আমার কোমরে একটা বেদনায় বড় অসুস্থ করিয়াছে। আর দিনকয়েক বাদে এ স্থানে বড় শোভা হইবে—ক্রোশ-ক্রোশব্যাপী গোলাপফুলের মাঠে ফুল ফুটিবে। সেই সময়ে সতীশ কতকগুলো তাজাফুল ও ডাল মহোৎসব উপলক্ষে পাঠাইবে বলিতেছে। যোগেন কোথায়, কেমন আছে? বাবুরাম কেমন আছে? সারদা কি এখন তেমনি চঞ্চলচিত্ত? গুপ্ত কি করিতেছে? তারক-দাদা, গোপাল-দাদা প্রভৃতিকে আমার প্রণাম। মাষ্টারের ভাইপো কতদূর পড়িল? রাম ও ফকির ও কৃষ্ণময়ীকে আমার আশীর্বাদাদি দিবেন। তাহারা পড়াশুনা কেমন করিতেছে? ভগবান্ করুন, আপনার ছেলে যেন ‘মানুষ’ হয়—না-মরদ না হয়। তুলসীবাবুকে আমার লক্ষ লক্ষ সাদর সম্ভাষণ দিবেন এবং এবারে একলা সাণ্ডেলও নিজের খাটনি খাটিতে পারিবে কিনা? চুনীবাবু কেমন আছেন?
বলরামবাবু, মাতাঠাকুরাণী যদি আসিয়া থাকেন, আমার কোটি কোটি প্রণাম দিবেন ও আশীর্বাদ করিতে বলিবেন—যেন আমার অটল অধ্যবসায় হয়, কিম্বা এ শরীরে যদি তাহা অসম্ভব, যেন শীঘ্রই ইহার পতন হয়।
(পরের পত্রখানি) গুপ্তকে দেখাইবেন।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৩২
[স্বামী সদানন্দকে লিখিত]
১৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
কল্যাণবরেষু,
বোধ করি শারীরিক কুশলে আছ। আপনার জপতপ সাধন ভজন করিবে ও আপনাকে দাসানুদাস জানিয়া সকলের সেবা করিবে। তুমি যাঁহাদের কাছে আছ, আমিও তাঁহাদের দাসানুদাস ও চরণরেণুর যোগ্য নহি—এই জানিয়া তাঁহাদের সেবা ও ভক্তি করিবে। ইঁহারা গালি দিলে বা খুন করিলেও ক্রুদ্ধ হইও না। কোন স্ত্রীসঙ্গে যাইও না—hardy (কষ্টসহিষ্ণু) হইবার অল্প অল্প চেষ্টা করিবে এবং সইয়ে সইয়ে ক্রমে ভিক্ষা দ্বারা শরীর ধারণ করিবার চেষ্টা করিবে। যে কেহ রামকৃষ্ণের দোহাই দেয়, সেই তোমার গুরু জানিবে। কর্তাত্ব সকলেই পারে—দাস হওয়া বড় শক্ত। বিশেষতঃ তুমি শশীর কথা শুনিবে। গুরুনিষ্ঠা, অটল ধৈর্য ও অধ্যবসায় ব্যতিরিক্ত কিছুই হইবে না—নিশ্চিত, নিশ্চিত জানিবে। Strict morality (কঠোর নীতিপরায়ণতা) চাহি—একটুকু এদিক ওদিক হইলে সর্বনাশ। ইতি
নরেন্দ্রনাথ
৩৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
১৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
গঙ্গাধর ভায়াকে আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে নিষেধ করিয়া ও কোন স্থানে বসিয়া যাইতে পরামর্শ দিয়া এবং তিব্বতে কি কি সাধু দেখিয়াছেন এবং তাঁহাদের আচার-ব্যবহার কি প্রকার, সবিশেষ লিখিতে এক পত্র লিখিয়াছিলাম। তদুত্তরে তিনি যে পত্র লিখিয়াছেন, তাহা অত্র পত্রের সহিত আপনার নিকট পাঠাইতেছি। কালী (অভেদানন্দ) ভায়ার হৃষীকেশে পুনঃপুনঃ জ্বর হইতেছে, তাঁহাকে এ স্থান হইতে এক টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছি; উত্তরে যদি আমার যাওয়ার আবশ্যক তিনি বিবেচনা করেন, এ স্থান হইতে একেবারেই হৃষীকেশে যাইতে বাধ্য হইব, নতুবা দুই-এক দিনের মধ্যেই ভবৎসকাশে উপস্থিত হইতেছি। মহাশয় হয়তো এই মায়ার প্রপঞ্চ দেখিয়া হাসিবেন—কথাও তাই বটে। তবে কি না লোহার শিকল ও সোনার শিকল—সোনার শিকলের অনেক উপকার আছে, তাহা [সেই উপকার] হইয়া গেলে আপনা-আপনি খসিয়া যাইবে। আমার গুরুদেবের পুত্রগণ আমার অতি সেবার পাত্র—এই স্থানেই একটু duty (কর্তব্য)-বোধ আছে। সম্ভবতঃ কালীভায়াকে এলাহাবাদে অথবা যে স্থানে সুবিধা হয়, পাঠাইয়া দিব। আপনার চরণে আমার শত শত অপরাধ রহিল, পুত্রস্তেঽহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ (আমি আপনার পুত্র, শরণাগত, আমায় শাসন করুন, শিক্ষা দিন)। কিমধিকমিতি
দাস
নরেন্দ্র
৩৪
[স্বামী অখণ্ডানন্দ বা ‘গঙ্গাধর’কে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
ফেব্রুআরী, ১৮৯০
প্রাণাধিকেষু,
তোমার পত্র পাইয়া অতি প্রীত হইলাম। তিব্বত সম্বন্ধে যে কথা লিখিয়াছ, তাহা অতি আশাজনক, আমি সে স্থানে যাইবার একবার চেষ্টা করিব, সংস্কৃতে তিব্বতকে ‘উত্তরকুরুবর্ষ’ কহে—উহা ম্লেচ্ছভূমি নহে। পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উচ্চ ভূমি—এজন্য শীত অত্যন্ত, কিন্তু ক্রমে ক্রমে সহিয়া যাইতে পারে। তিব্বতী লোকদিগের আচার-ব্যবহার তুমি তো কিছুই লিখ নাই; যদি এত আতিথেয়, তবে কেন তোমাকে যাইতে দিল না? সবিশেষ লিখিবে—সকল কথা খুলিয়া একখান বৃহৎ পত্রে। তুমি আসিতে পারিবে না জানিয়া দুঃখিত হইলাম। তোমাকে দেখিবার বড় ইচ্ছা ছিল। তোমাকে সমধিক ভালবাসি বলিয়া বোধ হয়। যাহাই হউক, এ মায়াও আমি কাটাইবার চেষ্টা করিব।
তিব্বতীদের যে তন্ত্রাচারের কথা কহিয়াছ, তাহা বৌদ্ধধর্মের শেষ দশায় ভারতবর্ষেই হইয়াছিল। আমার বিশ্বাস যে, আমাদিগের যে সকল তন্ত্র প্রচলিত আছে, বৌদ্ধেরাই তাহার আদিম স্রষ্টা। ঐ সকল তন্ত্র আমাদিগের বামাচারবাদ হইতে আরও ভয়ঙ্কর (উহাতে ব্যভিচার অতি মাত্রায় প্রশ্রয় পাইয়াছিল), এবং ঐ প্রকার immorality (চরিত্রহীনতা) দ্বারা যখন (বৌদ্ধগণ) নির্বীর্য হইল, তখনই [তাহারা] কুমারিল ভট্ট দ্বারা দূরীকৃত হইয়াছিল। যে প্রকার সন্ন্যাসীরা শঙ্করকে ও বাউলরা মহাপ্রভুকে secret (গোপনে) স্ত্রীসম্ভোগী, সুরাপায়ী ও নানাপ্রকার জঘন্য আচরণকারী বলে, সেই প্রকার modern (আধুনিক) তান্ত্রিক বৌদ্ধেরা বুদ্ধদেবকে ঘোর বামাচারী বলে এবং ‘প্রজ্ঞাপারমিতো’ক্ত তত্ত্বগাথা প্রভৃতি সুন্দর সুন্দর বাক্যকে কুৎসিত ব্যাখ্যা করে; ফল এই হইয়াছে যে, এক্ষণে বৌদ্ধদের দুই সম্প্রদায়; বর্মা ও সিংহলের লোক প্রায় তন্ত্র মানে না ও সেই সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুর দেবদেবীও দূর করিয়াছে, এবং উত্তরাঞ্চলের বৌদ্ধেরা যে ‘অমিতাভ বুদ্ধম্’ মানে, তাঁহাকেও ঢাকীসুদ্ধ বিসর্জন দিয়াছে। ফল কথা এই, উত্তরের লোকেরা যে ‘অমিতাভ বুদ্ধম্’ ইত্যাদি মানে, তাহা ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’দিতে নাই, কিন্তু দেবদেবী অনেক মানা আছে। আর দক্ষিণীরা জোর করিয়া শাস্ত্র লঙ্ঘন করিয়া দেবদেবী বিসর্জন করিয়াছে। যে everything for others (‘যাহা কিছু সব পরের জন্য’—এই মত) তিব্বতে বিস্তৃত দেখিতেছ, ঐ phase of Buddhism (বৌদ্ধর্মের ঐ ভাব) আজকাল ইওরোপকে বড় strike করিয়াছে (ইওরোপের বড় মনে লাগিয়াছে)। যাহা হউক, ঐ phase (ভাব) সম্বন্ধে আমার বলিবার অনেক আছে, এ পত্রে তাহা হইবার নহে। যে ধর্ম উপনিষদে জাতিবিশেষে বদ্ধ হইয়াছিল, বুদ্ধদেব তাহারই দ্বার ভাঙিয়া সরল কথায় চলিত ভাষায় খুব ছড়াইয়াছিলেন। নির্বাণে তাঁহার মহত্ত্ব বিশেষ কি? তাঁহার মহত্ত্ব in this unrivalled sympathy (তাঁহার অতুলনীয় সহানুভূতিতে)। তাঁহার ধর্মে যে সকল উচ্চ অঙ্গের সমাধি প্রভৃতির গুরুত্ব, তাহা প্রায় সমস্তই বেদে আছে; নাই তাঁহার intellect (বুদ্ধি) এবং heart (হৃদয়), যাহা জগতে আর হইল না।
বেদের যে কর্মবাদ, তাহা jew (য়াহুদী) প্রভৃতি সকল ধর্মের কর্মবাদ, অর্থাৎ যজ্ঞ ইত্যাদি বাহ্যোপকরণ দ্বারা অন্তর শুদ্ধি করা—এ পৃথিবীতে বুদ্ধদেব the first man (প্রথম ব্যক্তি), যিনি ইহার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয়েন। কিন্তু ভাব ঢঙ সব পুরাতনের মত রহিল, সেই তাঁহার অন্তঃকর্মবাদ—সেই তাঁহার বেদের পরিবর্তে সূত্রে বিশ্বাস করিতে হুকুম। সেই জাতিও ছিল, তবে গুণগত হইল (বুদ্ধের সময় জাতিভেদ যায় নাই), সেই যাহারা তাঁহার ধর্ম মানে না, তাহাদিগকে ‘পাষণ্ড’ বলা। ‘পাষণ্ড’টা বৌদ্ধদের বড় পুরানো বোল, তবে কখনও বেচারীরা তলওয়ার চালায় নাই, এবং বড় toleration (উদারভাব) ছিল। তর্কের দ্বারা বেদ উড়িল, কিন্তু তোমার ধর্মের প্রমাণ?—বিশ্বাস কর!!—যেমন সকল ধর্মের আছে, তাহাই। তবে সেই কালের জন্য বড় আবশ্যক ছিল এবং সেই জন্যই তিনি অবতার হন। তাঁহার মায়াবাদ কপিলের মত। কিন্তু শঙ্করের how far more grand and rational (কত মহত্তর এবং অধিকতর যুক্তিপূর্ণ)! বুদ্ধ ও কপিল কেবল বলেন—জগতে দুঃখ দুঃখ, পালাও পালাও। সুখ কি একেবারেই নাই? যেমন ব্রাহ্মরা বলেন, সব সুখ—এও সেই প্রকার কথা। দুঃখ, তা কি করিব? কেহ যদি বলে যে সহিতে সহিতে অভ্যাস হইলে দুঃখকেই সুখ বোধ হইবে? শঙ্কর এ দিক্ দিয়ে যান না—তিনি বলেন, ‘সন্নাপি অসন্নাপি, ভিন্নাপি অভিন্নাপি’—আছে অথচ নেই, ভিন্ন অথচ অভিন্ন এই যে জগৎ, এর তথ্য আমি জানিব—দুঃখ আছে কি কী আছে; জুজুর ভয়ে আমি পালাই না। আমি জানিব, জানিতে গেলে যে অনন্ত দুঃখ তা তো প্রাণভরে গ্রহণ করিতেছি; আমি কি পশু যে ইন্দ্রিয়জনিত সুখদুঃখ-জরামরণ-ভয় দেখাও? আমি জানিব—জানিবার জন্য জান দিব। এ জগতে জানিবার কিছুই নাই, অতএব যদি এই relative-এর (মায়িক জগতের) পার কিছু থাকে—যাকে শ্রীবুদ্ধ ‘প্রজ্ঞাপারম্’ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন—যদি থাকে, তাহাই চাই। তাহাতে দুঃখ আসে বা সুখ আসে I do not care (আমি গ্রাহ্য করি না)। কি উচ্চভাব! কি মহান্ ভাব! উপনিষদের উপর বুদ্ধের ধর্ম উঠেছে, তার উপর শঙ্করবাদ। কেবল শঙ্কর বুদ্ধের আশ্চর্য heart (হৃদয়) অণুমাত্র পান নাই; কেবল dry intellect (শুষ্ক জ্ঞানবিচার)—তন্ত্রের ভয়ে, mob-এর (ইতরলোকের) ভয়ে ফোড়া সারাতে গিয়ে হাতসুদ্ধ কেটে ফেললেন, এ সকল সম্বন্ধে গেলে পুঁথি লিখতে হয়; আমার তত বিদ্যা ও আবশ্যক—দুইয়েরই অভাব।
বুদ্ধদেব আমার ইষ্ট, আমার ঈশ্বর। তাঁহার ঈশ্বরবাদ নাই—তিনি নিজে ঈশ্বর, আমি খুব বিশ্বাস করি। কিন্তু ‘ইতি’ করিবার শক্তি কাহারও নাই। ঈশ্বরেরও আপনাকে limited (সীমাবদ্ধ) করিবার শক্তি নাই। তুমি যে ‘সূত্তনিপাত’ হইতে গণ্ডারসূত্ত তর্জমা লিখিয়াছ, তাহা অতি উত্তম। ঐ গ্রন্থে ঐ প্রকার আর একটি ধনীর সূত্ত আছে, তাহাতেও প্রায় ঐ ভাব। ‘ধম্মপদ’-মতেও ঐ প্রকার অনেক কথা আছে। কিন্তু সেও শেষে যখন ‘জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ’১৭—যাহার শরীরের উপর অণুমাত্র শারীর বোধ নাই, তিনি মদমত্ত হস্তীর ন্যায় ইতস্ততঃ বিচরণ করিবেন। আমার ন্যায় ক্ষুদ্র প্রাণী এক জায়গায় বসিয়া সাধন করিয়া সিদ্ধ হইলে তখন ঐ প্রকার আচরণ করিবে—সে দূর—বড় দূর।
চিন্তাশূন্যমদৈন্যভৈক্ষ্যমশনং পানং সরিদ্বারিষু
স্বাতন্ত্র্যেণ নিরঙ্কুশা স্থিতিরভীর্নিদ্রা শ্মশানে বনে।
বস্ত্রং ক্ষালনশোষণাদিরহিতং দিগ্বাস্তু শয্যা মহী
সঞ্চারো নিগমান্তবীথিষু বিদাং ক্রীড়া পরে ব্রহ্মণি॥
বিমানমালম্ব্য শরীরমেতদ্
ভুনক্ত্যশেষান্ বিষয়ানুপস্থিতান্।
পরেচ্ছয়া বালবদাত্মবেত্তা
যোঽব্যক্তলিঙ্গোঽননুষক্তবাহ্যঃ॥
দিগম্বরো বাপি চ সাম্বরো বা
ত্বগম্বরো বাপি চিদম্বরস্থঃ।
উন্মত্তবদ্বাপি চ বালবদ্বা
পিশাচবদ্বাপি চরত্যবন্যাম্॥১৮
ব্রহ্মজ্ঞের ভোজন, চেষ্টা বিনা উপস্থিত হয়—যেথায় জল, তাহাই পান। আপন ইচ্ছায় ইতস্ততঃ তিনি পরিভ্রমণ করিতেছেন—তিনি ভয়শূন্য, কখনও বনে, কখনও শ্মশানে নিদ্রা যাইতেছেন; যেখানে বেদ শেষ হইয়াছে, সেই বেদান্তের পথে সঞ্চরণ করিতেছেন। আকাশের ন্যায় তাঁহার শরীর, বালকের ন্যায় পরের ইচ্ছাতে পরিচালিত; তিনি কখনও উলঙ্গ, কখনও উত্তমবস্ত্রধারী, কখনও জ্ঞানমাত্রই আচ্ছাদন, কখনও বালকবৎ, কখনও উন্মত্তবৎ, কখনও পিশাচবৎ ব্যবহার করিতেছেন।
গুরুচরণে প্রার্থানা করি যে তোমার তাহাই হউক এবং তুমি গণ্ডারবৎ ভ্রমণ কর। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৫
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
Lumbago (কোমরের বাতে) বড় ভোগাইতেছে, নহিলে ইতিপূর্বেই যাইবার চেষ্টা দেখিতাম। এস্থানে আর মন তিষ্ঠিতেছে না। তিন দিন বাবাজীর স্থান হইতে আসিয়াছি, কিন্তু তিনি দয়া করিয়া প্রায় প্রত্যহই আমার খবর লয়েন। কোমর একটু সারিলেই বাবাজীর নিকট বিদায় লইয়া যাইতেছি। আমার অসংখ্য প্রণাম জানিবেন। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৩৬
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
মার্চ, ১৮৯০
প্রাণাধিকেষু,
কল্য তোমার পত্র পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছি। এখানে পওহারীজী নামক যে অদ্ভুত যোগী ও ভক্ত আছেন, এক্ষণে তাঁহারই কাছে রহিয়াছি। ইনি ঘরের বাহির হন না—দ্বারের আড়াল হইতে কথাবার্তা কহেন। ঘরের মধ্যে এক গর্ত আছে, তন্মধ্যে বাস করেন। শুনিতে পাই, ইনি মাস মাস সমাধিস্থ হইয়া থাকেন। ইঁহার তিতিক্ষা বড়ই অদ্ভুত। আমাদের বাঙলা ভক্তির দেশ ও জ্ঞানের দেশ, যোগের বার্তা একেবারে নাই বলিলেই হয়। যাহা কিছু আছে, তাহা কেবল বদখত দমটানা ইত্যাদি হঠযোগ—তা তো gymnastics (কসরত)। এইজন্য এই অদ্ভুত রাজযোগীর নিকট রহিয়াছি—ইনি কতক আশাও দিয়াছেন। এখানে একটি বাবুর একটি ছোট্ট বাগানে একটি সুন্দর বাংলা-ঘর আছে; ঐ ঘরে থাকিব এবং উক্ত বাগান বাবাজীর কুটীরের অতি নিকট। বাবাজীর একজন দাদা ঐখানে সাধুদের সৎকারের জন্য থাকে, সেই স্থানেই ভিক্ষা করিব। অতএব এ রঙ্গ কতদূর গড়ায়, দেখিবার জন্য এক্ষণে পর্বতারোহণ-সংকল্প ত্যাগ করিলাম। এবং কোমরে দুমাস ধরিয়া একটা বেদনা—বাত (lumbago)—হইয়াছে, তাহাতেও পাহাড়ে উঠা এক্ষণে অসম্ভব। অতএব বাবাজী কি দেন, পড়িয়া পড়িয়া দেখা যাউক।
আমার motto (মূলমন্ত্র) এই যে, যেখানে যাহা কিছু উত্তম পাই, তাহাই শিক্ষা করিব। ইহাতে বরাহনগরের অনেকে মনে করে যে, গুরুভক্তির লাঘব হইবে। আমি ঐ কথা পাগল এবং গোঁড়ার কথা বলিয়া মনে করি। কারণ, সকল গুরুই এক এবং জগদ্গুরুর অংশ ও আভাসস্বরূপ।
তুমি যদি গাজীপুরে আইস, গোরাবাজারের সতীশবাবু অথবা গগনবাবুর নিকট আসিলেই আমার সন্ধান পাইবে। অথবা পওহারী বাবা এত প্রসিদ্ধ ব্যক্তি যে, ইঁহার নামমাত্রেই সকলে বলিবে, এবং তাঁহার আশ্রমে যাইয়া পরমহংসজীর খোঁজ করিলেই সকলে বলিয়া দিবে। মোগলসরাই ছাড়াইয়া দিলদারনগর ষ্টেশনে নামিয়া Branch Railway (শাখা রেল) একটু আছে; তাহাতে তারিঘাট—গাজীপুরের আড়পারে নামিয়া গঙ্গা পার হইয়া আসিতে হয়।
এক্ষণে আমি গাজীপুরে কিছুদিন রহিলাম; দেখি বাবাজী কি করেন। তুমি যদি আইস, দুইজনে উক্ত কুটীরে কিছুদিন থাকিয়া পরে পাহাড়ে বা যেথায় হয়, যাওয়া যাইবে। আমি গাজীপুরে আছি, একথা বরাহনগরে কাহাকেও লিখিও না। আমার আশীর্বাদ জানিবে।
সতত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী
নরেন্দ্র
৩৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৩ মার্চ, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র এইমাত্র পাইলাম। আপনি জানেন না—কঠোর বৈদান্তিক মত সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত নরম প্রকৃতির লোক। উহাই আমার সর্বনাশ করিতেছে। একটুকুতেই এলাইয়া যাই, কত চেষ্টা করি যে, খালি আপনার ভাবনা ভাবি। কিন্তু বারংবার পরের ভাবনা ভাবিয়া ফেলি। এবার বড় কঠোর হইয়া নিজের চেষ্টার জন্য বাহির হইয়াছিলাম—এলাহাবাদে এক ভ্রাতার পীড়ার সংবাদ পাইয়া অমনি ছুটিতে হইল। আবার এই হৃষীকেশের খবর—মন ছুটিয়াছে। শরৎকে এক টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছি, আজিও উত্তর আইসে নাই—এমন স্থান, টেলিগ্রাম আসিতেও এত দেরী! কোমরের বেদনা কিছুতেই ছাড়িতে চায় না, বড় যন্ত্রণা হইতেছে। পওহারীজীর সঙ্গে আর দেখা করিতে কয়েক দিন যাইতে পারি নাই, কিন্তু তাঁহার বড় দয়া, প্রত্যহ লোক পাঠাইয়া খবর নেন। কিন্তু এখন দেখিতেছি ‘উল্টা সমঝ্লি রাম!’—কোথায় আমি তাঁহার দ্বারে ভিখারী, তিনি আমার কাছে শিখিতে চাহেন! বোধ হয়—ইনি এখনও পূর্ণ হয়েন নাই, কর্ম এবং ব্রত এবং আচার অত্যন্ত, এবং বড় গুপ্তভাব। সমুদ্র পূর্ণ হইলে কখনও বেলাবদ্ধ থাকিতে পারে না, নিশ্চিত। অতএব অনর্থক ইঁহাকে উদ্বেজিত করা ঠিক নহে স্থির করিয়াছি; এবং বিদায় লইয়া শীঘ্রই প্রস্থান করিব। কি করি, বিধাতা নরম করিয়া যে কাল করিয়াছেন! বাবাজী ছাড়েন না, আবার গগনবাবু (ইঁহাকে আপনি বোধ হয় জানেন, অতি ধার্মিক, সাধু এবং সহৃদয় ব্যক্তি) ছাড়েন না। টেলিগ্রামে যদ্যপি আমার যাইবার আবশ্যক হয়, যাইব; যদ্যপি না হয়, দুই-চারি দিনে কাশীধামে ভবৎসকাশে উপস্থিত হইতেছি। আপনাকে ছাড়িতেছি না—হৃষীকেশে লইয়া যাইবই, কোন ওজর আপত্তি চলিবে না। শৌচের কথা কি বলিতেছেন? পাহাড়ে জলের অভাব—স্থানের অভাব? তীর্থ এবং সন্ন্যাসী—কলিকালের? টাকা খরচ করিলে সত্রওয়ালারা ঠাকুর ফেলিয়া দিয়া ঘর ছাড়িয়া দেয়, স্থানের কা কথা!! কোন গোল নাই, এতদিনে গরম আরম্ভ হইয়াছে, তবে কাশীর গরম হইবে না—সে তো ভালই। রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা চিরকাল, তাহাতে নিদ্রা উত্তমরূপ হইবারই কথা।
আপনি অত ভয় পান কেন? আমি guarantee (দায়ী), আপনি নিরাপদে ঘরে ফিরিবেন এবং কোন কষ্ট হইবে না। ব্রিটিশ রাজ্যে কষ্ট ফকিরের, গৃহস্থের কোন কষ্ট নাই, ইহা আমার experience (অভিজ্ঞতা)।
সাধ করে বলি—আপনার সঙ্গে পূর্বের সম্বন্ধ? এক চিঠিতে আমার সকল resolution (সংকল্প) ভেসে গেল, আবার সব ফেলে গুটি গুটি কাশী চলিলাম। ইতি
গঙ্গাধর ভায়াকে ফের এক চিঠি লিখিয়াছি, এবার তাঁহাকে মঠে যাইতে বলিয়াছি। যদি যান, অবশ্যই কাশী হইয়া যাইবেন ও আপনার সহিত দেখা হইবে। আজকাল কাশীর স্বাস্থ্য কেমন? এ স্থানে থাকিয়া আমার ম্যালেরিয়া সম্বন্ধে সকল (উপসর্গ) সারিয়াছে, কেবল কোমরের বেদনায় অস্থির, দিন রাত কনকন করে এবং জ্বালাতন করিতেছে—কেমন করিয়া বা পাহাড়ে উঠিব, ভাবিতেছি। বাবাজীর তিতিক্ষা অদ্ভুত, তাই কিছু ভিক্ষা করিতেছি, কিন্তু উপুড় হস্তের নামটি নাই, খালি গ্রহণ! খালি গ্রহণ! অতএব আমিও প্রস্থান।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
পুঃ—আর কোন মিঞার কাছে যাইব না—
‘আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারু ঘরে,
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।
পরম ধন এই পরশমণি, যা চাবি তাই দিতে পারে,
এমন কত মণি পড়ে আছে চিন্তামণির নাচদুয়ারে।’
এখন সিদ্ধান্ত এই যে—রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই, সে অপূর্ব সিদ্ধি, আর সে অপূর্ব অহেতুকী দয়া, সে intense sympathy (প্রগাঢ় সহানুভূতি) বদ্ধ-জীবনের জন্য—এ জগতে আর নাই। হয়, তিনি অবতার—যেমন তিনি নিজে বলিতেন, অথবা বেদান্তদর্শনে যাহাকে নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষ ‘লোকহিতায় মুক্তোঽপি শরীরগ্রহণকারী’ বলা হইয়াছে, নিশ্চিত নিশ্চিত ইতি মে মতিঃ, এবং তাঁহার উপাসনাই পাতঞ্জলোক্ত ‘মহাপুরুষ-প্রণিধানাদ্বা।’১৯
তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি কখনও আমার প্রার্থনা গরমঞ্জুর করেন নাই—আমার লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিয়াছেন—এত ভালবাসা আমার পিতামাতায় কখনও বাসেন নাই। ইহা কবিত্ব নহে, অতিরঞ্জিত নহে, ইহা কঠোর সত্য এবং তাঁহার শিষ্যমাত্রেই জানে। বিপদে, প্রলোভনে ‘ভগবান্ রক্ষা কর’ বলিয়া কাঁদিয়া সারা হইয়াছি—কেহই উত্তর দেয় নাই—কিন্তু এই অদ্ভুত মহাপুরুষ বা অবতার বা যাই হউন, নিজ অন্তর্যামিত্বগুণে আমার সকল বেদনা জানিয়া নিজে ডাকিয়া জোর করিয়া সকল অপহৃত করিয়াছেন। যদি আত্মা অবিনাশী হয়—যদি এখনও তিনি থাকেন, আমি বারংবার প্রার্থনা করি—হে অপারদয়ানিধে, হে মমৈকশরণদাতা রামকৃষ্ণ ভগবান্, কৃপা করিয়া আমার এই নরশ্রেষ্ঠ বন্ধুবরের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর। আপনার সকল মঙ্গল—এ জগতে কেবল যাঁহাকে অহেতুকদয়াসিন্ধু দেখিয়াছি—তিনিই করুন। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
দাস নরেন্দ্র
পুনঃ—পত্রপাঠ উত্তর দিবেন। নরেন্দ্র
৩৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৮ মার্চ, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র পাইলাম, অতএব আমিও প্রয়াগ যাইতেছি। আপনি প্রয়াগে কোথায় থাকিবেন, অনুগ্রহ করিয়া লিখিবেন। ইতি
দাস
নরেন্দ্র
পুঃ—দুই-এক দিনের মধ্যে অভেদানন্দ যদ্যপি আইসেন, তাঁহাকে কলিকাতায় রওনা করিয়া দিলে অত্যন্ত অনুগৃহীত হইব।
নরেন্দ্র
৩৯
নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
১১ মার্চ, ১৮৯০
বলরামবাবু,
Receipt (রসিদ) পাইবামাত্র লোক পাঠাইয়া Fairlie Place (ফেয়ার্লি প্লেস) রেলওয়ে গুদাম হইতে গোলাপ ফুল আনাইয়া শশীকে পাঠাইয়া দিবেন। আনাইতে বা পাঠাইতে বিলম্ব না হয়।
বাবুরাম Allahabad (এলাহাবাদ) যাইতেছে শীঘ্র—আমি আর এক জায়গায় চলিলাম।
নরেন্দ্র
P.S. দেরী হলে সব খারাপ হইয়া যাইবে—নিশ্চিত জানিবেন।
নরেন্দ্র
৪০
[বলরামবাবুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
গাজীপুর
১৫ মার্চ, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র কল্য পাইয়াছি। সুরেশবাবুর পীড়া অত্যন্ত কঠিন শুনিয়া অতি দুঃখিত হইলাম। অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহাই হইবে। আপনারও পীড়া হইয়াছে, দুঃখের বিষয়। ‘অহং’-বুদ্ধি যতদিন থাকে, ততদিন চেষ্টার ত্রুটি হইলে তাহাকে আলস্য এবং দোষ এবং অপরাধ বলা যায়। যাঁহার উক্ত বুদ্ধি নাই, তাঁহার সম্বন্ধে তিতিক্ষাই ভাল। জীবাত্মার বাসভূমি এই শরীর কর্মের সাধনস্বরূপ—ইহাকে যিনি নরককুণ্ড করেন, তিনি অপরাধী এবং যিনি অযত্ন করেন, তিনিও দোষী। যেমন সামনে আসিবে, খুঁত খুঁত কিছু মাত্র না করিয়া তেমনই করিয়া যাউন।
‘নাভিনন্দেত মরণং নাভিনন্দেত জীবিতম্।
কালমেব প্রতীক্ষেত নিদেশং ভূতকো যথা॥’
যেটুকু সাধ্য সেটুকু করা, মরণও ইচ্ছা না করিয়া এবং জীবনও ইচ্ছা না করিয়া—ভৃত্যের ন্যায় আজ্ঞা প্রতীক্ষা করিয়া থাকাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
কাশীতে অত্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা হইতেছে—প্রমদাবাবু প্রয়োগে গিয়াছেন। বাবুরাম হঠাৎ এ স্থানে আসিয়াছে, তাহার জ্বর হইয়াছে—এমন অবস্থায় বাহির হওয়া ভাল হয় নাই। কালীকে২০ ১০৲ টাকা পাঠানো গিয়াছে—সে বোধ হয় গাজীপুর হইয়া কলিকাতাভিমুখে যাইবে। আমি কল্য এস্থান হইতে চলিলাম। কালী আসিয়া আপনাদের পত্র লিখিলে যাহা হয় করিবেন। আমি লম্বা। আর পত্র লিখিবেন না, কারণ আমি এস্থান হইতে চলিলাম। বাবুরাম ভাল হইয়া যাহা ইচ্ছা করিবেন।
ফুল—বোধ হয় রিসিট (রসিদ) প্রাপ্তিমাত্রই আনাইয়া লইয়াছেন। মাতাঠাকুরাণীকে আমার অসংখ্য প্রণাম।
আপনারা আশীর্বাদ করুন যেন আমার সমদৃষ্টি হয়—সহজাত বন্ধন ছাড়াইয়া পাতানো বাঁধনে আবার যেন না ফাঁসি। যদি কেহ মঙ্গলকর্তা থাকেন এবং যদি তাঁহার সাধ্য এবং সুবিধা হয়, আপনাদের পরম মঙ্গল হউক—ইহাই আমার দিবারাত্র প্রার্থনা। কিমধিকমিতি—
দাস
নরেন্দ্র