নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেড মাস্টার হাফিজুল কবির সাহেব একটা ছোট্ট সমস্যা নিয়ে বিব্রত। সমস্যাটির বয়স সাত মাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সমস্যাই খানিকটা পাতলা হয়। তারটা হচ্ছে না। বরং খানিকটা জোরাল হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা এ রকম–ফুড ফর ওয়ার্ক প্রোগ্রামে গত মাসে নীলগঞ্জ হাই স্কুলকে পঞ্চাশ বস্তা গম দেয়া হয়েছিল। তিনি মবিনুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে গম আনতে গেলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, একটা সমস্যা হয়েছে হেড মাস্টার সাহেব।
তিনি বললেন, কী সমস্যা?
পঞ্চাশ বস্তা গম তো আপনাকে দিতে পারছি না। দশ বস্তা নিয়ে যান।
দশ বস্তা।
হ্যাঁ, দশ। আর ক্যাশ টাকা দিচ্ছি। পাঁচ হাজার।
হেড মাস্টার সাহেব বললেন, খাতায় সই করতে হবে পঞ্চাশ বস্তা গম?
হ্যাঁ। নানান ফ্যাকরা রে ভাই। সাহায্যের গম বারো ভূতে লুটে খাচ্ছে। সৎভাবে যে কিছু করব তার উপায় নেই। আপনি তো সবই বুঝেন। বুঝেন না?
জি, বুঝব না কেন?
দশ বস্তা গম নিয়ে যান। আর নিতে যদি না চান কোনো অসুবিধা নেই। আমার অন্য প্রোগ্রামে ট্রান্সফার করে দেব। নেবেন, না নেবেন না?
নিব।
আসুন তাহলে খাতায় সই করুন।
হেড মাস্টার সাহেব বিচক্ষণ লোক। নিজে সই করলেন না, মবিনুর রহমানকে সই করতে বললেন। তিন মাস পর উপর থেকে চিঠি এলো–বিশেষ ব্যবস্থায় নীলগঞ্জ হাই স্কুলকে যে একশ বস্তা গম দেওয়া হয়েছিল তা কীভাবে খরচ হয়েছে? উন্নয়নের কোন কোন খাতে অৰ্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা যেন অতি সত্ত্বর জানানো হয়।
হেড মাস্টার সাহেব ছুটে গেলেন উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে। আমতা আমতা করে বললেন, একশ বস্ত, গমের কথা কীভাবে এলো স্যার?
চেয়ারম্যান সাহেব হাই তুলে বললেন, কাগজপত্রে তাই লেখা আছে, আপনি নিজে সই করে নিয়েছেন।
আমি সই করি নি স্যার, মবিনুর রহমান করেছে।
মবিনুর রহমানটা কে?
আমাদের স্কুলের সায়েন্স টিচার।
তাহলে তো আপনি বেঁচেই গেলেন। তদন্ত কমিটি করে দেন। ব্যাটার চাকরি চলে যাক। সব সমস্যার সমাধান। নতুন টিচার নিয়ে নেবেন। বাংলাদেশে সায়েন্স গ্র্যাজুসেটের কোনো অভাব নেই। আমার এক ভাইস্তা আছে বিএসসি পাস করে ঘুরছে, তাকেও নিতে পারেন।
হেড মাস্টার সাহেব মুখ শুকনো করে বসে রইলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব চা এবং কেক খাওয়ালেন। কোনো কিছুই তাঁর মুখে রুচল না।
হেড মাস্টার সাহেব তদন্তু কমিটি তৈরির ব্যাপারটা অনেকদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ডিসট্রিক্ট এড়ুকেশন অফিসার অতি জরুরি সিল মেরে চিঠি পাঠিয়েছেন। আর দেরি করা যায় না। হেড মাস্টার সাহেব জালালুদ্দিন সাহেবকে অফিসে ডেকে পাঠালেন। সরু গলায় বললেন, জালাল সাহেব, আপনাকে তো একটা অপ্রিয় দায়িত্ব পালন করতে হয়। একটা তদন্ত কমিটি হচ্ছে, আপনি তার চেয়ারম্যান, তিনজন মেম্বার। আফজাল সাহেব, সেক্রেটারি সাহেব এবং উপজেলা চেয়ারম্যান। আমাদের মধ্যে আপনি সবচে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং ধর্মপ্ৰাণ ব্যক্তি–সেই হিসেবে আপনি চেয়ারম্যান।
জালাল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কীসের তদন্ত?
হেড মাস্টার সাহেব গলা পরিষ্কার করতে করতে বললেন, কেলেংকারি ব্যাপার হয়েছে। স্পেশাল পারমিশনে নীলগঞ্জ স্কুলকে একশ বস্তা গম দেয়া হয়েছিল। মবিনুর রহমান সইসোবুদ করে গম নিয়েছে। আমাকে বলেছে দশ বস্তা। আমি তো তাই সরল মনে বিশ্বাস করলাম। মবিনকে অবিশ্বাস করার কি কোনো কারণ আছে? আপনি বলেন। যাই হোক দুমাস পর ডিও-র চিঠি পেয়ে আমি তো যাকে বলে থান্ডারষ্ট্রাক, বজ্রাহত।
জালালুদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, মবিন এই কাজ করেছে আমার বিশ্বাস হয় না। যদি আসমান থেকে ফেরেশতা নেমে এসে বলে–মোবিন গম চুরি করেছে। আমি বিশ্বাস করব না।
বিশ্বাস তো আমিও করি না। করি না বলেই তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান করলাম। আপনাকে। আপনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মবিনকে আজই কিছু বলার দরকার নেই…
আমার তো মনে হয় আজই কথা বলা দরকার।
দরকার মনে হলে বলবেন-আপনি হচ্ছেন তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান। আপনি যা ডিসাইড, করবেন তাই হবে। থরো ইনকোয়ারি হবে।
আমি কিছুই বুঝছি না। কিছুই না–এমন একজন ভালো মানুষ!
ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ চট করে চেনা যায় না জালাল সাহেব। চট করে মানুষ চেনা গেলে কি আর দুনিয়ার আজ এই হালত? তবে আপনাকে একটা কথা বলি, গোড়া থেকেই কিন্তু এই লোকটাকে আমার পছন্দ না। তারপর যখন দুমাস আগে নৌকা কিনে ফেলেছে–দুই না তিন হাজার টাকা দাম। নৌকা ঘাটে বাধা থাকে। তখনো মনে খচ করে উঠল।
জালাল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হেড মাস্টার সাহেবের কথা শুনতে তার এখন আর ভালো লাগছে না। টিচার্স কমনরুমে মবিনুর রহমানকে পেলেন না। দীর্ঘদিন পর এই মানুষটা স্কুল কামাই করেছে এবং বেছে বেছে আজকের দিনে। এটা কি পুরোপুরি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার? জালাল সাহেব ক্লাস সিক্সে ধর্ম পড়াতে পড়াতে হঠাৎ বললেন, সুরা বনি ইসরাইলে দুটা চমৎকার বাক্য আছে–মানুষ যেভাবে ভালো চায়, সেভাবেই মন্দ চান। মানুষের বড়ই তাড়াহুড়া। তোমরা এই দুই লাইনের ব্যাখ্যা করা। তোমাদের যা মনে আসে তাই লেখ। আর শোন, কেউ হৈ চৈ করবে না। আমার মন আজ ভালো না। মন। অসম্ভব খারাপ। বলতে বলতে জালাল সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।