ধৃতরাষ্ট্রের বনবাসে ব্যাসের অনুমোদন
বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহামতি ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে এই কথা কহিতেছেন, এমন সময় মহর্ষি বেদব্যাস তথায় সমুপস্থিত হইয়া ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! রাজা ধৃতরাষ্ট্র যাহা কহিতেছেন, তুমি অবিচারিতচিত্তে তাহাতে সম্মত হও। ধৃতরাষ্ট্র একে বৃদ্ধ, তাহাতে আবার পুত্রশোকে একান্ত কাতর হইয়াছেন; অতএব বোধ হইতেছে, ইনি রাজ্যমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক কখনই কষ্টভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না। যশস্বিনী গান্ধারীও কেবল ধৈৰ্য্যবশতঃ পুত্রশোক সহ্য করিতেছেন। অতএব আমি তোমাকে কহিতেছি, তুমি উঁহাদিগকে বনগমনে অনুমতি প্রদান কর। উঁহারা কেন বৃথা রাজধানীতে প্রাণত্যাগ করিবেন? অচিরাৎ বনগমন করিয়া পুরাতন রাজাদিগের তুল্য-গতি লাভ করুন। চরমে বনগমন করাই রাজর্ষিদিগের প্রধান ধর্ম্ম।”
মহর্ষি বেদব্যাস এই কথা কহিলে, রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভগবন্! আপনি আমাদিগের পূজ্য ও কুলগুরু। আপনি আমার পিতা ও আমি আপনার পুত্রস্বরূপ। ধর্ম্মানুসারে পুত্র পিতার বশবর্ত্তী হইয়া থাকে। অতএব আমি আপনার আজ্ঞা প্রতিপালন করিব, তাহার আর সংশয় কি?” যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, ভগবান্ বেদব্যাস পুনরায় তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! নরপতি ধৃতরাষ্ট্র এক্ষণে অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছেন; অতএব আমি ইঁহাকে বনগমনে অনুজ্ঞা প্রদান করিতেছি। তুমি ঐ বিষয়ে সম্মত হও। ইনি এক্ষণে বনে গমন করিয়া স্বীয় অভিলাষানুরূপ কার্য্য সম্পাদন করুন। তুমি তদ্বিষয়ে কোন প্রতিবন্ধকতাচরণ করিও না। যুদ্ধে বা বনমধ্যে বিধিপূর্ব্বক প্রাণত্যাগ করা ভূপতিদিগের পরমধর্ম্ম। তোমার পিতা পাণ্ডু প্রতিনিয়ত পিতার ন্যায় ইঁহার সেবা করিয়াছেন। সেই মহাত্মা যে সময় পৃথিবী প্রতিপালন করিতেন, সেই সময়ে এই অন্ধরাজ রত্নপর্ব্বতপরিশোভিত ভূরিদক্ষিণ যজ্ঞের অনুষ্ঠান, উৎকৃষ্টরূপে প্রজাপালন ও গোসমুদয়ের বন্ধনমোচন প্রভৃতি বিবিধ সৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তৎপরে তুমি বনগমন করিলে পর ইনি ত্রয়োদশ বৎসর পুত্রপরিরক্ষিত রাজ্যভোগ ও বিবিধ ধনরাশি প্রদান করিয়াছেন। তুমিও এক্ষণে পঞ্চদশ বৎসর ভৃত্যগণের সহিত ইঁহার ও গান্ধারীর যথোচিত সেবা করিলে। এক্ষণে ইঁহার তপানুষ্ঠানের সময় উপস্থিত, অতএব তুমি ইঁহাকে তদ্বিষয়ে অনুমতি প্রদান কর। এখন তোমাদিগের প্রতি উঁহার অণুমাত্র ক্রোধ নাই।”
মহাত্মা বেদব্যাস এইরূপে বারংবার ধৃতরাষ্ট্রের নগমনবিষয়ে অনুমতি করিতে অনুরোধ করিলে, ধৰ্ম্মরাজ অগত্যা তাঁহার বাক্যে সম্মত হইলেন। তখন ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন যুধিষ্ঠিরকে সম্মত দেখিয়া অচিরাৎ স্বস্থানে গমন করিলেন।
মহর্ষি বেদব্যাস প্রস্থান করিলে পর ধৰ্ম্মনন্দন ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “তাত! আপনার যাহা অভিমত এবং ভগবান বেদব্যাস, মহাধনুর্দ্ধর কৃপাচার্য্য, বিদুর, সঞ্জয় ও যুযুৎসু আমাকে যে বিষয়ে অনুরোধ করিয়াছেন, আমি অবশ্যই তাহা সম্পাদন করিব। ইঁহারা সকলেই আমার মান্য ও কুরুকুলের হিতৈষী। এক্ষণে আমি প্রণিপাতপূর্ব্বক আপনার নিকট এই প্রার্থনা করিতেছি যে, আপনি প্রথমতঃ আহার করুন; পশ্চাৎ অরণ্যাশ্রমে গমন করিবেন।”