৪র্থ অধ্যায় – দুর্য্যোধনসমীপে কৃপাচার্যের সন্ধিপ্রস্তাব
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় সচ্চরিত্র কৃপাচার্য্য সেই রুদ্রদেবের ক্রীড়াভূমি সংগ্রামস্থলে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। কোন স্থানে রথ ও রথনীড় সমুদয় নিপতিত রহিয়াছে, কোন স্থানে হস্তী ও পদাতিসকল নিহত হইয়াছে এবং কোন স্থলে লোকান্তরিত ভূপতিগণের বিক্ষত অভিজ্ঞানসকল শোভা পাইতেছে। রাজা দুর্য্যোধন শোকে নিতান্ত কাতর হইয়াছেন; সৈন্যগণ পার্থের বিক্রমদর্শনে নিতান্ত উদ্বিগ্ন, ধ্যানপরায়ণ ও একান্ত দুঃখিত হইয়াছে এবং মথ্যমান [মথিতমর্দিত] বলসমুদয় আর্তস্বরে চীৎকার করিতেছে। মহাত্মা কৃপাচার্য্য কৌরবসৈন্যের সেইরূপ দুর্দশা-দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কুরুরাজ দুৰ্য্যোধনের সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে দুর্য্যোধন! আমি এক্ষণে যাহা কহিতেছি, তাহা শ্রবণপূৰ্ব্বক যদি অভিপ্রেত হয়, তবে তাহার অনুষ্ঠান কর। দেখ, যুদ্ধধৰ্ম্ম ব্যতিরেকে ক্ষত্রিয়গণের শ্রেয়স্কর পথ আর কিছুই নাই। তাহারা ঐ ধৰ্ম্ম আশ্রয় করিয়া পুত্র, মাতা, পিতা, স্বস্রীয় [ভাগিনেয়], মাতুল, সম্বন্ধী ও বান্ধবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া থাকে। যুদ্ধে মৃত্যু হইলে পরমধর্ম ও যুদ্ধ হইতে পলায়ন করিলে যারপরনাই অধৰ্ম্ম হয়। অতএব ক্ষত্রিয়গণের জীবিতার্থে পলায়ন করা নিতান্ত দোষাবহ, সন্দেহ নাই। এক্ষণে আমি তোমাকে যে কিছু হিতকথা কহিতেছি, তাহা শ্রবণ কর।
মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্রথ ও তোমার ভ্রাতৃগণ এবং তোমার আত্মজ লক্ষ্মণ নিহত হইয়াছেন; সুতরাং এক্ষণে আমরা আর কি করিব? আমরা যে সমস্ত বীরের হস্তে যুদ্ধভার অর্পণ করিয়া নিষ্কণ্টকে রাজভোগ করিতে অভিলাষী হইয়াছিলাম, তাঁহারা কলেবর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ব্রহ্মবিদগণের গতি লাভ করিয়াছেন। আমরাই ঐ সমুদয় ভূপতির নিধনের হেতু। এক্ষণে আমরা সেই সমস্ত গুণবান্ মহারথের বিরহে অতি দীনভাবে অবস্থান করিতেছি। দেখুন, ভীষ্ম, দ্রোণপ্রভৃতি বীরগণ জীবিত থাকিতেও মহাবীর ধনঞ্জয় পরাজিত হয় নাই। বাসুদেব অর্জুনের চক্ষুঃস্বরূপ, সুতরাং দেবগণও তাহাকে পরাজয় করিতে সমর্থ নহেন। তাহার শক্তচাপ ও বজ্রের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন ইন্দ্ৰধ্বজসদৃশ, উন্নত বানরধ্বজ অবলোকন করিয়া আমাদিগের বলসমুদয় বিচলিত হইয়াছে। এক্ষণে তাহার পাঞ্চজন্য শঙ্খধ্বনি ও গাণ্ডীবনির্ঘোষ এবং ভীমসেনের ভীষণ সিংহনাদে আমাদিগের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইবে। ঐ দেখ, অর্জুনের গাণ্ডীব শরাসন বারংবার কম্পিত হইয়া অলাতচক্রের ন্যায় শোভাধরণ করিতেছে এবং জলধর মধ্যস্থিত চপলার ন্যায় চতুর্দ্দিকে বিরাজিত হইয়া সকলের নয়নজ্যোতি অপহরণ করিতেছে। উহার শশিকাশসমপ্রভ [চন্দ্র ও কাশকুসুমতুল্য শ্বেতকাশের ফুলই খুব সাদা] তুরঙ্গমগণ বায়ুসঞ্চালিত জলধরপটলের ন্যায় কৃষ্ণকর্ত্তৃক চালিত হইয়া উহাকে বহনপূৰ্ব্বক আকাশকে পান করিয়াই যেন মহাবেগে গমন করিতেছে। হুতাশন যেমন অরণ্যমধ্যে প্রাদুর্ভূত হইয়া তৃণরাশি দগ্ধ করে, তদ্রূপ মহাবীর ধনঞ্জয় শরানলে আমাদের সৈন্যগণকে নিতান্ত সন্তপ্ত করিতেছে। ঐ মহেন্দ্রসদৃশ প্রভাবসম্পন্ন মহাবীর দংষ্ট্রা চতুষ্টয়পরিশোভিত দ্বিপেন্দ্রের ন্যায় আমাদিগের সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া সৈন্যগণকে বিক্ষোভিত ও মহীপালগণকে বিত্রস্ত করিয়া কমলবনপ্রমার্থ মাতঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতেছে। উহার গাণ্ডীবনির্ঘোষে আমাদিগের বলসমুদয় সিংহগর্জ্জনভীত মৃগযূথের ন্যায় বারংবার বিভ্রাসিত হইতেছে। ঐ দেখ, ধনুর্ধরাগ্রগণ্য বাসুদেব ও ধনঞ্জয় বৰ্মধারণপূর্ব্বক লোকমধ্যে বিরাজিত হইতেছেন। অদ্য সপ্তদশ দিবস হইল, এই ভয়ঙ্কর সমর সমুপস্থিত হওয়াতে অসংখ্য লোক হইয়াছে। তোমার সৈন্যগণ ধনঞ্জয়ের প্রভাবে বায়ুসঞ্চালিত শারদীয় জলধরপটলের ন্যায় ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছে। মহাবীর ধনঞ্জয় তাহাদিগকে মহার্ণবমধ্যে বায়ু বিধূনিত নৌকার ন্যায় নিরন্তর কম্পিত করিয়াছে। হে মহারাজ! যখন সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ অর্জুনের বাণগোচরে নিপতিত হইয়াছিলেন, তখন তোমার সূতপুত্র, অনুচরবর্গসমবেত দ্রোণ, হৃদিকাত্মজ এবং ভ্রাতৃপরিবৃত দুঃশাসনই বা কোথায় ছিলেন? আমি কোথায় ছিলাম? আর তুমি স্বয়ংই বা কোথায় ছিলে? মহাবীর ধনঞ্জয় তোমার সম্বন্ধী, ভ্রাতা, সহায় ও মাতুলগণের প্রতি বিক্রম প্রকাশ করি সকলের মস্তক আক্রমণপূৰ্ব্বক তাঁহাদের সমক্ষেই সিন্ধুরাজকে নিহত করিয়াছে। এক্ষণে আর আমরা কি করিব? অর্জ্জুনকে পরাজয় করিতে পারে, এমন আর কেহই নাই। ঐ মহাবীরের নিকট বিবিধ দিব্যাস্ত্র বিদ্যমান আছে। তাহার গাণ্ডীবনির্ঘোষে আমাদিগের বলবীৰ্য্য বিনষ্ট করিয়া থাকে। এক্ষণে আমাদিগের সেনাপতি বিনষ্ট হওয়াতে অনীকিনী [সৈন্য] নিশানাথবিরহিত নিশীথিনীর ন্যায় হতভ ও ভগ্নপাদপা শুষ্কতোয়া তটিনীর ন্যায় ব্যাকুলিত হইয়া উঠিয়াছে। অতএব হুতাশন যেমন তৃণরাশির মধ্যে প্রজ্জ্বলিত হইয়া বিচরণ করে, তদ্রূপ মহাবীর ধনঞ্জয় আমাদের এই সেনাপতিশূন্য সৈন্যমধ্যে স্বেচ্ছানুসারে সঞ্চরণ করিবে, সন্দেহ নাই। মহাবীর সাত্যকি ও ভীমসেনের ভীষণ বেগ পৰ্ব্বত বিদারণ ও সমুদ্র শোষণ করিতে পারে। মহাবীর বৃকোদর সভামধ্যে যে যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, তৎসমুদয় প্রায় সফল করিয়াছে এবং যাহা অবশিষ্ট আছে, তাহাও অচিরাৎ সফল করিবে। আর দেখ, ইতিপূৰ্ব্বে মহাবীর সূতপুত্র সম্মুখে অবস্থান করিবেও ধনঞ্জয় নিতান্ত দুর্ভেদ্য স্বীয় সৈন্যসমুদয় অনায়াসে রক্ষা করিয়াছে। হে দুর্য্যোধন! যাহা সাধুলোকের অবশ্য পরিহার্য্য, তোমরা অকারণে তাহারই অনুষ্ঠান করিয়াছ। এক্ষণে সেই সমস্ত দুষ্কর্মের ফল উপস্থিত হইয়াছে। তুমি আত্মকাৰ্য্য সংসাধনার্থ যত্নসহকারে এই সমুদয় লোক আহরণ করিয়া এক্ষণে ইহাদের সহিত প্রাণসঙ্কটে নিপতিত হইয়াছ; অতএব তুমি আত্মরক্ষায় যত্ন কর। আত্মাই সকলের মূল। আত্মা না থাকিলে কেহই আর বশীভূত থাকিবে না। হে মহারাজ! সুরগুরু বৃহস্পতি এইরূপ নীতিবিধান করিয়াছেন যে, লোক শত্রু অপেক্ষা হীন বা তাহার সমান হইলে সন্ধিস্থাপন করিবে, আর শত্রু অপেক্ষা প্রবল হইলে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে। এক্ষণে আমরা পাণ্ডবগণ অপেক্ষা বলবিক্রমে ন্যূন হইতেছি; অতএব তাহাদের সহিত সন্ধিস্থাপন করাই আমাদের কর্তব্য। যে ব্যক্তি শ্রেয়ঃ অবগত নহে, এবং যে শ্ৰেয়স্কর কাৰ্য্যে অনাদর প্রদর্শন করে, সে অবিলম্বেই রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে এবং তাহার কদাচ মঙ্গললাভ হয় না। এক্ষণে আমরা যদি রাজা যুধিষ্ঠিরের নিকট বিনত হইয়া রাজ্য লাভ করিতে পারি, তাহা হইলে আমাদের মঙ্গল হইবে। মূঢ়তাবশতঃ পাণ্ডবগণের নিকট সমরে পরাভূত হওয়া আমাদিগের কদাপি কর্তব্য হইতেছে না। হে মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির অতিশয় দয়ালু, তিনি রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও বাসুদেবের বাক্যে তোমাকে অবশ্যই রাজপদে নিয়োগ করিবেন। দেখ, বাসুদেব যাহা কহিলেন, ধৰ্ম্মরাজ, অর্জ্জুন ও ভীমসেন কখনই তাহা উল্লঙ্ঘন করিবেন না। হে মহারাজ! স্পষ্টই বোধ হইতেছে, কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য উল্লঙ্ঘন করিতে সমর্থ হইবেন না এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও কৃষ্ণের বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শন করিবেন না। অতএব পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন করাই তোমার কর্তব্য, যুদ্ধ করা কদাপি শ্রেয়স্কর নহে। হে মহারাজ! আমি দীনতা বা প্রাণরক্ষার নিমিত্ত এ কথা কহিতেছি না, ইহা হিতকর বলিয়াই তোমাকে কহিলাম। আমি যাহা কহিলাম, ইহা তোমার পক্ষে শ্রেয়ঃ কি না, তাহা তুমি গতাসু হইয়া স্মরণ করিবে।’ হে অম্বিকানন্দন! বৃদ্ধ কৃপাচার্য্য দুর্য্যোধনকে এইরূপ কহিয়া দীর্ঘ ও উষ্ণ নিশ্বাস পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বিমোহিত হইলেন।”