০৪. তিষা বাসায় ঢুকে তার মাকে বলল

তিষা বাসায় ঢুকে তার মাকে বলল, “আম্মু, বল দেখি এটার মানে কী?”

তারপর সে প্রথমে তার ডান হাতটা নিজের বুকের উপর রাখে, তারপর দ্বিতীয় হাতটাও বুকের উপর নিয়ে আসে তারপর দুই হাত দিয়ে তার আম্মুকে দেখায়। আম্মু বললেন, “জানি না বাপু।”

তিষা বলল, “এর মানে হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

আম্মু বললেন, “তুই কাউকে ভালোবাসলে সোজাসজি মুখ ফুটে বলে ফেল। হাত পা নেড়ে এতো কায়দা করে বলতে হবে কেন?”

তিষা বলল, “এটা হচ্ছে সাইন ল্যাংগুয়েজ। আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে এসেছে সে কানে শুনতে পায় না, ঠিক করে কথাও বলতে পারে না। সবকিছু সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলে। আমাদেরকে সে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাচ্ছে।”

আম্মু বললেন, “ব্যাপারটা খারাপ হয় না। তুই যতক্ষণ বাসায় আছিস সারাক্ষণ সাইন ল্যাংগুয়েজ কথা বললে বাসাটা একটু নিরিবিলি থাকবে!”

তিষা তার মাকে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “যাও আম্মু। তোমার সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা।”

টুইটি তিষাকে সমর্থন করে ভারী গলায় ডাকল। তাকে যখন প্রথম আনা হয়েছিল তারপর দুই বছর পার হয়ে গেছে এখন সে আর ছোট কুকুরটি নেই, রীতিমত বড় হয়ে গেছে। তেজী শরীর, মসৃণ অবয়ব, কৌতূহলী চোখ। যতক্ষণ তিষা স্কুলে কিংবা বাইরে থাকে টুইটি ততক্ষণ খুবই দায়িত্বশীল একটা কুকর। সে বাসায় আসা মাত্র তার দুষ্টুমি শুরু হয়ে যায়। সে লাফ ঝাঁপ দিতে থাকে, তিষাকে ঘিরে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। তার প্রিয় খেলা হচ্ছে তিষার একপাটি জুতো মুখে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যাওয়া। ঘরের ভেতরে না থেকে বাইরে ছোটাচ্চুটি করা টুইটির অনেক বেশী পছন্দ। যতদিন শীত না পড়েছে ততদিন সমস্যা ছিল না কিন্তু বরফ পড়তে শুরু করার পর তিষা বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে–টুইটি সেটা বুঝতে পারে না। সে যেরকম বরফে ছোটাচ্চুটি করতে পারে তার ধারণা সবাই বুঝি সে রকম পারে!

এই দুই বছরে তিষাও অনেক বড় হয়েছে। তার ক্লাশের আমেরিকান বান্ধবীরা অবশ্যি আর কিশোরী নেই সবাই তরুণী হয়ে গেছে। তিষা এখনো হালকা পাতলা, চোখে মুখে একটু বাড়তি বুদ্ধির ছাপ, চাল চলনে একটু বেশী আত্মবিশ্বাস তা না হলে হয়তো বোঝাই যেতো না তার বয়স এখন। পনেরো।

রাতে খাবার টেবিলে তিষা আবার তার ক্লাশের কানে না শোনা ছেলেটির কথা তুলল, বলল, “আব্বু, তুমি জান আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে এসেছে, ছেলেটা কানে শুনতে পায় না কিন্তু কম্পিউটারের জিনিয়াস।”

আব্বু বলল, “হতেই পারে। কানে না শুনলে একজন কী জিনিয়াস হতে পারে না? বিটোভেন কানে শুনতেন না–তাতেই কতো বড় শিল্পী কানে শুনলে না জানি কী হতো!”

তিষা বলল, “ছেলেটার নাম জন। জন উইটক্যাম্প। খুবই সুইট। একদিন বাসায় নিয়ে আসব দেখো।”

“নিয়ে আসিস।”

“আমাদেরকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাচ্ছে।”

“ইন্টারেস্টিং।” আব্বু বললেন, “আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন সাইন ল্যাংগুয়েজের কথা জানতাম না। যদি জানতাম তাহলে কী করতাম বল দেখি?”

“কী করতে?”

“পরীক্ষার হলে নকল করা খুব সোজা হতো। আমাদের ফার্স্ট বয় এক কোনায় বসে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলতো আর পুরো হলের আমরা সবাই লিখে ফেলতাম। একেবারে নিঃশব্দে।”

“আব্বু, আজকাল পরীক্ষায় নকল করার জন্যে সাইন ল্যাংগুয়েজ লাগে না। কতো রকম ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বের হয়েছে তুমি জান?”

“তা ঠিক।”

আম্মু বললেন, “এই যে ছেলেটা কানে শুনতে পায় না তার ক্লাশ করতে সমস্যা হয় না?

“মোটেও না। লিপ রিডিং করতে পারে। ঠোঁট নাড়া দেখে সব কথা বুঝতে পারে। একটু একটু বলতেও পারে, কষ্ট করে বুঝতে হয়।”

“ইন্টাররেস্টিং।” আব্বু বললেন, “আমরা যখন লেখাপড়া করেছি তখন কেউ কল্পনাও করতে পারত না এরকম একজন আমাদের সাথে লেখাপড়া করবে।”

তিষা বলল, “জন তো মোটামুটি স্বাভাবিক। আমাদের স্কুলে একজন আছে অন্ধ। আরো দুইজন হুইল চেয়ারে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, যে মেয়েটি অন্ধ সে তার ক্লাশের মনিটর।”

“বাহ!”

“আমরা কেউ অবশ্যি অন্ধ বলি না, সবসময়েই বলি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।”

“তাইতো বলা উচিত।”

.

পরের কয়েকদিন প্রচুর তুষারপাত হল, চারদিক বরফে ঢেকে গেল। এর মাঝে তিষা একদিন খবর আনল কাছাকাছি সাসকুয়ান হ্রদটা বরফে ঢেকে গেছে, সবাই তার ওপরে স্কেটিং করছে।

আম্মু বললেন, “জানি না বাপু।হ্রদের উপর বরফ জমে গেছে সেখানে স্কেটিং করার সময় বরফ ভেঙ্গে যদি নিচে পড়ে যায়?”

তিষা বলল, “কী বল আম্মু? বরফ কতো শক্ত হয় জান? লেকের ওপর রীতিমত গাড়ী যেতে পারে!”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। চল একবার দেখে আসি।”

“তোর আব্বুকে বল, গিয়ে দেখে আসব। খোদার দুনিয়ায় কতো বিচিত্র জিনিষই না আছে!”

“আমি আমার স্কেট নিয়ে যাব।”

“ঠিক আছে।”

এই বয়সী মেয়েরা যা করে তিষাও সেগুলো করে। রোলার স্কেটিং করে আইস স্কেটিং করে, উইক এন্ডে দলবেধে মলে বেড়াতে যায়। সবাই মিলে সিনেমা দেখে। দেশের অনেক মানুষ এখানে এসে তাদের ছেলেমেয়েদের ঘরে বেঁধে রাখতে চেষ্টা করে, তিষার আব্বু আম্মু কখনো সেটা করেন নি।

.

দুই সপ্তাহ পর এক উইক এন্ডে তিষাকে নিয়ে তার আবু আম্মু জমে যাওয়া সাসকুয়ান লেক দেখতে গেল। আব্বু গাড়ী চালাচ্ছেন সামনে আম্মু। পিছনে তিষা আর টুইটি। টুইটির উত্তেজনা চোখে পড়ার মত, অনেকদিন পর ঘর থেকে বের হতে পেরে তার আনন্দের শেষ নেই।

প্রায় দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করে তারা সেই জমে যাওয়া হদে উপস্থিত হলো। এমনিতে দেখে বোঝার উপায় নেই কোথায় শক্ত মাটি কোথায় হ্রদ সবকিছু ধবধবে সাদা বরফে ঢাকা। একটু লক্ষ করলে বোঝা যায়, যেখানে হ্রদ ছিল সেখানে গাছ নেই, আশে পাশে পাতা ঝড়ে যাওয়া অনেক গাছ।

উইক এন্ড বলে আজকে অবশ্যি অনেক মানুষ। দূরে গাড়ী পার্ক করে সবাই হ্রদের উপর স্কেটিং করতে চলে এসেছে। উজ্জল রঙ্গীন কাপড় পরে নানা বয়সী মানুষ ছোটাচ্চুটি করছে, দেখতে ভারি ভালো লাগে। তিষা গাড়ী থেকে নেমে তার স্কেটগুলো হাতে নিয়ে সামনে ছুটে যেতে থাকে, তার ভাব দেখে মনে হয় সামনে যে বিশাল আনন্দোৎসব চলছে একটু দেরী করলেই সেটা বুঝি শেষ হয়ে যাবে। টুইটিরও উৎসাহের শেষ নেই, সে তিষার পিছনে পিছনে ডাকতে ডাকতে ছুটতে থাকে।

আব্বু আর আম্মু গাড়ী থেকে বের হয়ে আসেন। দুই হাত ঘষে একটু উষ্ণতা তৈরী করতে করতে তারা বরফে ঢেকে যাওয়া হ্রদের একটু কাছে এগিয়ে যান।

তিষা কতোক্ষণ স্কেটিং করছিল মনে নেই, এই শীতের মাঝেও তার শরীর প্রায় ঘেমে গিয়েছে। তাদের ক্লাসের কয়েকজন এতো চমৎকার আইস স্কেটিং করতে পারে যে দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। বরফের ওপর এতো সুন্দর করে ঘুরপাক খায় যে দেখে মনে হয় কাজটা বুঝি খুবই সহজ। তিষা চেষ্টা করে দেখেছে, কাজটা মোটেও সহজ নয়, চেষ্টা করতে গিয়ে একটু পরপর বরফের ওপর আছাড় খেয়ে পড়েছে!

তিষা ঘুরপাক খেতে খেতে হ্রদের একপাশে চলে এসেছিল ঠিক তখন সে প্রথমে একজনের তারপর হঠাৎ করে সম্মিলিত মানুষের একটা ভয় পাওয়া আতংকের চিৎকার শুনতে পায়। তিষা দাঁড়িয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী হয়েছে, তখন সে মানুষের চিৎকারের পাশাপাশি বরফ ভাঙ্গার একটা চাপা আওয়াজ শুনতে পেল এবং পরমুহূর্তে তার পায়ের নিচ থেকে কিছু একটা সরে যাওয়ার অনুভূতি হল। কী ঘটছে সেটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় নেয়। হ্রদের উপর যে বিশাল বরফের স্তর রয়েছে সেটা হঠাৎ করে ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছে–এটা সত্যিই ঘটা সম্ভব কী না সেটা নিয়ে এই মুহূর্তে ভাবার সময় নেই, এখন এখান থেকে দ্রুত সরে যেতে হবে। তিষা দেখল আতংকে চিৎকার করতে করতে সবাই হ্রদের তীরে ছুটে যেতে শুরু করেছে। তিষা মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কোন দিকে গেলে সে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি তীরে পৌঁছাতে পারবে, তারপর ঘুরে সে সেদিকে ছুটতে থাকে ঠিক তখন তার সামনে হঠাৎ করে বরফের এটা ফাটল বের হয়ে নিচ থেকে কুচকুচে কালো হিমশীতল পানি বের হয়ে আসে। তিষা প্রাণপণে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে থামতে পারল না। তিষা বরফের উপর শুয়ে পড়ে বরফকে খামচে ধরে নিজেকে থামাতে চেষ্টা করল কিন্তু তবু নিজেকে থামাতে পারল না। তিষা বরফের ফাটল দিয়ে হিমশীতল পানিতে পড়ে মুহূর্তের মাঝে তলিয়ে গেল। টুইটি ঠিক তখন ছুটতে ছুটতে সেখানে এসেছে, বরফের ফাটলের সামনে দাঁড়িয়ে সেটি একবার হাহাকার করে ডাকল, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে কালো হিমশীতল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তিষার আলু আর আম্মু এক ধরনের আতংক নিয়ে হ্রদের দিকে তাকিয়েছিলেন, কী ঘটছে বুঝতে তাদের একটু সময় লাগল। এতো মানুষের ভীড়ে তিষাকে খুঁজেও পাচ্ছিলেন না, যখন সব মানুষ নিরাপদে সরে এসেছে। এবং তাদের ভেতরে কোথাও তিষা কিংবা টুইটিকে খুঁজে পেলেন না। তখন হঠাৎ করে একটা অচিন্ত্যনীয় ভয়াবহ আতংকে তারা পাথর হয়ে গেলেন। যারা ছুটে এসেছে তাদের মুখে আব্বু আম্মু শুনতে পেলেন বরফের ফাটল দিয়ে লাল পার্কা পরা একটি মেয়ে পড়ে গেছে আর তার পিছু পিছু একটা কুকুর সেখানে ঝাঁপ দিয়েছে, তখন হঠাৎ করে তিষার আব্বু আম্মুর পুরো জগৎটি মুহূর্তে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। আম্মু চিৎকার করে সেখানে ছুটে যেতে চাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে কেউ যেতে দিল না, সবাই মিলে তাকে ধরে রাখল।

বেশ কয়েকজন সতর্ক ভাবে তিষার খোঁজে এগিয়ে গেল, বরফের ফাটল দিয়ে উঁকি দেয়া কুচকুচে কালো পানিতে তিষার কোনো চিহ্ন নেই। তিষা সাঁতার জানে কিন্তু এই হিমশীতল পানিতে ডুবে বরফের নিচে চলে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। নিঃশ্বাস নিতে না পারলে মানুষ কয়েক মিনিটের বেশি বেঁচে থাকতে পারে না। এর মাঝে বেশ কয়েক মিনিট সময় পার হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে এই বরফের নিচ থেকে তিষাকে জীবিত উদ্ধার করার সব আশা খুব দ্রুত শেষ। হয়ে যেতে শুরু করল।

উদ্ধারকারীদের খবর দেওয়া হয়েছে, তারা কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে, কিন্তু যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান তখন এই উদ্ধারকারী দলের এখানে পৌঁছে কিছু করার থাকবে না। তারা এসে হয়তো তিষার মৃতদেহটা শুধু উদ্ধার করবে।

ঠিক এরকম সময়ে মানুষজনের চিৎকার শোনা গেল, বরফের ফাটলের এক জায়গায় লাল পার্কার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে তার পাশে কিছু একটা নড়ছে, নিশ্চয়ই টুইটি। বেশ কয়েকজন মানুষ ছুটে যায়, তারা তিষার হিমশীতল শরীরটি টেনে তোলে। ক্লান্ত শ্রান্ত টুইটি বরফের ফাটলে পা রেখে ওঠার চেষ্টা করে, উঠতে পারে না। একজন তাকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু তার হাত পিছলে টুইটি আবার পানিতে পড়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্যে টুইটিকে দেখা যায় না, একটু পর সে আবার ভেসে উঠে, আবার সে ওঠার চেষ্টা করে। উঠতে পারে না, একজন তাকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করল, পারল না, টুইটি আবার তলিয়ে গেল, আর তাকে দেখা গেল না।

তিষা বেঁচে আছে না নেই কেউ সেটা পরীক্ষা করার চেষ্টা করল না, তাকে নিয়ে ছুটে যেতে থাকে, ততক্ষণে একটা এম্বুলেন্স চলে এসেছে। এম্বুলেন্সের স্ট্রেচারে শুইয়ে দিতেই এম্বুলেন্সটি সাইরেন বাজাতে বাজাতে ছুটে যেতে থাকে।

আম্মু আব্বুর বুকের কাপড় ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “আমার তিষা এনিম্যান বেঁচে যাবে? বেঁচে যাবে?”

আব্বু কিছু বললেন না। এতো দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকলে কেউ বেঁচে থাকে না কথাটি কেমন করে বলবেন? যদি বেঁচে থাকে সেই বেঁচে থাকার অর্থ কী? মস্তিষ্কে অক্সিজেন না গেলে সেই মস্তিষ্কের যে ক্ষতি হয় সেই ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক নিয়ে বেঁচে থাকা একজন মানুষের জীবন কতো ভয়ংকর সেটি কী কেউ কল্পনা করতে পারবে?