তিতুনি কী করবে সেটা নিয়ে এক মুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর হাত বাড়িয়ে এলিয়েন তিতুনিকে খপ করে ধরে ভেতরে টেনে আনল। সে যে ফ্রকটা পরে আছে এলিয়েন তিতুনিও একই ফ্রক পরে আছে, কাজেই দুইজন বদলাবদলি করলে কেউ ধরতে পারবে না।
তিতুনি এলিয়েন তিতুনির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি ঘরের ভেতরে লুকিয়ে থাকো। বের হয়ো না।”
এলিয়েন তিতুনি মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল, যেন এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সব বাসাতেই যেন দুইটি করে তিতুনি থাকে, একজন বাইরে কথাবার্তা বলে আরেকজন ঘরের ভেতরে লুকিয়ে থাকে।
ঘর থেকে বের হয়ে তিতুনি টোটনের কাছে গেল, টোটন হচড় পাঁচড় করে কোনোভাবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তিতুনি তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? ভাইয়া তোমার কী হয়েছে?”
টোটন তিতুনিকে দেখে কেমন যেন ভয় পেয়ে ঝটকা মেরে তিতুনির হাতটা সরিয়ে একটা লাফ দিয়ে সরে গেল, তোতলাতে তোতলাতে বলল, “তু-তু-তু-তুই! তু-তু-তুই?”
“আমি?” তিতুনি কিছুই বুঝতে পারে নাই সে রকম ভান করে বলল, “আমি কী?”
ততক্ষণে আব্বু আর আম্মুও ছুটে চলে এসেছেন।
ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
তিতুনি বলল, “জানি না।”
টোটন তিতুনির দিকে আঙুল তুলে বলল, “তি-তি-তি…” কিন্তু কথাটা শেষ করল না, সে যে তিতুনি বলার চেষ্টা করছে সেটা বুঝতে অবশ্যি কারো সমস্যা হলো না।
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে তিতুনির?”
টোটন এবার খানিকটা সামলে নিয়েছে। তিতুনিকে দেখে সে কেমন জানি ভয় পেয়ে গেল, একটু সরে গিয়ে বলল, “দু-দুইটা তিতুনি।”
কথাটার অর্থ তিনি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারল না। তিতুনি অবশ্য তার আব্বু আর আম্মুর মতো ভান করল সেও টোটনের কথাটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। বলল, “দুইটা আমি?”
“হ্যাঁ”, টোটন বলল, “তুই দুইটা।”
আব্বু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তিতুনি দুইটা? তার মানে কী?”
টোটন বলল, “একটা তিতুনি ঘরের ভেতরে। আরেকটা বাইরে।”
আব্বু আর আম্মু একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন, তারপর তিতুনির দিকে তাকালেন, তিতুনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আম্মু টোটনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “একজন মানুষ দুইটা কেমন করে হয়?”
টোটন বলল, “আমি দেখেছি। দুইটা তিতুনি।”
আম্মু বললেন, “কোথায় দেখেছিস?”
টোটন তিতুনির ঘরের দিকে দেখিয়ে বলল, “ঘরের ভেতরে।”
তিতুনি এইবারে হাসার ভঙ্গি করল, তারপর বলল, “ভাইয়ার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
টোটন গর্জন করে বলল, “মাথা খারাপ হয় নাই। আমি স্পষ্ট দেখেছি।”
“তাহলে ভাইয়া গাঞ্জা খেয়ে এসেছে।”
টোটন আরো জোরে গর্জন করে উঠল, বলল, “আমি গাঞ্জা খাই নাই।”
“তাহলে ইয়াবা।”
টোটন এবারে কোনো কথা বলল না, শুধু হিংস্র চোখে তিতুনির দিকে তাকাল। তার চোখ থেকে আগুন বের হতে থাকল।
আব্বু চিন্তিত মুখে বললেন, “কী হয়েছে বোঝা দরকার। টোটন বাবা তুমি পরিষ্কার করে বলো দেখি তুমি কী দেখেছ।”
টোটন বলল, “আমি দেখেছি দুইটা তিতুনি। একটা ঘরের ভেতরে আরেকটা বাইরে।”
“দুইটা তিতুনি মানে কী?”
টোটন কেমন জানি অধৈর্য হয়ে বলল, “দুইটা মানে দুইটা। এক দুই। ওয়ান টু।”
আব্বু বললেন, “একজন মানুষ দুইটা হয় কেমন করে?”
টোটন যুক্তি-তর্কের দিকে গেল না, বলল, “হয়েছে। আমি দেখেছি।”
তিতুনি বলল, “হয় নাই। তুমি তবু দেখেছ। তুমি তো আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারো না তাই সব জায়গায় আমাকে দেখো। তোমার মনের ভুল।”
আম্মু মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ। মনের ভুল।”
আব্বু বললেন, “কিংবা চোখের ভুল।”
তিতুনি বলল, “মাথায় ঠাণ্ডা পানি ঢাললে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে।” আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠাণ্ডা পানি আনব?”
টোটন রেগে বলল, “না। তোর ঠাণ্ডা পানি আনতে হবে না।”
তিতুনি বলল, “তাহলে লবণ পানি। লবণ পানি খেলে মাথা ঠাণ্ডা হয়।”
টোটন দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল, “লাগবে না লবণ পানি।”
তিতুনি মুখটা গম্ভীর করে বলল, “আম্মু। আমার মনে হয় ভাইয়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।”
আম্মু চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লেন। আব্বু বললেন, “একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেই হবে। সকালবেলা ঠিক হয়ে যাবে।”
টোটন বলল, “আমার ঘুমের ওষুধ খেতে হবে না। আমার কিছু হয় নাই। আমি দেখেছি এই ঘরের ভেতরে আরেকটা তিতুনি আছে।”
তিতুনি মুখ গম্ভীর করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, “ভাইয়া পাগল হয়ে যাচ্ছে।”
আব্বু বললেন, “আমার কী মনে হচ্ছে জানো?” আম্মু আর তিতুনি একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“টোটন যেহেতু একেবারে জোর দিয়ে বলছে ঘরের ভেতরে আরেকটা তিতুনি আছে আমাদের তিতুনির ঘরে গিয়ে টোটনকে দেখানো উচিত যে আসলে সেখানে কিছু নাই। তখন টোটন বিশ্বাস করবে।”
তিতুনির মুখটা হাঁ হয়ে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আ-আ-আমার ঘরে?”
“হ্যাঁ তোর ঘরের দরজাটা খোল দেখি।”
তিতুনি আঁতকে উঠল, “দরজা খুলব?”
“হ্যাঁ। টোটনকে দেখাই তোর ঘর ফাঁকা। আর কেউ নাই।” তিতুনি জানে তার ঘর মোটেও ফাঁকা নয়, তার ঘরে এলিয়েন তিতুনি বসে আছে। ঘরে ঢুকলেই তাকে পেয়ে যাবে। তখন কী ভয়ানক একটা কাণ্ড ঘটবে! বোঝা যাবে টোটনের কথাটাই সত্যি, আসলেই তিতুনি দুইজন। কোনটা খাঁটি কোনটা ভেজাল? কেমন করে কী বোঝাবে? যদি এলিয়েন তিতুনিকে খাঁটি মনে করে তাকে বিদায় করে দেয় তখন কী হবে? ভয়ে-আতঙ্কে তিতুনির হাত-পা কাঁপতে থাকে। সে দুর্বলভাবে তার আব্বকে থামানোর চেষ্টা করল, বলল, “আব্বু আমার ঘরে তোমাদের যাওয়া মনে হয় ঠিক হবে না।”
আব্বু ভুরু কুঁচকে বললেন, “কেন?”
“মানে ইয়ে তাহলে–”, তিতুনি কী বলবে বুঝতে পারছিল না, একটু ইতস্তত করে বলল, “তাহলে ভাইয়ার কথাকে বিশ্বাস করা হলো। ভাইয়াকে বোঝানো হলো উল্টাপাল্টা জিনিস বলা যায়-ভাইয়া আরো বেশি উল্টাপাল্টা জিনিস বলবে। কোনোদিন হয়তো বলবে—”
“কী বলবে?”
“বলবে আমি একটা এলিয়েন।”
“এলিয়েন?” আবু চোখ কপালে তুলে বললেন, “এলিয়েন? তোকে এলিয়েন কেন বলবে?”
আম্মু বললেন, “এত সব কথা না বলে টোটনকে নিয়ে তিতুনির বরে ঢুকে তাকে দেখাও, তাহলে টোটন শান্ত হবে।”
টোটন কাঁপা গলায় বলল, “আমি ঢুকতে চাই না। আমার ভয় করে।”
আব্বু অবাক হয়ে বললেন, “ভয় করে? কিসের ভয়?”
টোটন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “জানি না।”
আম্মু বললেন, “কোনো ভয় নাই। আয় আমার সাথে।”
তারপর টোটনের হাত ধরে তিতুনির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রথমে আম্মু, তারপর আব্ব, সবার শেষে টোটন। তিতুনি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল, যেকোনো মুহূর্তে তার ঘরের ভেতর থেকে ভয়ংকর একটা চিৎকার শোনা যাবে। সবাই আতঙ্কে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে আসবে। তখন সে কী করবে?
তিতুনি তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটা ভয়ংকর চিৎকারের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড-কোনো চিৎকার নেই। দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড, তিরিশ সেকেন্ড-তবু কোনো চিৎকার নেই, বরং খুবই নিরীহ কথা শোনা গেল। আব্বু বললেন, “দেখলি টোটন, এখানে কোনো তিতুনি নেই।”
আম্মু বললেন, “কেমন করে থাকবে? এটা কি সম্ভব?”
টোটন বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, তিতুনি সেই কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না।
আব্বু বললেন, “আর কত দেখবি? সব তো দেখা হলো।”
আম্মু বললেন, “এখন বিশ্বাস হলো?”
টোটন আবার বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। তিতুনি এই কথাটাও বুঝতে পারল না। কিন্তু এতক্ষণে তার ভেতরে সাহস ফিরে এসেছে, সে তখন তার ঘরে ঢুকল। ঘরের ভেতর টোটন তখন নিচু হয়ে তার খাটের তলাটা দেখছে। তিতুনি বলল, “ভাইয়া, পেয়েছ আরেকজন তিতুনি?”
টোটন গরগর করে কিছু একটা বলল, যার অর্থ যা কিছু হতে পারে।
তিতুনি সাবধানে চারিদিকে তাকাল, এলিয়েন তিতুনির কোনো চিহ্ন নেই। তিতুনির ভয় কেটে গেছে, সে এবার টোটনকে জ্বালাতে শুরু করল, বলল, “ভাইয়া আমার ব্যাক পেকের ভেতরে দেখতে চাও?”
টোটন বলল, “চুপ কর। পাজি মেয়ে।”
“বালিশের তলায় দেখেছ? ড্রয়ারের ভেতরে?” টোটন চোখ লাল করে ফেলল, “ফাজলেমি করবি না। খবরদার।”
তিতুনি বলল, “কে ফাজলেমি করছে? আমি না তুমি? যদি বলো আমি ছাড়া আরো একজন তিতুনি আছে তাহলে সেটা ফাজলেমি হলো না?”
আম্মু বললেন, “থাক থাক, অনেক হয়েছে।”
আব্বু বললেন, “টোটন, যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো।”
টোটনকে খুবই বিমর্ষ দেখাল, বলল, “আমি স্পষ্ট দেখলাম।”
আব্বু বললেন, “যত স্পষ্টই দেখো, এটা সত্যি হতে পারে না। এটা হয় চোখের ভুল না হয় মনের ভুল।”
তিতুনি বলল, “কিংবা মগজের গোলমাল।”
টোটন চোখ লাল করে তিতুনির দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না, সে এখন আসলেই মনে করতে শুরু করছে যে তার মগজে গোলমাল হতে শুরু করেছে।
তার ঘর থেকে সবাই বের হয়ে যাবার পর তিতুনি দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে তার বিছানার উপরে বসে এদিক-সেদিক তাকাল। সামনের দরজাটা ছাড়া এই ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, আবার মেয়েটা এই ঘরেও নেই। তাহলে মেয়েটা গেল কোথায়?
ঠিক তখন শুনল ফিসফিস করে মেয়েটা তাকে ডাকছে, “তিতুনি! এই তিতুনি।
তিতুনি চমকে উঠে এদিক-সেদিক তাকাল, মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না, কোথা থেকে কথা বলছে?
“এই যে। আমি এইখানে।”
তিতুনি গলার স্বর লক্ষ্য করে উপরের দিকে তাকাল এবং উপরের দৃশ্যটি দেখে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মাথার ওপরে ফ্যানটা ফুল স্পিডে ঘুরছে, তার উপরে ফ্যানের রডটা ধরে গুটিশুটি মেরে মেয়েটি বসে আছে। কোনোভাবে যদি হাত ফসকে যায় তাহলে ফ্যানের ব্লেডের উপর পড়বে, তখন কী অবস্থা হবে সে চিন্তাও করতে পারে না।
আব্বু-আম্মুকে নিয়ে টোটন এই ঘরের সব জায়গায় মেয়েটাকে খুঁজেছে, কিন্তু তাদের কারো মাথায় একবার উপরে তাকানোর কথা মনে হয়নি। কেন তাকাবে, একজন মানুষ যে ঘুরন্ত ফ্যানের রড ধরে ঝুলে থাকতে পারে, সেটা কি কেউ কখনো চিন্তা করতে পারে?
মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, “তিতুনি। ফ্যানটা একটু বন্ধ করো।”
তিতুনি তখন দৌড়ে ফ্যান বন্ধ করল। ফ্যানের ব্লেডগুলো থেমে যাবার আগেই মেয়েটা রড থেকে ঝুলে মেঝেতে নেমে এলো। হাত দিয়ে শরীর পরিষ্কার করতে করতে তিতুনির দিকে এমনভাবে তাকাল
যেন এটা খুবই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
তিতুনি হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তু-তুমি ওখানে উঠেছ কেমন করে?”
তিতুনি যে রকম করে কাঁধ ঝাঁকায় মেয়েটা ঠিক সেভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “চেষ্টা-মেস্টা করে।”
“কী রকম চেষ্টা-মেস্টা?”
“তুমি হলে যে রকম উঠতে আমি সে রকম করে উঠেছি।”
“আমি মোটেও ফ্যানের উপরে উঠে বসে থাকতাম না।”
মেয়েটা তিতুনির কথা মেনে নিয়ে একটা হাই তুলল। তিতুনি কেন জানি একটু রেগে ওঠে। রেগে উঠলে গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে কথা বলতে হয় কিন্তু এখন ফিসফিস করে কথা বলতে হচ্ছে, তাই রাগটা পুরোপুরি বোঝানোনা গেল না। হাত-পা নেড়ে ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে আমি একশ’বার বলেছি বাসায় আসবে না বাসায় আসবে না-তারপরেও তুমি বাসায় কেন চলে এসেছ?”
“অনেকক্ষণ বাসায় কাউকে দেখি না, তাই কী রকম মন কেমন কেমন করছিল।”
তিতুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললে? বাসায় কাউকে দেখো না? তুমি কোথাকার একজন এলিয়েন আর আমার বাসার মানুষের জন্য তোমার মন কেমন কেমন করে?”
এলিয়েন মেয়েটা মাথা নাড়ল। তিতুনি আরো রেগে বলল, “ঢং করো?”
মেয়েটা না-সূচকভাবে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ্। ঢং করি না। এখন তো আমি হচ্ছি তুমি। সারাদিন বন-জঙ্গল, মাঠঘাট, নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ালে তোমার বাসার মানুষের জন্যে মন খারাপ করত না?”
তিতুনি অস্বীকার করতে পারল না যে তারও মন খারাপ হতো কিন্তু তারপরও বিষয়টা মেনে নেওয়া তার জন্যে সহজ হলো না।
তিতুনির মতো মেয়েটা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তা ছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে।”
তিতুনি জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”
“অন্ধকার হবার পর কেমন জানি ভয় ভয় করতে লাগল।”
“ভয়?”
তিতুনি অবাক হয়ে বলল, “কীসের ভয়?”
মেয়েটা একেবারে সরল মুখে বলল, “ভূতের।”
তিতুনি আরেকটু হলে একটা চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে ফিসফিস করে বলল, “তুমি ভূতকে ভয় পাও?”
মেয়েটা বলল, “তুমি ভয় পাও দেখেই তো আমি ভয় পাই। আমি হচ্ছি তুমি।”
তিতুনি কী বলবে বুঝতে পারল না। খানিকক্ষণ হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “দেখো মেয়ে, তোমার জন্যে আমার কিন্তু অনেক বড় বিপদ হতে পারে।”
“কী বিপদ?”
“যদি কোনোভাবে কেউ তোমার কথা জেনে যায়, তাহলে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবেই। তোমার জায়গায় আমাকে ধরে নিয়ে যাবার চান্স ফিফটি ফিফটি। যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায় তখন কী হবে?”
মেয়েটা মাথা চুলকে বলল, “কেটেকুটে দেখবে। মনে হয় ইলেকট্রিক শক দিবে। ব্রেনটা খুলে খুলে দেখবে।”
“তাহলে?”
মেয়েটাকে কিছুক্ষণ চিন্তিত দেখায়, তারপর হঠাৎ চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “যেটা হয় নাই সেটা নিয়ে চিন্তা করে কী হবে? যখন হবে তখন দেখা যাবে।”
তিতুনি অবশ্যি এত সহজে ছেড়ে দিল না, ফিসফিস করে বলল, “তোমার কাজটা ঠিক হয় নাই।”
“কোন কাজটা?”
“এই যে আমার মতো চেহারা করেছ। অন্য রকম চেহারা করলে কী হতো?”
মেয়েটা অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, “তোমাকে প্রথম দেখলাম, পছন্দ হলো
তিতুনি হাত নেড়ে বলল, “পছন্দের খেতা পুড়ি।”
কিছুক্ষণ দুইজনেই চুপ করে থাকে। মেয়েটা একসময় বলল, “যখন সকাল হবে তখন আমি না হয় চলে যাব।”
“কোথায়?”
“এই তো এদিক-সেদিক। এসেছি যখন পৃথিবীটা একটু ঘুরে দেখি।”
তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, “সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার কী? এখনই যাও। আমার ঝামেলা মিটে যায়।”
মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, “না বাবা। ভয় করে।”
“সকালবেলা কেমন করে যাবে? যদি আম্মু না হয় আবু দেখে ফেলে তখন কী হবে?”
“দেখবে না। খুব সকালে কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগে চলে যাব।” তিতুনি বলল, “মনে থাকে যেন।”
“মনে থাকবে।”
তিতুনি একটু ইতস্তত করে বলল, “দেখো তুমি মনে কোরো না যেন আমি তোমাকে বাসা থেকে বের করে দিচ্ছি।”
মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দিচ্ছই তো।”
“না।” তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, “তুমি একজন এলিয়েন মানুষ, তুমি কত কী করতে পারো। আমি তো আর কিছু করতে পারি না। তোমার মতন দেখতে বলে যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায় শুধু সেই জন্যে-বুঝেছ?”
এলিয়েন মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি।”
তিতুনি গলার স্বরটা একটু নরম করে বলল, “তুমি আমার উপরে রাগ হওনি তো?”
“নাহ্। নিজের উপর নিজে রাগ হবে কেমন করে? তুমি আর আমি তো একই।” বলে মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর সেটা দেখে তিতুনির একটু মন খারাপ হলো।