টুং করে একবার শুধু দরজায় বেল বাজল।
সামান্য শব্দেই কাকাবাবুর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটা তুলে দেখলেন পৌনে ছটা বাজে।
জানলার পরদা সরানো, বাইরে দেখা যাচ্ছে ভোরের নরম নীল আকাশ।
শুয়ে-শুয়েই কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কে?
উত্তর এল না, আবার বেল বাজল একবার।
উঠে ড্রেসিং গাউন গায়ে জড়িয়ে, ক্রাচ দুটো না নিয়েই তিনি এক পায়ে লাফাতে-লাফাতে এলেন দরজার কাছে।
ম্যাজিক আই দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলেন। কাউকে দেখা গেল না।
আবার লাফিয়ে-লাফিয়ে ফিরে গিয়ে বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা নিয়ে এসে এক ঝটকায় খুলে ফেললেন দরজা।
আড়াল থেকে সামনে এসে দাঁড়াল একটি কিশোরী মেয়ে। তেরো-চোদ্দো বছর বয়েস হবে। একটা ধপধপে সাদা ফ্রক পরা, ফরসা রং, মুখোনি ভারী সরল আর সুশ্রী, টানা-টানা চোখ। তার হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা।
সেই ফুলগুলি কাকাবাবুর পায়ের কাছে রেখে সে প্রণাম করল।
কাকাবাবু মুগ্ধ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?
মেয়েটি বাংলায় উত্তর দিল, আমার নাম রাধা।
তারপর সে ঘরের মধ্যে তাকিয়ে বলল, সন্তুদাদা এখনও ওঠেনি?
কাকাবাবু বললেন, সন্তু? তুমি সন্তুকে চেনো নাকি?
রাধা ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি সন্তুদাকে চিনি, আপনাকে চিনি, জোজো-দেবলীনাকে চিনি।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু এবার আসেনি আমার সঙ্গে। এসো, ভেতরে এসো।
রাধা একটি চেয়ারে বসে বলল,
বাঃ, এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়? আমি কোনওদিন কোনও হোটেলে থাকিনি।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এত সকালে তুমি কোথা থেকে এলে বলো তো?
রাধা বলল, আমি একটা হস্টেলে থাকি। ভোরবেলা আমার সাঁতার শেখার ক্লাশ। আমি তো সাঁতার জানি, তাই রোজ-রোজ ওই ক্লাশে যেতে ইচ্ছে করে না। সেইজন্য আজ পালিয়ে এসেছি।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, সেটা বেশ করেছ। দাঁড়াও একটু চায়ের অর্ডার দিচ্ছি, তুমি চা খাও?
রাধা দুদিকে মাথা নাড়ল।
কাকাবাবু ফোনে চায়ের কথা বলে দিয়ে রাধার সামনে এসে বসলেন।
তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এবারে বলো তো, তুমি সন্তুকে, আমাকে কী করে চিনলে? সন্তু তো কখনও ভাইজাগে আসেইনি।
রাধা বলল, বাঃ, আমরা আগে কলকাতায় থাকতাম না? সাত আট বছর বয়েস পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। সেখানেই বাংলা শিখেছি। আমরা কিন্তু বাঙালি নই। আমার পুরো নাম রাধা গোমেজ। আমার মাও বাংলা জানতেন।
তোমরা কলকাতায় কোথায় থাকতে?
খিদিরপুর বলে একটা জায়গা আছে না? সেইখানে। আমার এক মামাতো দাদার সঙ্গে সন্তুদাদা এক ইস্কুলে পড়ত। সন্তুদাদা একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিল সেই দাদার সঙ্গে। সন্তুদাদাকে আমি সেই একবারই মোটে দেখেছি।
তুমি আমাকেও তখন দেখেছিলে?
না, আপনাকে কক্ষনও দেখিনি। আপনাকে চিনেছি বই পড়ে। সবুজ দ্বীপের রাজা বইটা কতবার যে পড়েছি তার ঠিক নেই। সন্তুদাদা আর আপনার সব অভিযানের কথা আমি পড়েছি।
বেশ। কিন্তু রাধা বলো তো, আমি যে এখানে এই হোটেলে আছি, তা তুমি জানলে কী করে?
আমি এসেছি বলে আপনি রাগ করেছেন, কাকাবাবু?
না, না, মোটেই রাগ করিনি। তোমার মতন এমন একটা ফুটফুটে মেয়েকে দেখলে কি রাগ করা যায়? তবে অবাক হয়েছি। এই হোটেলে আমার থাকার কথা তোমাকে কে বলল?
রাধা একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তার হাসিমাখা ঝলমলে মুখোনা করুণ হয়ে গেল। ছলছল করে উঠল চোখ দুটি।
হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে সে বলল, আমার বাবা আপনাকে মেরে ফেলবে!
কাকাবাবু দারুণ চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ, কী বললে!
রাধা আবার বলল, আমার বাবা গুণ্ডাদের সর্দার। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব লোকেরা বাবার অনুচর। তারা বলেছে। আপনাকে মেরে ফেলবে!
কাকাবাবু এবারে একটু হেসে বললেন, তুমি বুঝি গল্প বানাতে ভালবাস, রাধা?
রাধা চোখ বড়-বড় করে বলল, না, গল্প নয়, সত্যি, আপনি বিশ্বাস করুন। আমি নিজের কানে শুনেছি, ওরা বলেছে, রাজা রায়চৌধুরীকে সরিয়ে দিতে হবে!
কাকাবাবু বললেন, তোমার বাবা কে? তার নাম কী?
রাধা বলল, পিটার গোমেজ। আগে ভাল ছিল, এখন খারাপ হয়ে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, সব ব্যাপারটা খুলে বলো তো। তুমি কোথায় ওকথা শুনলে, কী করে শুনলে? তুমি তো হস্টেলে থাকো?
রাধা বলল, আমি হস্টেলে থাকি। শনিবার বিকেলে নিজেদের বাড়িতে যাই। ভিমানিপতনম কোথায় জানেন? অনেকটা দূরে, সেই যেখানে ডাচদের ভাঙা দুর্গ আর লাইট হাউস আছে, সেখানে আমাদের মস্ত বড় বাড়ি। আমার বাবা আগে একটা জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিল, তখন আমরা কত ভাল ছিলাম, কত জায়গায় বেড়িয়েছি। তারপর কীজন্য যেন বাবার চাকরি চলে গেল। ছ মাসের জন্য জেল খেটেছিল। কী জন্য, তা আমি জানি না। সেই সময় আমার মাও মনের দুঃখে মরে গেল।
কাকাবাবু বললেন, ইস। কত বছর আগে?
রাধা বলল, ঠিক সাড়ে ছ বছর। আমার তখন সাত বছর বয়েস। সব মনে আছে। তখন আমরা কলকাতাতেই থাকতাম। জেল থেকে বেরুবার কিছুদিন পর বাবা এখানে চলে এসে মাছের ব্যবসা শুরু করল। তারপরই আমার নতুন মা এল।
কাকাবাবু বললেন, তোমার বাবা আবার বিয়ে করেছেন? রাধা বলল, হ্যাঁ। এই নতুন মা আসার পরই বাবা একদম বদলে যায়। হঠাৎ খুব বড়লোক হয়ে গেছে। এখন আমাদের তিনখানা গাড়ি। মাছের ব্যবসা নয়, বাবার দলের লোকেরা স্মাগলিং করে, আমি সব জানি।
কাকাবাবু বললেন, তুমি কী করে জানলে, সেটা এবার বলো তো!
রাধা বলল, আমার আর কোনও ভাইবোন নেই। নতুন মায়েরও ছেলেমেয়ে নেই। বাবা আমাকে খুব ভালবাসে। প্রত্যেক শনিবার গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে হস্টেল থেকে বাড়িতে নিয়ে যায়। নতুন মা কিন্তু আমাকে তেমন পছন্দ করে না। তাই বাবার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলাও হয় না। আমি খুব বই পড়ি। বই পড়তেই সবচেয়ে ভালবাসি। বাংলা, ইংরিজি, তেলুগু সবরকম বই পড়ি। বই পড়তে-পড়তে অনেক রাত হয়ে যায়। তখন আমি টের পাই, গভীর রাতে চুপিচুপি বাবার কাছে অনেক লোক আসে। আমাদের বাড়ির মাটির নীচে সুড়ঙ্গ আছে। দু-তিনটে ঘর আছে। ডাচদের আমলের পুরনো বাড়ি সারিয়ে নেওয়া হয়েছে তো, ওদের ওরকম থাকত। আমি এক-একদিন পা টিপে টিপে গিয়ে দরজায় কান পেতে শুনেছি। সেই দলের মধ্যে আমার নতুন। মাও থাকে। ওরা স্মাগলিংয়ের কথা বলে, মানুষ খুন করার কথা বলে। শুনতে-শুনতে ভয়ে আমার বুক কাঁপে, তবু না গিয়েও পারি না। একদিন ঝাণ্ডু নামে একটা লোক আমাকে দেখে ফেলেছিল। বাবার দলের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে নিষ্ঠুর। সে বাবাকে কিছু বলেনি। গত রবিবার সেখানেই আমি শুনলাম, ঝাণ্ডু দাঁত কিড়মিড় করে বলছে, পার্ক হোটেলে রাজা রায়চৌধুরী উঠেছে, তাকে সরিয়ে দিতে হবে। ও এখানে এসেছে কেন? বাবাও বলল, হ্যাঁ, রাজা রায়চৌধুরীকে সরিয়ে দিতে হবে। ও একটা পথের কাঁটা। কাকাবাবু, সরিয়ে দেওয়া মানে কী? মেরে ফেলা নয়?
কাকাবাবু হালকাভাবে বললেন, সরিয়ে দিতে চাইলেই কি সরিয়ে দেওয়া যায়?
রাধা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, ওরা সাঙ্ঘাতিক লোক। আগেও মানুষ মেরেছে। ঘণ্টে নামে অন্য দলের একটা স্মাগলারকে ওরাই খুন করেছে আমি জানি। ওরা যদি আপনাকে মেরে ফেলে আমি কী করে সহ্য করব? আমি মনে-মনে আপনাকে পুজো করি। সন্তুদাদাকে কত ভালবাসি…।
কাকাবাবু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, এ কী, তুমি কাঁদছ কেন? চোখ মুছে ফেলল, তোমার ভয় নেই, আমাকে কেউ মারতে পারবে না।
একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে রাধা মুখ তুলে বলল, আপনাকে মারতে পারবে না, তাই না?
কাকাবাবু বললেন, নাঃ। পারবে না।
রাধা বলল, তা হলে আপনি আমার বাবাকে মেরে ফেলবেন?
কাবাবু বললেন, আরে না, না, আমি মারতে যাব কেন?
রাধা বলল, আমি জানি, আপনাকে কেউ হারাতে পারে না। আপনার শত্রুরাই শেষপর্যন্ত হেরে যায়। তারাই মরে যায় কিংবা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। আমার বাবা খুব বেপরোয়া, ধরা দেবে না, আপনার হাতেই মরবে। বাবা মরে গেলে নতুন মা আমাকে খুব কষ্ট দেবে।
কাকাবাবু বললেন, তোমার বাবাকে আমি কিছুতেই মারব না, এই তোমাকে কথা দিলাম, রাধা।
রাধা বলল, আমার ভয় করে, সবসময় ভয় করে। আমার বাবা কেন এইরকম হয়ে গেল! কাকাবাবু, আপনি আর এখানে থাকবেন না। কলকাতায় ফিরে যান। এই স্মাগলাররা সাঙ্ঘাতিক লোক। আমি জানি, বাবাদের দল ছাড়াও আর একটা দল আছে। এই দুই দলে খুব রেষারেষি। এরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। আর এই দুই দলই মনে করে, আপনি তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এখানে এসেছেন। পুলিশ যা পারে না, আপনি তাই পারেন।
কাকাবাবু বললেন, কী মুশকিল, সবাই যে কেন একথা ভাবছে! আমি মোটেই সেজন্য আসিনি। স্মাগলার-টাগলারদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
একবার শুধু আন্দামানে একটা ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলাম, সেটা ওদেরই দোষ!
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, কী দুঃখের কথা। তোমার বয়সী একটি মেয়ে এখন পড়াশুনো করবে, গান গাইবে, ছবি আঁকবে, খেলাধুলো করবে। সাঁতার কাটবে, নিজেকে নিয়ে মশগুল হয়ে থাকবে, এইসবই তো স্বাভাবিক। তা নয়, খুন, স্মাগলিং এসব কথা তোমার মুখে শুনতেও খারাপ লাগছে!
রাধা বলল, ওই ঝাণ্ডু কী বলে জানেন তো? ও বলে একটু বড় হলে আমাকেও ওদের দলে নিয়ে নেবে, আমার নতুন মায়ের মতন। আমি অবশ্য ঠিক করেছি, ইস্কুলের পড়া শেষ হলেই কলকাতা চলে যাব। ওখানে কলেজে পড়ব।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তুমি কলকাতায় চলে এলে আমরা তোমার দেখাশুনো করব। তুমি একটু বসো তো রাধা, আমি বাথরুমে দাঁতটা মেজে আসি।
টুথব্রাশে টুথপেস্ট লাগাতে-লাগাতে কাকাবাবু আপন মনে হাসলেন। কী অদ্ভুত যোগাযোগ! তিনি ঠিক করেছিলেন, স্মাগলিং নিয়ে মাথা না ঘামালেও যারা তাঁকে জেলে ভরার ব্যবস্থা করেছিল, আর ছুরি মারার জন্য ঘাতক পাঠিয়েছিল, তাদের পাণ্ডাকে খুঁজে বার করে তিনি শাস্তি দেবেনই। কিন্তু সেই দলের পাণ্ডাকে খুঁজতেই হল না। তার নাম-ধাম সবই জানা গেল। সেই পিটার গোমেজ এই রাধার মতন একটি সরল, সুন্দর মেয়ের বাবা। পিটার গোমেজকে শাস্তি দিলে রাধাও কষ্ট পাবে খুব। বাবার দোষে কি মেয়েকে শাস্তি দেওয়া যায়?
নাঃ, পুলিশ যা পারে করুক, তিনি আর এর মধ্যে থাকবেন না।
বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখলেন, রাধা একটা ইতিহাসের বই পড়ছে মন দিয়ে। বইটা কাকাবাবু সঙ্গে এনেছেন।
কাকাবাবু বললেন, রাধা, আমি এখান থেকে আজই চলে যাব ঠিক করলাম। তা হলে তোমার বাবার দলের কেউ আমার ধরা-ছোঁয়া পাবে না। আমার দিক থেকেও তোমার বাবার কোনও বিপদ হবে না। রাধা হাততালি দিয়ে বলল, সেই ভাল, সেই ভাল।
কাকাবাবু বললেন, এখন তুমি আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবে। হোটেলে একা-একা খেতে আমার ভাল লাগে না। তারপর আমি তোমাকে হস্টেলে পৌঁছে দেব।
রাধা বলল, আমি নিজেই যেতে পারব, পৌঁছে দিতে হবে না।
কাকাবাবু বললেন, তোমার জন্য আমার চিন্তা হচ্ছে। তুমি যে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ, এটা যদি ওরা টের পেয়ে যায়? রাধা, তুমি খুব সাবধানে থাকবে। হস্টেল থেকে এক পাও বেরোবে না এখন কিছুদিন। মন দিয়ে পড়াশুনো করবে, স্মাগলিং টাগলিং নিয়ে একদম চিন্তা করবে না।
নীচের রেস্তরাঁয় না গিয়ে কাকাবাবু রুম সার্ভিসে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিলেন।
ফলের রস, কর্ন ফ্লেক্স, টোস্ট, ওমলেট, সসেজ এসে গেল একটু পরেই। রাধা অনেকখানি ভুরু তুলে বলল, ওমা, এত খাবার?
কাকাবাবু বললেন, তুমি আমার অতিথি, তোমাকে তো খাতির করতেই হবে।
রাধা বলল, আমাদের হস্টেলে ভাল খাবার দেয়। কিন্তু আমার খেতেই ইচ্ছে করে না। বাড়ির কথা ভাবলেই আমার মনখারাপ হয়ে যায়।
কাকাবাবু বললেন, তুমি শিগগিরই বড় হয়ে উঠবে। তখন নিজের ইচ্ছেমতন জীবনটা গড়ে তুলবে।
ছুরিকাঁটা হাতে নিয়ে রাধা কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার সামনে বসে কোনওদিন খাব, এ-কথা কল্পনাও করিনি। আপনি তো আমার স্বপ্নের মানুষ। আচ্ছা, সন্তুদাদা কেন এল না?
কাকাবাবু বললেন, সন্তুর এখন পরীক্ষা চলছে, তাই সঙ্গে আনিনি।
আচ্ছা রাধা, তুমি ছেলেবেলা বাংলা শিখেছিলে, এখনও মনে রেখেছ কী করে?
আমি যে বই পড়ি! এখানে আমাদের স্কুলে দুটি বাঙালি মেয়ে আছে তাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলি, তাদের কাছ থেকে বই চেয়ে নিই। এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে ভাল লাগে বই পড়তে। বই আমার একমাত্র বন্ধু।
আচ্ছা, তুমি কীরকম বাংলা পড়ো, একটু পরীক্ষা নিই তো! বলল, এটা কার লেখা?
আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি…
এটা তো কবিতা। আমি কবিতা বেশি পড়িনি।
কবিতা না পড়লে কিন্তু কোনও ভাষা ভাল করে শেখাই যায় না। কবিতা পড়লে কল্পনাশক্তি বাড়ে। আচ্ছা, তুমি যখের ধন পড়েছ?
হ্যাঁ, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা। কাকাবাবু, আপনি আমাকে বাচ্চা ভাবছেন নাকি? আমি ওর চেয়ে বড়দের বই পড়েছি।
যেমন?
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক। খুব চমৎকার। বইটা আমার আছে। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, এই তো সেদিন পড়লাম বিমল করের একটা বই, আর মতি নন্দীর কোনি কী ভাল লেগেছে!
খেতে-খেতে গল্প চলতে লাগল, ইংরেজি বইও বেশ কয়েকটা পড়েছে। রাধা।
কাকাবাবু ওকে মবি ডিক-এর গল্পটা শোনালেন।
খাবার শেষ হতে কাকাবাবু বললেন, তুমি যেমন বই ভালবাস, আমিও তেমনই ভালবাসি। দেখলে তো, বইয়ের কথা বলার সময় চোর, ডাকাত, খুনিদের কথা আমাদের একবারও মনে পড়েনি!
উঠে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু বললেন, চলো, তোমার হস্টেলটা দেখে আসা যাক।
হোটেলের গেটের কাছেই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। সতর্কভাবে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে কাকাবাবু একটা ট্যাক্সিতে উঠলেন, সেটা চলল সমুদ্রের ধার দিয়ে।
এই বেলাভূমির নাম দেওয়া হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ বিচ। এখন এখানে অনেক লোকজন। এই বেলাভূমিতে অবশ্য কেউ স্নান করে না, প্রচুর এবড়োখেবড়ো পাথর রয়েছে, জলে নামা বিপজ্জনক।
খানিকদূর যাওয়ার পর ট্যাক্সি ঢুকে গেল শহরের দিকে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যে এতক্ষণ বাইরে রইলে, তোমায় কেউ কিছু বলবে না?
রাধা মুচকি হেসে বলল, একটু বকুনি দিতে পারে। বেশি না।
কাকাবাবু বললেন, আর এরকম বেরিয়ো না। সাবধানে থাকবে।
হস্টেলটা প্রায় একটা মাঠের মধ্যে। চারদিক ফাঁকা। বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায়, বেশ বড়লোকের মেয়েরাই শুধু এখানে থাকতে পারে। গেটের কাছে রয়েছে বন্দুকধারী দরোয়ান।
কাকাবাবু রাধার হাত ছুঁয়ে আবার বললেন, খুব সাবধানে থাকবে কিন্তু।
রাধা বলল, আপনিও তাই থাকবেন।
ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে নিয়ে কাকাবাবু বললেন, সমুদ্রের ধার দিয়েই আবার হোটেলে ফিরে চলো।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে কাকাবাবুর মনে হল, এই বঙ্গোপসাগরেরই এক প্রান্তে শ্রীলঙ্কা, আগে যে দেশের নাম ছিল সিংহল বা সিলোন। এখন সেখানে সরকারি সৈন্যদের সঙ্গে জঙ্গি তামিলদের মারামারি কাটাকাটি চলছে। ওই জঙ্গিরা এ-দেশের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে অকারণে মেরে ফেলল, তবু একদল লোক ওদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। পৃথিবীর যেখানেই যুদ্ধ চলুক, একদল লোক সেখানে অস্ত্র পাঠিয়ে বড়লোক হতে চায়। কত মানুষ যে মরে, তা তারা গ্রাহ্যও করে না!
হোটেলে ফিরে কাকাবাবু লবিতে একটা কাচের ঘরে ঢুকে অধ্যাপক ভার্গবের বাড়িতে ফোন করলেন।
ভার্গব ফোন ধরতে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন? আর কোনও হামলা হয়নি তো?
ভার্গবের গলার স্বর খুব মিনমিনে। তিনি ক্লান্তভাবে বললেন, না, হামলা হয়নি, পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু ওরা আবার ভয় দেখিয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? কী করে ভয় দেখাল?
ভার্গব বললেন, টেলিফোনে। একজন খুব বিশ্রী ভাষায় গালাগালি দিয়ে বলল, বাঁচতে চাস তো কনাটকে ফিরে যা। এখানে থাকলে পুলিশও তোকে বাঁচাতে পারবে না! এইরকম ভাষা শুনলেই আমার বুক কাঁপে। ভাবছি, ব্যাঙ্গালোরেই চলে যাব। সেখানে গিয়ে কিছুদিন থাকব।
কাকাবাবু বললেন, আর একটা কাজ করা যায়। আমরা আরাকু ভ্যালিতে চলে যেতে পারি। সেখানে তো এসব উপদ্রব থাকবে না। আজই গেলে কেমন হয়?
ভার্গব টেনে-টেনে বললেন, রায়চৌধুরী, তা বোধ হয় আমি পারব না। মনের জোর পাচ্ছি না। ব্যাঙ্গালোরে চলে যাওয়াই এখন আমার পক্ষে ভাল মনে হয়। প্লেনের টিকিট পেলেই চলে যাব।
কাকাবাবু একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তা হলে আমি কি একলাই ঘুরে আসতে পারি? আমিও আর ভাইজাগে থাকতে চাই না। ওখানে কটা দিন নিরিবিলিতে কাটাব, গুহার মধ্যে মূর্তিগুলো দেখে আসব।
ভার্গব বললেন, তা যেতে পারেন। আপনার কাছে যে ম্যাপটা পাঠিয়েছি, সেটা দেখে আপনার খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না। আমি তো মাস চারেক সেখানে যাইনি, আপনি গিয়ে দেখে আসুন মূর্তিগুলো কী অবস্থায় আছে।
ফোন রেখে দিয়ে কাকাবাবু তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নিজের বেশিরভাগ জিনিসপত্র রেখে দিতে বললেন হোটেলের। লকারে। একটা ব্যাগে দু-একটা জামা-প্যান্ট গুছিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করে দিলেন।