এ জাহাজ কি আশ্চার্য ব্যাপার! যে সমুদ্র—ডাঙা থেকে চাইলে ভয় হয়, যাঁর মাঝখানে আকাশটা নুয়ে এসে মিলে গেছে বোধ হয়, যাঁর গর্ভ হতে সূর্যমামা ধীরে ধীরে উঠেন আবার ডুবে যান, যাঁর একটু ভ্রূভঙ্গে প্রাণ থরহরি, তিনি হয়ে দাঁড়ালেন রাজপথ, সকলের চেয়ে সস্তা পথ! এ জাহাজ করলে কে? কেউ করেনি; অর্থাৎ মানুষের প্রধান সহায়স্বরূপ যে সকল কলকব্জা আছে, যা নইলে একদণ্ড চলে না, যার ওলটপালটে আর সব কলকারখানার সৃষ্টি, তাদের ন্যায়—সকলে মিলে করেছে। যেমন চাকা; চাকা নইলে কি কোন কাজ চলে? হ্যাঁকচ হোঁকচ গরুর গাড়ী থেকে ‘জয় জগন্নাথে’র রথ পর্যন্ত, সূতো-কাটা চরকা থেকে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কারখানার কল পর্যন্ত কিছু চলে? এ চাকা প্রথম করলে কে? কেউ করেনি, অর্থাৎ সকলে মিলে করেছে। প্রাথমিক মানুষ কুড়ুল দিয়ে কাঠ কাটছে, বড় বড় গুঁড়ি ঢালু জায়গায় গড়িয়ে আনছে, ক্রমে তাকে কেটে নিরেট চাকা তৈরী হল, ক্রমে অরা নাভি ইত্যাদি ইত্যাদি—আমাদের চাকা। কত লাখ বৎসর লেগেছিল কে জানে? তবে এ ভারতবর্ষ যা হয়, তা থেকে যায়। তার যত উন্নতি হোক না কেন, যত পরিবর্তন হোক না কেন, নীচের ধাপগুলিতে ওঠবার লোক কোথা না কোথা থেকে এসে জোটে, আর সব ধাপগুলি রয়ে যায়। একটা বাঁশের গায়ে একটা তার বেঁধে বাজনা হল; তার ক্রমে একটা বালাঞ্চির ছড়ি দিয়ে প্রথম বেহালা হল, ক্রমে কত রূপ বদল হল, কত তার হল, তাঁত হল, ছড়ির নাম রূপ বদলাল, এসরাজ সারঙ্গি হলেন। কিন্তু এখনও কি গাড়োয়ান মিঞারা ঘোড়ার গাছকতক বালাঞ্চি নিয়ে একটা ভাঁড়ের মধ্যে বাঁশের চোঙ বসিয়ে ক্যাঁকো করে ‘মজওয়ার কাহারের’ জাল বুনবার বৃত্তান্ত৯ জাহির করে না? মধ্যপ্রদেশে দেখগে, এখনও নিরেট চাকা গড়গড়িয়ে যাচ্ছে! তবে সেটা নিরেট বুদ্ধির পরিচয় বটে, বিশেষ এ রবার-টায়ারের দিনে।
অনেক পুরাণকালের মানুষ, অর্থাৎ সত্যযুগের যখন আপামর সাধারণ এমনি সত্যনিষ্ট ছিলেন যে, পাছে ভেতরে একখান ও বাহিরে আর একখান হয় বলে কাপড় পর্যন্ত পরতেন না। পাছে স্বার্থপরতা আসে বলে বিবাহ করতেন না; এবং ভেদবুদ্ধিরহিত হয়ে কোঁৎকা লোড়া-লুড়ির সহায়ে সর্বদাই ‘পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ’ বোধ করতেন; তখন জলে বিচরণ করবার জন্য তাঁরা গাছের মাঝখানটা পুড়িয়ে ফেলে অথবা দু-চারখানা গুঁড়ি একত্রে বেঁধে সালতি ভেলা ইত্যাদির সৃষ্টি করেন। উড়িষ্যা হতে কলম্বো পর্যন্ত কট্টুমারন (Catamaran) দেখেছ তো? ভেলা কেমন সমুদ্রেও দূর দূর পর্যন্ত চলে যায় দেখেছ তো? উনিই হলেন— ‘ঊর্ধ্বমূলম্’।
আর ঐ যে বাঙ্গাল মাঝির নৌকা—যাতে চড়ে দরিয়ার পাঁচ পীরকে ডাকতে হয়; ঐ যে চাটগেঁয়ে-মাঝি-অধিষ্ঠিত বজরা—যা একটু হাওয়া উঠলেই হালে পানি পায় না এবং যাত্রীদের আপন আপন ‘দ্যাব্তার নাম নিতে বলে; ঐ যে পশ্চিমে ভড়—যার গায়ে নানা চিত্রবিচিত্র-আঁকা পেতলের চোক দেওয়া, দাঁড়ীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড় টানে, ঐ যে শ্রীমন্ত সদাগরের নৌকা (কবিকঙ্কণের মতে শ্রীমন্ত দাঁড়ের জোরেই বঙ্গোপসাগর পার হয়েছিলেন এবং গলদা চিঙড়ির গোঁপের মধ্যে পড়ে, কিস্তি বানচাল হয়ে ডুবে যাবার যোগাড় হয়েছিলেন; তথাপি কড়ি দেখে পুঁটিমাছ ঠাউরেছিলেন ইত্যাদি) ওরফে গঙ্গাসাগুরে ডিঙি—উপরে সুন্দর ছাওয়া, নীচে বাঁশের পাটাতন, ভেতরে সারি সারি গঙ্গাজলের জালা (যাতে ‘মেতুয়া গঙ্গাসাগর’—থুড়ি, তোমরা গঙ্গাসাগর যাও আর কনকনে উত্তরে হাওয়ার গুঁতোয় ‘ডাব নারিকেল চিনির পানা’ খাও না); ঐ যে পানসি নৌকা, বাবুদের আপিস নিয়ে যায় আর বাড়ী আনে, বালির মাঝি যার নায়ক, বড় মজবুত, ভারি ওস্তাদ—কোন্নগুরে মেঘ দেখেছে কি কিস্তি সামলাচ্চে, এক্ষণে যা জওয়ানপুরিয়া জওয়ানের দখলে চলে যাচ্চে (যাদের বুলি—‘আইলা গাইলা বানে বানি’, যাদের ওপর তোমাদের মহন্ত মহারাজের ‘বঘাসুর’ ধরে আনতে হুকুম হয়েছিল, যারা ভেবেই আকুল—‘এ স্বামিনাথ! এ বঘাসুর কঁহা মিলেব? ইত হাম জানব না’)। ঐ যে গাধাবোট—যিনি সোজাসুজি যেতে জানেনই না, ঐ যে হুড়ি, এক থেকে তিন মাস্তুল—লঙ্কা, মালদ্বীপ বা আরব থেকে নারকেল, খেজুর, শুঁটকি মাছ ইত্যাদি বোঝাই হয়ে আসে; আর কত বলব, ওরা সব হলেন—‘অধঃশাখা প্রশাখা।’
পালভরে জাহাজ চালান একটি আশ্চর্য আবিষ্ক্রিয়া। হাওয়া যে দিকে যাক না কেন, জাহাজ আপনার গম্যস্থানে পৌঁছবেই পৌঁছবে। তবে হাওয়া বিপক্ষ হলে একটু দেরী। পালওয়ালা জাহাজ কেমন দেখতে সুন্দর, দূরে বোধ হয়, যেন বহুপক্ষবিশিষ্ট পক্ষিরাজ আকাশ থেকে নামছেন। পালের জাহাজ কিন্তু সোজা চলতে বড় পারেন না; হাওয়া একটু বিপক্ষ হলেই এঁকে বেঁকে চলতে হয়, তবে হাওয়া একেবারে বন্ধ হলেই মুশকিল—পাখা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। মহা-বিষুবরেখার নিকটবর্তী দেশসমূহে এখনও মাঝে মাঝে এইরূপ হয়। এখন পাল-জাহাজেও কাঠ-কাঠরা কম, তিনিও লৌহনির্মিত। পাল-জাহাজের কাপ্তানি করা ষ্টীমার অপেক্ষা অনেক শক্ত, এবং পাল-জাহাজে অভিজ্ঞতা না থাকলে ভাল কাপ্তান কখনও হয় না। প্রতি পদে হাওয়া চেনা, অনেক দূর থেকে সঙ্কট জায়গার জন্য হুঁশিয়ার হওয়া, ষ্টীমার অপেক্ষা এ দুটি জিনিষ পাল-জাহাজে অত্যাবশ্যক। ষ্টীমার অনেকটা হাতের মধ্যে, কল মুহূর্তমধ্যে বন্ধ করা যায়। সামনে পিছনে যেমন ইচ্ছা অল্প সময়ের মধ্যে ফিরানো যায়। পাল-জাহাজ হাওয়ার হাতে। পাল খুলতে, বন্ধ করতে, হাল ফেরাতে হয়তো জাহাজ চড়ায় লেগে যেতে পারে, ডুবো পাহাড়ের উপর চড়ে যেতে পারে, অথবা অন্য জাহাজের সহিত ধাক্কা লাগতে পারে। এখন আর যাত্রী বড় পাল-জাহাজে যায় না, কুলী ছাড়া। পাল-জাহাজ প্রায় মাল নিয়ে যায়, তাও নুন প্রভৃতি খেলো মাল। ছোট ছোট পাল-জাহাজ, যেমন হুড়ি প্রভৃতি, কিনারায় বাণিজ্য করে। সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে টানবার জন্য ষ্টীমার ভাড়া করে হাজার হাজার টাকা টেক্স দিয়ে পাল-জাহাজের পোষায় না। পাল-জাহাজ আফ্রিকা ঘুরে ছ-মাসে ইংলণ্ডে যায়। পাল-জাহাজের এই সকল বাধার জন্য তখনকার জল-যুদ্ধ সঙ্কটের ছিল। একটু হাওয়ার এদিক ওদিক, একটু সমুদ্র-স্রোতের এদিক ওদিকে হার জিত হয়ে যেত। আবার সে-সকল জাহাজ কাঠের ছিল। যুদ্ধের সময় ক্রমাগত আগুন লাগত, আর সে আগুন নিবুতে হত। সে জাহাজের গঠনও আর একরকমের ছিল। একদিক ছিল চেপ্টা আর অনেক উঁচু, পাঁচ-তলা ছ-তলা। যেদিকটা চেপ্টা, তারই উপর তলায় একটা কাঠের বারান্দা বার করা থাকত। তারই সামনে কমাণ্ডারের ঘর—বৈঠক। আশে পাশে অফিসারদের। তারপর একটা মস্ত ছাত—উপর খোলা। ছাতের ওপাশে আবার দু-চারটি ঘর। নীচের তলায়ও ঐ রকম ঢাকা দালান, তার নীচেও দালান; তার নীচে দালান এবং মাল্লাদের শোবার স্থান, খাবার স্থান ইত্যাদি। প্রত্যেক তলার দালানের দু-পাশে তোপ বসানো, সারি সারি দ্যালের গায়ে কাটা, তার মধ্যে দিয়ে তোপের মুখ—দু-পাশে রাশীকৃত গোলা (আর যুদ্ধের সময় বারুদের থলে)। তখনকার যুদ্ধ-জাহাজের প্রত্যেক তলাই বড় নীচু ছিল; মাথা হেঁট করে চলতে হত। তখন নৌ-যোদ্ধা যোগাড় করতেও অনেক কষ্ট পেতে হত। সরকারের হুকুম ছিল যে, যেখান থেকে পার ধরে, বেঁধে, ভুলিয়ে লোক নিয়ে যাও। মায়ের কাছ থেকে ছেলে, স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামী—জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যেত। একবার জাহাজে তুলতে পারলে হয়, তারপর—বেচারা কখনও হয়তো জাহাজে চড়েনি—একেবারে হুকুম হল, মাস্তুলে ওঠ। ভয় পেয়ে হুকুম না শুনলেই চাবুক। কতক মরেও যেত। আইন করলেন আমীরেরা, দেশ-দেশান্তরের বাণিজ্য লুটপাট করবার জন্য; রাজস্ব ভোগ করবেন তাঁরা, আর গরীবদের খালি রক্তপাত, শরীরপাত, যা চিরকাল এ পৃথিবীতে হয়ে আসছে!! এখন ও-সব আইন নেই, এখন আর ‘প্রেস গ্যাঙ্গের’ নামে চাষা-ভুষোর হৃৎকম্প হয় না। এখন খুশীর সওদা; তবে অনেকগুলি চোর-ছ্যাঁচড় ছোঁড়াকে জেলে না দিয়ে এই যুদ্ধ-জাহাজে নাবিকের কর্ম শেখানো হয়।
বাষ্পবল এ সমস্তই বদলে ফেলেছে। এখন ‘পাল’—জাহাজে অনাবশ্যক বাহার। হাওয়ার সহায়তায় উপর নির্ভর বড়ই অল্প। ঝড়-ঝাপটার ভয়ও অনেক কম। কেবল জাহাজ না পাহাড়-পর্বতে ধাক্কা খায়, এই বাঁচাতে হয়। যুদ্ধ-জাহাজ তো একেবারে পূর্বের অবস্থার সঙ্গে বিলকুল পৃথক্। দেখে তো জাহাজ বলে মনেই হয় না। এক একটি ছোট বড় ভাসন্ত লোহার কেল্লা। তোপও সংখ্যায় অনেক কমে গেছে। তবে এখনকার কলের তোপের কাছে সে প্রাচীন তোপ ছেলেখেলা বৈ তো নয়। আর এ যুদ্ধ-জাহাজের বেগই বা কি! সব চেয়ে ছোটগুলি ‘টরপিডো’ ছুঁড়বার জন্য, তার চেয়ে একটু বড়গুলি শত্রুর বাণিজ্যপোত দখল করতে, আর বড়-বড়গুলি হচ্ছেন বিরাট যুদ্ধের আয়োজন।
আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেট্সের সিভিল ওয়ারের সময়, ঐকরাজ্যপক্ষেরা১০ একখান কাঠের জঙ্গি জাহাজের গায় কতকগুলো লোহার রেল সারি সারি বেঁধে ছেয়ে দিয়েছিল। বিপক্ষের গোলা তার গায়ে লেগে, ফিরে যেতে লাগল, জাহাজের কিছুই বড় করতে পারলে না। তখন মতলব করে, জাহাজের গা লোহা দিয়ে জোড়া হতে লাগল, যাতে দুষমনের গোলা কাষ্ঠ ভেদ না করে। এদিকে জাহাজি তোপেরও তালিম বাড়তে চলল—তা-বড় তা-বড় তোপ; তোপ—যাতে আর হাতে সরাতে, হটাতে, ঠাসতে, ছুঁড়তে হয় না, সব কলে হয়। পাঁচ-শ লোক যাকে একটুকুও হেলাতে পারে না, এমন তোপ, এখন একটা ছোট ছেলে কল টিপে যে দিকে ইচ্ছে মুখ ফেরাচ্চে, নাবাচ্চে ও ঠাসছে, ভরছে, আওয়াজ করছে—আবার তাও চকিতের ন্যায়! যেমন জাহাজের লোহার দ্যাল মোটা হতে লাগল, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে বজ্রভেদী তোপেরও সৃষ্টি হতে চলল। এখন জাহাজখানি ইস্পাতের দ্যালওয়ালা কেল্লা, আর তোপগুলি যমের ছোট ভাই। এক গোলার ঘায়ে, যত বড় জাহাজই হন না, ফেটে চুটে চৌ-চাকলা! তবে এই ‘লুয়ার বাসর ঘর’, যা নকিন্দরের বাবা স্বপ্নেও ভাবেনি; এবং যা ‘সাতালি পর্বতের’ ওপর না দাঁড়িয়ে সত্তর হাজার পাহাড়ে ঢেউয়ের মাথায় নেচে নেচে বেড়ায়, ইনিও ‘টরপিডো’র ভয়ে অস্থির। তিনি হচ্ছেন কতকটা চুরুটের চেহারা একটি নল; তাঁকে ত্যাগ করে ছেড়ে দিলে তিনি জলের মধ্যে মাছের মত ডুবে ডুবে চলে যান। তারপর যেখানে লাগবার, সেখানে ধাক্কা যেই লাগা, অমনি তার মধ্যের রাশীকৃত মহাবিস্তারশীল পদার্থসকলের বিকট আওয়াজ ও বিস্ফোরণ, সঙ্গে সঙ্গে যে জাহাজের নীচে এই কীর্তিটা হয়, তার ‘পুনর্মূষিকো ভব’ অর্থাৎ লৌহত্বে ও কাঠকুটোত্বে কতক এবং বাকীটা ধূমত্বে ও অগ্নিত্বে পরিণমন! মনিষ্যিগুলো, যারা এই টরপিডো ফাটবার মুখে পড়ে যায়, তাদেরও যা খুঁজে পাওয়া যায়, তা প্রায় ‘কিমা’তে পরিণত অবস্থায়! এই সকল জঙ্গি জাহাজ তৈয়ার হওয়া অবধি জলযুদ্ধ আর বেশী হতে হয় না। দু-একটা লড়াই আর একটা বড় জঙ্গি ফতে বা একদম হার। তবে এই রকম জাহাজ নিয়ে লড়াই হবার পূর্বে, লোকে যেমন ভাবত যে, দু-পক্ষের কেউ বাঁচবে না, আর একদম সব উড়ে পুড়ে যাবে, তত কিছু হয় না।
ময়দানি জঙ্গের সময়, তোপ বন্দুক থেকে উভয় পক্ষের উপর যে মুষলধারা গোলাগুলি সম্পাত হয়, তার এক হিস্সে যদি লক্ষ্যে লাগে তো উভয় পক্ষের ফৌজ মরে দু- মিনিটে ধুন হয়ে যায়। সেই প্রকার, দরিয়াই জঙ্গের জাহাজের গোলা, যদি ৫০০ আওয়াজের একটা লাগত তো উভয় পক্ষের জাহাজের নাম-নিশানাও থাকত না। আশ্চর্য এই যে, যত তোপ-বন্দুক উৎকর্ষ লাভ করছে, বন্দুকের যত ওজন হাল্কা হচ্ছে, যত নালের কিরকিরার পরিপাটি হচ্ছে, যত পাল্লা বেড়ে যাচ্চে, যত ভরবার ঠাসবার কলকব্জা হচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি আওয়াজ হচ্ছে, ততই যেন গুলি ব্যর্থ হচ্ছে! পুরানো ঢঙের পাঁচ হাত লম্বা তোড়াদার জজেল, যাকে দোঠেঙ্গো কাঠের উপর রেখে, তাগ করতে হয়, এবং ফুঁ ফাঁ দিয়ে আগুন দিতে হয়, তাই-সহায় বারাখজাই, আফ্রিদ আদমী অব্যর্থসন্ধান—আর আধুনিক সুশিক্ষিত ফৌজ, নানা-কল-কারখানা-বিশিষ্ট বন্দুক হাতে, মিনিটে ১৫০ আওয়াজ করে খালি হাওয়া গরম করে! অল্প স্বল্প কলকব্জা ভাল। মেলা কলকব্জা মানুষের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপাপত্তি করে জড়পিণ্ড তৈয়ার করে। কারখানায় লোকগুলো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর, সেই একঘেয়ে কাজই কচ্চে—এক এক দলে এক একটা জিনিষের টুকরোই গড়ছে। পিনের মাথাই গড়ছে, সুতোর জোড়াই দিচ্চে, তাঁতের সঙ্গে এগু-পেছুই কচ্চে—আজন্ম। ফল, ঐ কাজটিও খোয়ানো, আর তার মরণ—খেতেই পায় না। জড়ের মত একঘেয়ে কাজ করতে করতে জড়বৎ হয়ে যায়। স্কুলমাষ্টারি, কেরানীগিরি করে ঐ জন্যই হস্তিমূর্খ জড়পিণ্ড তৈয়ার হয়!
বাণিজ্য-যাত্রী জাহাজের গড়ন অন্য ঢঙের। যদিও কোন কোন বাণিজ্য-জাহাজ এমন ঢঙে তৈয়ার যে, লড়ায়ের সময় অত্যল্প আয়াসেই দু-চারটা তোপ বসিয়ে অন্যান্য নিরস্ত্র পণ্যপোতকে তাড়াহুড়ো দিতে পারে এবং তজ্জন্য ভিন্ন ভিন্ন সরকার হতে সাহায্য পায়, তথাপি সাধারণতঃ সমস্তগুলিই যুদ্ধপোত হতে অনেক তফাত। এ সকল জাহাজ প্রায়ই এখন বাষ্পপোত এবং প্রায় এত বৃহৎ ও এত দাম লাগে যে, কোম্পানী ভিন্ন একলার জাহাজ নাই বললেই হয়। আমাদের দেশের ও ইওরোপের বাণিজ্যে পি. এণ্ড ও. কোম্পানী সকলের অপেক্ষা প্রাচীন ও ধনী; তারপর, বি. আই. এস্. এন্. কোম্পানী; আরও অনেক কোম্পানী আছে। ভিন্ন সরকারের মধ্যে মেসাজারি মারিতীম (Messageries Maritimes) ফরাসী, অষ্ট্রীয়ান লয়েড, জার্মান লয়েড এবং ইতালীয়ান রুবাটিনো কোম্পানী প্রসিদ্ধ। এতন্মধ্যে পি. এণ্ড ও. কোম্পানী যাত্রী-জাহাজ সর্বাপেক্ষা নিরাপদ ও ক্ষিপ্রগামী—লোকের এই ধারণা। মেসাজারির ভক্ষ্য-ভোজ্যের বড়ই পারিপাট্য।
এবার আমরা যখন আসি, তখন ঐ দুই কোম্পানীই প্লেগের ভয়ে কালা আদমী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এবং আমাদের সরকারের একটা আইন আছে যে, যেন কোন কালা আদমী এমিগ্রাণ্ট অফিসের সার্টিফিকেট ভিন্ন বাহিরে না যায়। অর্থাৎ আমি যে স্ব-ইচ্ছায় বিদেশে যাচ্চি, কেউ আমায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোথাও বেচবার জন্য বা কুলী করবার জন্য নিয়ে যাচ্চে না, এইটি তিনি লিখে দিলে তবে জাহাজে আমায় নিলে। এই আইন এতদিন ভদ্র-লোকের বিদেশ যাওয়ার পক্ষে নীরব ছিল, এক্ষণে প্লেগের ভয়ে জেগে উঠেছে; অর্থাৎ যে কেউ ‘নেটিভ’ বাহিরে যাচ্চে, তা যেন সরকার টের পান। তবে আমরা দেশে শুনি, আমাদের ভেতর অমুক ভদ্র জাত, অমুক ছোট জাত; সরকারের কাছে সব ‘নেটিভ’। মহারাজা, রাজা, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—সব এক জাত—‘নেটিভ’। কুলির আইন, কুলীর যে পরীক্ষা, তা সকল ‘নেটিভের’ জন্য—ধন্য ইংরেজ সরকার! একক্ষণের জন্যও তোমার কৃপায় সব ‘নেটিভের’ সঙ্গে সমত্ব বোধ করলেম। বিশেষ, কায়স্থকুলে এ শরীরের পয়দা হওয়ায়, আমি তো চোরের দায়ে ধরা পড়েছি।
এখন সকল জাতির মুখে শুনছি, তাঁরা নাকি পাকা আর্য! তবে পরস্পরের মধ্যে মতভেদ আছে—কেউ চার পো আর্য, কেউ এক ছটাক কম, কেউ আধ কাঁচ্চা! তবে সকলেই আমাদের পোড়া জাতের চেয়ে বড়, এতে একবাক্য! আর শুনি, ওঁরা আর ইংরেজরা নাকি এক জাত, মাসতুতো ভাই; ওঁরা কালা আদমী নন। এ দেশে দয়া করে এসেছেন, ইংরেজের মত। আর বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, মূর্তিপূজা, সতীদাহ, জেনানা পর্দা ইত্যাদি ইত্যাদি—ও-সব ওদের ধর্মে আদৌ নাই। ও-সব ঐ কায়েতফায়েতের বাপ-দাদা করেছে। আর ওঁদের ধর্মটা ঠিক ইংরেজদের ধর্মের মত। ওঁদের বাপ-দাদা ঠিক ইংরেজদের মত ছিল; কেবল রোদ্দুরে বেড়িয়ে বেড়িয়ে কালো হয়ে গেল! এখন এস না এগিয়ে? ‘সব নেটিভ’ সরকার বলছেন। ও কালোর মধ্যে আবার এক পোঁচ কম-বেশী বোঝা যায় না; সরকার বলছেন, সব নেটিভ। সেজেগুজে বসে থাকলে কি হবে বল? ও টুপি-টাপা মাথায় দিয়ে আর কি হবে বল? যত দোষ হিঁদুর ঘাড়ে ফেলে সাহেবের গা ঘেঁষে দাঁড়াতে গেলে, লাথি-ঝাঁটার চোটটা বেশী বৈ কম পড়বে না। ধন্য ইংরেজরাজ! তোমার ধনে-পুত্রে লক্ষী লাভ তো হয়েছেই, আরও হোক, আরও হোক। কপনি, ধুতির টুকরো পরে বাঁচি। তোমার কৃপায় শুধু-পায়ে শুধু-মাথায় হিল্লী দিল্লী যাই, তোমার দয়ায় হাত চুবড়ে সপাসপ দাল-ভাত খাই। দিশি সাহেবিত্ব লুভিয়েছিল আর কি, ভোগা দিয়েছিল আর কি। দিশি কাপড় ছাড়লেই, দিশি ধর্ম ছাড়লেই, দিশি চাল-চলন ছাড়লেই ইংরেজ রাজা মাথায় করে নাকি নাচবে শুনেছিলুম, করতেও যাই আর কি, এমন সময় গোরা পায়ের সবুট লাথির হুড়োহুড়ি, চাবুকের সপাসপ! পালা পালা, সাহেবিতে কাজ নেই, নেটিভ কব্লা। ‘সাধ করে শিখেছিনু সাহেবানি কত, গোরার বুটের তলে সব হৈল হত।’ ধন্য ইংরেজ সরকার! তোমার ‘তখ্ৎ তাজ অচল রাজধানী’ হউক।
আর যা কিছু সাহেব হবার সাধ ছিল, মিটিয়ে দিলে মার্কিন ঠাকুর। দাড়ির জ্বালায় অস্থির, কিন্তু নাপিতের দোকানে ঢোকবামাত্রই বললে ‘ও চেহারা এখানে চলবে না!’ মনে করলুম, বুঝি পাগড়ি-মাথায় গেরুয়া রঙের বিচিত্র ধোকড়া-মন্ত্র গায়, অপরূপ দেখে নাপিতের পছন্দ হল না; তা একটা ইংরেজী কোট আর টোপা কিনে আনি। আনি আর কি—ভাগ্যিস একটি ভদ্র মার্কিনের সঙ্গে দেখা; সে বুঝিয়ে দিলে যে বরং ধোকড়া আছে ভাল, ভদ্রলোকে কিছু বলবে না, কিন্তু ইওরোপী পোষাক পরলেই মুশকিল, সকলেই তাড়া দেবে। আরও দু-একটা নাপিত ঐ প্রকার রাস্তা দেখিয়ে দিলে। তখন নিজের হাতে কামাতে ধরলুম। খিদেয় পেট জ্বলে যায়, খাবার দোকানে গেলুম, ‘অমুক জিনিষটা দাও’; বললে ‘নেই’। ‘ঐ যে রয়েছে।’ ‘ওহে বাপু সাদা ভাষা হচ্চে, তোমার এখানে বসে খাবার জায়গা নেই।’ ‘কেন হে বাপু?’ ‘তোমার সঙ্গে যে খাবে, তার জাত যাবে।’ তখন অনেকটা মার্কিন মুলুককে দেশের মত ভাল লাগতে লাগল। যাক পাপ কালা আর ধলা, আর এই নেটিভের মধ্যে উনি পাঁচ পো আর্য রক্ত, উনি চার পো, উনি দেড় ছটাক কম, ইনি আধ ছটাক, আধ কাঁচ্চা বেশী ইত্যাদি—বলে ‘ছুঁচোর গোলাম চামচিকে, তার মাইনে চোদ্দ সিকে।’ একটা ডোম বলত, ‘আমাদের চেয়ে বড় জাত কি আর দুনিয়ার আছে? আমরা হচ্চি ডম্ম্ম্ম্!’ কিন্তু মজাটি দেখছ? জাতের বেশী বিটলেমিগুলো—যেখানে গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, সেইখানে!
বাষ্পপোত বায়ুপোত অপেক্ষা অনেক বড় হয়। যে সকল বাষ্পপোত আটলাণ্টিক পারাপার করে, তার এক একখান আমাদের এই ‘গোলকোণ্ডা’১১ জাহাজের ঠিক দেড়া। যে জাহাজে করে জাপান হতে পাসিফিক্ পার হওয়া গিয়েছিল, তাও ভারি বড় ছিল। খুব বড় জাহাজের মাঝখানে প্রথম শ্রেণী, দুপাশে খানিকটা জায়গা, তারপর দ্বিতীয় শ্রেণী ও ‘ষ্টীয়ারেজ’ এদিক ওদিকে। আর এক সীমায় খালাসীদের ও চাকরদের স্থান। ষ্টীয়ারেজ যেন তৃতীয় শ্রেণী; তাতে খুব গরীব লোক যায়, যারা আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে উপনিবেশ করতে যাচ্চে। তাদের থাকবার স্থান অতি সামান্য এবং হাতে হাতে আহার দেয়। যে সকল জাহাজ হিন্দুস্থান ও ইংলণ্ডের মধ্যে যাতায়াত করে, তাদের ষ্টীয়ারেজ নাই, তবে ডেকযাত্রী আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে খোলা জায়গা, সেই স্থানটায় তারা বসে শুয়ে যায়। তা দূর-দূরের যাত্রায় তো একটিও দেখলুম না। কেবল ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে চীনদেশে যাবার সময়, বোম্বে থেকে কতকগুলি চীনে লোক বরাবর হংকং পর্যন্ত ডেকে গিয়েছিল।
ঝড়-ঝাপট হলেই ডেকযাত্রীর বড় কষ্ট, আর কতক কষ্ট যখন বন্দরে মাল নাবায়। এক উপরে ‘হরিকেন ডেক’ ছাড়া সব ডেকের মধ্যে একটা করে মস্ত চৌকা কাটা আছে, তারই মধ্য দিয়ে মাল নাবায় এবং তোলে। সেই সময় ডেকযাত্রীর একটু কষ্ট হয়। নতুবা কলকেতা হতে সুয়েজ পর্যন্ত এবং গরমের দিনে ইওরোপেও ডেকে বড় আরাম। যখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীরা তাঁদের সাজান গুজান কামরার মধ্যে গরমের চোটে তরলমূর্তি ধরবার চেষ্টা করছেন, তখন ডেক যেন স্বর্গ। দ্বিতীয় শ্রেণী—এসব জাহাজের বড়ই খারাপ।কেবল এক নূতন জার্মান লয়েড কোম্পানী হয়েছে; জার্মানীর বের্গেন নামক শহর হতে অষ্ট্রেলিয়ায় যায়; তাদের দ্বিতীয় শ্রেণী বড় সুন্দর, এমন কি ‘হরিকেন ডেকে’ পর্যন্ত ঘর আছে এবং খাওয়া-দাওয়া প্রায় গোলকোণ্ডার প্রথম শ্রেণীর মত। সে লাইন কলম্বো ছুঁয়ে যায়। এ গোলকোণ্ডা জাহাজে ‘হরিকেন ডেকে’র উপর কেবল দুটি ঘর আছে; একটি এ পাশে, একটি ও পাশে। একটিতে থাকেন ডাক্তার, আর একটি আমাদের দিয়েছিল। কিন্তু গরমের ভয়ে আমরা নীচের তলায় পালিয়ে এলুম। ঐ ঘরটি জাহাজের ইঞ্জিনের উপর। জাহাজ লোহার হলেও যাত্রীদের কামরাগুলি কাঠের; ওপর নীচে, সে কাঠের দেয়ালে বায়ুসঞ্চারের জন্য অনেকগুলি ছিদ্র থাকে। দ্যালগুলিতে ‘আইভরি পেণ্ট’ লাগানো; এক একটি ঘরে তার জন্য প্রায় পঁচিশ পাউণ্ড খরচ পড়েছে। ঘরের মধ্যে একখানি ছোট কার্পেট পাতা। একটি দ্যালের গায়ে দুটি খুরোহীন লোহার খাটিয়ার মত এঁটে দেওয়া; একটির উপর আর একটি। অপর দ্যালের ঐ রকম একখানি ‘সোফা’। দরজার ঠিক উল্টা দিকে মুখ হাত ধোবার জায়গা, তার উপর একখানি আরশি, দুটো বোতল, খাবার জলের দুটো গ্লাস। ফি-বিছানার গায়ের দিকে একটি করে জালতি পেতলের ফ্রেমে লাগানো। ঐ জালতি ফ্রেম সহিত দ্যালের গায়ে লেগে যায়, আবার টানলে নেবে আসে। রাত্রে যাত্রীদের ঘড়ি প্রভৃতি অত্যাবশ্যক জিনিষপত্র তাইতে রেখে শোয়। নীচে বিছানার নীচে সিন্দুক প্যাঁটরা রাখবার জায়গা। সেকেণ্ড ক্লাসের ভাবও ঐ, তবে স্থান সংকীর্ণ ও জিনিষপত্র খেলো। জাহাজী কারবারটা প্রায় ইংরেজের একচেটে। সে জন্য অন্যান্য জাতেরা যে সকল জাহাজ করেছে, তাতেও ইংরেজযাত্রী অনেক বলে খাওয়া-দাওয়া অনেকটা ইংরেজদের মত করতে হয়। সময়ও ইংরেজী-রকম করে আনতে হয়। ইংলণ্ডে, ফ্রান্সে, জার্মানীতে, রুশিয়াতে খাওয়া-দাওয়ায় এবং সময়ে অনেক পার্থক্য আছে। যেমন আমাদের ভারতবর্ষে—বাঙলায়, হিন্দুস্থানে, মহারাষ্ট্রে, গুজরাতে, মান্দ্রাজে তফাত। কিন্তু এ সকল পার্থক্য জাহাজে অল্প দেখা যায়। ইংরেজীভাষী যাত্রীর সংখ্যাধিক্যে ইংরাজী ঢঙে সব গড়ে যাচ্চে।
বাষ্পপোতে সর্বেসর্বা কর্তা হচ্ছেন ‘কাপ্তেন’। পূর্বে ‘হাই সী’তে১২ কাপ্তেন জাহাজে রাজত্ব করতেন; কাউকে সাজা দিতেন, ডাকাত ধরে ফাঁসি দিতেন, ইত্যাদি। এখন অত নাই, তবে তাঁর হুকুমই আইন—জাহাজে তাঁর নীচে চারজন ‘অফিসার’ বা (দিশী নাম) ‘মালিম’, তারপর চার পাঁচ জন ইঞ্জিনীয়র। তাদের যে ‘চীফ্’, তার পদ অফিসারের সমান, সে প্রথম শ্রেণীতে খেতে পায়। আর আছে চার পাঁচ জন ‘সুকানি’—যারা হাল ধরে থাকে পালাক্রমে, এরাও ইওরোপী। বাকী সমস্ত চাকর-বাকর, খালাসী, কয়লাওয়ালা হচ্ছে দেশী লোক, সকলেই মুসলমান। হিন্দু কেবল বোম্বাইয়ের তরফে দেখেছিলুম, পি. এণ্ড ও. কোম্পানীর জাহাজে। চাকররা এবং খালাসীরা কলকেতার, কয়লাওয়ালারা পূর্ববঙ্গের, রাঁধুনীরাও পূর্ববঙ্গের ক্যাথলিক ক্রিশ্চান। আর আছে চারজন মেথর। কামরা হতে ময়লা জল সাফ প্রভৃতি মেথররা করে, স্নানের বন্দোবস্ত করে, আর পায়খানা প্রভৃতি দুরস্ত রাখে। মুসলমান চাকর-খালাসীরা ক্রিশ্চানের রান্না খায় না; তাতে আবার জাহাজে প্রত্যহ শোর তো আছেই। তবে অনেকটা আড়াল দিয়ে কাজ সারে। জাহাজের রান্নাঘরের তৈয়ারী রুটি প্রভৃতি স্বচ্ছন্দে খায়, এবং যে সকল কলকেত্তাই চাকর নয়া রোশনাই পেয়েছে, তারা আড়ালে খাওয়া-দাওয়া বিচার করে না। লোকজনদের তিনটা ‘মেস’ আছে। একটা চাকরদের, একটা খালাসীদের, একটা কয়লাওয়ালাদের; একজন করে ভাণ্ডারী অর্থাৎ রাঁধুনী আর একটি চাকর কোম্পানী ফি-মেসকে দেয়। ফি-মেসের একটা রাঁধবার স্থান আছে। কলকেতা থেকে কতক হিঁদু ডেকযাত্রী কলম্বোয় যাচ্ছিল; তারা ঐ ঘরে চাকরদের রান্না হয়ে গেলে রেঁধে খেত। চাকরবাকররা জলও নিজেরা তুলে খায়। ফি-ডেকে দ্যালের গায় দুপাশে দুটি ‘পম্প’; একটি নোনা, একটি মিঠে জলের, সেখান হতে মিঠে জল তুলে মুসলমানেরা ব্যবহার করে। যে সকল হিঁদুর কলের জলে আপত্তি নাই, খাওয়া-দাওয়ার সম্পূর্ণ বিচার রক্ষা করে এই সকল জাহাজে বিলাত প্রভৃতি দেশে যাওয়া তাদের অত্যন্ত সোজা। রান্নাঘর পাওয়া যায়, কারুর ছোঁয়া জল খেতে হয় না, স্নানের পর্যন্ত জল অন্য কোন জাতের ছোঁবার আবশ্যক নাই; চাল ডাল শাক পাত মাছ দুধ ঘি সমস্তই জাহাজে পাওয়া যায়, বিশেষ এই সকল জাহাজে দেশী লোক সমস্ত কাজ করে বলে ডাল চাল মূলো কপি আলু প্রভৃতি রোজ রোজ তাদের বার করে দিতে হয়। এক কথা—‘পয়সা’। পয়সা থাকলে একলাই সম্পূর্ণ আচার রক্ষা করে যাওয়া যায়।
এই সকল বাঙালী লোকজন প্রায় আজকাল সব জাহাজে—যেগুলি কলকেতা হতে ইওরোপে যায়। এদের ক্রমে একটা জাত সৃষ্টি হচ্ছে; কতকগুলি জাহাজী পারিভাষিক শব্দেরও সৃষ্টি হচ্ছে। কাপ্তেনকে এরা বলে—‘বাড়ীওয়ালা’, ‘অফিসার’—‘মালিম’, মাস্তুল— ‘ডোল’, পাল—‘সড়’, নামাও—‘আরিয়া’, ওঠাও—‘হাবিস’ (heave) ইত্যাদি।
খালাসীদের এবং কয়লাওয়ালাদের একজন করে সর্দার আছে, তার নাম ‘সারেঙ্গ’, তার নীচে দুই তিন জন ‘টিণ্ডাল’, তারপর খালাসী বা কয়লাওয়ালা।
খানসামাদের (boy) কর্তার নাম ‘বট্লার’ (butler); তার ওপর একজন গোরা ‘ষ্টুয়ার্ড’। খালাসীদের জাহাজ ধোওয়া-পোঁছা, কাছি ফেলা তোলা, নৌকা নামানো ওঠানো, পাল তোলা, পাল নামানো (যদিও বাষ্পপোতে ইহা কদাপি হয়) ইত্যাদি কাজ করে। সারেঙ্গ ও টিণ্ডালরা সর্বদাই সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে, এবং কাজ করছে। কয়লাওয়ালা ইঞ্জিন-ঘরে আগুন ঠিক রাখছে; তাদের কাজ দিনরাত আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা, আর ইঞ্জিন ধুয়ে পুঁছে সাফ রাখা। সে বিরাট ইঞ্জিন, আর তার শাখা-প্রশাখা সাফ রাখা কি সোজা কাজ? ‘সারেঙ্গ’ এবং তার ‘ভাই’ আসিস্টাণ্ট সারেঙ্গ কলকেতার লোক, বাঙলা কয়, অনেকটা ভদ্রলোকের মত; লিখতে পড়তে পারে, স্কুলে পড়েছিল, ইংরেজীও কয়—কাজ চালানো। সারেঙ্গের তের বছরের ছেলে কাপ্তেনের চাকর—দরজায় থাকে আর্দালী। এই সকল বাঙালী খালাসী, কয়লাওয়ালা, খানসামা প্রভৃতির কাজ দেখে, স্বজাতির উপর যে একটা হতাশ বুদ্ধি আছে, সেটা অনেকটা কমে গেল। এরা কেমন আস্তে আস্তে মানুষ হয়ে আসছে, কেমন সবলশরীর হয়েছে, কেমন নির্ভীক অথচ শান্ত! সে নেটিভি পা-চাটা ভাব মেথরগুলোরও নেই—কি পরিবর্তন!
দেশী মাল্লারা কাজ করে ভাল, মুখে কথাটি নাই, আবার সিকিখানা গোরার মাইনে। বিলাতে অনেকে অসন্তুষ্ট; বিশেষ—অনেক গোরার অন্ন যাচ্চে দেখে, খুশী নয়। তারা মাঝে মাঝে হাঙ্গামা তোলে। আর তো কিছু বলবার নেই; কাজে গোরার চেয়ে চটপটে। তবে বলে, ঝড়-ঝাপ্টা হলে, জাহাজ বিপদে পড়লে এদের সাহস থাকে না। হরিবোল হরি! কাজে দেখা যাচ্চে—ও অপবাদ মিথ্যা। বিপদের সময় গোরাগুলো ভয়ে মদ খেয়ে, জড় হয়ে, নিকম্মা হয়ে যায়। দেশী খালাসী এক ফোঁটা মদ জন্মে খায় না, আর এ পর্যন্ত কোন মহা বিপদে একজনও কাপুরুষত্ব দেখায়নি। বলি, দেশী সেপাই কি কাপুরুষত্ব দেখায়? তবে নেতা চাই। জেনারেল ষ্ট্রঙ্ নামক এক ইংরেজ বন্ধু সিপাহী-হাঙ্গামার সময় এদেশে ছিলেন। তিনি ‘গদরে’র গল্প অনেক করতেন। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করা গেল যে, সিপাহীদের এত তোপ বারুদ রসদ হাতে ছিল, আবার তারা সুশিক্ষিত ও বহুদর্শী, তবে এমন করে হেরে মলো কেন? জবাব দিলেন যে, তার মধ্যে যারা নেতা হয়েছিল, সেগুলো অনেক পেছনে থেকে ‘মারো বাহাদুর’—‘লড়ো বাহাদুর’ করে চেঁচাচ্ছিল; অফিসার এগিয়ে মৃত্যুমুখে না গেলে কি সিপাহী লড়ে? সকল কাজেই এই। ‘শিরদার তো সরদার’; মাথা দিতে পার তো নেতা হবে। আমরা সকলেই ফাঁকি দিয়ে নেতা হতে চাই; তাইতে কিছুই হয় না, কেউ মানে না!