০৪. জালাল খাঁকে আনতে গাড়ি গিয়েছিল

জালাল খাঁকে আনতে গাড়ি গিয়েছিল সন্ধ্যায়। তিনি এসেছেন রাত নটায়। পিটার নিকলস-এর একটা বই পড়ছিলেন—Holocaust and Catastrophe. বই হাত থেকে নামাতে পারছিলেন না বলে এত দেরি। বই-এর শেষ দুটা পাতা গাড়িতে বসে পড়েছেন।

জালাল খাঁর বয়স পঞ্চাশ। এই বয়সে মানুষের মাথায় কাঁচাপাকা চুল থাকে। জালাল খাঁর মাথার সব চুল পাকা। টকটকে গৌরবর্ণের একজন মানুষ যার মাথা ভর্তি শরতের মেঘের মতো ধবধবে সাদা চুল। পৃথিবীতে সবচে বেশি সংখ্যক বই পড়েছেন এই সূত্রে মানুষটার নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এ যেতে পারত। কিন্তু গিনেস বুকওয়ালাদের এ ধরনের কোনো ক্যাটাগরি নেই।

মাহতাব সাহেব বললেন, তুই কি আইসি এনেছিস?

জালাল খাঁ বললেন, কীসের আইসি?

মাহতাব সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কীসের আইসি মানে? তোকে না। বললাম, একজন মানুষকে টেস্ট করা হবে।

জালাল খাঁ বললেন, তোকে তো খুবই উত্তেজিত মনে হচ্ছে। এত উত্তেজিত কেন? এত উত্তেজিত হবার মতো কিছু পৃথিবীতে ঘটে না। এটম বোমা পড়ার ঘটনা এই পৃথিবীতে মাত্র দুবার ঘটেছে।

তোকে আনাই হয়েছে লোকটাকে পরীক্ষা করার জন্যে।

পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষার ব্যবস্থা করা আছে। আমার একটা ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার আছে। নষ্ট হয়ে গেছে। ভয়েস রেকর্ড হয় না। সেটা এনেছি। তোর মিস্ত্রিকে সেটা ঠিক করতে দেয়া হবে। তুই শান্ত হ। ডাক তাকে। তার আগে ব্রিফিং দেলোকটার ব্যাপারটা কী? সে কি ভিলেজ ইডিয়ট?

ভিলেজ ইডিয়ট মানে?

সব গ্রামে একজন থাকে মহানিৰ্বোধ। তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। সে যখন হঠাৎ কিছু বুদ্ধির পরিচয় দেয় তখন হৈচৈ পড়ে যায়। সেরকম না তো?

না, সেরকম না। লোকটা নির্বোধ না। পড়াশোনা কিছুই জানে না। তার। জীবিকা হলো মাটি কাটা।

জালাল খাঁ বললেন, তোর কথা বুঝতে পারছি নালোকটার যদি যন্ত্রপাতি ঠিক করার জাদুকরি ক্ষমতা থাকে তাহলে সে মাটি কাটবে কেন? সে একটা ওয়ার্কশপ দিয়ে দুহাতে টাকা কামাবে। এটা সে কেন করছে না?

 

মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তুই ডেকে জিজ্ঞেস কর কেন করছে না।

আমি রহস্যভেদ করতে পারছি না বলেই তোক ডেকেছি।

জালাল খাঁ হাসতে হাসতে বললেন, জানি না তোর কী হয়েছে। তুই খুবই উত্তেজিত। উত্তেজনায় তোর কথাবার্তাও জড়িয়ে যাচ্ছে। ডাক তোর মিস্ত্রিকে। কথা বলি।

মাহতাব সাহেব বন্ধুকে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে বসলেন। বারেককে পাঠালেন খলিলুল্লাহকে আনতে। বিশেষ করে বলে দিলেন খলিলুল্লাহর সঙ্গে টুনটুনি যেন না আসে। টুনটুনি সারাক্ষণ খলিলুল্লাহর সঙ্গে লেগে আছে—এটা মাহতাব সাহেবের ভালো লাগছে না। লাইব্রেরি ঘরে খলিলুল্লাহর বসার জন্যে একটা টুল রাখা হলো। টুলের সামনে দুটা সোফা। একটিতে মাহতাব সাহেব, অন্যটিতে জালাল খাঁ। রীতিমতো ভাইবা পরীক্ষা।

খলিলুল্লাহকে দেখে মাহতাব উদ্দিন চমকে উঠলেন। এ কে? এ তো খলিলুল্লাহ না। এ অন্য কেউ। কী সুন্দর চেহারা! মুখের চামড়ায় রোদে পোড়া ভাব নেই। মেয়েদের চামড়ার মতো কমনীয় চামড়া। চোখের মণির রঙ নীলাভ। এটা অবশ্যি সবুজ রঙের শার্ট পরার কারণে হতে পারে। সার্টের সবুজ রঙ পড়েছে চোখের মণিতে। আগে লোকটা কুঁজো হয়ে দাঁড়াত, এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকাচ্ছে না। বরং কৌতূহলী চোখে জালাল খাঁকে দেখছে।

জালাল খাঁ বিস্মিত হয়ে চাপা গলায় মাহতাব সাহেবকে বললেন, এই কি তোর সেই খলিলুল্লাহ?

মাহতাব সাহেব বললেন, হুঁ।

মাটি কাটা যার জীবিকা?

হুঁ।

দেখে তো সেরকম মনে হচ্ছে না।

মাহতাব সাহেব কিছু না বলে সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে লক্ষ করলেন তার হাত কাঁপছে। টেনশনের লক্ষণ। তার ভেতর চাপা টেনশন কাজ করছে। প্রেসার কি আবারো বেড়েছে।

জালাল খাঁ খলিলুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কী?

আমার নাম অরণ্য।

জালাল খাঁ তাকালেন মাহতাব সাহেবের দিকে। মাহতাব সাহেব নিজের মনে সিগারেট টানছেন। খলিলুল্লাহর কথায় তাঁর কোনো ভাবান্তর হলো না।

তোমার নাম অরণ্য?

জ্বি।

তুমি লেখাপড়া জানো?

জানতাম না। এখন শিখছি।

কে শেখাচ্ছে।

আম্মাজি শিখাচ্ছেন।

আম্মাজিটা কে?

আম্মাজির নাম টুনটুনি।

ও আচ্ছা, আমাদের টুনটুনি হলো শিক্ষিকা? খুব ভালো। কতদিনে লেখাপড়া শিখে ফেলতে পারবে বলে তোমার ধারণা।

বেশিদিন লাগবে না।

শুনেছি তুমি গ্রামে থাকতে। মাটি কাটার কাজ করতে। এটা কি সত্যি?

জ্বি সত্যি।

গ্রামের একজন মাটি কাটা শ্ৰমিক গ্রাম্য ভাষায় কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছ।

আম্মাজি আমাকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে বলেছেন।

তোমার আম্মাজি তোমাকে যা বলে তাই করো?

খলিলুল্লাহ কিংবা অরণ্য এই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে জালাল খাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল। এই হাসিতে কোনো সংকোচ নেই, দ্বিধা নেই।

জালাল খাঁ বললেন, শুনেছি তুমি ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে সারতে পারো।

ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি কী আমি জানি না। রেডিও-টিভি সারতে পারি।

আমার সঙ্গে একটা ডিভিআর আছে। ডিভিআর হলো ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার। জিনিসটা দেখতে কলমের মতো। পকেটে রেখে দিলে আধ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষজনের কথাবার্তা রেকর্ড হয়। যন্ত্রটা কাজ করছে না। তুমি এটা ঠিক করতে পারবে?

খলিলুল্লাহ হাত বাড়িয়ে বলল, যন্ত্রটা দেন।

জালাল খাঁ ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারটা দিলেন। বারেক কফি নিয়ে এসেছে। জালাল খাঁ কফির মগ হাতে নিয়ে খলিলুল্লাহর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে কৌতুক ঝিকমিক করছে। তিনি যে ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার দিয়েছেন সেটা ঠিক আছে। বারো ভোল্টের নিকেল ক্যাডমিয়াম ব্যাটারিটা রেকর্ডারে ফিট করা নেই। তিনি পকেটে করে নিকেল ক্যাডমিয়াম ব্যাটারি এনেছেন তবে সেই ব্যাটারি ক্যামেরার ব্যাটারি। ছয় ভোল্টের ব্যাটারি।

খলিলুল্লাহ কলমের মতো ছোট্ট জিনিসটা একবার ডান হাতে নিল। আরেকবার বাম হাতে নিল। সে যন্ত্রটার দিকে তাকাচ্ছে না। তবে তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে আছে। যেন সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে জটিল কোনো জিনিস বোঝার চেষ্টা করছে।

জালাল খাঁ বললেন, তোমার কাছে ছোট স্কু ড্রাইভার আছে? স্কু ড্রাইভার থাকলে যন্ত্রটা খুলে দেখ—কোন জিনিস নষ্ট না খুলে বুঝবে কী করে?

খলিলুল্লাহ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, যন্ত্রটা ঠিক আছে। যন্ত্র ঠিক আছে তাহলে চলে না কেন? খলিলুল্লাহ ব্যাটারি চেম্বার খুলে বলল, এই জায়গায় একটা জিনিস লাগবে।

ব্যাটারির কথা বলছ? এটা হলো ব্যাটারি চেম্বার। আমার কাছে একটা ব্যাটারি আছে। দেখ তো এটা দিয়ে হবে কি না।

খলিলুল্লাহ ব্যাটারি হাতে নিয়েই বলল, এটা দিয়ে হবে না। আচ্ছা দেখি, যাতে হয় সেই ব্যবস্থা করি।

কী ব্যবস্থা করবে?

খলিলুল্লাহ হাসছে। ভালো কোনো ম্যাজিক দেখানোর আগে ম্যাজিসিয়ানরা যে ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি।

জালাল খাঁ লক্ষ করলেন খলিলুল্লাহ হাতের নখ দিয়ে ডিভিআর এর অতি ক্ষুদ্র স্কু খুলে ফেলছে। ভোলা স্তুগুলো কোথাও রাখছে না, হাতের তালুর ভাঁজেই আছে। কাজটা সে এত দ্রুততার সঙ্গে করছে যে মনে হচ্ছে হাতের নখ দিয়ে স্ক্রু খোলা হলো লোকটার পেশা। গত বিশ পঁচিশ বছর ধরে সে এই কাজই করছে।

কোন স্কু কোথায় লাগবে তোমার মনে আছে? একেকটা তো একেক রকম।

মনে আছে।

তোমার কতক্ষণ লাগবে?

খলিলুল্লাহ জবাব দিল না। এখন সে কাজ করছে চোখ বন্ধ করে। জালাল খাঁ মাহতাব সাহেবের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ছয় ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে বারো ভোল্টের ডিভিআর চলবে না। তোমার এই লোক কী করছে সেই জানে, তবে তার কর্মপদ্ধতি মজার। যন্ত্রপাতি সম্পর্কে এই লোক কিছু জানে না—তাও ঠিক না। সে অবশ্যই জানে। ডিভিআর হাতে নিয়েই সে বলেছে এটা ঠিক আছে। ব্যাপারটা সত্যি হলেও আমার ধারণা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।

জালাল খাঁর কথার মাঝখানেই খলিলুল্লাহ বলল, স্যার নেন। এখন ঠিক হয়েছে।

ঠিক হয়েছে মানে?

খলিলুল্লাহ ছোট্ট করে নিশ্বাস নিল। জালাল খাঁ ভয়েস রেকর্ডার হাতে নিলেন। বোতাম টিপে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো, ওয়ান টু থ্রি বললেন। রিপ্লে করলেন। ভয়েস রেকর্ডার থেকে কথা শোনা গেল হ্যালো হ্যালো, ওয়ান টু থ্রি।

জালাল বিস্মিত গলায় ইংরেজিতে বললেন, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। যন্ত্রের কোনো এক জায়গায় রেজিসটেন্স বদলাতে হয়েছে। সেটা কী করে সম্ভব আমি বুঝতে পারছি না। আমি পুরোপুরি কনফিউজড।

খলিলুল্লাহ বলল, স্যার আমি যাই?

জালাল খাঁ বললেন, যাও। যন্ত্রটা হাতে করে নিয়ে যাও। এটা আমি তোমাকে উপহার দিলাম।

আমার দরকার নাই।

খলিলুল্লাহ চলে যাচ্ছে। জালাল খাঁ একবার তাকাচ্ছেন খলিলুল্লাহর দিকে, একবার তাকাচ্ছেন মাহতাব সাহেবের দিকে। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছেন না। মাহতাব সাহেবের ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে। কপাল ঘামছে। অবশ্যই প্রেসার বাড়ার লক্ষণ।

 

রাত দশটা বাজে।

মাহতাব ঘুমুবার আয়োজন করছেন। তিনি কখনোই রাত বারটার আগে ঘুমুতে যান না। আজ তাঁর শরীর খারাপ লাগছে। বিকেল থেকেই প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা ছিল। কড়া পেইন কিলার খেয়ে মাথার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। যন্ত্রণা চলে গেছে কিন্তু সে তার পালক ফেলে গেছে। সেই পালকের নাম ভোতা অবসাদ। তিনি রাতে খাবার খান নি। হঠাৎ করে আবার এসিডিটি দেখা দিয়েছে। এন্ডােসকপির মতো কষ্টকর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আবার মনে হয় যেতেই হবে।

দরজায় টোকা পড়ছে। মাহতাব সাহেব বললেন কে?

টুনটুনির গলা শোনা গেল। টুনটুনি বলল, বাবা আমি। আমি কি ভেতরে আসব?

মাহতাব সাহেব বললেন, দরজা খোলা আছে। মা, তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি আমি তোমাদের স্কুলের হেড মিসট্রেস না। আমার ঘরে ঢোকার সময় তোমার অনুমতি নিতে হবে না। যখন ইচ্ছা ঘরে ঢুকবে। যখন ইচ্ছা বার হয়ে যাবে।

টুনটুনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। মাহতাব সাহেবের ঘরে খাটের পাশে কার্পেটের উপর আখরোট কাঠের একটা রকিং চেয়ার আছে। টুনটুনি রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে লাগল। তার মুখ বিষন্ন। মাহতাব সাহেব বললেন, মা, কোনো কারণে তোমার কি মন খারাপ?

টুনটুনি জবাব দিল না। মাহতাব সাহেব বললেন, মা শোন, তোমার সঙ্গে আমার একটা অলিখিত চুক্তি আছে। চুক্তিটা মনে আছে?

মনে আছে।

বলো দেখি চুক্তিটা কী?

আমার যদি মন খারাপ হয় তাহলে কেন মন খারাপ সেটা তোমাকে জানাব।

মাহতাব সাহেব মেয়ের সামনে বসতে বসতে বললেন, টুনটুনি মা শোনো। তোমার মা বেঁচে নাই। তোমার মা বেঁচে থাকলে তিনি নিজেই বের করে ফেলতেন কেন তোমার মন খারাপ। মা-দের পক্ষে অনেক কিছু সম্ভব যা বাবাদের পক্ষে সম্ভব না। কাজেই তোমাকেই মুখ ফুটে বলতে হবে কেন তোমার মন খারাপ।

টুনটুনি দোল খাওয়া বন্ধ করে বলল, অরণ্যকে তুমি তালাবন্ধ করে রেখেছ কেন?

অরণ্যটা কে?

অরণ্য কে তুমি খুব ভালো করে জানো। আমি খলিলুল্লাহ নাম বদলে অরণ্য নাম দিয়েছি।

মাহতাব সাহেব শীতল গলায় বললেন, মা, একটু কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? তার নাম তুমি বদলাবে কেন?

টুনটুনি বলল, বাবা, তুমিও কি একটু বাড়াবাড়ি করছ না। তাকে তুমি কেন তালাবন্ধ করে রাখবে? আমাদের এই বাড়িটা তো জেলখানা না। এবং সে এমন কোনো অপরাধও করে নি।

তাকে তালাবন্ধ করে রেখেছি এই জন্যে কি তোমার মন খারাপ?

টুনটুনি জবাব দিল না। আবারো দোল খেতে লাগল। মাহতাব সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, খলিলুল্লাহকে শাস্তি দেবার জন্যে তালাবন্ধ করে রাখা হয় নি। ও যেন চলে যেতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি লোকটির কর্মকাণ্ডে শঙ্কিত। আমি স্বস্তি বোধ করছি না। আমার মনে হচ্ছে something is wrong somewhere.

তুমি কি লোকটাকে ভয় পাচ্ছ?

হয়তো পাচ্ছি। যারা স্বাভাবিক মানুষ তারা অস্বাভাবিক মানুষের আশেপাশে অস্বস্তি বোধ করে। কালো আফ্রিকানদের দেশে প্রথম যখন সাদা চামড়ার মানুষ গেল, আফ্রিকানরা সেই সাদা চামড়ার মানুষকে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলল। শুধু যে মেরে ফেলল তা না, আগুন দিয়ে ঝলসে খেয়েও ফেলল। একইরকম ঘটনা ঘটল সাদা চামড়াদের দেশে। তাদের কাছে যখন হঠাৎ কালো চামড়ার একজন এসে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে অশুভ মানুষ হিসেবে তাকে পুড়িয়ে মারা হলো।

তুমি অরণ্যকে ভয় পাছ?

অরণ্য অরণ্য করবে না মা। তার যা নাম তাকে তাই ডাকো। সেটাই শোভন ও সুন্দর।

তুমি খলিলুল্লাহ ভাইকে ভয় পাচ্ছ?

হ্যাঁ, পাচ্ছি। কিছুটা ভয় পাচ্ছি।

তাহলে একটা কাজ করো, ওকে ছেড়ে দাও। সে যেখানে থেকে এসেছিল সেখানে চলে যাবে।

এটা সম্ভব না।

সম্ভব না কেন?

সম্ভব না, কারণ আমি তাকে ছাড়ব না। আমার কাছ থেকে যাবার আগে সে তার সব রহস্য ভেঙে তারপর যাবে। আমি রহস্য পছন্দ করি না।

বাবা, আমি তোমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছি।

অবাক হলেও কিছু করার নেই। মা শোননা, আমার শরীরটা ভালো লাগছে। না। আমি শুয়ে পড়ব।

টুনটুনি বলল, তোমার সঙ্গে আমার যে লিখিত চুক্তি ছিল তার দুটা পার্ট আছে। প্রথম পার্টে আমি আমার মন খারাপের কথা তোমাকে বলব। দ্বিতীয় পার্টে আছে তুমি চেষ্টা করবে আমার মন খারাপ ভাবটা দূর করতে। তা কিন্তু তুমি করছ না।

কী করলে তোমার মন খারাপ ভাব দূর হবে? ওকে ছেড়ে দিলে? ওকে আমি ছাড়ব না। তালাও খোলা হবে না। তবে একটা কাজ করতে পারিতোমাকে তালার চাবিটা দিতে পারি। তোমার যখনই তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করবে তুমি তালা খুলে তার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। কথা শেষ হবার পর আবার তালাবন্ধ করে ফেলবে। এবং চাবি আমার কাছে ফেরত দেবে। রাজি আছ?

হ্যাঁ, রাজি আছি।

মাহতাব সাহেব ড্রয়ার খুলে মেয়ের হাতে চাবি দিলেন। টুনটুনি চাবি নিয়ে চলে গেল। মাহতাব সাহেব বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিলেন। তার সারা শরীর কেন জানি জ্বালা করছে। বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে পারলে ভালো হতো। এখন তা করা যাবে না। টুনটুনি ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মাহতাব সাহেব আবার তাঁর ড্রয়ার খুললেন। হাবীবুর রহমান সাহেবের কাছ থেকে যে চিঠি এসেছে সেটা আবার পড়লেন

চৌধুরী সাহেব,

আসসালাম। আপনার পত্ৰ পাইয়াছি। আপনি অতি মহানুভব ব্যক্তি। আপনি আমাকে ঢাকায় আসিতে বলিয়াছেন। আমার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা করিবেন বলিয়া জানাইয়াছেন। আমি যুগপৎ আনন্দিত ও বিস্মিত হইয়াছি। আজকালকার যুগে এতটা কেউ করে না। আমি অতি দ্রুত ঢাকা আসিবার ব্যবস্থা করিতেছি।

আপনার কথামতো বড় বৌমার নিকট খলিলুল্লাহর বিষয়ে সন্ধান নিব বলিয়া মনস্থির করিয়াছি। এখননা ব্যবস্থা নিতে পারি নাই। আপনি আমার বড় বৌমার সহিত সাক্ষাতে আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন। ইহা আমার জন্যে অতীব সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু জনাব আমার বড় বৌমার পিতামাতা অত্যন্ত রক্ষণশীল ধারার মানুষ। তের বৎসর বয়স হইতেই বড় বৌমার বাপের বাড়ির সকল মেয়েদের বোরকা পরিধান করতে হয়। এমতাবস্থায় আপনাকে ঐ বাড়িতে নিয়া গেলেও বিশেষ সুবিধা হইবে বলিয়া মনে হয় না। তবে বড় বৌমা সন্তান প্রসবের পর আমার বাড়িতে আসিলেই আপনি তাহার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারিবেন।

আমার বড় বৌমা তাহার শাশুড়ি মাতার সহিত (অর্থাৎ আমার স্ত্রী) যে আলাপ করিয়াছে তাহা অতি সম্প্রতি আমি আমার স্ত্রীর নিকট হইতে উদ্ধার করিয়াছি। আপনার জ্ঞাতার্থে আপনাকে তাহা জানাইতেছি। আমার বড় বৌমার ধারণা খলিলুল্লাহ মানুষ নহে, সে জিন।

জিন ও ইনসানের কথা পবিত্র কোরান শরিফে উল্লেখ আছে। হযরত সোলায়মান আয়হেস সালামের অধীনে জিন সম্প্রদায় কর্মকাণ্ড করিত ইহাও কোরান শরিফে উল্লেখ আছে।

আপনার অবগতির জন্য জানাইতেছি সর্বমোট তিন প্রকারের বুদ্ধিমান সম্প্রদায় আল্লাহপাক সৃষ্টি করিয়াছেন। যেমন ফেরেশতা। ইহারা আগুনের তৈয়ারি। ইহারা সন্তান সন্ততির জন্ম দিতে পারে না। ইচ্ছামতো যে-কোনো রূপ ধারণ করতে পারে।

ফেরেশতাদের পরেই আছে জিন সম্প্রদায়। ইহারাও আগুনের তৈয়ারি। তবে ইহারা সংসারধর্ম পালন করে। সন্তান সন্ততির জন্ম দেয়। মানুষের মতোই ইহাদেরও জন্ম-মৃত্যু আছে। শয়তান (ইবলিশ) জিন সম্প্রদায়ভুক্ত। যদিও অনেকে শয়তানকে পথভ্ৰষ্ট ফেরেশতা মনে করে। ইহা সঠিক না।

বড় বৌমা কেন খলিলুল্লাহকে জিন ভাবিয়াছে তাহা আমি বলিতে পারি না। তবে ইহা অবশ্যই সত্য নয়। মেয়েছেলেরা দুর্বলচিত্ত হইয়া থাকে। রজ্জ্বকে সর্প ভ্রম করা তাহাদের স্বভাব।

জনাব আপনার নিকট দীর্ঘ পত্ৰ দিয়াছি। পত্রের দোষত্রুটি নিজগুণে ক্ষমা করিবেন। আল্লাহপাক আপনার মঙ্গল করুক।

ইতি
নাদান
হাবীবুর রহমান