০৪. জন বরগ শান্ত মুখে বসে আছেন

জন বরগ শান্ত মুখে বসে আছেন। তার চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই। যেন কিছুই হয় নি, তিনি সাধারণ একটি সভায় এসেছেন। রুটিন কাজ। এ রকম একটি সভা আমি আগে একবার উপস্থিত ছিলাম। সেই সভার সঙ্গে আজকের সভার আমি কোনো প্ৰভেদ দেখছি না। উদ্বেগের কিছু ছাপ আমি ইনোর চোখে-মুখে দেখছি। সে দ্রুত চোখের পাতা ফেলছে, কিছুক্ষণ পরপর ঢোক গিলছে।

জন বরগ কথা বলা শুরু করলেন। শান্ত স্বর। আমি মনে মনে এই মানুষটির সাহসের প্রশংসা করলাম। এই মানুষটির স্নায়ু খুব সম্ভব ইস্পাতের তৈরি।

বন্ধুগণ, দুটি লালবাতি জ্বলেছে। কাজেই পরিস্থিতি কী সেই ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। তবু কিছু ব্যাখ্যা করছি, কারণ এই মুহূর্তে আমাদের কিছু করার নেই। এই মহাবিপদে আমাদের যারা সাহায্য করতে পারে তারা ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছে। তারা হচ্ছে সেন্ট্রাল কম্পিউটার সিডিসি-১০ এবং সাহায্যকারী কম্পিউটার নিডিসি-৭, জরুরি পরিস্থিতির কারণে হিসাব-নিকাশের কিছু অংশ তিশ-১০০ রিজার্ভ কম্পিউটার করে দিচ্ছে।

ব্যাপারটা কি হল বলি। আমরা হঠাৎ করে একটা অকল্পনীয় আকর্ষণীয় শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পড়ে গিয়েছি। এই আকর্ষণী শক্তির উৎস কোথায় আমরা জানি না। শুরুতে মনে হচ্ছিল আমরা একটি কৃষ্ণ গহ্বরে পড়ে গেছি। কিন্তু এটি কৃষ্ণ গহ্বর নয়। আমাদের চারপাশে কিছুই নেই। অথচ এই মহাশূন্য অতি তীব্র শক্তিতে আমাদের আকর্ষণ করছে। শক্তির পরিমাণ ১০১৫ থেকে ১০২৭G, সমুদ্র তরঙ্গের মতো এটা বাড়ছে এবং কমছে। মনে হচ্ছে আমরা একটা স্পাইরেলের ভেতর ঢুকে পড়েছি। এবং সোজাসুজি অগ্রসর হচ্ছি। স্পাইরেলের এক একটা বাহুর কাছাকাছি আসা মাত্র আকর্ষণী শক্তি বেড়ে যায়, আবার বাহু অতিক্রম করা মাত্র কিছুটা কমে যায়।

ইনো বলল, এর থেকে বেরুবার জন্যে আমরা কী করছি তা কি জানতে পারি?

অবশ্যি জানতে পারেন। আমি সিডিসি-৭কে সভা শুরু হবার আগেই বলে রেখেছি এই বিষয়ে কথা বলবার জন্যে।

সিডিসি সঙ্গে সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। এর গলার স্বরে কোনো ধাতব ঝংকার নেই। সে কথা বলছে অনেকটা পুরুষালি গলায়। মাঝে মাঝে থামছে। আবার শুরু করছে। আঁটা ইচ্ছাকৃত। আমাদের সমস্ত ব্যাপারটা আত্মস্থ করবার জন্যে সময় দিচ্ছে।

সম্মানিত অভিযাত্রী, খুবই দুঃসময়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। অল্প সময়ে আমি বক্তব্য শেষ করতে চাচ্ছি। সেই কারণে কোনো কিছুই পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না।

আমরা বেকায়দায় পড়ে গেছি, কারণ ব্যাপারটা আচমকা ঘটেছে। প্রচণ্ড শক্তিশালী নিউট্রন স্টার কিংবা ব্ল্যাক হোল মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহাকাশযানের অতি উন্নত সেনসর অনেক দূর থেকে তাদের অস্তিত্ব টের পায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এখানে তা সম্ভব হয় নি, কারণ আচমকা আমরা একটি স্পাইরেলের ভেতর পড়ে গেছি। এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কেন্দ্রবিন্দুর দিকে।

এইসব ক্ষেত্রে মহাকাশযানের দিক পরিবর্তন করা হয় এবং শক্তিশালী গ্রাভিট্রন ফ্লাঙ্ক ব্যবহার করা হয়। দিক পরিবর্তন আমরা ঠিকই করতে পারছি, তবে গ্রাভিট্ৰন ফ্লাস্ক ব্যবহার করতে পারছি না। কারণ অলটারনেটিং চৌম্বক ক্ষেত্রে গ্রাভিট্ৰন ফ্লাঙ্ক কাজ করে না।

আমরা মহাকাশযানের গতিবেগও কমাতে পারছি না, কারণ এই মুহুর্তে মহাকাশযানের গতিবেগ ০.৬২৬C–আলোর গতিবেগের শতকরা বাষট্টি ভাগেরও বেশি। এই গতিবেগ কমিয়ে শূন্যতে নিয়ে আসতে আমাদের সময় লাগবে ১১২.৭০ ঘণ্টা। এত সময় আমাদের হাতে নেই।

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ম্যানোফ ঠাণ্ডা গলায় বললেন, একটি হাইপার স্পেস ডাইভ দিলে কেমন হয়? ঐ ব্যাপারে কি চিন্তা ভাবনা করা হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। হাইপার স্পেস ডাইভ দিতে হলে গতিবেগ ০.৮২৫ প্রয়োজন। সেই গতিবেগ এই মুহূর্তে আমাদের নেই। থাকলেও আমরা হাইপার স্পেস ডাইভ দিতে পারতাম না, কারণ আমাদের গ্র্যভিট্রন ফ্লাস্ক কাজ করছে না।

প্রসঙ্গক্ৰমে আপনাদের জানিয়ে রাখি যে ১.২G আকৰ্ষণী শক্তির মধ্যেও হাইপার স্পেস ডাইভ দেয়া যায় না। হাইপার স্পেস ডাইভ দেয়ার মুহুর্তে মহাকাশযানকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ বলয়ে থাকতে হয়।

ম্যানোফ বললেন, আমি তা জানি। পরিস্থিতি আমাকে অন্যভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করছে। আমি জানতে চাচ্ছি আমাদের পরিকল্পনা কী?

কোনো পরিকল্পনা নেই।

কী অদ্ভুত কথা! পরিকল্পনা নেই মানে কী? আমরা কিছুই করব না?

আমাদের এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে যে সব তথ্য যোগাড় হয়েছে, সেসব পৃথিবীতে পাঠান। যাতে পৃথিবীর মানুষ এখানে কী ঘটল তা বুঝতে পারে। এর ফলে তারা ভবিষ্যতের মহাকাশযানগুলিকে এই পরিস্থিতি সামলাবার মতো করে তৈরি করবে। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে পৃথিবীতে তথ্য পাঠানোর ব্যাপারটি আমরা চমৎকারভাবে সম্পন্ন করছি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা করা হবে।

ইনো বলল, আমাদের ভবিষ্যৎ কী?

ভবিষ্যতের কথা আমরা বলি না। আমরা বলি বর্তমান।

আমাদের বর্তমানটাইবা কী?

ভালো নয়।

ভালো নয় মানে কী?

ভালো নয় মানে খারাপ–খুবই খারাপ।

উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাবনা কত?

আমাদের কাছে যা তথ্য আছে তার থেকে মনে হয় সম্ভাবনা ০.০৩৭, সম্ভাবনা নেই বলাই ভালো।

আমি কালাম জন বরগের দিকে। জন বরগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকেই দেখছেন। চোখে চোখ পড়ামাত্র তিনি অল্প হাসলেন। তারপর বললেন, একটা কাজ করলে কেমন হয়? আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, অত্যন্ত দামি একটি শ্যাম্পেনের বোতল মহাকাশযানে আছে। বোতলটি নেয়া হয়েছিল অন্য গ্যালাক্সিতে পদার্পণের উৎসব উদযাপনের অংশ হিসেবে। এখন দেখতে পাচ্ছি সেই সম্ভাবনা ০.০৩৭; কাজেই আমি প্রস্তাব করছি, বোতলটি এখনি খোলা হোক। কারো আপত্তি থাকলে হাত তুলে জানাতে পারেন।

কেউ হাত তুলল না। তেমন কোনো বাড়তি উৎসাহও কারো মধ্যে লক্ষ করলাম না। সবাই গ্লাস হাতে নিল মোটামুটি যন্ত্রের মতো। যেন নিয়ম রক্ষা করছে। মিশন প্রধানের হুকুম পালন করছে।

জন বরগ গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালেন এবং মোটামুটি নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, আপনারা বোধ হয় জানেন না, একজন অসাধারণ ইএসপি ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ আমাদের মধ্যে আছেন, যিনি এই মহাবিপদের কথা প্রায় ছেষট্টি মিনিট আগে টের পেয়েছিলেন। আমি তখন তাঁর কথায় তেমন গুরুত্ব দিই নি। এখন দিচ্ছি। এখন আমি তার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছি, আমাদের ভবিষ্যৎ কী? তাঁর ইএসপি ক্ষমতা কী বলছে?

আমি উত্তর দেবার আগেই তিন নম্বর লালবাতি জ্বলে উঠল। চরম বিপর্যয়ের শেষ সংকেত। তার পরপরই মহাকাশযানের কৃত্রিম মাধ্যাকৰ্ষণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম স্তরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হল। এর মধ্যেই আমি মিশন প্রধান জন বগের গলা শুনলাম, আসুন আমরা এই বিপর্যয়ের নামে মদ্যপান করি।

তাঁর কথা শেষ হল না, তৃতীয় স্তরে আরেকটি বিস্ফোরণ হল। আগুনের নীল শিখা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের গ্রাস করল।

এর পরের কথা আমার আর কিছু মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়।