খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল রিশান। কোথাও কিছু নেই, মাথার কাছে একটা সবুজ বাতি থাকার কথা সেটিও নেই। সে যেন এক অলৌকিক শূন্যতায় ভেসে রয়েছে। সত্যিই কি তার চেতনা ফিরে আসছে নাকি এটিও একটি স্বপ্ন? রিশান প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল সে কোথায় এবং কেন তার মাথার কাছে একটা সবুজ বাতি থাকার কথা, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না।
ঘুম এবং জাগরণের মাঝামাঝি তরল অবস্থায় দীর্ঘ সময় কেটে গেল এবং খুব ধীরে ধীরে আবার তার চেতনা ফিরে আসতে থাকে। এক সময় সে চোখ খুলে তাকায় এবং দেখতে পায় মাথার কাছে সত্যি একটি সবুজ বাতি জ্বলছে। কুরু ইঞ্জিনের কম্পন অনুভব করে রিশান, কান পেতে থেকে গুমগুম একটা চাপা আওয়াজ শুনতে পায় সে।
রিশান চোখ বুজে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। ঘুম থেকে ওঠা নিস্তেজ ভাবটা কেটে গিয়ে খুব ধীরে ধীরে শরীরের ভিতরে সজীব একটা ভাব ফিরে আসতে শুরু করেছে। ক্যাপসুলের ভিতরে আলো জ্বলে উঠছে ধীরে ধীরে। শীতল একটা বাতাস বইছে ভিতরে, অচেনা কী একটা ফুলের গন্ধ সেই বাতাসে। রিশান ধীরে ধীরে উঠে বসে, সাথে সাথে মাথার উপর থেকে ঢাকনাটা সরে যায়। দেয়ালে নানা ধরনের প্যানেল জ্বলজ্বল করছে, উপরে বামদিকে একটা সৌরঘড়ি সময় জানিয়ে দিচ্ছে। রিশান অবাক হয়ে দেখল সে ঘুমিয়েছিল এক বছরেরও কম সময় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে, এটা কী করে সম্ভব?
রিশান ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে আসে। এক মুহূর্ত সময় নেয় নিজের তাল সামলে নিতে, তারপর দেয়াল ধরে এগিয়ে যায়, লি–রয়কে খুঁজে বের করতে হবে এখনই। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে নিশ্চয়ই, তাদের কয়েক যুগ ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল।
নিয়ন্ত্রণঘরে বড় স্ক্রিনের সামনে লি–রয় দাঁড়িয়েছিল। রিশানকে দেখে বলল, তোমাকেও ঘুম থেকে তুলেছে?
হ্যাঁ। কী ব্যাপার?
জানি না। মনে হয় তোমার সন্দেহই সত্যি। আমাদের মূল অভিযানের পাশাপাশি আরো কোনো অভিযান শেষ করতে হবে।
তথ্যকেন্দ্র কী বলে?
বিশেষ কিছু বলে না। কাছাকাছি কোনো অঞ্চল থেকে একটা বিপদ সঙ্কেত পেয়ে আমাদের ডেকে তুলেছে।
আমরা পৃথিবী থেকে এক আলোকবর্ষ দূরেও যাই নি–পৃথিবী এই বিপদ সঙ্কেতের কথা জানত।
লি–রয় মাথা নাড়ল, মনে হয় জানত।
আমাদেরকে বলে নি।
না।
আমরা কি এই বিপদ সঙ্কেত অগ্রাহ্য করে আমাদের মূল অভিযানে যেতে পারি না?
ইচ্ছে করলে পারি। কিন্তু
কিন্তু কী?
বিপদ সঙ্কেত অগ্রাহ্য করা যায় না।
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। ঠিকইঅলেছ। অন্যেরা কি এখনো ঘুমাচ্ছে?
না। সবাইকে জাগানো শুরু করা হয়েছে। তারা উঠে আসতে আসতে চল তুমি আর আমি যাবতীয় তথ্যগুলো সংগ্রহ করে ফেলি।
ঘণ্টাখানেক পরে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণঘরে যখন ছয় জন ক্রু একত্র হয়েছে তখন সবাই কমবেশি বিচলিত। লি–রয়, সবাইকে শান্ত করে দ্রুত কাজ ক্ষ করে দেয়। বড় টেবিলের একপাশে বসে মনিটরে সবুজ রঙের একটা গ্রহের ছবি স্পষ্ট করতে করতে বলল, আমাদের যাবতীয় সমস্যার মূল হচ্ছে এই গ্রহটি। গাছের পাতায় সবুজ খুব সুন্দর দেখায়। কিন্তু গ্রহ হিসেবে সবুজ রং ভালো নয়, কেমন জানি পচে যাওয়ার একটা ভাব রয়েছে। এই গ্রহটির বেলায় কথাটি আরো বেশি সত্যি।
হান অধৈর্য হয়ে বলল, কী বলতে চাইছ তুমি। গ্রহ আবার পচে যায় কেমন করে?
বলছি। তোমরা সবাই জান, পৃথিবী থেকে এক আলোকবর্ষ যাবার আগেই আমাদের একটা বিপদ সঙ্কেত দিয়ে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে। বিপদ সঙ্কেতটি এসেছে এই গ্রহ। থেকে।
নিডিয়া অবাক হয়ে বলল, এই গ্রহে মানুষের বসতি রয়েছে?
হ্যাঁ। প্রায় চল্লিশ বছর আগে এখানে মানুষ বসতি করেছিল। মানুষ থাকার উপযোগী গ্রহ এটি নয় তবু মানুষ বসতি করেছিল। তোমরা যখন জেগে উঠছিলে তখন আমি আর রিশান মিলে গ্রহটা সম্পর্কে মোটামুটি খোঁজখবর নিয়েছি, তথ্যকেন্দ্র থেকে সরাসরি সেসব জানতে পারবে কিন্তু তবু তোমাদের বলে দিই। লি–রয় এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, রিশান, তুমিই বল।
রিশান অন্যমনস্কভাবে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, গ্রহ বলতে আমাদের যেরকম একটি জিনিসের কথা মনে হয়, এটি সেরকম কিছু নয়। পৃথিবীর তরের চার ভাগের
এক ভাগ কিছু জিনিস কোনোভাবে আটকে আছে। নিয়মিত কোনো কক্ষপথ নেই, আশপাশের অন্যান্য মহাজাগতিক আকর্ষণে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। সৌরজগতে গ্রহগুলোতে আলোর উৎস হচ্ছে সূর্য, এখানে সেরকম কিছু নেই। গ্রহটিতে লৌহ জাতীয় আকরিক থাকায় শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে, খুব বিচিত্র একটি বায়ুমণ্ডল রয়েছে, সেখানে আয়োনিত গ্যাসে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন থেকে বিচিত্র এক ধরনের আলো তৈরি হয়। এই আলো নিয়মিত নয়, কখনো বেশি কখনো কম, কখনো উজ্জ্বল কখনো নিষ্প্রত–শব্দটা হওয়া উচিত ভূতুড়ে।
গ্রহটি অসম্ভব শীতল; কিন্তু মাটির নিচে প্রচণ্ড চাপে আটকে থাকা কিছু গলিত আকরিক থাকার কারণে স্থানে স্থানে তাপমাত্রা সহ্য করার পর্যায়ে রয়েছে। চল্লিশ বছর আগে মানুষ যখন এখানে বসতি করেছিল এ রকম একটা উষ্ণ জায়গা বেছে নিয়েছিল।
গ্রহটি সম্পর্কে আরো নানারকম ঘুঁটিনাটি তথ্য রয়েছে, তোমরা ইচ্ছে করলে তথ্যকেন্দ্র থেকে পেতে পার, আমি আর সেগুলো জোর করে শোনাতে চাই না।
রিশানের কথা শেষ হতেই হান বলল, কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারছি না তোমরা গ্রহটা পচে গেছে কেন বলছ?
লি–রয় হাসার মতো এক ধরনের ভঙ্গি করে বলল, পচে যাওয়া মানে কী হান?
হান মাথা চুলকে বলল, রূপক অর্থে বোঝানো হয় নষ্ট হয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া। তুমি কি বলতে চাইছ–এখানকার মানুষের যে বসতি রয়েছে তারা নিজেদের সাথে নিজেরা ঝগড়াঝাটি করছে? যুদ্ধ–বিগ্রহ করছে? ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
না, সেরকম কিছু না। পচে যাওয়ার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর ভোজসভা। এই গ্রহটিতে সেরকম কিছু ঘটেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
উপস্থিত যারা ছিল তারা সবাই চমকে উঠে বলল, এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে?
হা। খুব নিম্নস্তরের এককোষী প্রাণ। কিন্তু প্রাণ। মানুষের বসতি হয়েছিল সে কারণেই। পৃথিবীর বাইরে যে প্রাণের বিকাশ হয়েছে সেটা সম্পর্কে তথ্য সগ্রহ করা।
নিডিয়া ইতস্তত করে বলল, আমি জীববিজ্ঞানী নই, প্রাণের রহস্য আমার জানা নেই, কিন্তু এককোষী প্রাণ সম্পর্কে তথ্য সগ্রহ করতে মানুষের চল্লিশ বছর লেগে গেছে?
সেটাই সমস্যা। লি–রয় চিন্তিত মুখে বলল, এই এককোষী প্রাণীদের নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে এই গ্রহে। মানুষ সেটা ধরতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে, এখন যে কয়জন মানুষ বেঁচে আছে তারা ফিরে যেতে চাইছে। আমাদের কাছে। বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়েছে তাদের উদ্ধার করে ফেরত পাঠানোর জন্যে।
ষুন ঘুরে তাকাল লি–রয়ের দিকে, ব্যস? আর কিছু নয়?
না, আর কিছু নয়।
তাহলে রিশান যেটা ভেবেছিল, আমাদের পাঠানো হচ্ছে ভয়ানক একটা নৃশংস কাজ করার জন্যে সেটা সত্যি নয়?
না, সেরকম কিছু নয়।
রিশানের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। রিশান মাথা নেড়ে বলল, ষুন, তুমি কি ভাবছ আমার খুব মন খারাপ হয়েছে যে আমার সন্দেহটি মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে?
ষুন তার মঙ্গোলীয় সরু চোখকে আরো সরু করে বলল, না, আমি তা বলছি না।
তাছাড়া এখনো সময় শেষ হয়ে যায় নি। ব্যাপারটা যেরকম সহজ মনে হচ্ছে হয়তো তত সহজ নয়। এককোষী কিছু জীবাণু নিয়ে গবেষণা করতে মানুষের চল্লিশ বছর সময় লাগার কথা নয়। এর মাঝে অন্য কোনো ব্যাপার থাকা এতটুকু বিচিত্র নয়।
ষুন ঘুরে তাকাল রিশানের দিকে। তুমি তাই মনে কর?
রিশানের কী হল কে জানে, শক্ত মুখ করে বলল, হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। আমি দুঃখিত, কিন্তু সত্যি আমি তাই মনে করি।