০৪. চিঠি
সেদিন বাসায় এসে দেখি আমার তিনটি চিঠি এসেছে। একটিতে টিকিট লাগানো নেই, তাই বেয়ারিং। সেটা বাবা লিখেছেন। অনা দু’টির একটি লিখেছে মা আর একটি রাঙাবুব। আরেকটা লিখেছে আমার প্রাণের বন্ধু দুলাল। বেয়ারিং চিঠিটা পয়সা দিয়ে নিতে হয়েছে, আমার খুব লজ্জা লাগল ছোট খালার সামনে। অন্যের চিঠি নাকি খুলতে হয় না, কিন্তু ছোট খালা সবগুলো চিঠি খুলে রেখেছেন। আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমার চিঠি আছে কি না দেখার জন্যে খুলেছিলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আছে, ছোট খালা?
হ্যাঁ! বুবু লিখেছে একটা। তোকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করছে। ভালো করে একটা চিঠি লিখে দিস।
দেব, ছোট খালা।
তারপর আমি চিঠিগুলো নিয়ে পড়তে বসেছি। প্রথমে পড়লাম মায়ের চিঠি, পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গেল একেবারে। নানারকম উপদেশ আছে চিঠিতে, ছোর্ট খালা আর খালুর কথা যেন শুনি, বল্ট আর মিলির সাথে যেন ঝগড়া না করি, মন দিয়ে যেন পড়াশোনা করি, শরীরের যেন যত্ন করি, জুম্মার নামাজ কখনো যেন কাজা না করি, রাস্তাঘাটে যেন খুব সাবধানে বের হই, একা একা যেন কোথাও না যাই—এইরকম অনেক কথা।
মায়ের চিঠি শেষ করে রাঙাবুবুর চিঠি পড়লাম। আগে ভেবেছিলাম রাঙাবুবু শুধু সুন্দর করে গল্প বলতে পারে, এখন দেখলাম খুব সুন্দর চিঠিও লিখতে পারে। কী সুন্দর করে চিঠিটাই না লিখেছে। বাড়ির সব খবর দিয়েছে চিঠিতে, লাল গাইটা আমাকে কেমন করে খোঁজ করে, রাতে শেয়াল এসে কেমন করে মোরগ নিয়ে গেছে, বাবা কেমন উল্টাপাল্টা বাজার করে আনছেন, বড়বুবুর ছোট বাচ্চাটি কি রকম দুষ্টু, এইরকম সমর্জার মজার খবর। রাঙাবুবুও আবার বড় বোনের মতো উপদেশ দিয়েছে, তার লিখেছে আমি যেন কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা না করি, কারণ দেখতে দেখতে রোজার দুটি এসে যাবে, আর তখন আমি বাড়ি চলে আসতে পারব।
রাঙাবুবুর চিঠি শেষ করে আমি পড়লাম দুলালের চিঠি। দুলাল আর আমি একজন আরেকজনকে তুই তুই করে বলি, কিন্তু সে চিঠি লিখেছে তুমি তুমি করে। সারা চিঠিতে অনেকগুলো বানান ভুল। ‘ড়’ বলে যে একটা অক্ষর আছে মনে হয় সে জানেই না, ‘বাড়ি’কে লিখেছে ‘বারি’, ‘পড়া’কে লিখেছে ‘পরা’! বানান ভুল থাকুক আর যাই থাকুক, চিঠিটার মাঝে অনেক খবর আছে। আমি নেই বলে গোল্লাছুট খেলা আর জমছে না, এই বছর ফুটবল টিম বেশি সুবিধে করতে পারছে না, মেম্বার সাহেবের ছোট ছেলে যাত্রাদলের একটা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে মেম্বার সাহেব তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন, বাজারের কাছে সে একটা ঘর ভাড়া করে আছে, মাছবাজারে আগুন লেগেছিল, বেশি ক্ষতি হওয়ার আগেই আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে, নীল গাঙে নাকি একটা মাছ ধরা পড়েছে, সেটার অর্ধেক মানুষ অর্ধেক মাছ, জেলের সাথে কথা বলেছে, তখন জেলে তাকে ছেড়ে দিয়েছে, উল্লাপুরের পীর সাহেব এক টাকার নোটকে দশ টাকার নোট বানিয়ে দিচ্ছেন, খানসাহেবের ছোট ছেলে খৎনা করার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে ইত্যাদি। চিঠির শেষে লিখেছে, গাড়ি চড়ার লোতে তাকে ছেড়ে চলে আসাটা একেবারেই ভালো কাজ হয় নাই। জীবন অল্পদিনের প্রাণের বন্ধুর মনে আঘাত দেওয়া ভালো কাজ নয়, আল্লাহ্ নারাজ হতে পারেন।
সবার শেষে বাবার চিঠিটা হাতে নিলাম। বেশি বড় চিঠি নয়, রুল-টানা কাগজের দুই পৃষ্ঠায় লেখা। বাবার হাতের লেখা বেশ ভালো, তবে বেশি লেখেন না। বাবাও আমাকে তুই-তুই করে বলেন, কিন্তু লিখেছেন তুমি করে। বাবা লিখেছেন :
বাবা বিলু :
পর সমাচার এই যে, তুমি চলিয়া যাইবার পর লাল গাইটি অত্যন্ত মন-খারাপ করিয়াছে। গতকল্য সে আমার সহিত দীর্ঘ সময় কথা বলিয়াছে। সে এবং তাহার বাছুর দুইজনেই মনে করে তোমার অবিলম্বে ফিরিয়া আসা উচিত। পশুপাখি সাধারণত সত্য কথা বলিয়া থাকে, তুমি বিবেচনা করিয়া দেখিবা।
বাড়ির পিছনে যে জঙ্গল রহিয়াছে, সেইখানে যে বড় গাবগাছটি রহিয়াছে, সেইটি আমাকে বড়ই বিরক্ত করিতেছে। গাবগাছটির ধারণা, তাহার উপর একটি দুষ্ট প্রকৃতির ভূত রাত্রিনিবাস করিয়া থাকে। আমি তাহাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করিয়াছি যে পৃথিবীতে ভূত বলিয়া কিছু নাই সব তাহার মনের ভুল। তুমি আসিয়া তাহাকে একবার বুঝাইলে সম্ভবত সে বিশ্বাস করিবে। বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস যে ভূত নিয়া গবেষণা করিয়া তাহা প্রমাণ করিয়াছেন, সেইটি অবশ্যি অবশ্যি তাহাকে বুঝাইয়া দিণ্ড।
তোমার মা তোমার খবরের জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়াছেন বলিয়া আমি মাছবাজারের বড় দড়িকাকটিকে তোমার হোট খালার বাসায় পাঠাইয়াছিলাম। প্রথমে সে এত দূরে উড়িয়া যাইতে রাজি হয় নাই, রাজি করাইবার জন্য তাহাকে একটা কুকী বিস্কুট কিনিয়া দিতে হইয়াছিল। সে ফিরিয়া আসিয়া বলিয়াছে যে তুমি ভালোই আছ, কিন্তু বাড়িতে ফিরিয়া আসিবার জন্য তোমার মন অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছে। মাঝে মাঝে খবরের জন্য আমি তাহাকে তোমার কাছে পাঠাইব। তুমি দেখিলেই চিনিতে পারিবে, সে একটু গম্ভীর প্রকৃতির এবং ডান পা’টি একটু টানিয়া টানিয়া হাঁটে। তাহার চক্ষু লাল রঙের। তাহাকে দেখিলে তুমি একটি কুকী বিস্কুট কিনিয়া দিও, সে কুকী বিস্কুট খাইতে খুব পছন্দ করে।
তোমার পিতা
ফজলুল করিম।
চিঠিগুলো পড়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম, মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। দূরে অনেকগুলো কাক ঝগড়া করছে, কে জানে এর মাঝে বাবার সেই লাল চোখের দাঁড়কাকটি আছে কি না।
এরকম সময়ে বল্টু এসে বলল, আম্মা বলেছে তোমার বাবার চিঠিটা দিতে।
কেন?
জানি না। মনে হয় আরাকে দেখাবে।
আমি বললাম, চিঠিটা নাই।
কেন? কী হয়েছে? ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
ছিঁড়ে ফেলেছ?
হ্যাঁ।
কেন?
আমি পকেটে হাত দিয়ে বাবার চিঠিটা ছুঁয়ে সরল মুখে বললাম, আমি সবসময় চিঠি পড়া শেষ হলে ছিঁড়ে ফেলি। রেখে কী হবে?
বল্টু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। আমি তখন বাবার চিঠিটা বের করে আবার পড়তে শুরু করলাম।