চমৎকার সকাল।
সূর্যের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। আকাশের রঙ ঘন নীল। ছবির মতো সুন্দর একটি শহরে ট্রেন এসে থেমেছে। ট্রেন থেকে নেমে তারা একটি ছোট্ট কাচের ঘরে ঢুকল। এখান থেকে চারদিক দেখা যায়। ইরিনা মুগ্ধ হয়ে গেল। কেউ তাকে বলে দেয় নি, কিন্তু সে বুঝতে পারছে এটা হচ্ছে তৃতীয় শহর। সুখের শহর, দুঃখ এখান থেকে নির্বাসিত। এর আকাশ-বাতাস পর্যন্ত অন্য রকম। সে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, কী সুন্দর, কী সুন্দর!
মীর তার পাশেই, সে কিছু বলল না। হাই তুলল। রাতে তার ঘুম ভালো হয় নি। ঘুম ঘুম লাগছে। তৃতীয় নগরীর সৌন্দর্য তাকে স্পর্শ করছে না।
ইরিনা বলল, এখন আমরা কোথায় যাব?
মীর হাই চাপতে চাপতে বলল, তুমি এত ব্যস্ত হলে কেন? ওরা ব্যবস্থা করে রেখেছে। যথাসময়ে কোথাও চাপাবে। যথাসময়ে পৌঁছবে।
হাতে কিছু সময় থাকলে শহরটা ঘুরে দেখতাম।
আমি দেখাদেখির মধ্যে নেই, তোমাকে যেতে হবে একা। আমি ঘুমুবার চেষ্টা করছি। কোথাও যেতে চাইলে যাবে আমাকে জাগাবে না।
মীর সত্যি সত্যি ঘুমুবার আয়োজন করল। তারা বসে আছে ছোট্ট একটা ঘরে। এত ছোট যে হাত বাড়ালে দেয়াল এবং ছাদ দুই-ই ছোয়া যায়। এতটুকু ঘরেও চার-পাঁচটা চেয়ার সাজানো। তেমন কোনো আরামদায়ক কিছু নয়। ঘরের দেয়াল অতি স্বচ্ছ কাচ জাতীয় পদার্থের তৈরি। বাইরের সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। অরচ লীওন তাদের এখানে বসিয়ে রেখে উধাও হয়েছেন, আর কোনো খোজ নেই। ইরিনা একবার বেরুতে চেষ্টা করল। বেরুবার পথ পেল না। দরজা-টিরজা এখন কিছুই নেই বলে মনে হচ্ছে। অথচ এই ঘরে ঢোকার সময় কোনো বাধা পাওয়া যায় নি।
মীর, আপনি কি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?
চেষ্টা করছি।
এটাকে কেমন যেন খাঁচার মতো মনে হচ্ছে। বেরুতে পারছি না।
বেরুবার দরকারটা কি?
ইরিনার অস্বস্তি লাগছে, এমন নির্জন জায়গা। আশেপাশে একটিও মানুষ নেই, অথচ বাইরের কত চমৎকার সব দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
মীর, আপনি এরকম চোখ বন্ধ করে থাকবেন? আমার ভয় ভয় লাগছে।
ভয় ভয় লাগার কারণ কি?
মানুষজন কিচ্ছু নেই।
মানুষজন ঠিকই আছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ না। কাচের এই ঘরটায় বসে তুমি বাইরের যেসব দৃশ্য দেখছ, তা সত্যি নয়। বানান, মেকি।
তার মানে! তার মানে আমি জানি না। টেলিভিশনে যেমন ছবি দেখ, এখানেও তাই দেখছ। একটাও সত্যি নয়।
কি করে বুঝলেন?
খুব সহজেই বুঝলাম। আমরা ট্রেন থেকে নেমেছি ভোর হবার ঠিক আগে আগে। রোবটটি আমাকে বলল সূর্য ওঠার ঠিক আগে আগে ট্রেন পৌঁছবে। অথচ এই ঘরে বসে আমরা দেখছি সূর্য মাথার ওপরে।
তই তো।
ইরিনা পরিষ্কার চোখে দেখার চেষ্টা কর এবং আমার মনে হয় এখন থেকে যা দেখবে তাই বিশ্বাস করার অভ্যাসটা ত্যাগ করলে ভালো হবে। এই দেখ আমাদের চারপাশে দৃশ্য এখন বদলে গেল।
ইরিনা মুগ্ধ হয়ে দেখল সত্যি সত্যি সব বদলে গেছে। তাদের চারপাশে এখন ঘন নীল সমুদ্র, ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সমুদ্রসারস উড়ছে। সমুদ্রের নীল পানিতে সূৰ্য প্রায় ড়ুবু ড়ুবু। সে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, অপূর্ব!
মীর বলল, আমার মনে হচ্ছে এটা যাত্রীদের বিশ্রামের কোনো জায়গা। অনেকক্ষণ যাদের অপেক্ষা করতে হয় তারা যাতে বিরক্ত না হয় সেই ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে।
সুন্দর ব্যবস্থা। আপনার কাছে সুন্দর লাগছে না?
না। এর চেয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন আমি দেখি।
এটা তো আর স্বপ্ন নয়।
স্বপ্ন নয় তোমাকে বলল কে? পুরোটাই স্বপ্ন। সুন্দর সুন্দর ছবি দেখছ, যার কোনো অস্তিত্ব নেই।
ঘরের চারপাশের দৃশ্য আবার বদলে গেল। এখন দেখা যাচ্ছে চারপাশেই উচু উচু পাহাড়। পাহরে চূড়ায় বরফ জমেছে। সূর্যের আলোয় সেই বরফ ঝিকমিক করছে। ইরিনা মুগ্ধ গলায় বলল, এবারের দৃশ্য আরো সুন্দর!
বলতে বলতেই ছবি কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল। ইরিনার মনে হল ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। কানে ঝিঝি শব্দ। সে কোনোমতে বলল, এসব কী হচ্ছে?
মীর ক্লান্ত গলায় বলল, আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাদের যেখানে নেবার, সেখানে ঘুমন্ত অবস্থায় নেবে। যেন…
গভীর গাঢ় ঘুমে দুজনেই তলিয়ে যাচ্ছে। ইরিনা প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে জেগে থাকতে। কিছুতেই পারছে না, চোখের সামনের আলো কমে কমে প্ৰায় অন্ধকার হয়ে এল। দূরে তীক্ষ্ম বাঁশির আওয়াজের মতো আওয়াজ। ইরিনা তার মাকে ডাকতে চেষ্টা করল। পারল না। তার দুচোখে অতলান্তিক ঘুম।