মনকে সংযত করবার পূর্বে মনকে জানতে হবে।
চঞ্চল মনকে সংযত ক’রে বিষয় থেকে টেনে এনে একটা ভাবে স্থির ক’রে রাখতে হবে। বারবার এইরকম করতে হবে। ইচ্ছাশক্তি দ্বারা মনকে সংযত ক’রে, রুদ্ধ ক’রে ভগবানের মহিমা চিন্তা কর।
মনকে সংযত করবার সব চেয়ে সোজা উপায় চুপ ক’রে বসে কিছুক্ষণের জন্য মনকে ছেড়ে দেওয়া, যেখানে সে ভেসে যেতে চায় যাক-দৃঢ়ভাবে চিন্তা করবে, ‘আমি দ্রষ্টা, সাক্ষী; বসে বসে মনের ভাসাডোবা-ভেসে-যাওয়া দেখছি। মন আমি নয়!’ তারপর মনটাকে দেখ। ভাবো, মন থেকে তুমি সম্পূর্ণরূপে পৃথক। ভগবানের সঙ্গে নিজেকে অভিন্নভাবে চিন্তা কর, জড়বস্তুর বা মনের সঙ্গে নিজেকে এক ক’রে ফেলো না।
কল্পনা কর-মন যেন তোমার সম্মুখে প্রসারিত একটা নিস্তরঙ্গ হ্রদ, এবং যে চিন্তাগুলি মনে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে, সেগুলি যেন হ্রদে বুদ্বুদ্ উঠছে আর তার বুকে লয় পাচ্ছে। চিন্তাগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করবার কোন চেষ্টা ক’রো না, কল্পনার চক্ষে সেগুলি কেবল সাক্ষীর মতো দেখে যাও-কেমন ক’রে তারা ভেসে চলেছে। একটা পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন প্রথমে খুব ঘন ঘন তরঙ্গ ওঠে, তারপর তরঙ্গের পরিধি যত বেড়ে যায়, তরঙ্গ তত কমে আসে; তেমনি মনকে ঐভাবে ছেড়ে দিলে তার চিন্তার পরিধি যত বেড়ে যাবে, মনোবৃত্তি তত কমে আসবে। কিন্তু আমরা এই প্রণালী উলটে দিতে চাই। প্রথমে একটা চিন্তার বড় বৃত্ত থেকে আরম্ভ ক’রে সেটাকে ছোট করতে করতে যখন মন একটা বিন্দুতে আসবে, তখন তাকে সেখানে স্থির ক’রে রাখতে হবে। এই ভাবটি ধারণা করঃ আমি মন নই; আমি দেখছি-আমি চিন্তা করছি, আমি আমার মনের গতিবিধি লক্ষ্য করছি। এইরকম অভ্যাস করতে করতে নিজের সঙ্গে মনের যে অভিন্নভাব, তা দিন দিন কমে আসবে; শেষ পর্যন্ত নিজেকে মন থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক্ ক’রে ফেলতে পারবে, এবং ঠিক ঠিক বুঝতে পারবে, মন তোমার থেকে পৃথক্।
এটা যখন হয়ে যাবে, তখন মন তোমার চাকর, তাকে তুমি ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে। যোগী হওয়ার প্রথম স্তর-ইন্দ্রিয়গুলিকে অতিক্রম করা; আর যখন মনকে জয় করা হয়ে গেছে, তখন সাধক সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছে।
যতদূর সম্ভব একলা থাকবে। আসন নাতি-উচ্চ হওয়া উচিত; প্রথমে কুশাসন, তারপর মৃগচর্ম, তারপর রেশম বা পট্টবস্ত্র বিছাবে। হেলান দেবার কিছু না থাকাই ভাল, আর আসন যেন দৃঢ় হয়।
সর্বপ্রকার চিন্তা ত্যাগ ক’রে মনকে খালি ক’রে ফেলো; যখনই কোন চিন্তা মনে উঠবে, তখনই তাকে দূর ক’রে দেবে। এই কাজ সম্পন্ন করতে গেলে জড় বস্তুকে ও আমাদের দেহকে অতিক্রম ক’রে যেতে হবে। বাস্তবিকপক্ষে মানুষের সমগ্র জীবনই ঐ অবস্থা আনবার একটি অবিরাম চেষ্টা।
চিন্তাগুলি ছবি, ওগুলি আমরা সৃষ্টি করি না। প্রত্যেক ধ্বনির বা শব্দের নিজস্ব অর্থ আছে; আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে এগুলি জড়িত।
আমাদের শ্রেষ্ঠ আদর্শ হচ্ছেন ভগবান্। তাঁকেই ধ্যান কর। আমরা জ্ঞাতাকে জানতে পারি না, কারণ আমাদের স্বরূপই যে তিনি। অশুভ দেখি বলেই অনর্থের সৃষ্টি আমরা নিজেরাই করি। আমরা ভিতরে যা, বাইরে তাই দেখি, কেন না জগৎটা আমাদের আয়নার মতো। এই ছোট দেহটা আমাদের সৃষ্ট একখানি ছোট আয়না, প্রকৃতপক্ষে সারা বিশ্বই হচ্ছে আমাদের শরীর। সর্বদা এই চিন্তা করতে হবে, তবেই বুঝতে পারবো-আমরা মরি না বা কাকেও আঘাত করতে পারি না, কারণ যাকে আঘাত ক’রব সেও যে আমিই। আমাদের জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই; আমাদের কর্তব্য শুধু সকলকে ভালবেসে যাওয়া।
‘এই বিশ্বজগৎ আমার শরীর; সমস্ত স্বাস্থ্য, সমস্ত আনন্দ আমারই; কারণ সবই যে বিশ্বের ভেতর।’ বলো, ‘আমি এই বিশ্বজগৎ’। অবশেষে বুঝতে পারি-যা কিছু কর্মব্যাপার, সবই আমাদের থেকে আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
যদি মনে হচ্ছে, আমরা ছোট তরঙ্গের মতো, আমাদের সকলের পশ্চাতে এক অখন্ড সমুদ্র, এবং আমরা সকলেই তার সঙ্গে মিলিত। সমুদ্র ছাড়া তরঙ্গ একা থাকতে পারে না।
ঠিকভাবে নিয়োজিত হ’লে কল্পনা আমাদের পরম বন্ধুর কাজ করে। কল্পনা যুক্তির রাজ্য ছাড়িয়ে যায়, এবং একমাত্র কল্পনার আলোই আমাদের সর্বত্র নিয়ে যেতে পারে।
প্রেরণা আমাদের ভেতর থেকে ওঠে, তাই নিজ নিজ উচ্চতর শক্তি দ্বারা আমাদের নিজেদের অনুপ্রাণিত করতে হবে।