আমার ঘুম ভেঙেছে। চোখ মেলতে ইচ্ছা করছে না। কেন জানি মনে হচ্ছে চোখ মেললেই দেখব শান্তি-রোবটটা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সে তার ঘন নীল চোখে আমাকে দেখছে। সেই দৃষ্টিতে আর যা-ই থাকুক ভালবাসা নেই। অবশ্যি ঘৃণাও থাকবে না। রোবটবাহিনী ঘৃণা-ভালবাসার ঊর্ধ্বে।
আমার কপালে একের পর এক যা ঘটছে তাতে মনে হয় সিডিসি তাকে রেখে দিয়েছে আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে। আমি চোখ মেললেই সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে। এই পৃথিবীর সবচে কুৎসিত দৃশ্য সম্ভবত রোবটদের হাসি বা তাদের হাসির ভঙ্গি। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে আইন পাস করিয়ে এদের হাসি বন্ধ করার ব্যবস্থা করা যায় না?
ঘুম ভাঙার পর বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকা যায় না। ভেতর থেকে কে যেন বলতে থাকে, চোখ মেল। চোখ মেল।
আমি চোখ মেললাম। এবং হতাশ হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি আমার পাশে শান্তি-রোবটটা দাঁড়িয়ে আছে এবং হাসার মতো ভঙ্গি করছে। রোবটটার গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় কলে কেমন হয়? সে তার উত্তরে কী করবে? আমার গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় বসাবে? মনে হয় না। কারণ তাদের রাগ নেই। চড় খাবার পরেও আমার ধারণা সে বেশ স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার ঠোটের ফাকে আগের মতোই হাসির আভাস থাকবে।
আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম, তারপর তোমার খবর কি? সব ভাল তো?
রোবট কিছু বলল না। মানুষের মতো হ্যাঁ-সূচক মাথাও নাড়ল না। শুধু তার নীল চোখ একটু যেন বেশি জ্বলে উঠল।
তোমাকে কি আমার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে?
আমাকে বলা হয়েছে আপনার দিকে লক্ষ রাখতে।
আমি ঘর থেকে বের হতে পারব না?
তা তো আমি বলতে পারব না। সিডিসি যদি অনুগ্রহ করে দরজা খুলে দেন তাহলে আপনি বের হতে পারবেন। তবে আপনি যেখানেই যান আমি আপনার দুমিটার দূরত্বে থাকব।
শুনে খুবই আনন্দিত হলাম। একমিটারের ভেতর থাকলে আরো ভাল হত। কী আর করা। দেখি হাতটা বাড়াও তো হ্যান্ডশেক করি।
আমি হাত বাড়িয়ে আছি। শান্তি-রোবটটা সেই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের হাত বের করছে না। মনে হচ্ছে সে ধাঁধায় পড়ে গেছে।
আমি বললাম, মানবসমাজের অতি প্রাচীন নিয়মের একটি হচ্ছে দুজন যখন বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে কাছে আসে তখন তারা একজন আরেকজনের হাত ধরে। এবং কিছুক্ষণ ঝাঁকাঝাঁকি বা নড়াচাড়া করে।
কেন?
ভাল প্রশ্ন করেছ। হাত না ধরে দুজন দুজনের পা বাড়িয়ে দিতে পারত। পায়ে পায়ে ঘষাঘষি করতে পারত। তা না করে কেন হাত ধরে তা আমি জানি না। মহাজ্ঞানী সিডিসিকে এক ফঁাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব। তার আগে আমরা কি হ্যান্ডশেক করতে পারি?
রোবটটা তার হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি তার হাত ধরতে-ধরতে বললাম, তোমার হাত তো বেকুবের মতো ধরলাম। এখন অটো সিস্টেমে তোমার হাত থেকে আমার হাতে সিরিঞ্জ ঢুকে যাবে না তো? বন্ধু পাতাতে গিয়ে শাঁ করে রক্তে ঘুমের ওষুধ ঢুকে গেল আর আমি ধড়াম করে বিছানায় পড়ে গেলাম। বাকি কয়েক ঘণ্টা আর কোন খবর নেই।
না তা হবে না।
আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত কি সিডিসি তোমাকে দেয়? নাকি তুমি নিজেই নাও?
এই সিদ্ধান্তটি সিডিসির কাছ থেকে আসে।
তাহলে তোমাদের গুরুদেব হচ্ছে মহাজ্ঞানী সিডিসি।
সবকিছুর মূল নিয়ন্ত্রণ তাঁর কাছে। এবং অবশ্যই তিনি মহাজ্ঞানী।
আমি হাই তুলতে-তুলতে বললাম, একটা মিথ্যাবাদীর হাতে তোমাদের সব নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে?
আপনি ভুল করছেন, কম্পিউটার মিথ্যা বলতে পারে না।
আমি হতাশ গলায় বললাম, কম্পিউটার মিথ্যা বলতে পারে কি পারে না তা আমি জানি না। আমি অতি সাধারণ মানুষ। মহাজ্ঞানীদের কেউ না। তবে আমি প্রমাণ করে দিতে পারি যে তোমাদের গুরুদেব মহা-মিথুক। যা-ই হোক প্রমাণ পরে করা যাবে। আপাতত আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। আমাকে কিছু খেতে হবে। তুমি মানুষ হলে তোমাকেও আমার সঙ্গে খেতে বলতাম। দুর্ভাগ্য যে তুমি মানুষ না। তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা কর। আমি কিছু খেয়ে আসি। বেশি সময় লাগবে না। যাব আর আসব।
আমাকেও আপনার সঙ্গে যেতে হবে। আমি আগেই বলেছি আমাকে আপনার দুমিটারের মধ্যে থাকতে হবে। তার বেশিও না কমও না।
বেশ তো এসো আমার সঙ্গে। যে রোবটটি আমাকে খাবার দেয় সে বেশ। ভালমানুষ টাইপ রোবট। আমি আদর করে তার নাম দিয়েছি এলা। সে কারো শরীরে সুচ ঢুকায় না। তার সঙ্গে তোমার প্রেমও হয়ে যেতে পারে। না কি রোবটদের মধ্যে প্রেম হয় না?
শান্তি-রোবট জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে স্বল্পভাষী। সে কথার চেয়ে কর্মে বিশ্বাসী।
আমি খাবারঘরের দিকে রওনা হলাম।
টেবিলে আমার জন্যে খাবার সাজানোই ছিল। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে আগে খানিকটা ফ্লেটিশ মাছের ডিম খেলাম। পরিজ-জাতীয় একটা খাবার খেলাম। এই খাবারটা আগে খাই নি। অত্যন্ত সুস্বাদ। মটরদানার তৈরি কিছু খাবার ছিল। খাবারটার বৈশিষ্ট্য হল—খেতে ভাল লাগে না। কিন্তু মুখের খাবারটা শেষ হয়ে গেলে আবারো খেতে ইচ্ছা করে। সেই অদ্ভুত খাবারও খাব না খাব না করে বেশ খানিকটা খেয়ে ফেললাম। পরপর দুকাপ গরম কফি খেলাম। শরীরটা মনে হল ঠিক হয়ে আসছে। এতক্ষণ মাথা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল, সেই ফাঁকা ভাব কিছুটা যেন কমেছে।
এলার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলে কেমন হয়? শান্তি-রোবটটাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াও আমার সামাজিক দায়িত্ব। দুজনের মধ্যে প্রেম হলেও ক্ষতি কী?
এলা! জ্বি।
তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি—এ শান্তি-রোবট। অশান্তি-রোবট নাম হলে ভাল হত। এই শান্তি-রোবটের সবই ভাল—শুধু সুচ ফোটায়, তবে তোমাকে সুচ ফুটিয়ে কিছু করতে পারবে না। হা হা হা।
এলা বলল, আপনি মনে হয় খুব আনন্দে আছেন?
আমি হাসতে-হাসতে বললাম, ঠিক ধরেছ আমি আসলেই আনন্দে আছি। সেই আনন্দের উৎস কি ধরতে পারছি না। তুমি কেমন আছ? আনন্দে না নিরানন্দে?
আমরা আনন্দেও থাকি না, নিরানন্দেও থাকি না। আমরা শুধু থাকি।
তোমাকে নিয়ে আমি একটা ছড়া লিখেছি।
কখন লিখলেন?
এই এখন। ছড়াটা খুব উচ্চমানের হয় নি। নিম্নমানেরও হয় নি। নিম্নের নিচে যদি কিছু থাকে তা হয়েছে।
ছড়াটি কি আপনি আমাকে শোনাবেন?
অবশ্যই শোনাব। ছড়াটা হল–
এলা এলা
চলে যাচ্ছে বেলা
কাজ হল মেলা
এখন শুধুই খেলা।
এলা বলল, স্যার আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
একটু আগেই যে বললে তুমি আনন্দিতও হতে পার না, আবার দুঃখিতও হতে পার না।
স্যার মনে হয় ভুল বলেছি। এখন আমার আনন্দ হচ্ছে।
এর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ ফাজলামি করা যেত, তা করা গেল না। খাবারঘরে দপ করে লাল আলো জ্বলেই নিভে গেল। এই আলো হল মনযোগ আকর্ষণমূলক আলো। কেউ আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। আমি কান পেতে রইলাম।
ইয়ায়ু আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সিডিসি কথা বলছে। আমাকেই বলছে, আমিই হলাম ইয়ায়ু। গাধাটা এই নাম কোত্থেকে জোগাড় করল? আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কেন ইয়ায়ুর দৃষ্টি আকর্ষণ করছ?
কাউন্সিলের সামনে উপস্থিত হতে হবে।
কাউন্সিল আবার কী?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কারণ আপনাকে বলা হয়েছে যে এই মহাকাশযানে পৃথিবীর অত্যন্ত খ্যাতনামা কিছু মানুষ আছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন সাত তারকা সম্মানে সম্মানিত বিজ্ঞানী সুরা এবং লিলিয়ান। সাত তারা খচিত বিজ্ঞানীদের যে কোন তিনজন উপস্থিত থাকলেই তাঁরা কাউন্সিলের অধিবেশন ডাকতে পারেন। এবং তিনজন একমত হলে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যদিও এই মহাকাশযানে তিনজন সাত তারা খচিত বিজ্ঞানী নেই, তার পরেও বিশেষ অধিবেশন ডাকার ক্ষমতা তাদের আছে। বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়েছে। মহাকাশযানের সকল সদস্যদের উপস্থিত হতে বলা হয়েছে।
অধিবেশন ডাকা হয়েছে কেন? আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্যে? আবারো কোন গুরুত অপরাধ কি করে ফেলেছি?
আমি তা বলতে পারছি না। তবে এই অধিবেশন ডাকার মূল কারণ যে আপনি তা বলতে পারছি।
আমি হাই তুলতে-তুলতে বললাম, আমি এখন যেতে পারছি না। খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে। আঁসফাস লাগছে। ভাবছি এর সঙ্গে গল্পগুজব করার পর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। গড়াগড়ি করব।
কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়েছে, আপনাকে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে, আর আপনি বলছেন আপনি শুয়ে থাকবেন?
হ্যাঁ তা বলছি। বলাটা কি খুব অন্যায় হয়েছে?
আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। আপনি এক্ষুণি হলঘরে যাবেন। শান্তি-রোবট আপনাকে নিয়ে যাবে।
হলঘর শুনলে মনে হয় বিশাল একটা ঘর। এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখা যায় না এমন। আসলে তা না, হলঘরটা বেশ ছোট এবং মহাকাশযানের বেশিরভাগ ঘরের মতো গোলাকার। মাঝখানে স্টেজের মতো জায়গায় যে দুজন বসে আছেন তাদের একজনকে চিনতে পারছি, তার নাম সুরা। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তাঁর হাতে ডিটেকটিভ বইটা এখনো আছে। এবং আমি যখন ঢুকলাম তখনও তিনি বইটা পড়ছিলেন। আমাকে একঝলক দেখেই বই-এ চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
সুরার পাশে যিনি বসে আছেন তিনি নিশ্চয়ই লিলিয়ান। লিলিয়ান একজন মহিলা হবেন তা নাম থেকেই আমার আঁচ করা উচিত ছিল। আঁচ করতে পারি নি। সুরার চেহারায় যেমন শিশুসুলভ ব্যাপার আছে এই মহিলার চেহারায় তা নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কোনরকম ছেলেমানুষির প্রশ্রয় অতীতে দেন নি। ভবিষ্যতেও দেবেন না। মহিলা অসম্ভব রূপবতী, তবে চেহারা রুক্ষ ও কঠিন। তাঁর কাঠিন্য রূপকে ছাড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া ভদ্রমহিলার চোখ অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে এমন রূপবতী মহিলার প্রেমে কেউ কখনোই পড়বে না। ভেলেনটাইনস ডে তে ফুল এবং চকোলেট পাবার আশা এই মহিলার নেই।
হলঘরে সকল সদস্য মূর্তির মতো বসে ছিল। তাদের বসার জায়গাটা অনেকটা প্রাচীনকালের থিয়েটারের বক্সের মতো। সবাই আলাদা আলাদা খুপরিতে বসে আছেন। প্রতিটি খুপরি কাচ দিয়ে ঢাকা। কারোর সঙ্গে কারোর কোন যোগ নেই।
আমি হলঘরে ঢুকতেই সবাই আমার দিকে তাকাল। আমি বিনীতভাবে হাসলাম। কেউ সেই হাসির উত্তর দিল না। সবাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার মূর্তির মতো হয়ে গেল। শুধু লিলিয়ান তাকিয়ে থাকলেন। হলঘরে খালি খুপরি আরো আছে। আমাকে কেউ বসতে বলল না বলে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে ভয়াবহ কোন অপরাধীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে লিলিয়ান আমার বিচার করবেন। বাকি সবাই জুরি বোর্ডের মেম্বার। বিচারের রায়ে আমার মৃত্যুদণ্ড হবে। এ বিষয়ে কারো মত পার্থক্য থাকবে না, শুধু মৃত্যুদণ্ডটা কিভাবে হবে তা নিয়ে কথা কাটাকাটি হবে। কেউ বলবেন ইলেকট্রিক চেয়ার আবার কেউ বলবেন ইনজেকশন মেথড।
লিলিয়ান বললেন—(তাঁর গলার স্বরও চেহারার মতোই কঠিন, আমি মনে মনে আশা করেছিলাম তাঁর গলার স্বরটা মিষ্টি হবে।) কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন শুরু হচ্ছে। মহামান্য সুরা! অধিবেশন আপনি ডেকেছেন। আপনার যা বলার তা বলুন।
সুরা উঠে দাঁড়ালেন। অন্য সবাই তাঁর সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সুরা হাতের ইশারায় বসতে বললেন। সবাই বসল। এটাই বোধহয় নিয়ম। আমার কাছে কেমন যেন হাস্যকর লাগছে। জ্ঞানী মানুষরা সবসময়ই কিছু হাস্যকর কাণ্ডকারখানা করেন।
সুরা বললেন, শান্তি-রোবটের পাশে যাকে আপনারা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন তার নাম-ইয়ায়ু।
আমি হাত তুললাম এবং গলাখাকারি দিয়ে বললাম, স্যার আপনি সামান্য ভুল করছেন। আমার নাম ইয়ায়ু নয়। আমার নাম মানুষ। সম্ভবত আপনি ঘটনাটা ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা না। আমি হলে চেহারাও ভুলে যেতাম। আপনি চেহারাটা মনে রেখেছেন এতেই আমি মহাখুশি।
হলের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের তাকানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে আমি ভয়াবহ কোন অন্যায় করে ফেলেছি। আমার কথা শেষ হবার পরও বেশ কিছু সময় কেউ কোন কথা বলল না। লিলিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। হলের সবাই তার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সবাই মিলে কি পিটি করছে নাকি? কী হাস্যকর। কী হাস্যকর। তিনি তাদের বসতে বললেন। সবাই বসল। লিলিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাউন্সিল অধিবেশনে বিনা অনুমতিতে কথা বলা অমার্জনীয় অপরাধ। এই বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। এখন মহামান্য সুরা তাঁর বক্তব্য শেষ করবেন।
সুরা বললেন, ইয়ায়ু বা মানুষ নামের এই ভদ্ৰলোক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি দাবি করছেন তাকে জোর করে মহাকাশযানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি কোন ভলেন্টিয়ার না। বিষয়টির মীমাংসা হওয়া উচিত।
লিলিয়ান বললেন, বিষয়টির মীমাংসা হয়েছে। আমাদের সবার সামনে একটি ফাইল আছে সেই ফাইলের কাগজপত্রের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কাগজপত্রে ইয়ায়ু ভলেন্টিয়ার হিসেবে তাকে গ্রহণ করার বিনীত অনুরোধ জানিয়ে সায়েন্স কাউন্সিলে আবেদন করেছেন। কাগজে তার হাতের ছাপ আছে। চোখের রেটিনার ছাপও আছে। আমি এই ছাপের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে নেয়া ছাপ এফটু এনালাইজার দিয়ে মিলিয়েছি। একশ ভাগ মিল পাওয়া গেছে। অধিবেশনের এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করছি। মহামান্য সুরা মাঝে মাঝে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত হন। আশা করি ভবিষ্যতে তিনি উত্তেজনা পরিহার করবেন। অবসর সময়টা গল্পের বই পড়ে কাটাচ্ছেন তা ভাল। সেইসব বই ক্রাইম-বিষয়ক না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সুরা বললেন, অধিবেশন শেষ করার আগে আমার আরেকটা তুচ্ছ বিষয় বাকি আছে। এই বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই।
সবাই তাকিয়ে আছে সুরার দিকে।
লিলিয়ানের চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি। তিনি ভুরু কুঁচকে আছেন। তাঁর চোখ মুখে বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে তো মহা যন্ত্রণায় পড়া গেল এরকম ভাব। অন্যদের ভেতর খানিকটা কৌতূহল দেখা যাচ্ছে। দুই মহান বিজ্ঞানীদের ছেলেমানুষি ঝগড়ার ব্যাপারটায় হয়ত তারা মজা পান। এখনো কিছু মজা পাবার অপেক্ষায় আছেন।
সুরা বললেন ব্যাপারটা ঘটল অবজারভেশন ডেকে। আপনারা হয়ত জানেন, অবজারভেশন ডেকে বসে গল্পের বই পড়তে আমার ভাল লাগে। এবং এও হয়ত জানেন পাঠক হিসেবে আমার রুচি খুবই নিম্নমানের। আমি সাধারণত হালকা ধরনের বই পড়ি। সাসপেন্স, থ্রিলার। প্রেমের উপন্যাসও পড়ি। কয়েকদিন আগে একটা বই শেষ করলাম—সিরিয়াস প্রেমের উপন্যাস। দুটা কম্পিউটারের মধ্যে প্রেম হয়ে গেল। একটা হল N-5 ধরনের কম্পিউটার অন্যটা QX কম্পিউটার। গভীর প্রেম হয়ে গেলেও N-5 কম্পিউটার বুঝতে পারছে যে প্রেম ব্যাপারটি তার হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ মানবিক আবেগের ব্যাপার। এবং মানব প্রজননের সঙ্গে সম্পর্কিত। N-5কম্পিউটার যখন তার অস্বাভাবিকতা বুঝল তখন সে স্বেচ্ছায় তার হার্ডডিস্ক নষ্ট করে ফেলল। অর্থাৎ বলা যেতে পারে সে আত্মহত্যা করল। QX কম্পিউটার তার প্রেমিকের আত্মহত্যা সহজভাবে নিতে পারল না। তার কাছে মনে হল এই নিঃসঙ্গ জীবন কিভাবে কাটাবে? সে একবার ভাবল নিজের হার্ডডিস্ক নষ্ট করবে, আরেকবার ভাবল করবে না। এই দুই বৈপরীত্যের মুখোমুখি দীর্ঘক্ষণ থাকায় তার লজিক-বোর্ড এলোমেলো হয়ে গেল। অর্থাৎ সে পাগল হয়ে গেল। গল্পটি ভাল। তবে QX টাইপ কম্পিউটারের লজিক-বোর্ড এলোমেলোর ব্যাপারটা একটু কষ্টকল্পিত। লেখক বলছেন লজিকবোর্ড এলোমেলো হওয়ায় বুলিয়ান এলজেব্রা…
লিলিয়ান বললেন, মহান সুরা কম্পিউটারের প্রেমের গল্প এখন কি না করলেই নয়? আমরা কি মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি না?
স্রুরা বললেন, হ্যাঁ সরে যাচ্ছি। আমার কাজের ধারাই এমন। আমি মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে থেকে কাজ করতে করতে মূল প্রসঙ্গে চলে আসি। পদার্থবিদ্যায় যে সব কাজ করার জন্যে আপনারা আমাকে মহান পদার্থবিদ বলছেন এবং সাতটা তারা গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন সেইসব কাজগুলি আমি এইভাবেই করেছি। আপনার কাজের ধারা ভিন্ন। আপনি মূল প্রসঙ্গ থেকে কখনো এক চুল সরেন নি। আমি আপনার মতো না। আমি দেখেছি বা বলতে পারেন আমার মনে হয়েছে বড় সমস্যাগুলি কেন্দ্রীভূত নয়। বড় সমস্যা কেন্দ্রের বাইরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে।
যা-ই হোক মূল কথা হচ্ছে আমি অবজারভেশন ডেকে বই পড়ছিলাম। এই যে এই বইটা পড়ছিলাম। এমন সময় ইয়ায়ু বা মানুষ নামের এই ভদ্ৰলোক এলেন। আমার সঙ্গে তাঁর কিছু কথাবার্তা হল। ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হল। খুবই পছন্দ হল। এটিও আমার একটা সমস্যা। যেই আমার সঙ্গে কথা বলে তাকেই আমার পছন্দ হয়। খুবই পছন্দ হয়। এমন কি মহান লিলিয়ানকেও আমার পছন্দ। খুবই পছন্দ।
হলঘরে চাপা হাসির শব্দ উঠেই থেমে গেল। আমি লক্ষ করলাম লিলিয়ানের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রমহিলা অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছেন। তার চেহারা থেকে কাঠিন্য সরে গেছে এবং তার মধ্যে অসহায় ভাব চলে এসেছে। ভদ্রমহিলা যে কত সুন্দর তা এখনই শুধু বোঝা যাচ্ছে।
স্রুরা বললেন—লোকটি আমার পাশে বসল। আমরা গল্পগুজব করছি। যে বইটি আমি পড়ছি তার বিষয়বস্তুই হচ্ছে আলোচনার কেন্দ্র। তখন দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটল। ঘটনাগুলো এ রকম
১. কম্পিউটার সিডিসি আলোচনায় অংশগ্রহণ করল।
২. একটি শান্তি-রোবটের আগমন ঘটল।
৩. জানা গেল ইয়ায়ু বা মানুষ নামের এই লোকটি প্রক্সিমা সেনচুরির অতি বুদ্ধিমান প্রাণীদের জন্যে সংগৃহীত একটি উপহার।
৪. ইয়ায়ু বা মানুষ তা স্বীকার করছে না। সে বলছে সে কোন কালেই ভলেন্টিয়ার হবার কথা বলে নি।
৫. সিডিসি তাকে কেবিনে যেতে বলল।
৬. সে রাজি হল না। সে বলল সিডিসি মিথ্যা কথা বলছে।
৭. শান্তি-রোবট তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে পাঁজাকোলা করে কেবিনে নিয়ে গেল।
ঘটনাগুলি অত্যন্ত দ্রুত ঘটল। এবং আমার মধ্যে কিছু বিরাট খটকার জন্ম হল। আপনারা জানেন যে কোন খটকাকে গাছের বীজের সঙ্গে তুলনা করা চলে। খটকাগুলি মন-নামক জমিতে বীজের মতো রোপিত হয়। প্রয়োজনীয় জলহাওয়া পেলে বীজ থেকে গাছ হয়। গাছ বড় হয়ে চারদিকে বিশাল সব ডালপালা বিস্তার করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল—আমার খটকা ফুলেফেঁপে একাকার হল। এবং যে কারণে মহান লিলিয়ানের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আমি কাউন্সিল অধিবেশন ডাকলাম।
স্রুরা এটুকু বলেই লিলিয়ানের দিকে হাসিমুখে তাকালেন। লিলিয়ান কঠিন গলায় বললেন, আমি কি আশা করতে পারি না যে আপনার খটকা ইতিমধ্যে দূর হয়েছে।
আশা করতে দোষ নেই। মানুষ যে কোন কিছু আশা করতে পারে। তবে আমার খটকা দূর তো হয়ই নি ক্রমেই বাড়ছে।
বেশ খটকা দূর করুন।
আমি কম্পিউটার সিডিসিকে অধিবেশনে আহ্বান করছি।
হলঘরের বাঁ পাশের পর্দায় কিছু নকশার ছবি ভেসে উঠল। নকশাগুলি ত্রিমাত্রিক এবং অসম্ভব সুন্দর। তৈরি হচ্ছে ভেঙে যাচ্ছে আবার অন্যভাবে তৈরি হচ্ছে। রঙ বদলাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় এতই সুন্দর। সুরা এখন কথা বলছেন নকশার দিকে তাকিয়ে কাজেই আমি ধরে নিলাম এই নকশাগুলিই সিডিসি।
কম্পিউটার সিডিসি।
আমি আগেও উপস্থিত ছিলাম, এখনো আছি।
বিজ্ঞান কাউন্সিল নীতিমালায় মহাকাশযানে শান্তি-রোবটের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। এটা কি সত্যি?
জ্বি সত্যি।
এই মহাকাশযানে কজন শান্তি-রোবট আছে?
চারজন।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের নীতিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে কেন?
আমরা প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহ রার মহাজ্ঞানী প্রাণীদের জন্যে একটি বিশেষ উপহার নিয়ে যাচ্ছি। মানবসম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধি যার নাম ইয়ায়ু। দুর্ভাগ্যক্রমে এই প্রতিনিধি একজন ভয়ংকর ব্যক্তিত্ব। তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যেই এই বিশেষ ব্যবস্থা।
ভয়ংকর ব্যক্তিত্ব কেন?
আপনারা তার ডিএনএ প্ৰফাইলের একটা অংশ পর্দায় দেখুন। তাহলেই বুঝবেন তিনি কত ভয়ংকর একজন মানুষ।
স্রুরা বললেন, আমরা তাহলে অতি ভয়ংকর একজন মানুষকে মানবসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাচ্ছি? খুবই ভাল কথা। ওরা বুঝবে কত ধানে কত চাল।
সিডিসি জবাব দিল না। পর্দায় ডিএনএ প্রফাইলের একটি অংশ দেখা গেল। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি। কিছুই বুঝতে পারছি না, তারপরেও আমার খুব মজা লাগছে। কেন জানি মনে হচ্ছে সব কিছুই জট পাকিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হল দাঁড়িয়ে আছি। পা ধরে গেছে। বসতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আমার মতে একজন ভয়ংকর প্রাণীকে সম্ভবত বসতে দেয়া যায় না।
স্রুরা বললেন, পর্দায় ডিএনএ ছবি দেখে আমি বা লিলিয়ান কিছুই বুঝব না। আমাদের এখানে জেনেটিকস্বিদ্যার দুজন বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের কিছু বলার থাকলে বলুন।
দাড়িওয়ালা রোগা এক ভদ্ৰলোক উঠে দাঁড়ালেন। তিনি স্পষ্ট স্বরে বললেন, ডিএনএ প্রফাইল দেখে আমি কোনরকম সন্দেহ ছাড়াই বলছি এই মানুষটির ডিএনএ প্ৰফাইলে বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে। একটা জায়গায় বেস পেয়ারের নাইট্রোজেন পরমাণুর বদলে এলুমিনিয়াম পরমাণু আছে। এই ব্যতিক্ৰম ভয়াবহ ব্যতিক্রম।
সুরা বললেন, কাজেই আপনি বলতে চাচ্ছেন যে তার জন্যে সার্বক্ষণিক শান্তি-রোবট রাখা বাঞ্ছনীয়।
অবশ্যই। এবং আমার উপদেশ হচ্ছে এই মানুষটিকে কেবিনে নয়। হিমাগারে সংরক্ষণ করে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাকে হস্তান্তরের সময়ই শুধু হিমাগার থেকে আনা হবে। তখনই শুধু তার জ্ঞান ফেরানো হবে। পুরো যাত্রাপথে সে যাবে অর্ধ-চেতন অবস্থায়।
লিলিয়ান বললেন, মহান সুরা আমরা কি ধরে নিতে পারি যে আপনার খটকা দূর হয়েছে? আমরা কাউন্সিল অধিবেশনের সমাপ্তি কি ঘঘাষণা করতে পারি?
সুরা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমার খটকা আরো বেড়েছে। এখন যে খটকা ঢুকেছে তা এই লোকটির ডিএনএ প্রোফাইলের চেয়েও ভয়ংকর। এই খটকা শুধুমাত্র সিডিসি দূর করতে পারবে। আমি এখন তাকেই প্রশ্ন করছি।
সিডিসি।
মহান সুরা আমি আছি।
ডিএনএ প্রফাইলের ভয়ংকর ক্রুটিযুক্ত একটি মানুষকে কি আমরা উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি যার জন্যে সার্বক্ষণিক শান্তি-রোবট প্রয়োজন।
জ্বি পাচ্ছি। তার নাম ইয়ায়ু।
মানব-শিশু জন্মের আগেই কি তার ডিএনএ প্রফাইল তৈরি হয় না?
জ্বি হয়। ফিটার থেকে কোষ এনে সেই পরীক্ষা করা হয়।
ডিএনএ পাইলে বড় ধরনের কিংবা মাঝারি ধরনের ত্রুটি থাকলে কি মানব-শিশু দ্রুণাবস্থাতেই নষ্ট করে ফেলা হয় না?
অবশ্যই হয়।
ইয়ায়ুর মতো ভয়াবহ ত্রুটিযুক্ত ডিএনএ নিয়ে কোন মানুষ কি পৃথিবীতে আছে?
জ্বি না, নেই।
থাকা সম্ভবও নয়। বিজ্ঞান কাউন্সিল তা অনুমোদন করবে না। এরকম ভয়ংকর একজন মানুষ পৃথিবীতে থাকতে পারে না। এটাই কি সত্যি?
জি সত্যি।
তাহলে কি আমি ধরে নিতে পারি না যে তুমি মিথ্যা কথা বলছ। তুমি ইয়ায়ুর ডিএনএ প্রফাইল আমাদের দেখাচ্ছ না। অন্য ফাইল দেখাচ্ছ।
জ্বি ধরে নিতে পারেন। যুক্তিবিদ্যা তাই বলে।
আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে একটি ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলে সে তার প্রয়োজনে যে কোন ক্ষেত্রেই মিথ্যা কথা বলতে পারে।
জ্বি ধরে নিতে পারেন।
সুরা বললেন, আমার আসলে আর কিছু বলার নেই। আমার মাথা ঘুরছে। আমি এখন অবজারভেশন ডেকে চলে যাব। বইটা শেষ করব। হাতের বইটা শেষ না করা পর্যন্ত আমি আসলে কোন দিকেই মন দিতে পারছি না। কাজেই লিলিয়ান সিদ্ধান্তের দায়িত্ব আমি তোমার উপর ছেড়ে দিলাম। এখন তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই আমার সিদ্ধান্ত।
লিলিয়ান প্রায় বাচ্চামেয়েদের মতো অনুনয়ের গলায় বলল, আপনি এখন যেতে পারবেন না।
সুরা বললেন, কে বলল যেতে পারব না। এই দেখ যাচ্ছি।
তিনি স্টেজ থেকে নেমে হেঁটে চলে গেলেন। আমি হাত উঁচিয়ে বললাম, ম্যাডাম আমি কি একটা কথা বলতে পারি? কথাটা অত্যন্ত জরুরি।
লিলিয়ান গম্ভীর গলায় বললেন–বলুন।
অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আমার পা ধরে গেছে। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার কেবিনে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারি।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অধিবেশন আপনাকে কেন্দ্র করেই আর আপনি কোন্ বিবেচনায় চলে যেতে চাচ্ছেন?
আমাকে নিয়ে অধিবেশন হলেও আমার এখানে কথা বলার সুযোগ নেই। আমি শুরুতে কিছু বলতে চেয়েছিলাম আপনি বলতে দেন নি। কঠিনভাবেই আমাকে থামিয়ে দিয়েছেন। কাজেই এখানে থেকে আমি কী করব।
এখন আমরা আপনার বক্তব্য শুনব।
এখন আমি নিজে কিছু বলব না। এবং কিছু মনে করবেন না আপনি মহান পদার্থবিদ হলেও আমার ধারণা আপনার বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নপর্যায়ের। কম্পিউটার সিডিসিকে আমি গাধা বলে ডাকি। আপনি একজন মহিলা, আপনার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে পারি না। তবে আমার মতে আপনারই চলে যাওয়া উচিত হিমাগারে। এখন আমি কি কেবিনে ফিরে যেতে পারি?
পারেন। আমি চলে এলাম। আমার পেছনে পেছনে শান্তি-রোবটও চলে এল।
জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সব কেমন জানি জট পাকিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশ্রেণীর দার্শনিক চিন্তা আমার মাথায় এসেছে। চিন্তাটা হচ্ছে—আমাদের জীবন লম্বা একখণ্ড রঙিন সুতা। এই সুতা আমরা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। তার নামই জীবনযাপন। কারো সুতা রঙিন, কারোটা আবার কালো। নাড়াচাড়া করার সময় অসাবধান হলেই সুতা জট পাকিয়ে যায়। কেউ-কেউ সেই জট খুলতে পারে, কেউ-কেউ পারে না। আর একবার যদি জট পেকে যায় তাহলে জট পাকাতেই থাকে।