ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে। দু পাশের শিরাগুলো দপদপ করছে। মোমবাতিটা পিটপিট করে জ্বলছে। খসখস একটা শব্দ।
কিরীটী সতর্ক হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, দেওয়ালের সেই গুপ্তদ্বার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই গুপ্তদ্বারপথে যার মূর্তি ভেসে উঠল, তাকে দেখে কিরীটী যেন ভূত দেখার মতই চমকে ওঠে।
মাথার ওপরে স্বল্প ঘোমটা, রাণীসাহেবা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী শয্যার ওপরে উঠে বসে বললে, আসুন রাণীসাহেবা।
কিরীটীবাবু!
বসুন রাণীসাহেবা। আপনি কেন এত রাত্রে এসেছেন তা আমি জানি।
আমাকে এ কলঙ্ক থেকে বাঁচান। কিরীটীবাবু! অসহ্য কান্নার দুর্দমনীয় বেগে রাণী যেন ভেঙে পড়লেন।
কিরীটি ঘরের মধ্যে ধীরভাবে পায়চারি করছিল, সহসা রাণীসাহেবার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর তীক্ষ্ণ অথচ চাপা কণ্ঠে বললে, আপনি যা বলছেন, তা কি সত্যি আপনার মনের কথা রাণীসাহেব? সত্যিই কি এই কলঙ্ক থেকে আপনি মুক্ত হতে চান?
হ্যাঁ।
কিন্তু দুদিন আগেও তো আপনার এ সদিচ্ছা ছিল না রাণীসাহেবা?
বিস্মিত দৃষ্টি তুলে রাণীসাহেবা কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
তার মানে?
তা হলে সে রাত্রে এমনি করে আপনি আমার কাছে সত্যকে গোপন করতেন না।
আপনি কি বলছেন কিরীটীবাবু!
রাণীসাহেবা! এখনও আপনার মনে কিন্তু আছে। আমার কাছে আগাগোড়াই আপনি নিজেকে গোপনতার আড়ালে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু বৃথা আপনার সে প্রয়াস। আপনি-আপনি বুঝতে পারছেন না। রাণীসাহেবা, কত বড় কলঙ্ক আপনার মাথার ওপরে ঝুলছে! দেবতুল্য আপনার স্বামী। আপনার প্রতি অশেষ শ্ৰদ্ধা ও ভালবাসা। একবার যখন সমস্ত কথা প্রকাশ পাবে, বুঝতে পারছেন কি, আপনার প্রতি তাঁর এই শ্রদ্ধা ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে, আপনার সকল অহঙ্কার চুর্ণ হবে! সারাটা জীবন আপনাকে চোখের জলে ভাসতে হবে। এখনও ভেবে দেখুন রাণীসাহেবা, আমার কথা এখনও ভেবে দেখুন-এ কলঙ্ক হতে মুক্তি চান, না। সারা জীবন ধরে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান? সোনার সিংহাসনে আপনি আজ সমারাঢ়। মুহুর্তে আপনি ধুলোর ওপরে লুটিয়ে পড়বেন। শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।
রাণীসাহেবা দু হাতের মধ্যে মুখ গুজে ফুলে ফুলে কাঁদিতে লাগলেন।
কিরীটি রোরুদ্যমানা রাণীসাহেবার দিকে তাকিয়ে রইল নিশ্চল হয়ে।
অনেকক্ষণ কেঁদে রাণীসাহেবা কিছুটা শান্ত হলেন, অশুধৌত মুখখানি তুলে বললেন, বলুন, আমাকে কি করতে হবে কিরীটীবাবু? আমি প্রস্তুত।
আমার ওপরে যদি বিশ্বাস রাখেন, তবে সব কথা আমায় খুলে বলতে হবে।
জিজ্ঞাসা করুন।
সে রাত্রে, মানে যেদিন আপনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেদিন দ্বিপ্রহরে আপনার স্বামীকে মেসমেরাইজড করা হয়েছিল, কেমন, সত্যি কিনা?
হ্যাঁ।
কিন্তু মোসমেরাইজ তাঁর সেদিন ভাঙানো হয়নি।
না, না, তাকে আবার ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল।
না, আপনি জানেন না, তা হয়নি। মোসমেরাইজের ঝোকেই আপনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার সেই অবস্থাতেই আপনারা তাকে নিয়ে গিয়ে শয্যায় শুইয়ে দেন। বুঝতে পারছেন কি, কত বড় নিষ্ঠুরতা আপনার স্বামীর প্রতি সেদিন করা হয়েছিল! আপনার জেগে থাকা অবস্থাতেই আপনার স্বামী আপনার চোখের সামনে আয়রন সেফ খুলে ঝাপিসমেত সিংহাসনটি বের করে নিয়ে গুপ্তদ্বারপথে নীচে চলে যান, তাই না?
রাণীসাহেবা চুপ করে রইলেন।
কিরীটী আবার বলতে লাগল, কেমন করে সে কথা প্রথম আমার মনে উদয় হয় জানেন? এই মেরজাবটা (তারের যন্ত্র বাজাতে হলে আঙুলের মাথায় যে জিনিসটি পরে নিতে হয়) আমি ঝাঁপির মধ্যে পাই। কিরীটী সেটা পকেট থেকে বের করে দেখালে এবং বললে, এটা আপনার স্বামীরই, এটা প্ল্যাটিনামের তারে তৈরী। এ ধরনের মেরজাবি আপনার স্বামীই সেতার বাজাবার সময় আঙুলের মাথায় পরে থাকেন। সে কথা জ্ঞানদাশঙ্করবাবুর কাছ থেকে আমি জানতে পারি। অথচ আপনার স্বামী মেসমেরাইজড় অবস্থায় এ কাণ্ড করে ছিলেন বলেই পরে কিছুই তাঁর মনে ছিল না। কেন আমি আপনার স্বামীকে সন্দেহ করে ছিলাম তার একটি প্রধান কারণ ঐ।
দ্বিতীয়ত, আপনাদের অন্দরমহল এমনভাবে তৈরী যে বাইরের কোন লোকের পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য। তার পর আমি জেনেছি আপনাদের শয়নকক্ষে কেবল আপনি, আপনার স্বামী, পুরাতন ভৃত্য ভজু ও রাজমাতা ছাড়া আর কারুরই প্রবেশাধিকার নেই। আয়রন সেফের চাবিও আপনাদের শয়নকক্ষেই থাকে। সেক্ষেত্রে সে ঘর থেকে আপনাদের অজান্তে আয়রন সেফ খুলে সিংহাসনটি চুরি করে আনা, একমাত্র যাদের সে ঘরে গতিবিধি আছে তারা ছাড়া তৃতীয় কোন লোকের পক্ষে শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভব।
তাই যদি মেনে নিই যে, বাইরের কেউ এসে চুরি করতে পারে না, তবে চুরি করেছে। এমন কেউ যাদের ঐ ঘরে গতিবিধি আছে!
প্রথমত ধরুন আপনার স্বামী রাজাবাহাদুর। তিনি যদি জানতেন যে তিনিই চুরি করেছেন, তা হলে এভাবে তিনি সেটা অনুসন্ধান করবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ করে আনতেন না কখনও। অতএব তাঁকে অনায়াসেই বাদ দেওয়া যায়। বৃদ্ধ রাজমাতার দ্বারাও সম্ভব নয়। তৃতীয় রইলেন। আপনি।
বলতে বাধা নেই, তাই আপনার ওপরেই আমার সন্দেহ পড়ে এবং সে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় যখন রাজাবাহাদুরের মুখে শুনলাম, চুরির পরদিনই আপনি বাপের বাড়িতে গেছেন। পূর্বদিন স্বামী অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও কোন স্ত্রী তার অসুস্থ স্বামীকে ফেলে এভাবে যেতে পারে না। আপনার সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তখন আপনাদের খুড়োমশাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করি।
তাঁর কাছে শুনলাম, আপনার স্নেহ ও মমতার নাকি তুলনা নেই। শতকণ্ঠে তিনি আপনার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তখন আমার সন্দেহ হল, আপনি পাকেপ্রকারে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন এবং সেইজন্যই আপনি ঐভাবে পরদিন পালিয়ে বঁচবার চেষ্টা করেছেন।
তার পর? ক্ষীণ স্বরে রাণীসাহেবা প্রশ্ন করলেন।
তার পর আরও একটা দিক ভাববার ছিল। আপনিই যদি সিংহাসনটি চুরি করে ধাকেন, তবে কেন করলেন? আপনার কিসের অভাব? অতুল ঐশ্বর্য, মান-সম্মান, কিছুরই তো আপনার অভাব নেই! তবে? তা ছাড়া যদি আপনি চুরি করেই থাকেন, কিভাবে আপনি সেটা লুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করবেন? ধরা পড়বার সম্ভবনা আছে প্রচুর। অথচ ঝাঁপির মধ্যে পেলাম। আপনার স্বামীর সেতার বাজাবার মেরজাবটি।
তখন মনে হল এর মধ্যে প্রকাণ্ড এক যড়যন্ত্র আছে, যার মধ্যে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক আপনি জড়িয়ে পড়েছেন। সেই কারণেই আপনার স্বামীর সামনে আপনাকে আমি প্রশ্ন করা শুরু করি। ঐ সময়কার আপনার হাবভাব দেখে আপনার ওপরে আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। আপনার মুখেই আপনার ভাইয়ের কথা আমি শুনি এবং সব কথা শুনে বুঝতে আর আমার কষ্ট হয় না যে, আপনার ভাই আপনাকে যন্ত্র-হিসাবে এ কাজে ব্যবহার করেছে, অথচ আপনি তা জানেন না বা জানিবার চেষ্টাও করেননি। শুধু তাই নয়, আপনি এও জানেন না, আপনার বিবাহের পর গত চার-পাঁচ বছরে আপনার ভাইয়ের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। বহু ধারকর্জ হয়েছে। আকণ্ঠ দেনার দায়ে তিনি এখন মুহ্যমান। আমি কলকাতায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসব জানতে পারি।
আশ্চর্য, আমার ভাই! এর মধ্যে আছে?
হ্যাঁ। তিনি আপনার স্বামীকে মেসমেরাইজ করে সিংহাসনটি চুরি করেন, আপনার স্বামীরই হাত দিয়ে। অদ্ভুত চাতুর্য। অভিনব চৌর্য-কৌশল! আপনি জানেন না, আপনাদের এখানে আসবার দিন গাড়িতে সহযাত্রী হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার ভাল করে পরিচয় হয়। নিজের প্রতি আসাধারণ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি শ্ৰীনগরের যে অত্যাশ্চর্য নির্ভুল কাহিনী আমার কাছে ব্যক্ত করেন, তাতেই তার প্রতি আমার বিশেষ সন্দেহ জাগে। ছদ্মবেশে এবং ছদ্মনামে তখন তিনি ছিলেন এবং সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই আবার তিনি আজ এ বাড়িতে আমার সমানে আসতে দুঃসাহসী হয়েছেন। তিনি জানেন না, একবার যে কণ্ঠস্বর আমি শুনি, এ জীবনে তা আর আমি ভুলি না। চিরদিন আমার তা মনে থাকে। তাছাড়া একজন সাধারণ তৃতীয় পক্ষের যে অমন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রাজবাড়ির সব কথা জানা অসম্ভব, সেকথাও তার মনে হয়নি সেদিন।
আমি ওঁকে সন্দেহ করেছিলাম বটে, কিন্তু…
সেই জন্যই আপনি স্বামীর অসুস্থতা সত্ত্বেও ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন, কেমন না?
হ্যাঁ, কিন্তু…
কিন্তু আপনি সিংহাসনটির খোঁজ পেলেন না!
না। আমার ভাই যদি সিংহাসনটি নিয়ে থাকবে, কোথায় গেল সেটা? আমি অনেক খুঁজেছি, তার প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টিও এ ক’দিন রেখেছি।
সেও আর এক মস্ত কেরামতি তাঁর। শুনে দুঃখ পাবেন না, আপনার ভাইটি শুধু চোরই নন, একজন পাকা চোর। হ্যাঁ ভাল কথা, আজ। আপনার ভাই কোথায় শুয়েছেন?
আমাদেরই পাশের ঘরে।
তার বীণাটি নিয়ে আসতে পারেন?
বীণাটি কেন?
নিয়ে আসুন না। যাঁরা সত্যিকারের বাজিয়ে তাঁরা কখনও তাদের নিজেদের ব্যবহৃত ভাঙা বাদ্যযন্ত্র আপনার ভাইয়ের মত অত যত্নসহকারে সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে বেড়ান না। আর একটা কথা, আপনি কোনদিন গল্পচ্ছলে নিশ্চয়ই আপনার ভাইয়ের কাছে আপনার বহু মূল্যবান সিংহাসনটির কথা বলেছিলেন!
হ্যাঁ!
এরপর রাণীসাহেবা গুপ্তদ্বারপথ দিয়ে তার ভাইয়ের বীণাযন্ত্রটি নিয়ে এলেন।
কিরীটী ইতিমধ্যে জামাকাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে ছিল।
ও কি, আপনি জামাকাপড় পরেছেন যে?
আমি এবার বিদায় নেব রাণীসাহেবা। আপনাদের পারিবারিক এ কলঙ্কের মধ্যে আর না থাকাই মঙ্গল। আপনি নিজে থেকে আজ রাত্রে আমার কাছে এভাবে না এলে ভেবেছিলাম চিঠিতেই আপনার কাছে সব লিখে রেখে ভোররাত্রের ট্রেনে চলে যাব।
কিন্তু স্টেশন তো এখান থেকে অনেক দূরের পথ!
শেষরাত্রের দিকে চাঁদ উঠবে। চাঁদের আলোয় হেঁটে চলে যাব, খুড়োমশাইকে বলে গেট খুলে রাখবার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছি। ঐ বীণার খোলের মধ্যেই খুব সম্ভব আপনার সিংহাসনটি আছে!
হঠাৎ রাণীসাহেবার হাত থেকে বীণাটি মাটিতে পড়ে গেল এবং বীণার খোলটি ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল। রাণীসাহেবা বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, সেই দ্বিখণ্ডিত বীণার খোলের মধ্যে বত্রিশ সিংহাসনটি মোমবাতির আলোয় ঝলমল করছে।
কিরীটী মৃদু হাসল।
হাতের ঘড়ি দেখে বললে, এবার না বের হলে রাত্রি পাঁচটার ট্রেন আমি ধরতে পারব না, রাণীসাহেবা। আপনার স্বামীকে আমার নমস্কার দেবেন। আপনাদের হৃত জিনিস আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে আমি বিদায় নিলাম।
নমস্কার।
নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কিরীটী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।