গ্রুনো রবোট
দুপুরের পর বড় জানালাগুলো দিয়ে রোদ এসে আমার অফিস-ঘরটি আলোকিত হয়ে যায়। আমি তখন চেয়ারটা টেনে নিয়ে বোদে গিয়ে বসি, বয়স হয়ে যাবার পর এ ধরনের ছোটখাটো উষ্ণতার জন্যে শরীরটা কাঙাল হয়ে থাকে। এখানে বসে জানালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঢাকা প্রাঙ্গণটুকুর পুরোটাই চোখে পড়ে। বসে বসে ছাত্রছাত্রীদের হৈচৈ দেখতে বেশ লাগে। তারুণ্যের একটা আকর্ষণ আছে, আমি সহজে চোখ ফেরাতে পারি না। হৈচৈ চেঁচামেচি দেখে মাঝে মাঝেই আমার নিজের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে যায়, সমস্ত পৃথিবীটা তখন রঙিন মনে হত। একজন মানুষ তার জীবনে যা-কিছু পেতে পারে, আমি সবই পেয়েছি, কিন্তু তবু মনে হয় এর সবকিছুর বিনিময়ে ছাত্রজীবনের একটি উজ্জ্বল অপরাহ্নও যদি কোনোভাবে ফেরত পেতে পারতাম!
জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় ঝাউগাছটার নিচে একটা ছোট জটলার মত। মাঝখানে দাঁড়িয়ে লানা হাত-পা নেড়ে কথা বলছে, তাকে ঘিরে বেশ কিছু উত্তেজিত তরুণ-তরুণী। লানা আমার একজন ছাত্রী, সময় পরিভ্রমণের সূত্রের উপর আমার সাথে কাজ করে। বুদ্ধিমতী মেয়ে, রাজনীতি বা সমাজসেবা এই ধরনের আনুষঙ্গিক কার্যকলাপে যদি এত সময় ব্যয় না করত, তা হলে এতদিনে তার ডিগ্রি শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। খুব প্রাণবন্ত মেয়ে, অন্যদের জন্যে কিছু করার জন্যে এত ব্যস্ত থাকতে আগে কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ইদানীং মাঝে মাঝে চশমা-পরা এলোমেলো চুলের এক তরুণের সাথে দেখি। সাহিত্যের ছাত্র, নাম জিশান লাও। ওর বাবাকে খুব ভালো করে চিনি, কারণ ছাত্রজীবনে দুজনে রাত জেগে দীর্ঘ সময় নানারকম অর্থহীন বিষয় নিয়ে তর্ক করেছি। ছেলেটি যদি তার বাবার হৃদয়ের এক-ভগ্নাংশও কোনোভাবে পেয়ে থাকে, তা হলে অত্যন্ত হৃদয়বান একটি ছেলে হবে তাতে সন্দেহ নেই। লালার সাথে সম্ভবত ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, নূতন ভালবাসার মতো মধুর জিনিস পৃথিবীতে কী আছে? লানা এবং জিশানকে একসাথে দেখে আমার নিজের প্রথম যৌবনের কথা মনে পড়ে যায়, যখন মনে হত ভালবাসার মেয়েটির একটি চুলের জন্যে আমি সমস্ত জগৎ লিখে দিতে পারি।
আমি চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। সপ্তম মাত্রার একটা সমীকরণ নিয়ে কয়েকদিন থেকে বসে আছি। সমাধানটি মাথায় উঁকি দিয়ে দিয়েও সরে যাচ্ছে, কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। যৌবনে মস্তিষ্কের যে একটা সতেজ ভাব ছিল, সেটা এখন নেই, নিজেই প্রায় সময়ে অনুভব করতে পারি। হাঁটুর উপর মোটা খাতাটি রেখে পেন্সিল দিয়ে সমীকরণটি বড় বড় করে লিখে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। সমাধানটি আবার মাথায় উঁকি দিয়ে যেতে থাকে, আমার সমগ্র একাগ্রতা জটিল সমীকরণটির সেই অস্পষ্ট সমাধানটির পিছু ছুটতে থাকে।
কতক্ষণ মোটামুটি ধ্যানস্থ হয়ে বসে ছিলাম জানি না, লানার গলার স্বরে ঘোর ভাঙল।
স্যার, ভিতরে আসতে পারি?
আমি কিছু বলার আগেই সে ভিতরে ঢুকে এল। বরাবরই তাই করে, আমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকলে কেউ আমাকে বিরক্ত করার সাহস পায় না, গত সপ্তাহে শহরের মেয়র আমার সাথে দেখা করতে এসে দরজার বাইরে পনের মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে তুলনায় এই মেয়েটি যে দুঃসাহসী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি লানার মুখের দিকে তাকালাম। তার চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ সবসময়েই থাকে। সতেজ গলায় বলল, সার, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
আমি চেষ্টা করে মুখে গাম্ভীর্যটা ধরে রাখলাম, বললাম, আশা করি কাজটা গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
তুমি জান, আমার নিজের কাজ ছাড়াও আমাকে আরো অন্তত দশটা কমিটির জন্যে কাজ করতে হয়।
জানি—লানা মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলল, আমার ধারণা, আপনি সেসব কমিটিতে সময় নষ্ট না করলে নিজের কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারতেন।
লানাকে দেখার আগে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, কেউ এভাবে আমার সাথে কথা বলতে পারে। কিন্তু না যে-কথাটি বলেছে সেটি সত্যি, আমি নিজে সেটা খুব ভালো করে জানি। আমি মেয়েটির কাছে সেটা প্রকাশ করলাম না, গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললাম, তুমি জান, সেসব কমিটির কোনো-নোেটিতে রাষ্ট্রপতি এবং বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন?
লানা নিজের চুল খামচে ধরে বলল, আমি বিশ্বাসই করতে রাজি না যে, আপনি ঐসব মানুষকে কোনো গুরুত্ব দেন। ওদের সবগুলোকে পাগলা-গারদে রাখার কথা।
আমার হাসি আটকে রাখতে অত্যন্ত কষ্ট হল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তোমার কাজটা কি?
আপনি জানেন, গ্রুনো নামে নতুন রবোট বের হয়েছে?
শুনেছি।
ওদের কপোট্রনে নাকি সিস্টেম-৯ ঢোকানো হয়েছে।
সেটার মানে কি?
আপনি সিস্টেম-৯ কী, জানেন না লানা আমার অজ্ঞতায় খুব অবাক হল এবং সেটা গোপন রাখার কোনো-রকম চেষ্টা করল না। বলল, গত দশ বছর থেকে সিস্টেম ৯-এর উপর কাজ হচ্ছে। এটা হচ্ছে এমন একটা সিস্টেম, যেটার সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই।
কী আছে সেখানে?
কেউ জানে না, অত্যন্ত গোপনীয় জিনিস। এখন সেটাকে গ্রুনো রবোটের কপোট্রনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সেটার মানে কি?
লালা উত্তেজিত মুখে বলল, তার মানে গ্রুনো রবোর্টের সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। দেখে, কথা বলে কোনোভাবেই বোঝা যাবে না কোনটা মানুষ, কোনটা রবোট।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, পৃথিবীতে কি সত্যিকার মানুষের অভাব আছে যে এখন গ্রুনো রবোটকে মানুষ হিসেবে বাজারে ছাড়তে হবে?
লানা আমার কথাটি লুফে নিয়ে বলল, সেটাই তো কথা। বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা কী বলছে শোনেন নি?
কী বলেছে?
কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে দেশের সব বিচারপতিদের অবসর করিয়ে দিয়ে সেখানে গ্রুনো রবোটদের বসানো হবে।
সত্যি?
সত্যি। লানা মুখের উপর থেকে চুলের গোছা সরিয়ে বলল, আজকের কাগজে উঠেছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা লোকটির সম্ভবত সত্যিই মাথা খারাপ। লানার পরামর্শ শুনে কিছুদিন পাগলাগারদে আটকে রাখলে মনে হয় মন্দ হয় না। আমার সাথে লোকটির মাঝে মাঝে দেখা হয়। বলে দিতে হবে যেন এরকম বেফাঁস কথাবার্তা না বলে। দেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ রবোটশিল্পের উপর নির্ভরশীল, মনে হয় সেই শিল্পকে খুশি রাখার জন্যে এ-ধরনের কথাবার্তা মাঝে মাঝে বলে ফেলতে হয়।
নানা গম্ভীর গলায় বলল, গ্রুনো কোম্পানির সাহস কী পরিমাণ বেড়েছে, আপনি শুনতে চান?
ওদের ফ্যাক্টরি থেকে দুজন মানুষ পাঠিয়েছে আমাদের কাছে, তার মাঝে নাকি একজন হচ্ছে সত্যিকার মানুষ, আরেকজন গ্রুনো রবোট।
কোনটা গ্রুনো রবোট?
জানি না। লানাকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, বলল, কোনটা ওরা বলবে না, আমাদের বের করতে হবে।
কেন?
আমরা গ্রুনো রবোটকে বিচারপতি পদে বসানো নিয়ে একটা প্রতিবাদ সভা করেছিলাম, সেটা শুনে কোম্পানি এই দুজন মানুষ পাঠিয়েছে। ওরা আমাদের কাছে প্রমাণ করতে চায় যে, গ্রুনো রবোট হুবহু মানুষের মতে, কোনো পার্থক্য নেই। ওরা দাবি করেছে যে, আমরা কিছুতেই বের করতে পারব না কোনটা মানুষ, কোনটা গ্রুনো রবোট।
পেরেছ?
লানা ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, না।
বাজিতে হেরে গেলে?
কিন্তু স্যার, আপনি বুঝতে পারছেন আমরা যদি বের করতে না পারি তা হলে কী হবে?
কী হবে?
গ্রুনো রবোট কোম্পানি সব খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশনে খবরটা প্রকাশ করে দেবে। বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দেবে যে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ চব্বিশ ঘণ্টা চেষ্টা করেও গ্রুনো রবোটের সাথে মানুষের পার্থক্য ধরতে পারে নি। তারপর সত্যি সত্যি বিচারকদের জায়গায় গ্রুনো রবোটকে বসানো হবে।
সমস্যার কথা, কী বল?
লানা আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল আমি ঠাট্টা করছি কি না। একটু পর প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, আপনি বের করে দেবেন?
আমি?
লানা মাথা নাড়ে, আমরা সারা দিন চেষ্টা করেছি।
পার নি?
না। লজ্জায় মেয়েটির চোখে প্রায় পানি এসে যায়। কাতর গলায় বলল, যতভাবে সব চেষ্টা করেছি, মানুষের যতরকম অনুভূতি আছে সবগুলো চেষ্টা করে দেখেছি, কোনো লাভ হয় নি। লানা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, আপনি বের করে দেবেন?
আমার মেয়েটির জন্যে খুব মায়া হল। বাইরে সেটা প্রকাশ না করে উদাস ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললাম, যদি সত্যি বের করতে না পার, তাহলে তো স্বীকার করতেই হবে গ্রুনো রবোট সত্যিই মানুষের মতো।
সেটা তো স্বীকার করছিই। মানুষের মতো আর মানুষ দুটি তো এক জিনিস নয়। মানুষের সত্যিকার অনুভূতি থাকবে না, কিন্তু মানুষের বিচার করবে—সেটা তো হতে পারে না। দেবেন বের করে?
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, বিকেল হয়ে আসছে, সন্ধেবেলা একটা কনসার্টে যাবার কথা, হাতে খুব বেশি সময় নেই। কিন্তু মেয়েটি এত আশা করে এসেছে, তাকে তো নিরাশ করা যায় না। লানার দিকে তাকিয়ে বললাম, ঠিক আছে, ওদের নিয়ে এসে বাইরে অপেক্ষা কর। আমি না ডাকা পর্যন্ত ভিতরে আসবে না।
লানার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমি নিশ্চিত, অন্য কেউ হলে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরত। আমার মুখের গাম্ভীর্যটি দেখে সাহস করল না। দীর্ঘদিন চেষ্টা করে এই গাম্ভীর্যটি আয়ত্তে এনেছি, সহজে কেউ কাছাকাছি আসতে সাহস করে না।
লানা বের হয়ে যেতেই আমি আমার সেক্রেটারি ট্রীনাকে ডাকলাম। ট্ৰীনা মধ্যবয়সী হাসিখুশি মহিলা। ভিতরে ঢুকে বলল, কিছু বলবেন স্যার?
তোমার খানিকক্ষণ সময় আছে?
অবশ্যই। সে আমার সামনের খালি চেয়ারটিতে বসে পড়ে বলল, কী করতে হবে?
আমি ষড়যন্ত্রীর মতো গলা নামিয়ে বলল, লানার ছেলে-বন্ধু জিশানকে তুমি চেন?
টীনা বিস্ময়টুকু সযত্নে গোপন ককেবলল, সেরকম চিনি না, সাথে দেখেছি দু একবার।
ওর বাবা আমার বিশেষ বন্ধ ছিল। ছেলেটি যদি বাবার কাছাকাছি হয়, তা হলে খুব হৃদয়বান হওয়ার কথা।
ট্রীনা মাথা নেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি গলার স্বর আরো নামিয়ে বললাম, জিশানের পুরো নাম জিশান লাও। ডাটা বেসে খোঁজ করে দেখ তো, ওর সম্পর্কে কোনো চোখে পড়ার মতো তথ্য পাও কি না। আমার নাম বাবহার করে খোঁজ কর, অনেক রকম খোঁজ পাবে তা হলে।
ট্রীনা কিছুক্ষণের মাঝেই একটা কাগজ নিয়ে ঢুকল, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, জিশানের উপর অনেক বড় ফাইল আছে, আমি শুধু দরকারি জিনিসটা টুকে এনেছি।
আমি একনজর দেখে বললাম, ঠিক আছে ট্রীনা, তুমি লানাকে বলবে ভিতরে আসতে? তার দুজন সঙ্গীকে নিয়ে।
লানা প্রায় সাথে সাথেই দুজন মানুষকে নিয়ে ঢুকল। কিছু কিছু মানুষের চেহারা দেখে বয়স বোঝা যায় না, এদের দুজনেই সেরকম। পরনে মোটামুটি ভদ্র পোশাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মতো খাপছাড়া নয়। একজন আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম—
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তোমার নাম এক নম্বর।
হ্যাঁ, আপাতত তোমার ঠিক নামটি শুনে কাজ নেই। কারণ তুমি যদি গ্রুনো রবোট হয়ে থাক তাহলে সম্ভবত মিথ্যা একটা নাম বলবে। শুধু শুধু মিথ্যাচার করে লাভ কি? তোমাকে ডাকা যাক এক নম্বর।
এক নম্বরের দুই গাল একটু লাল হয়ে ওঠে। রাগ হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে উষ্ণ স্বরে বলল, আমি গ্রুনো রবোট নই। আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে ওর সাথে। সে দ্বিতীয় লোকটিকে দেখিয়ে বলল, ঐ হচ্ছে গ্রুনো রবোট।
দ্বিতীয় লোকটি এবারে একটু মধুর ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বলল, আপনার কথা অনেক শুনেছি আমি। পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগল। অবশ্যি ঠিক পরিচয় হল না, কারণ আপনি তো নিশ্চয়ই আমার নামও শুনতে চাইবেন না।
না। আপাতত তোমার নাম হোক দুই নম্বর।
মানুষকে তার নিজের পরিচয় দিতে না দেয়ার মাঝে খানিকটা অপমানের ব্যাপার আছে।
এক নম্বর ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, তোমার সাথে এসেছি বলে আজ আমার এই অপমান।
আমিও তো একই কথা বলতে পারি।
না, পার না, এক নম্বর চোখ লাল করে বলল, তুমি গ্রুনো।
তুমি এত নিশ্চিত হলে কেমন করে যে আমি গ্রুনো?
কারণ আমি জানি আমি গ্রুনো না, আমি মানুষ।
কেমন করে জান? হতে পারে তুমি মিথ্যা বলছ। কিংবা কে জানে আরো ভয়ংকর জিনিস হতে পারে, তুমি ভাবছ তুমি মানুষ, কিন্তু আসলে তুমি গ্রুনো। তুমি নিজেই জান না যে তুমি গ্রুনো।
এক নম্বরকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেটা কি হতে পারে?
কোনটা?
যে, আমি গ্রুনো কিন্তু আমি জানব না?
না। কারণ তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তা হলে তোমার মাথায় মস্তিষ্কের বদলে রয়েছে একটা কপোট্রন। তোমার বুকের মাঝে আছে একটা পারমাণবিক সেল। তোমার কপোট্রন ক্রমাগত হিসেব করছে সেলের ভোল্টেজ, ক্লক ফ্রিকোয়েন্সি, আর তোমাকে সেটা জানাচ্ছে মিলিসেকেণ্ড পরপর। কাজেই তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তা হলে তুমি মিথ্যাবাদী গ্রুনো।
এক নম্বর উষ্ণ স্বরে বলল, আমি শুনন না, আমি মানুষ।
গ্রুনোকে মানুষের মতো করে তৈরি করা হয়েছে, কাজেই তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তুমি মিথ্যা বলবে না আমি সেরকম আশা করছি না।
দু নম্বর একটু এগিয়ে এসে বলল, গত সংখ্যা বিজ্ঞান সংবর্তে আপনার লেখাটা পড়ে–
তুমি কি গ্রুনো?
দু নম্বর থতমত খেয়ে গেল। কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, আমি যতদূর জানি—আমি গ্রুনো না। আমার অতীত জীবনের সবকিছু পরিষ্কার মনে আছে, গ্রুনো হলে নিশ্চয়ই মনে থাকত না। খুব ছেলেবেলায় দোলনা থেকে পড়ে গিয়ে একবার হাঁটু কেটে গেল, সেটাও মনে আছে। সত্যি কথা বলতে, কাটা দাগটা এখনো আছে। দেখবেন?
আমি কিছু বলার আগেই এক নম্বর বলল, দেখাও দেখি।
নম্বর প্যান্ট হাঁটুর উপর টেনে তুলে একটা কাটা দাগ দেখাল।
এক নম্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাটা দাগটা খানিকক্ষণ দেখে বলল, জালিয়াতি, পুরো জালিয়াতি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কেমিক্যাল এচিং।
দু নম্বর গম্ভীর গলায় এক নম্বরকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি শৈশবের কথা মনে আছে?
অবশ্যই মনে আছে।
কত শৈশব?
অনেক শৈশব।
দু নশ্বর মাথা নেড়ে বলল, কিছু আসে-যায় না। আমি কোনোভাবে জানতে পারব তুমি সত্যি কথা বলছ, না মিথ্যা কথা বলছ।
আমি মিথ্যা বলি না।
সেটাও কোনদিন প্রমাণ করা যাবে না। দু নম্বর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলেন স্যার, আজ সারাটি দিন খুব অপমানের মিঝে কেটেছে। আমাকে দেখলেই বুঝবেন, জীবিকার জন্যে মানুষকে কী না করতে হয়। আমার সম্পর্কে এক চাচার কাজ ছিল একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গলদা চিংড়ি সেজে দাঁড়িয়ে থাকা। কী অপমান।
লানা আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার, কিছু বুঝতে পারলেন? আমার মনে হয় দু নম্বর, কী বলেন?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, এখনো জানি না।
তা হলে?
তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
আমি গলা নামিয়ে বললাম, তুমি তোমার অফিসে গিয়ে বস। আমি এখান থেকে দুজনকে পাঠাব। তুমি তাদের সাথে হালকা কোনো জিনিস নিয়ে কথা বলবে। হাসির কোনো গল্প। বেশিক্ষণ নয়, ঘড়ি ধরে দুই মিনিট।
ঠিক আছে।
আর শোন, ঘরের বাতিগুলো কমিয়ে দেবে, যেন তোমাকে ভালো করে দেখতে না পারে।
বেশ।
ওদের বসাবে তোমার খুব কাছাকাছি। একটা টেবিলের এপাশে আর ওপাশে।
ঠিক আছে স্যার।
লানা চলে যাচ্ছিল, আমি তাকে ডেকে ফেরালাম। হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভঙ্গি করে বললাম, তুমি তো রাজনীতি সমাজনীতি এরকম অনেক কাজকর্ম কর, কয়দিন থেকে ভাবছি তোমাকে একটা জিনিস বলব।
কী জিনিস? পরে বলল, আমাকে মনে করিয়ে দিও।
দেব স্যার।
আর এই কাগজটা রাখ, কাউকে দেখাবে না। কয়দিন থেকে তোমাকে দেব ভাবছি, মনে থাকে না।
লানা কাগজটি নিয়ে বের হয়ে প্রায় সাথে সাথে ফিরে এল। আমি জানতাম আসবে, কারণ এখানে যে-ছয়জনের নাম লেখা হচ্ছে, তার একজন হচ্ছে জিশান লাও। শুধু তাই নয়, উপরে লেখা আছে পুলিশের গুপ্তচর। লানা পাংশু মুখে জিজ্ঞেস করল, এখানে কাদের নাম?
আমি গলা নামিয়ে বললাম, তোমরা যারা রাজনীতি কর, তাদের পিছনে সরকার থেকে গুপ্তচর লাগানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ভান করে এরা তোমাদের ভিতর থেকে খবর বের করার চেষ্টা করবে। পুলিশের টিকটিকি। এদের থেকে সাবধান।
লানার মুখ মুহূর্তে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যায়। কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যেতে থাকে। এরকম প্রাণবন্ত একটি মেয়েকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখা খুব কষ্টকর। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।
আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে এক নম্বর এবং দু নম্বরকে বললাম, তোমরা দু জন এখন করিডোরের শেষ ঘরটিতে ঝবে। সেখানে লানা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সে তোমাদের সাথে কিছু-একটা কথা বলবে, সেটা শুনে আমার কাছে এস। ঠিক আছে?
দু জনে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
যাও।
দুজনেই বের হয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের মাঝেই দু জনে ফিরে এল। দুজনেরই হাসি-হাসি মুখ—এক নম্বরের মনে হল একটু বেশি হাসিমুখ।
জিজ্ঞেস করলাম, লানার সাথে কথা হল?
হ্যাঁ, হয়েছে। এক নম্বর দাঁত বের করে হেসে বলল, মেয়েটার যাকে বলে একেবারে তীক্ষ্ণ রসিকতাবোধ। এমন হাসির একটা গল্প বলেছে, কী বলব। একজন লোক টুথব্রাশ বিক্রি করে। দেখা গেল তার মতো আর কেউ
দু নম্বর বাধা দিয়ে বলল, আমার মনে হয় না স্যার এখন তোমার মুখ থেকে গল্পটা শুনতে চাইছেন।
না, আমি মানে—এক নম্বর আমতা-আমতা করে থেমে গেল। আমি টেবিলের উপর থেকে দরকারি কিছু কাগজপত্র আমার হাতব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বললাম, লানার মনের অবস্থা কেমন দেখলে?
মনের অবস্থা?
হ্যাঁ, মনের অবস্থা কেমন?
এক নম্বর একটু অবাক হয়ে বলল, মনের অবস্থা আবার কেমন হবে? ভালো। এত হাসির একটা গল্প বলল—এক নম্বর আবার দাঁত বের করে হাসা শুরু করে।
দু নম্বর মাথা নেড়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কি স্যার, আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন, আমি বলি, আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটার মন খারাপ।
মন খারাপ? এক নম্বর অবাক হয়ে বলল, মন খারাপ হবে কেন? কী দেখে তোমার মনে হল মন খারাপ?
দু নম্বর মাথা চুলকে বলল, ঠিক জানি না, কিন্তু মনে হল—
এক নম্বর মাথা চুলকে বলল, অন্ধকারে বসেছিল, ভালো করে দেখা পর্যন্ত যাচ্ছিল না, আর তোমার মনে হল মন খারাপ?
দু নম্বর একটু থতমত খেয়ে বলল, ইয়ে, ঠিক জানি না কেন মনে হল। আমি অবশ্যি একেবারে নিশ্চিত না। হতে পারে ভুল মনে হয়েছে।
আমি দু নম্বরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, না, তোমার ভুল মনে হয় নি, তুমি ঠিকই ধরেছ। লানার আসলেই মন খারাপ।
এক নম্বরের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, আমার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকাল সে। আমি আস্তে আস্তে বললাম, এক নম্বর, তুমি একজন গ্রুনো।
আ-আমি, আমি?
হ্যাঁ, তুমি। তাই তুমি ধরতে পার নি লনার মন খারাপ। একজন মানুষের যদি খুব মন খারাপ হয়, তার সাথে কোনো কথা না বলেও তার কাছাকাছি এসেই সেটা ধরে ফেলা যায়। এটা পরীক্ষিত সত্য। মানুষেরা ধরতে পারে। যন্ত্র পারে না।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে এক নম্বরের ডান কানের নিচে হাত দিয়ে সুইচটা খুঁজে বের করে তার সার্কিট কেটে দিলাম। দেখতে দেখতে তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল, মুখ দিয়ে অর্থহীন শব্দ করতে করতে এক নম্বর স্থির হয়ে গেল। শরীরে আর কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই।
আমি দু নম্বরকে বললাম, জিনিসটাকে নিচে শুইয়ে রাখ। হঠাৎ করে কারো উপর পড়ে গিয়ে একটা ঝামেলা করবে।
দু নম্বর বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমতা-আমতাভাবে বলল, কেমন করে শোওয়াব।
আমি এগিয়ে গিয়ে বুকে একটা ঘোট ধাক্কা দিয়ে বললাম, এভাবে।
গ্রুনো রবোটটি প্রচণ্ড শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। এক নম্বর দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে তাকে একবার ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। রবোটটি ভালো তৈরি করেছে, এভাবে আছড়ে পড়েও শরীরের কোনো অংশ ভেঙে আলাদা হয়ে গেল না।
আমি টেবিল থেকে আমার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বাসায় যাবার জন্যে প্রস্তুত হলাম। দুই নম্বর কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আপনাকে যে আমি কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করেন, নিজের উপর সন্দেহ এসে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমি কি সত্যিই মানুষ?
অবশ্যি তুমি মানুষ। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল। আমি আন্তরিকভাবে তার সাথে হাত মিলিয়ে বললাম, এখন তোমার নামটা আমি শুনতে পারি।
মিকালো-আমার নাম শিন মিকালো।
শিন মিকালো, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল।
ঠিক এ-সময় লানা দরজায় এসে দাঁড়ায়। মিকালো তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। উচ্চস্বরে বলল, স্যার বের করে ফেলেছেন গ্রুনোকে।
লানা মেঝেতে পড়ে থাকা গ্রুনোকে একনজর দেখে বলল, কেমন করে বের করলেন?
সহজ, একেবারে সহজ। মিকালো এক হাতের উপর অন্য হাত দিয়ে তালি দিয়ে বলল, একেবারে পানির মতো সহজ। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, লানার মনের অবস্থা কেমন? আমি বললাম, মন খারাপ, গ্রুনো বলল, না
লানা চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়। আমি কথোপকথনটি না শোনার ভান করে বললাম, না, তোমাকে একটা কাগজ দিয়েছিলাম খানিকক্ষণ আগে?
লানা শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?
তোমাকে ভুল কাগজটা দিয়েছি। আমি তাকে আরেকটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললাম, এটা হচ্ছে সেই কাগজ। আগেরটা ফেলে দিও।
আগেরটা ভুল?
হ্যাঁ, ভুল।
এটা ঠিক?
হ্যাঁ, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে আমার এক ছাত্র কাজ করে, সে মাঝে মাঝে এসব গোপন খবর দিয়ে যায়।
লানা একনজর কাগজটা দেখে বলল, তা হলে আগে যে-কাগজটা দিয়েছিলেন সেটা কি?
ওটা—এটা অন্য জিনিস।
কী জিনিস?
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর কিছু মৌলিক লেখা বই হিসেবে বের করবে, তাদের নাম। আমার এক বন্ধুর ছেলের নামও আছে, জিশান লাও। খুব ভালো ছেলে–
লালার মুখ থেকে গাঢ় বিষাদের ছায়া সরে গিয়ে সেখানে স্বচ্ছ একটা আনন্দের হাসি ঝলমল করে ওঠে। আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ভুল কাগজটা দিয়েছিলেন। ইচ্ছে করে। তাই না?
আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম, গ্রুনো কোম্পানি কি তাদের রবোটটা নিয়ে তোমাদের সাথে কোনোরকম চুক্তি সই করেছে?
না। কোননারকম চুক্তি সই করে নি?
না। কিছু না।
তা হলে একটা কাজ কর। ওটার কপোট্রনটা খুলে সিস্টেমটা বের করে নাও। সেটা কপি করে তোমাদের বন্ধুবান্ধব পরিচিত মানুষজনকে বিলিয়ে দিও। ঘরে ঘরে সবার কাছে যদি একটা করে সিস্টেম-৯-এর কপি থাকে, তা হলে গ্রুনো কোম্পানিকে পুরো সিরিজটা বাতিল করে দিতে হবে, ভবিষ্যতে আর এ ধরনের মামদোবাজি করবে না।
কপোট্রন কেমন করে খোলে?
স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে কপালের মাঝে জোরে আড়াআড়িভাবে চাপ দাও, খুলে যাবে। দাঁড়াও, আমি খুলে দিচ্ছি–
আমি একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে কপালে চাপ দিয়ে রবোটটার মাথাটা খুলে আনলাম।
গ্রুনো রবোটটি মাথা খোলা অবস্থায় ঘোলাটে চোখে বিসদৃশ ভঙ্গিতে মেঝের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে রইল।