০৪. খোঁজ-খবর সংগ্রহ

০৪.

হেলেন শুধু ওদের খোঁজ-খবর সংগ্রহ করেই হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি, উইলিংটনের একমাত্র নামকরা হোটেলে ফোন করে রাতে থাকার জন্য একটা ঘরেরও বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল।

লস-এঞ্জেলস থেকে একশো কুড়ি মাইল দূরে একটা পল্লীগ্রাম উইলিংটন যার নাম। ওখানকার প্যালেস থিয়েটারে সন্ধ্যের শোতে যাতে উপস্থিত থাকা যায়, তার জন্য দুপুরের ভোজন শেষ করেই গাড়ি নিয়ে আমরা উইলিংটনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাস্তায় মমি ফিলিপসের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার হওয়ার শুরু থেকে একেবারে সমাপ্ত পর্যন্ত যা যা ঘটনা ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ বিবরণ আমি হেলেনকে এক নিঃশ্বাসে বলে গেলাম।

যমজ বোন! সব শোনার পর অস্ফুট স্বরে বলে উঠল হেলেন।

এইবার ব্যাপারটা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ রহস্যের সমস্ত জট এখানে বেঁধেছে। এই রহস্যের চাবিকাঠি হচ্ছে এই দুই যমজ বোন।

তুমি ব্যাপারটাকে আর কেঁচেগস করো নাতো! আমি মৃদু ধমক দিয়ে বলি, সুসানকে এখনও পর্যন্ত আমরা চোখেই দেখলাম না, আর কোরিনের বাস তো সেই সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা।

ওখানে একবার ঘুরে এলে কেমন হয়, স্টিভ? আমার বহুদিনের শখ দক্ষিণ আমেরিকা যাবার।

আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে, আপাততঃ মন দিয়ে তুমি গাড়ি চালাও আর আমাকে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দাও। সারা সকাল কেবল চরকি বাজির মতো ঘুরে চলেছি, একদণ্ড বসার সুযোগ পর্যন্ত এই পোড়া কপালে জোটেনি।

ঠিক আছে, তুমি তাহলে ঘুমোও। আমার মাথায় একটা মতলব ঘুরপাক খাচ্ছে। কাজের মতো যদি হয়, তোমাকে ঘুম থেকে তুলে না হয় বলবো।

উইলিংটন না পৌঁছন পর্যন্ত ওটা তোমার মনের মধ্যেই চেপে রাখো, এই বলেই চোখ বন্ধ করলাম আমি…।

সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই উইলিংটন পৌঁছে গেলাম। জায়গাটা যতটা গ্রাম্য আশা করেছিলাম আমরা আমাদের কল্পনায়, আসলে ততটা কিন্তু নয়। রাস্তাঘাট বেশ ভালো, বাড়িগুলোও চমৎকার। আমরা সোজা হোটেলে গিয়ে উঠলাম।

শোয়ের সময়ও প্রায় এগিয়ে এসেছে। তাই চটপট হাত-মুখ ধুয়ে সামান্য কিছু জলযোগ করে, হোটেল-আপ্যায়িকার কাছে থিয়েটার হলটার নির্দেশ দিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।

প্যালেস থিয়েটারের দূরত্ব হোটেল থেকে খুব বেশী নয়, বড়জোর একশো গজ। গাড়ি না নিয়ে ওটুকু পথ আমরা পায়ে হেঁটেই চলে এলাম। তারপর টিকিট কেটে আমরা হলের মধ্যে প্রবেশ করলাম।

প্রথমে সঙ্গীত, তারপর হাস্যকৌতুক পরিবেশনের পর আলো কমিয়ে ব্রাড ডেনির নাম ঘোষণা করা হল। সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি মুখর এক চাপা গুঞ্জনে হল ভরে গেল। দর্শকের আসনে সংখ্যা গরিষ্ঠের দিক থেকে পুরুষরা অনেক এগিয়ে, আর সকলেই একটা উদ্দেশ্যই বুকে নিয়ে এসেছে তা হল সামনাসামনি সুসানকে দেখার আকাঙ্খা। এদিক থেকে দেখতে গেলে অসন্তোষটা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।

ব্যান্ড শুরু হল, জ্বলে উঠল আলো, ঝলমলে আলোয় স্টেজের মাঝখানে নৃত্যের ভঙ্গিমায় মঞ্চে প্রবেশ ঘটল এক তরুণের। সুদর্শন চেহারা, গোরা রঙ, বলিষ্ঠ কাঁধ, মনোরম হাসি, উজ্জ্বল দুটি চোখ, সদা সতর্ক দৃষ্টি। দর্শক বৃন্দের কাছে প্রথম দর্শনে সে অবাঞ্ছিত হলেও নাচ দেখানোর পর হাততালি কুড়োল প্রচুর।

পরিশেষে দর্শকদের দিক থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে তার নাচ শেষ করল ডেনি।

করতালির শেষ শব্দটা ক্রমশঃ মিলিয়ে যাবার পথে পা বাড়ালে হাত তুলল ডেনি।

লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন…এবার আপনাদের সামনে উপস্থিত হতে চলেছেন, প্রতিভাময়ী, দুঃসাহসী, অপরূপা এক নর্তকী–যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে আপনাদের কাছে শতাব্দীর সব চাইতে রোমাঞ্চকর নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন।…লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান ও সুসান গেলার্ট এবং মৃত্যুচুম্বন।

ডেনি একটু পিছিয়ে দাঁড়াতেই ড্রামবাদক দুবার করতালে ঝঙ্কার তুলে ড্রামের ওপর তার– কেরামতি শুরু করে দিল। দর্শকদের তালে তালে হাততালির সঙ্গে মঞ্চে আলো কমতে কমতে এমন এক সময় উপস্থিত হল যখন নিভে গেল সব আলো।

সারা হল জুড়ে থমথমে এক নীরব নীরবতা, টুক করে একটা আলপিন মাটি স্পর্শ করলেও তার শব্দ বোধহয় শোনা যেত।

সহসা আবার আলো জ্বলে উঠল, মঞ্চের ঠিক মাঝখানে মঞ্চ আলো করে দাঁড়িয়ে আছে অপরূপা সুন্দরী এক রমনী। তার পরণে ক্ষুদ্র কটিবস্ত্র আর উর্ধাঙ্গে বুকে আর কণ্ঠে আষ্ঠে-পিষ্ঠে বেষ্টন করে ফুঙ্কার দিচ্ছিল ছ ফুট লম্বা এক জীবন্ত গোখরো সাপ। রমনীর নগ্নতার এর চাইতে ভাল প্রাণবন্ত বর্ণনা নিজেকে উজাড় করেও এর বেশী বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

অবিরাম ধারায় ড্রামের আওয়াজ আর দর্শক আসনে উপবিষ্ট জনসাধারণের করতালি আর চিৎকারের মধ্যে প্রায় কুড়ি সেকেন্ড কণ্ঠে লেপ্টে থাকা সাপটার লেজ এক হাতে আর অন্য হাতে ফণা ধরে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রমনী।

দেখানোর মতোই শরীরী গঠন আর দৈহিক আকর্ষণ–এক কথায় অপূর্ব। এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় সাপটা ওর দেহ পেচিয়ে ধরতে আমরা সবাই চাপা উত্তেজনা বুকে নিয়ে ঝুঁকে বসে রইলাম আসনে।

এই জঘন্য নাচে তুমি এমন মোহিত হয়ে উঠবে জানলে তোমার জন্য একটা দূরবীন নিয়ে আসতাম।

লক্ষ্মীটি দয়া করে এখন একটু চুপ করো, আমাকে দেখতে দাও।

মঞ্চের ওপর ঘুরতে থাকল সুসান। বিরাট ভুল পদক্ষেপ। ওর ভঙ্গিমা দেখে আমি বুঝতে পারলাম, নাচের দক্ষতায় আমার চাইতে ও পিছনেই থাকবে। ছন্দের কোন বালাই নেই, নিতান্তই সাধারণ। কিন্তু হলের সকলেই তার দিক থেকে চোখ সরাবার ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে।নাচের দক্ষতা ওর থাক বা না থাক তাতে ওর কিছু আশাভঙ্গ হচ্ছে না। কারণ রমনী ওর দেহ দেখিয়ে দর্শককুলকে মূককরে রেখেছে, মূক হবার মতোই ওর দেহজ গঠন। দেহখানা যে ওর চাবুক তাতে কোন সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

মৃদুভাবে ওয়ালটজ-এর সুর বেজে উঠতেই রমনীর গতি আরো বেড়ে গেল। সাপের মাথাটা তখনও সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরা। এরপর লেজটা ছেড়ে দিতে সাপটা প্রচণ্ড এক ঝাঁপটা মেরে ওর শরীর পেঁচিয়ে ধরল। এই দৃশ্যে দেখে আশেপাশের কয়েকজন মহিলা অস্ফুট-আর্তনাদ করে উঠলেন আতঙ্কে বিবস হয়ে।

নিজের মনকে এই বোঝাবার চেষ্টা করলাম, সাপটার বিষ থলি খুলে নেওয়া হয়েছে, বর্তমানে ওর দ্বারা ক্ষতির কোন আশঙ্কা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি রুদ্ধনিঃশ্বাসে আশ্রয়দাতা ভেবে খামচে ধরলাম সীটের হাতল।

মাঝখানে নাচ থামিয়ে আবার স্থির হয়ে দাঁড়াল আমাদের নর্তকী সুসান। সাপটা ওর দেহের পাক ছেড়ে জড়িয়ে গেল তার হাত আর কণ্ঠে।

ড্রামের তালে তালে এবার হাঁটু ভেঙ্গেনীচু হতে লাগল সুসান। তারপর নিপুণ-দক্ষতায় নিজের দেহ থেকে সাপটা খুলে নিয়ে মাটিতে বসিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে পিছিয়ে এল কয়েক পা। সাপটা সঙ্গে সঙ্গে কুণ্ডলি পাকিয়ে ফণা মেলে ধরল। সামনে ঝুলছে তার সকলকে জিভ।

বেশ কিছুক্ষণনীরবে দাঁড়িয়ে সাপটার দিকে একদৃষ্টেঅপলকনয়নে তাকিয়ে রইল ও। তারপর খুব ধীরে ধীরে তার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে দিল।

আরে বাপ! আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলামনা, বেসামাল হয়েই বলে উঠি, ওটা যদি এখন ছোবল…।

চুপ! হেলেন ধমক দিয়ে বসে আমাকে, কিন্তু ওর গলার স্বরেই বুঝলাম ও নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি। অন্ধকার হলের মধ্যে এক মহিলার আর্তনাদ কানে এল। একজন আসন ছেড়েই লাফিয়ে উঠেছিল, পেছনের লোকেরা তার এই দশা দেখে জোরকরেতাকে তার আসনে বসিয়ে দিল।

নত হতে হতে সাপটার ভয়ঙ্কর ফণা থেকে ফুট খানেক দূরে মুখ এনে স্থির হয়ে গেল সুসান। ড্রামটাও থেমে গেল সহসা। হল বিভীষিকাময়-নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল।

সাপটাও স্থির-নিথর হয়ে আছে। উত্তেজনায় হেলেন আমার হাত খামচে ধরল। এখন আর এটা ছেলেখেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের আশেপাশের সকলেই মুমূর্ষ রোগীর মতো শ্বাস নিচ্ছে। কয়েকজন এমনভাবে গোঙানি দিয়ে উঠছে যেন এখুনি জ্ঞান হারাবার অন্তিম লগ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

আবার নড়ল সুসান। ইঞ্চি-ইঞ্চি করে সাপটার কাছে এগিয়ে আনতে লাগল তার মুখ। সাপটা তার কাটা চামচের মতো জিহ্বা ঢোকাচ্ছে আর অনর্গল বার করছে।…তফাৎ মাত্র এক ইঞ্চি। তার পরেই জিভটা চাবুকের আলতো আঘাতের মতো স্পর্শ করে গেল সুসানের নরম পাতলা-ঠোঁটে। জীবনে এরকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য খালি চোখে দেখার সৌভাগ্য ঘটেনি। নিঃসন্দেহে এটাই ছিল নৃত্যের চরম অন্তিম মুহূর্ত, এরপরই ঝন্‌ঝন্ শব্দে করতাল বেজে উঠল, নিভে গেল মঞ্চের আলো।

কয়েক মুহূর্ত বেশ চুপ করে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম আসনে হেলান দিয়ে। দশতলা সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠার দুরবস্থা আমার। সারা হল জুড়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ হচ্ছিল। হঠাৎ একসময় সমস্ত নীরবতা ভঙ্গ করে করতালির শব্দ ছাপিয়ে গেল সারা হল। কেউ সিটি দিল, চিৎকার বর্ষণ করে কেউ বা অভিবাদন জানাল। থরথর করে কাঁপছে সারা প্রেক্ষাগৃহে।

আলো জ্বলে উঠল, মঞ্চে সুসান মাথা ঝুঁকিয়ে সকলের অভিনন্দন গ্রহণ করতে লাগল। তার পরনে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা পান্না সবুজের একটা আলখাল্লা। কর্পূরের মতো উধাও গোখরোটা।

প্রায় মিনিট পাঁচেক সুসান দর্শকবৃন্দের তুমুল উচ্ছ্বাসের প্রতিদানে অনবরত মাথা ঝুঁকিয়ে আর চুম্বন নিক্ষেপের পর পর্দা নেমে গেল। জ্বলে উঠল আলো। সারা হল আলোর সাজে আবার সেজে উঠল। কিছু লোক কখনও চেঁচিয়ে কখনও সিটি দিয়ে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে যাচ্ছে।

আমার হাত আঁকড়ে ধরে হেলেন বলে উঠল, উঃ, বেরিয়ে চলো এখান থেকে। এই পরিবেশ আমার আর একটুও ভালো লাগছে না।

আমার বুকে তখনও হাতুড়ির পিটুনি হয়ে চলেছে, কুলকুল করে ঘর্মাক্ত সারা শরীর ঘামে ভিজে সপসপ করছে। কোনরকমে ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। পাশ দিয়ে উত্তেজিত দর্শক উচ্চস্বরে কথা বলতে বলতে পথচলছে, উত্তেজনায় জ্বল জ্বল করছেতাদের চোখ। কয়েকজনের চোখের দৃষ্টি ক্ষুধার্ত জন্তুর মতো। আমাকে কাদের মতো দেখাচ্ছিল কে জানে?

নিউইয়র্কে এরকম উত্তেজক শো কখনই সে প্রদর্শন করার অনুমতি পাবে না, হেলেন বলে উঠল।

আমারও সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। পুলিশের কাছ থেকে অনুমতির কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু আমি মনে করি এখানে দোষের ভাগীদার কিন্তু দর্শকরাই। ওরা আসলে পরিবেশ তৈরী করেছিল। চলল, ওর সঙ্গে একবার কথা বলব। তোমার মন কী বলে, সাপটা নির্বিষ সাপ?

তাতে কোন সন্দেহ আছে নাকি? সুস্থ মস্তিষ্কে কেউ বিষধর গোখরো সাপ নিয়ে খেলা দেখাতে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেবে?

যাক, একটা ব্যাপারে বাঁচোয়া যে আমাদের পলিসির মধ্যে সাপের কামড়ের কথাটারও উল্লেখ আছে। না হলে একটা সাপবদল করার মধ্যে কোন সাহসিকতা নেই। চলে গিয়েই দেখি মেয়েটা মুখে কী বলে।

বেশ কয়েকজন উন্মুখ দর্শক মঞ্চের দরজার সামনে তখনও ভিড় করে দাঁড়িয়ে। একজন পুলিশ তাদের ভিড় সরাবার চেষ্টায় ছিল। তার কাছে নিজের পরিচয়পত্রটা দেখিয়ে বললাম, আমি মিস গেলার্টের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।

এ ব্যাপারে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন, এই বলে দরজা খুলে ধরল সে। আমরা তার হাতের তলা দিয়ে গলে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

তার কাছে গিয়ে গলায় মধু ঢেলে অমায়িক সুরে বললাম, আমি মিস গেলার্টের খোঁজে এসেছিলাম। ম্যানেজার আর একজন বৃদ্ধ দারোয়ান নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিল। আমরা ঢুকতেই দুজনের দৃষ্টি আমাদের ওপর নিবদ্ধ হল।

কাছে এসে গলায় মধু ঢেলে অমায়িক সুরে বললাম, আমি মিস গেলার্টের খোঁজে, এসেছিলাম।

ম্যানেজার মাথা নাড়ল, উনি কারুর সঙ্গে দেখা করবেন বলে আমার মনে হয় না। কার্ড আছে। আপনার?

কার্ড এগিয়ে ধরলাম। ম্যানেজার একপলক চোখ বুলিয়ে সেটা দারোয়ানের হাতে দিল। এটা মিস গোলার্টকে দেখিয়ে জেনে এসো ভদ্রলোকের সঙ্গে উনি দেখা করবেন কিনা?

দারোয়ান বেরিয়ে যেতে আমি ম্যানেজারের হাতে একটা সিগারেট দিয়ে বললাম, ওঃ, একটা শো দেখালেন বটে!

ভালো লেগেছে আপনার?মাথা জুড়ে বিস্তীর্ণ টাকের মহাশয় ম্যানেজারটির মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল।

কিন্তু দেখুন এই পৃথিবীতে এমনও কিছু উত্যক্ত হৃদয়ের লোক আছেন যারা মুখে যা আসছে তাই লিখে যাচ্ছে অম্লান বদনে। শেরিফের অফিসেও কয়েকজন ছুটেছিল। অবশ্য আখেরে কিছুই সুবিধা হয়নি। তবে আমার হলের অবস্থা দেখে মনে হয়, বেশির ভাগ লোকেরই শো মনে খুব আনন্দ দিয়েছে, তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে তারা বাড়ি ফেরে। কিন্তু কার আর দায় পড়েছে আমাদের দ্বারস্থ হয়ে এই কথা বলার! সিগারেট ধরিয়ে হেলেনের দিকে তাকাল। এই হলে এর আগে এত বেশী দর্শক হয়নি। আপনার কেমন লাগল মিস?

আমি খুব একটা খুশি নই। উন্মুক্ত পোষাকে উলঙ্গ মেয়েদের উদ্দ্যম নৃত্য আমার ভালো লাগে না। তবে ডেনিকে মন্দ লাগেনি।

হ্যাঁ, সেও খারাপ নাচে না। মাথা নাড়তে নাড়তে সিগারেটে টান দেয় ম্যানেজার।

ছেলেটার ভাগ্য সত্যি ভালো মিস গেলার্টের মতো নর্তকীর সে সঙ্গ পেয়েছে। মেয়েটার ভবিষ্যৎ সত্যি উজ্জ্বল, ভবিষ্যতে আরো নাম খ্যাতি কুড়োবে।

যদি না জেলের জীবন ওর কপালে লেখা থাকে। হেলেনের কাঠ কাঠ জবাব শুনে ম্যানেজারকে ভুরু কোচকাতে দেখি। আমি পরিস্থিতিটা সামলে দিতে তাড়াতাড়ি বলে উঠি, আমি ওর জায়গায় থাকলে কখনোই সাপটার অত কাছে মুখ নিয়ে যাবার সাহস পর্যন্ত করতাম না। ওটার বিষ নেই যদিও, তবু এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি।

মাংসালো গোছের সাদা মুখে মুহূর্তের মধ্যে অমাবস্যার কালো মেঘে ছেয়ে গেল। বিষ নেই। আপনি এতো জোর দিয়ে বলছেন কী করে?হলের বাইরে বিজ্ঞাপনটা পড়ে দেখেননি?সাপটার বিষ নেই কেউ প্রমাণ করতে পারলেই তাকে আমরা একশো ডলার পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছি। যে কেউ যে কোন সময়ে এসে ওটা পরীক্ষা করে যেতে পারে।

এখনও পর্যন্ত পরীক্ষার জন্য কেউ এগিয়ে এসেছে? হেলেন মুখ খুলেই এই প্রশ্ন ছুঁড়ল।

নিশ্চয়ই। এইতো সেদিন এক চাষী এখানে এসেছিল, সাপ বিশেষজ্ঞ রূপে নিজেকে পরিচিত করাল। সাপটা রাখা আছে একটা কাঁচের বাক্সে। তাকে দেখা মাত্রই সাপটা ভেতর থেকেই এমন ছোবল মারে যে বিষটা কাঁচের ওপরই ছড়িয়ে পড়েছিল। লোকে কী এমনি ভিড় জমায় এখানে? আমি তো কিছুতেই ভেবে পাই না, আজ পর্যন্ত ওটা শোয়ের সময় ছোবল মারেনি কেন?

দারোয়ান ফিরে এল।

উনি দেখা করবেন। গমন পথের দিকে বুড়ো আঙুল বাঁকিয়ে দেখল সে।

ডানদিকের একেবারে শেষ দরজা, চলে যান।

ম্যানেজারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে হেলেনকে চাপা গলায় বললাম, মেয়েটার কাছে দুটো সাপ নেই তো! একটা বিষধর, অন্যটা বিষ ছাড়া?

হেলেন কথার কোন জবাব দিল না। দরজায় মৃদু টোকা দিতেই, ভেতর থেকে নারীকণ্ঠে সাড়া এল, আসুন।

ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। খুব সাধারণ এক সাজঘর। চেয়ারের সংখ্যা দুটো আর একটা প্রসাধনের টেবিল, আসবাব বলতে শুধু এগুলোই ঘরের শোভাবর্ধনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা দেওয়া একটা কুলুঙ্গী আলমারির প্রয়োজন মেটাচ্ছে। মেঝে জুড়ে এক টুকরো গালচে, আর আছে জলাধার, সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছিল জল।

প্রসাধন টেবিলের সামনে বসে সুসান গেলার্ট তোয়ালে দিয়ে জোরে চুল ঘষতেই ব্যস্ত। দেখেই বোঝা যায় এইমাত্র মাথা ধুয়েছে ও। হেলেনের পিঠে খোঁচা মারার একটা সুপ্ত বাসনা আমি আর সামলাতে পারলাম না। এতক্ষণ ধরে ও পরচুলা পরে অভিনয় করেনি একথা প্রমাণ হয়ে গেল। অর্থাৎ কোরিনই নিজের বোনের ছদ্মবেশে অভিনয় করছিল বলে যে অভিমত হেলেন কিছুক্ষণ আগে ব্যক্ত করেছিল তা ভ্রান্ত প্রমাণ হল। হেলেনকে আড়ষ্ট হয়ে কুঁকড়ে যেতে দেখে বুঝলাম, ভোয়ালে ঘষার অর্থটা ওর মগজেও ঢুকেছে।

সুসানের পরনে তখন নীল সোয়েটার আর কালো স্ন্যাক্স। প্রসাধনবিহীন থাকা সত্ত্বেও ওকে অপরূপই লাগছিল। ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নামিয়ে একমুখ হাসি হেসে ও তাকাল আমার দিকে। আসুন, আসুন। সত্যি অবাক হয়েছি, অবাক হবারই কথা কিন্তু।

হেলেনের দিকে দৃষ্টি পড়তে বলল, আপনি কী ওঁর স্ত্রী?

হ্যাঁ, হেলেনের উত্তর। তবে এই মুহূর্তে জেনারেল লায়বিলিটি কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব আমার ওপরেই।

ওঃ! সুসানের নীল চোখের তারা সামান্য গোলাকার হয়ে গেল। একপলক আমার কার্ডটার ওপর চোখের দেখা দেখে নিয়ে শুধু বলল, আর আপনার এখানে আগমন হয়েছে ন্যাশনাল ফিলিটি থেকে! কেন…কোন গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে নাকি?

বসুন, বসুন আপনারা। বসার জায়গাও এখানে নেই। অন্য চেয়ারটা হেলেনের উদ্দেশ্যে ঠেলে দিয়ে দেওয়ালের পাশে রাখা ট্যাঙ্কটা আমাকে দেখিয়ে দিল। কিছু মনে করবেন না, কেউ যে এখনে আসতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমি কিছু বলার আগেই গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ব্র্যাড!…এখানে এসো তো একবার!

বাইরের দরজা খোলার শব্দ হল। পরক্ষণেই মূর্তিমান ডেনিহাজির হল। আমাদের দিকে অবাক চোখে একবার তাকিয়ে সুসানের দিকে ফিরল সে।

এহচ্ছে ব্র্যাড ডেনি,তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হাসল সুসান। একাধারে আমার এজেন্ট আর পার্টনার। আর…এরা হলেন মিঃ অ্যান্ড মিসেস হারমাস।

মিঃ হারমাস এসেছেন ন্যাশানাল ফিডালিটি থেকে আর মিসেস হারমাস জেনারেল লায়বিলিটির প্রতিনিধি হয়ে।

মুহূর্তের জন্য থতমত খেয়ে গেল ডেনি, পরক্ষণেই দন্ত-বিকশিত করে হেসে ফেলল, আপনাদেরইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলো পরস্পরের মধ্যে ঘটকালির কাজ করে এর আগে জানতে সৌভাগ্য ঘটেনি তো!কিন্তু এতে ভেতরের গোপন খবর ফাঁস হয়ে যেতে পারে, তাইনা?আপনারা বোধহয় অন্য পলিসিগুলোর খবরও রাখেন?

হ্যাঁ, প্রত্যুত্তরে উত্তর দিলাম আমি। শুনেছি।

দুজনের ওপরই গভীর দৃষ্টি রেখেছিলাম, কিন্তু কারুর মধ্যেই অপরাধ জনিত মনোভাবের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ওরা পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে যেভাবে হাসাহাসি করছে তাতে মনে হয় ব্যাপারটাকে ওরা তেমন গুরুত্ব না দিয়ে তার পরিবর্তে মজার খোরাক রূপেই সেটা ব্যবহার করছে।

কথাটা আপনাদের জানানো উচিত ছিল কিনা জানি না, ডেনি দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দাঁড়াল। তবে অন্য কোম্পানিতে ইনসিওর করার কথাটা কেউ জানার আগ্রহ প্রকাশ করেনি বলে আমরাও সে বিষয়ে কোন উল্লেখ করিনি।

শুধু বললাম, আপনারা যে ধরণের পলিসি করেছেন তাতে অন্য কোম্পানিগুলোতে না জানালেও তেমন কিছু ক্ষতি হয়না। মিস গেলার্ট বোধহয় সবশুদ্ধ দশলক্ষ ডলারের ইনসিওর করিয়েছেন?

 হ্যাঁ, জ্বলজ্বল করে ওঠে সুসানের মুখ। কথাটা যখন প্রেস রিপোর্টারদের কানে উঠবে, কী হাস্যকর ব্যাপারটাই না হবে বলুন দেখি?আজকের শো দেখে আপনার মন কী বলে? সকলকে আমি তাক লাগিয়ে চমকে দিইনি? প্রতিদিন এরকমটাই ঘটে, তাই না ব্র্যাড?

নিশ্চয়ই, ডেনি গর্বিত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নিল সুসানের দিকে। বুঝলেন মিঃ হারমাস, আমি ওকে সবসময়ে একটা কথা বোঝাই তাহল ধৈর্য ধরে প্রতীক্ষা। নিউইয়র্ক যাবার আগে এইসব জায়গায় আমাদের খেলা দেখিয়ে খেলাটা আরও ভাল ভাবে রপ্ত করে নেবার সময় বা সুযোগ দুই আমরা পাব। কিন্তু সুসান এক্ষুনি ওখানে যেতে প্রস্তুত অথচ বেলারিয়াসের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা আমার নেই। কোন বড় জায়গায় খেলা দেখাতে গিয়ে শেষে কোন সমস্যা না দেখা দেয়?

বেলারিয়াস না কী যেন বললেন?

সুসান ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। ওটা আমার সাপের নাম। ওকে কেমন ট্রেনিং দিয়েছি তাতে নিজের চোখেই দেখলেন, ট্রেনিংটা কেমন দিয়েছি বলুন? অবশ্য ব্রাডের কথাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বেলারিয়াস মাঝে-মধ্যেই বড় খেয়ালী হয়ে ওঠে, তখন আমাকে চুমু দিতে একেবারেই অরাজী থাকে।

তাতে অত দুশ্চিন্তার কোন ব্যাপার দেখছি না ওদের ন্যাকামিত পিণ্ডি জ্বলে ওঠে আমার। আচ্ছা, শুনলাম সাপটা নাকি বিষধর সাপ, আর যতদুর আমি জানি, গোখরোর ছোবল সব সময়েই মৃত্যুকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডেকে আনে…

ঠিকই শুনেছেন। কিন্তু আমাকে ও দংশন করবে না।

আপনার বিশ্বাসের প্রশংসা না করে আমি পারছি না, অত ঝুঁকির মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে বিষ থলিটা বের করে নেন না কেন?

সেটা কী ঠিক হবে?বিমর্ষ গলায় বলে সুসান। ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে আমরা দর্শকের সঙ্গে প্রতারণা করব না নাকি?

আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি, আমার দিকে তাকিয়ে ডেনি বলল। প্রথমবার শো দেখার পর আমারও তাই মনে হয়েছিল। বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে যাবার পর আমি এখন অনেক ধাতস্থ হয়ে গেছি আর অভিজ্ঞতাও হয়েছে প্রচুর। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, প্রথম দুমাস ওর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার ওজন এক স্টোন কমে গিয়েছিল। তবে এখন আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামাইনা।

নিউইয়র্কে ব্র্যাড আমার জন্য নাইট ক্লাবে শো ঠিক করেছে, সহসা কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল স্বয়ং সুসান।

সে রকমই ইচ্ছা আছে, ডেনি বলল। দেখা যাক এখন কতদূর কী হয়?

সেই ভালো, আমি বললাম আপনাদের দুজনের জন্যই আমার আগাম শুভেচ্ছা রইল। আচ্ছা, এবার পলিসি সংক্রান্ত কিছু আলোচনা করা যাক।

কেন, ওর মধ্যে গণ্ডগোলের কিছু আছে নাকি? সুসানের মুখে চির রেখা ফুটে ওঠে। মিঃ গুডইয়ার যে বললেন, সব ঠিক আছে।

না না, পলিসিতে কোন গণ্ডগোল নেই। তবে আপনি যখন এতো লক্ষ ডলারের ইনসিওর করিয়েছেন, তাই আমার ওপরওয়ালা আপনাকে একবার সতর্ক করে দেওয়া উচিত বলে বিবেচনা করেছেন। অর্থাৎস্পষ্ট কথায়–কোন দুরাত্মা সমগ্র বিষয়টাকে নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগাতে পারে। ওরা দুজনেই আমার দিকে ফ্যাকাশে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল।

আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সুসানের মুখ দিয়ে পরিশেষে এই কথাগুলো বেরিয়ে এল।

আরও সহজ করে বলবো?…বেশ, শুনুন তবে। আপনার এই দশলক্ষ ডলারের দুর্ঘটনা বীমার দরুণ আপনাকে কেউ যদি হত্যা করে বসে, তাহলে জিনিসটা শুধু আপনার পক্ষেই ক্ষতিকারক নয়, এর জন্য আমাদের কোম্পানিরও লোকসানে ভুগতে হবে।

খুন করবে…ওকে? হতভম্ব হয়ে ডেনি বলে উঠল।

তার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সুসানকে লক্ষ্য করে বলি, দশলক্ষ ডলার নেহাৎ কম নয়। হয়তো আপনি এটাকে আমার অনধিকার চর্চা বলে মনে করবেন, কিন্তু দুর্ঘটনায় আপনার মরণ হলে বীমার টাকাটা কার ভাগ্যে জুটবে জানতে পারলে আমি খুশি হতাম।

কেন? কেউই পাবে না। মিঃ গুডইয়ার সে কথা আমাদের স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে এ বিষয়ে কিছু বলেন নি উনি?

তা বলেছে, তবে পলিসিতে কিছু গলতি আছে। ওতে লেখা আছে, উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়া অন্যকিছুতে মৃত্যু হলে আমরা টাকা দিতে বাধ্য থাকব।

কিন্তু, ডেনি বলল, মিঃ গুডইয়ারত আমাদের বলেছেন, দুর্ঘটনায় উনি সবরকমের সম্ভাবনার দিকগুলো পলিসিতে উল্লেখ করেছেন, আর সেই জন্যই এত কম প্রিমিয়াম দিচ্ছি আমরা।

এই দুজন যদি ধুরন্ধর অভিনয় না দেখাত তাহলে ওরা মুখে যা বলছে মনে মনে হয়তো সেটাও বিশ্বাস করে বসবে। ওদের দেখে এই কথাই মনে এল আমার।

এটাই হচ্ছে কথার কথা, স্থির গলায় বললাম আমি, সব রকমের পরিচিত দুর্ঘটনা। কিন্তু আমরা কখনোই নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি না যে এমন কোন দুর্ঘটনা নেই, যেটা কাজে লাগিয়ে কোন চতুর লোক সুবিধে আদায় করে নিতে পারে সহজেই।

ওহ, ব্র্যাড! চেয়ার ছেড়ে উৎফুল্ল হয়ে লাফিয়ে উঠল সুসান। উনি আমাকে অহেতুক ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন।

শুনুন মিঃ হারমাস, ডেনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল। এইসব অর্থহীন কথা বলে কোন লাভ নেই। আপনারা কীভাবে আপনাদের ব্যবসা চালাবেন সেটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে আপনাদের ওপর, তাই এ ব্যাপারে আমাদেরউতলা হবার কোন কারণ নেই। আমরা মিঃ গুডইয়ারকে গিয়ে ধরেছিলাম আর উনি আমাদের সব বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ পলিসিতে টাকা দাবি করার কোন সম্ভাবনাই নেই। আপনি অনর্থক ওর মনে অকারণ কেন ভয়ের সৃষ্টি করছেন আমার মাথায় ঢুকছে না।

অসহায় দৃষ্টিতে আমি হেলেনের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা ওর হাতেই ছেড়ে দিলাম পরম নিশ্চিন্তে।

আমার মনে হচ্ছে আমরা অনর্থক অহেতুক সময়ের অপব্যয় করছি হেলেনের কণ্ঠস্বর বরফের মত ঠাণ্ডা। তর্ক-বিতর্কের কোন প্রয়োজন নেই, মিস গেলার্ট। একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে সবরকম পরিচিত দুর্ঘটনার সঙ্গে আপনি বীমা করেছেন। ধরুন, এমন কোন এক অসম্ভব ঘটনাকী করে, সেটা এখন না হয় ছেড়ে দিন–অসম্ভব এক দুর্ঘটনার আপনি শিকার হলেন এবং প্রাণও হারালেন, যেটার কথা পলিসিতে উল্লেখ নেই। এবার বলুন, সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে বীমার টাকা দাবী করার কার অধিকার থাকতে পারে?

এইসব বিশ্রী ধরণের প্রসঙ্গ কেন তুলছেন বার বার আপনারা, বুঝতে পারছি না! সুসানের গলায় বিরক্তিকর সুর ঝরে পড়ে।

টাকাটা কার ভাগ্যে জুটবে বলুন? হেলেন এক ধাপ গলা চড়ায়।

আমি জানি না।

আপনি কোন উইল করেন নি?

না।

আপনার বাবা-মা জীবিত?

না, মারা গেছেন।

আপনজন কেউ নেই?

এক বোন ছাড়া আমার আপনজন আর দ্বিতীয় কেউ নেই।

টাকাটা তাহলে আপনার বোন পাবেন।

তাই পাওয়া উচিত, কিন্তু আমি তো তার কোন সম্ভাবনা…

আপনার বোনও কী এই লাইনের সঙ্গে যুক্ত? কথোপকথনের মোড় ঘোরাতে নিরুপায় হয়েই আমি মাঝপথে প্রশ্ন করলাম।

ছিল, কয়েক বছর হল ছেড়ে দিয়েছে। সুসান আবার বসে পড়ে কথাটা সমর্থনের আশায় ডেনির দিকে তাকায়। আমরা একসঙ্গেই কাজ করতাম। তারপর ওর বিয়ে হয়ে যায়।

ওর ঠিকানাটা দিতে পারলে আমাদের বড় ভালো হয়। আমার অনর্থক কৌতূহল দেখে আপনি মনে মনে বিরক্ত হচ্ছেন জানি, কিন্তু দশলক্ষ ডলার পলিসি করার পরে আমরাও আপনার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তরের প্রত্যাশা রাখি।

না না। আমি কিছু মনে করিনি। আপনি বলুন।

বেশ, তাহলে ওঁর ঠিকানাটা দিন দয়া করে।

আপনি কী ওর সঙ্গে দেখা করবেন?সুসানের গলায় সামান্য বিস্ময়। ও কিন্তু এসবের বিন্দু বিসর্গ জানে না। আমি ওকে চমকে দিতে চাই।

না না, ঠিকানাটা শুধুমাত্র ফাইলে রাখার উদ্দেশ্যেই চাইছি আমরা।

ও, তাহলে লিখে নিন। মিস কোরিন কনি…ডড লেক…স্প্রিংভিলে..ক্যালিফোর্নিয়া।

মুখে কোন বিস্ময় না ফুটিয়ে আমি ঠিকানাটা লিখে নিলাম। আমার অনুমান ছিল ঠিকানাটা দক্ষিণ আফ্রিকা হবে।

ব্যস, আজ এই পর্যন্তই থাক। আর আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। কাগজটা মুড়ে পকেটে রাখলাম। অজস্র ধন্যবাদ আপনাদের।

ওরা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তখন আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।

 সুসান প্রশ্ন করল, এর মধ্যে গণ্ডগোলের কোন ব্যাপার নেই তো, মিঃ হারমাস?

আপনি খুনটুনের কথা বলছেন…

মৃদু হাসলাম আমি। আরে না না, ওটা একটা কথার কথা। আপনার মতো অল্পবয়সী এক রমনী অত কম প্রিমিয়াম দিয়ে গোপনে দশ লক্ষ ডলারের একটা ইসিওর করালে তাতে আমাদের দাবি বিভাগের মনে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক। আর এই তদন্তটাও আপনার দোষেই হয়েছে। আপনি যদি আগে ভাগে আমাদের জানিয়ে রাখতেন যে, অন্য কোম্পানিগুলোর কাছেও একই ধরণের বীমা করিয়ে রেখেছেন, তাহলে আজ আমাকে এখানে আসতে হতো না। তবে এখন আপনার সাথে কথা বলার পর কোন দ্বন্দ্ব নেই আমার মনে, কথা বলে সন্তুষ্ট যে আপনি কারুর চাপে পড়ে এই পলিসিগুলো করেন নি। ব্যস, গণ্ডগোলের আর কিছুই নেই।

তাহলে সব ঠিক ঠাক আছে বলছেন? ঝুঁকে বসল সুসান।

হ্যাঁ।

আচ্ছা, পলিসিতে আপনি আঙুলের ছাপ দিয়েছেন কেন? হেলেন আচমকাই এই প্রশ্নটা করে বসল। আর কেনই বা দেখাতে চেয়েছেন ওটা হঠাৎ করে পড়ে গিয়েছিল?

কইনা তো! চোখ বড় বড় করল সুসান। ওটা হঠাই হয়ে গিয়েছিল।কলম থেকে আচমকা এক কালির ফোঁটা পড়ে যেতে আমি বুড়ো আঙুল দিয়ে ওটা চেপে দিয়েছিলাম।মিঃ গুডইয়ারের এব্যাপারে খুশির অন্ত ছিল না। আমিও দেখলাম, মতলবটা খুব খারাপনয়! তাই অন্য পলিসিগুলো করানোর সময়েও একইভাবে আঙুলের ছাপ দিয়ে দিয়েছিলাম।

মতলবটা আপনি কোন দিক থেকে ভালো বলছেন? হেলেন প্রশ্ন করে বসল।

মিঃ গুডইয়ার বলেছিলেন, আমার সই সম্বন্ধে এতে আর কোন সন্দেহ থাকবে না।

আপনি যখন এতই নিশ্চিত যে, পলিসিগুলো থেকে কেউ টাকা দাবি করতে পারবে না, তখন সই সম্বন্ধে সন্দেহ থাকার প্রশ্ন উঠছে কোথায়?

হেলেন প্রশ্নটা করার সময় মনোযোগসহকারে আমি সুসানের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিলাম। ওর সারা মুখে জুড়ে বিরক্তির চিহ্ন সুস্পষ্ট।

মিঃ গুডইয়ার যা বলেছিলেন আপনাকে সবটাই বললাম। তাই উনি নিজ মুখে স্বীকার করলেন কাজটা ভালোই হয়েছে, তখন ভাবলাম, এরকম করলে অন্য কোম্পানিগুলোও খুশীহবে নিশ্চয়ই। কেন, কাজটা কী আমি ভালো করিনি?

 না, ঠিকই করেছেন, বলে হেলেন দরজা দিয়ে এগিয়ে গেল।

হঠাৎ অন্ধকারে একটা ঢিল ছোঁড়ার বাসনা জাগল আমার। বললাম, যাবার আগে আপনাকে আর একটি মাত্র প্রশ্ন করতে চাই, মিস গেলার্ট। আচ্ছা লম্বা, স্বাস্থ্যবান চেহারা, নীল সাদা ডোরাকাটা কোট পরে এমন কোন লোকের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে কি? তার ভুরু দুটো নাকের ওপর থেকে জোড়া!

সুসান শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল, কই না তো! কে সে?

সে আপনার সন্ধান করছিল। ডেনিকে বলে উঠলাম, শুনেছি তাকে আপনার অফিসের ধারে কাছে ঘুর ঘুর করতে দেখা গেছে বহুদিন ধরে।

ডেনি ধীরে ধীরে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ালোচেহারার বর্ণনা শুনে ঠিক চিনতে পারছি না, তবে মনে হয় কোন অভিনেতা কাজ পাবার উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছিল। আসলে খুব অল্পদিনই হল এজেন্টের কাজ শুরু করেছি তো আমি, তাই যারা আমার খোঁজে আমার দোরগোড়ায় আসে তাদের অর্ধেককেই আমি চিনি না।

আচ্ছা চলি তাহলে। আপনাদের সঙ্গে কথা বলে আনন্দে মন ভরে গেল। আপনাদের শো এর জন্য আমার আগাম শুভেচ্ছা রইল। হেলেন আর আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম।

নীরবে হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামার পর আমি-ই সর্বপ্রথম মুখ খুললাম, তাহলে তোমার বদলি ভূমিকার অভিনয় করার সম্ভাবনাটা একেবারেই খাটল না। ও যে পরচুলা পরে ছিল না তাও স্পষ্টই বোঝা যায়। আর অ্যালানের কথাগুলোও বর্ণে বর্ণে মিলে গেল–ওদের দুজনকেই আমার ভালো লেগেছে। আমি অবশ্য আগেই টের পেয়েছিলাম যে এটা ম্যাডক্সের উর্বর মস্তিষ্কের একটা ভ্রান্ত চিন্তা মাত্র, এখন ভালোভাবে সেটা প্রমাণও হয়ে গেল।

আমার অনুমান কী বলে জানো? চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল হেলেন। আমার মনে হচ্ছে, ও দুটো যেন বড্ড বেশী ভালোমানুষ।

এটা তোমার মেয়েলি সন্দেহ মাত্র। তোমার অবাস্তব তত্ত্বটা ভুল প্রমাণিত হবার পরেও তোমার মন সেটা মেনে নিতে পারছে না কেন?

তোমরা যখন কথোপকথনে ব্যস্ত ছিলে, আমি হাত সাফাই করে ওর আয়নাটা পেঁড়িয়ে নিয়েছি। ওতে ভালো ভাবে গোটা দুই আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। ওটা তোমার পলিসির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার অভিপ্রায় আছে নাকি?

 নিশ্চয়ই দেখবো।উৎফুল্ল হয়ে উঠি আমি। এটার কথা তো আমার মাথাতেই আসেনি!..

হোটেলে পৌঁছেই ঘরে ঢুকে ব্রীফকেস খুলে পলিসির প্রতিলিপিটা বের করে ফেললাম। হেলেন মুখ দেখার ছোট্ট একটা আয়না বের করল। যাতে অনেকগুলো আঙুলের ছাপ বেশ স্পষ্টভাবেই অক্ষত ছিল। হেলেনের পাউডার কেস থেকে কিছুটা পাউডার নিয়ে আয়নার ওপর। ছড়িয়ে দিলাম। ছাপগুলো আরো স্পষ্ট রূপে চোখের সামনে ধরা দিল।

পলিসি আর আয়নায় অক্ষুণ্ণ থাকা ছাপগুলো আলোর নীচে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করেই বুঝতে অসুবিধে হল না, দুটোর মধ্যে কোন তফাৎ নেই। হেলেনকে বললাম, এই দেখ আঁকসির মতো শিরটা ওপর থেকে নীচে নেমে বাঁ দিকে ঘুরে গেছে, আর মাঝের এই গোলাকার চাকাটা দুটোই হুবহু এক। এবার তুমি সন্তুষ্ট হয়েছ তো?

সম্পূর্ণ ভাবে নয়, হেলেন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল। আমার মনে হয় ম্যাডক্সকে রিপোর্ট দেবার আগে পর্যন্ত আমাদের একবার কোরিন কন-এর মুখোমুখি হওয়া খুবই উচিত।

ম্প্রিংভিলের দূরত্ব এখান থেকে প্রায় দুশো মাইল। কী দরকার শুধু শুধু সময় নষ্ট করার? তর্ক করার বৃথা চেষ্টা করি আমি।

একটু ভাবো, চিন্তা করো স্টিভ। ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে ম্যাডক্সকে সম্পূর্ণ রিপোর্ট দেওয়া আমাদের উচিত হবে কি? আমি মানছি, সুসান আর ডেনিকে দেখে মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক করে না, তবু আমার স্থির বিশ্বাস যে, কোথাও কিছু না কিছু একটা গণ্ডগোল আছেই।

ডোরাকাটা কোট আর সেই সেন্ট লাগানো মেয়েটার কথা কী একেবারে ভুলে বসলে? দারোয়ান খুনের সঙ্গে অনায়াসেই ওদের জড়িয়ে ফেলা যায়। তাই বলছিলাম, কোরিন আর তার পতি দেবতার সঙ্গে দেখা করার পরই ঘাড় থেকে সন্দেহের বোঝাটা নামাতে পারব।

স্মরণে রেখো, সুসানের কিছু হলে কোরিন যদি টাকাটা পেয়ে যায়। ওর স্বামীরও তাতে ভাগ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তাই এটা যদি ঠকবাজি হয়, তারও এ ব্যাপারে জড়িত থাকা কোন অসম্ভব কিছু নয়। বেশ, তুমি যা চাইছ তাই হোক। বরং ফ্যান’শকে ফোন করে আমাদের বক্তব্যটা তাকে জানিয়ে দেওয়াই ভালো।