চতুর্থ পরিচ্ছেদ—খাণ্ডবদাহ
সুভদ্রাহরণের পরে খাণ্ডবদাহে কৃষ্ণের দর্শন পাই। পাণ্ডবেরা খাণ্ডবপ্রস্থে বাস করিতেন। তাঁহাদিগের রাজধানীর নিকট খাণ্ডব নামে এক বৃহৎ অরণ্য ছিল কৃষ্ণার্জুন তাহা দগ্ধ করেন। তাহার বৃত্তান্তটি এই। গল্পটা বড় আষাঢ়ে রকম।
পূর্বকালে শ্বেতকি নামে একজন রাজা ছিলেন। তিনি বড় যাজ্ঞিক ছিলেন। চিরকালই যজ্ঞ করেন। তাঁহার যজ্ঞ করিতে করিতে ঋত্বিক্ ব্রাহ্মণেরা হয়রাণ হইয়া গেল। তাহারা আর পারে না— সাফ জবাব দিয়া সরিয়া পড়িল। রাজা তাহাদিগকে পীড়াপীড়ি করিলেন— তাহারা বলিল, “এ রকম কাজ আমাদের দ্বারা হইতে পারে না— তুমি রুদ্রের কাছে যাও।” রাজা রুদ্রের কাছে গেলেন— রুদ্র বলিলেন, “আমরা যজ্ঞ করি না— এ কাজ ব্রাহ্মণের। দুর্বাসা এক জন ব্রাহ্মণ আছেন, তিনি আমারই অংশ— আমি তাঁহাকে বলিয়া দিতেছি।” রুদ্রের অনুরোধে, দুর্বাসা রাজার যজ্ঞ করিলেন। ঘোরতর যজ্ঞ— বার বৎসর ধরিয়া ক্রমাগত অগ্নিতে ঘৃতধারা। ঘি খাইয়া অগ্নির Dyspepsia উপস্থিত। তিনি ব্রহ্মার কাছে গিয়া বলিলেন, “ঠাকুর! বড় বিপদ, খাইয়া খাইয়া শরীরের বড় গ্লানি উপস্থিত হইয়াছে, এখন উপায় কি?” ব্রহ্মা যে রকম ডাক্তারি করিলেন তাহা Similia Similibus Curanter হিসাবে। তিনি বলিলেন, “ভাল , খাইয়া যদি পীড়া হইয়া থাকে, তবে আরও খাও। খাণ্ডব বনটা খাইয়া ফেল—পীড়া আরাম হইবে।” শুনিয়া অগ্নি খাণ্ডব বন খাইতে গেলেন। চারি দিকে হু হু করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন। কিন্তু বনে অনেক জীবজন্তু বাস করিত— হাতীরা শুঁড়ে করিয়া জল আনিল, সাপেরা ফণা করিয়া জল আনিল, এই রকম বনবাসী পশুপক্ষিগণ মিলিয়া আগুন নিবাইয়া দিল। আগুন সাত বার জ্বলিলেন, সাত বার তাহারা নিবাইল। অগ্নি তখন ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করিয়া কৃষ্ণার্জুনের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন, “আমি বড় পেটুক, বড় বেশী খাই, তোমরা আমাকে খাওয়াইতে পার?” তাঁহারা স্বীকৃত হইলেন। তখন তিনি আত্মপরিচয় দিয়া ছোট রকমের প্রার্থনা জানাইলেন— “খাণ্ডব বনটি খাব। খাইতে গিয়াছিলাম, কিন্তু ইন্দ্র আসিয়া বৃষ্টি করিয়া আমাকে নিবাইয়া দিয়াছে— খাইতে দেয় নাই।” তখন কৃষ্ণার্জুন অস্ত্র ধরিয়া বন পোড়াইতে গেলেন। ইন্দ্র আসিয়া বৃষ্টি করিতে লাগিলেন, অর্জুনের বাণের চোটে বৃষ্টি বন্ধ হইয়া গেল। সেটা কি রকমে হয়, আমরা কলিকালের লোক তাহা বুঝিতে পারি না। পারিলে, অতিবৃষ্টিতে ফসল রক্ষার একটা উপায় করা যাইতে পারিত। যাই হোক—ইন্দ্র চটিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। সব দেবতা অস্ত্র লইয়া তাঁহার সহায় হইলেন। কিন্তু অর্জুনকে আঁটিয়া উঠিবার যো নাই। ইন্দ্র পাহাড় ছুঁড়িয়া মারিলেন—অর্জুন বাণের চোটে পাহাড় কাটিয়া ফেলিলেন। (বিদ্যাটা এখনকার দিনে জানা থাকিলে রেইল্ওয়ে টনেল্ করিবার বড় সুবিধা হইত।) শেষ ইন্দ্র বজ্রপ্রহারে উদ্যত— তখন দৈববাণী হইল যে, ইহারা নরনারায়ণ প্রাচীন ঋষি।* দৈববাণীটা বড় সুবিধা— কে বলিল, তার ঠিকানা নাই— কিন্তু বলিবার কথাটা প্রকাশ হইয়া পড়ে। দৈববাণী শুনিয়া দেবতারা প্রস্থান করিলেন। কৃষ্ণার্জুন স্বচ্ছন্দে বন পোড়াইতে লাগিলেন। আগুনের ভয়ে পশুপক্ষী পলাইতেছিল, সকলকে তাঁহারা মারিয়া ফেলিলেন। তাহাদের মেদ মাংস খাইয়া অগ্নির মন্দাগ্নি ভাল হইল—বিষে বিষক্ষয় হইল—তিনি কৃষ্ণার্জুনকে বর দিলেন, পরাভূত দেবতারা আসিয়াও বর দিলেন। সকল পক্ষ খুসী হইয়া ঘরে গেলেন।
এরূপ আষাঢ়ে গল্পের উপর বুনিয়াদ খাড়া করিয়া ঐতিহাসিক সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইলে, কেবল হাস্যাস্পদ হইতে হয়—অন্য লাভ নাই। আর আমাদের যাহা সমালোচ্য—অর্থাৎ কৃষ্ণচরিত্র,—তাহার ভালমন্দ কোন কথাই ইহাতে নাই। যদি ইহার কোন ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকে, তবে সেটুকু এই যে, পাণ্ডবদিগের রাজধানীর নিকটে একটা বড় বন ছিল, সেখানে অনেক হিংস্র পশু বাস করিত, কৃষ্ণার্জুন তাহাতে আগুন লাগাইয়া, হিংস্র পশুদিগকে বিনষ্ট করিয়া জঙ্গল আবাদ করিবার যোগ্য করিয়াছিলেন। কৃষ্ণার্জুন যদি তাই করিয়াছিলেন, তাহাতে ঐতিহাসিক কীর্তি বা অকীর্তি কিছুই দেখি না। সুন্দরবনের আবাদকারীরা নিত্য তাহা করিয়া থাকে।
আমরা স্বীকার করি যে, এ ব্যাখ্যাটা নিতান্ত টাল্বয়স হুইলরি ধরণের হইল। কিন্তু আমরা যে এরূপ একটা তাৎপর্য সূচিত করিতে বাধ্য হইলাম, তাহার কারণ আছে। খাণ্ডবদাহটা অধিকাংশ তৃতীয় স্তরান্তর্গত হইতে পারে, কিন্তু স্থূল ঘটনার কোন সূচনা যে আদিম মহাভারতে নাই, এ কথা আমরা বলিতে প্রস্তুত নহি। পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে এবং অনুক্রমণিকাধ্যায়ে ইহার প্রসঙ্গ আছে। এই খাণ্ডবদাহ হইতে সভাপর্বের উৎপত্তি। এই বনমধ্যে ময়দানব বাস করিত। সেও পুড়িয়া মরিবার উপক্রম হইয়াছিল। সে অর্জুনের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাহিয়াছিল ; অর্জুনও শরণাগতকে রক্ষা করিয়াছিলেন। এই উপকারের প্রত্যুপকার জন্য ময়দানব পাণ্ডবদিগের অত্যুৎকৃষ্ট সভা নির্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন। সেই সভা লইয়া সভাপর্বের কথা।
এখন সভাপর্ব অষ্টাদশ পর্বের এক পর্ব। মহাভারতের যুদ্ধের বীজ এইখানে। ইহা একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। যদি তা না যায়, তবে ইহার মধ্যে কতটুকু ঐতিহাসিক তত্ত্ব নিহিত থাকিতে পারে, তাহা বিচার করিয়া দেখা উচিত। সভা এবং তদুপলক্ষে রাজসূয় যজ্ঞকে মৌলিক এবং ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করার প্রতি কোনই আপত্তি দেখা যায় না। যদি সভা ঐতিহাসিক হইল, তবে তাহার নির্মাতা এক জন অবশ্য থাকিবে। মনে কর, সেই কারিগর বা এঞ্জিনিয়রের নাম ময়। হয়ত সে অনার্যবংশীয়—এজন্য তাহাকে ময়দানব বলিত। এমন হইতে পারে যে, সে বিপন্ন হইয়া অর্জুনের সাহায্যে জীবন লাভ করিয়াছিল, এবং কৃতজ্ঞতাবশতঃ এই এঞ্জিনিয়রী কাজটুকু করিয়া দিয়াছিল। যদি ইহা প্রকৃত হয়, তবে সে যে কিরূপে বিপন্ন হইয়া অর্জুনকৃত উপকার প্রাপ্ত হইয়াছিল, সে কথা কেবল খাণ্ডবদাহেই পাওয়া যায়। অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে যে, এ সকলই কেবল অন্ধকারে ঢিল মারা। তবে অনেক প্রাচীন ঐতিহাসিক তত্ত্বই এইরূপ অন্ধকারেও ঢিল।
হয়ত, ময়দানবের কথাটা সমুদায়ই কবির সৃষ্টি। তা যাই হৌক, এই উপলক্ষে কবি যে ভাবে কৃষ্ণার্জুনের চরিত্র সংস্থাপিত করিয়াছেন, তাহা বড় মনোহর। তাহা না লিখিয়া থাকা যায় না। ময়দানব প্রাণ পাইয়া অর্জুনকে বলিলেন, “আপনি আমাকে পরিত্রাণ করিয়াছেন, অতএব আজ্ঞা করুন, আপনার কি প্রত্যুপকার করিব?” অর্জুন কিছু প্রত্যুপকার চাহিলেন না, কেবল প্রীতি ভিক্ষা করিলেন। কিন্তু ময়দানব ছাড়ে না; কিছু কাজ না করিয়া যাইবে না। তখন অর্জুন তাঁহাকে বলিলেন,—
“হে কৃতজ্ঞ! তুমি আসন্নমৃত্যু হইতে রক্ষা পাইয়াছ বলিয়া আমার প্রত্যুপকার করিতে ইচ্ছা করিতেছ, এই নিমিত্ত তোমার দ্বারা কোন কর্ম সম্পন্ন করিয়া লইতে ইচ্ছা হয় না।”
ইহাই নিষ্কাম ধর্ম ; খ্রীষ্টান ইউরোপে ইহা নাই। বাইবেল যে ধর্ম অনুজ্ঞাত হইয়াছে, স্বর্গ বা ঈশ্বর-প্রীতি তাহার কাম্য। আমরা এ সকল পরিত্যাগ করিয়া পাশ্চাত্ত্য গ্রন্থ হইতে যে ধর্ম ও নীতি শিক্ষা করিতে যাই, আমাদের বিবেচনায় সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। অর্জুনবাক্যের অপরার্ধে এই নিষ্কাম ধর্ম আরও স্পষ্ট হইতেছে। ময় যদি কিছু কাজ করিতে পারিলে মনে সুখী হয়, তবে সে সুখ হইতে অর্জুন তাহাকে বঞ্চিত করিতে অনিচ্ছুক। অতএব তিনি বলিতে লাগিলেন,—
“তোমার অভিলাষ যে ব্যর্থ হয়, ইহাও আমার অভিপ্রেত নহে। অতএব তুমি কৃষ্ণের কোন কর্ম কর, তাহা হইলেই আমার প্রত্যুপকার করা হইবে।”
অর্থাৎ, তোমার দ্বারা যদি কাজ লইতে হয়, তবে সেও পরের কাজ। আপনার কাজ লওয়া হইবে না।
তখন ময় কৃষ্ণকে অনুরোধ করিলেন—কিছু কাজ করিতে আদেশ কর। ময় “দানবকুলের বিশ্বকর্মা”—বা চীফ্ এঞ্জিনিয়র। কৃষ্ণও তাঁহাকে আপনার কাজ করিতে আদেশ করিলেন না। বলিলেন, “যুধিষ্ঠিরের একটা সভা নির্মাণ কর। এমন সভা গড়িবে, মনুষ্যে যেন তাহার অনুকরণ করিতে না পারে।”
ইহা কৃষ্ণের নিজের কাজ নহে—অথচ নিজের কাজ বটে। আমরা পূর্বে বলিয়াছি, কৃষ্ণস্বজীবনে দুইটি কার্য উদ্দিষ্ট করিয়াছিলেন—ধর্মপ্রচার এবং ধর্মরাজ্যসংস্থাপন। ধর্মপ্রচারের কথা এখনও বড় উঠে নাই। এই সভা নির্মাণ ধর্মরাজ্যসংস্থাপনের প্রথম সূত্র। এইখানেই তাঁহার এই অভিসন্ধির প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। যুধিষ্ঠিরের সভা নির্মাণ হইতে যে সকল ঘটনাবলী হইল, শেষে তাহা ধর্মরাজ্যসংস্থাপনে পরিণত হইল। ধর্মরাজ্যসংস্থাপন, জগতের কাজ ; কিন্তু যখন তাহা কৃষ্ণের উদ্দেশ্য, তখন এ সভাসংস্থাপন তাঁহার নিজের কাজ।
গত অধ্যায়ে সমাজসংস্করণের কথাটা উঠিয়াছিল। আমরা বলিয়াছি যে, তিনি সমাজসংস্থাপন বা Social Reformer হইবার প্রয়াস পান নাই। দেশের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পুনর্জীবন (Moral and Political Regeneration), ধর্মপ্রচার এবং ধর্মরাজ্যসংস্থাপন, ইহাই তাঁহার উদ্দেশ্য। ইহা ঘটিলে সমাজসংস্কার আপনি ঘটিয়া উঠে—ইহা না ঘটিলে সমাজসংস্কার কোন মতেই ঘটিবে না। আদর্শ মনুষ্য তাহা জানিতেন,—জানিতেন, গাছের পাট না করিয়া কেবল একটা ডালে জল সেচিলে ফল ধরে না। আমরা তাহা জানি না–আমরা তাই সমাজসংস্করণকে একটা পৃথক জিনিস বলিয়া খাড়া করিয়া গণ্ডগোল উপস্থিত করি। আমাদের খ্যাতিপ্রিয়তাই ইহার এক কারণ। সমাজসংস্কারক হইয়া দাঁড়াইলে হঠাৎ খ্যাতিলাভ করা যায়—বিশেষ সংস্করণপদ্ধতিটা যদি ইংরেজি ধরনের হয়। আর যার কাজ নাই, হুজুক তার বড় ভাল লাগে। সমাজসংস্করণ আর কিছুই হউক বা না হউক, একটা হুজুক বটে। হুজুক বড় আমোদের জিনিস। এই সম্প্রদায়ের লোকদিগকে আমরা জিজ্ঞাসা করি, ধর্মের উন্নতি ব্যতীত সমাজসংস্কার কিসের জোরে হইবে। রাজনৈতিক উন্নতিরও মূল ধর্মের উন্নতি। অতএব সকলে মিলিয়া ধর্মের উন্নতিতে মন দাও। তাহা হইলে আর সমাজসংস্করণের পৃথক্ চেষ্টা করিতে হইবে না। তা না করিলে, কিছুতেই সমাজসংস্কার হইবে না। তাই আদর্শ মনুষ্য মালাবারি হইবার চেষ্টা করেন নাই।
————————
* পাঠক দেখিয়াছেন, এক স্থানে কৃষ্ণ বিষ্ণুর কেশ; এখানে প্রাচীন ঋষি, আবার দেখিব, তিনি বিষ্ণুর অবতার। এ কথার সামঞ্জস্যচেষ্টায় বা খণ্ডনে আমাদের কোন প্রয়োজন নাই। কৃষ্ণচরিত্রই আমাদের সমালোচ্য।