০৪. ক্রিনিটি নিকির কোমরে বেল্ট বেঁধে

ক্রিনিটি নিকির কোমরে বেল্ট বেঁধে সেটি বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলের একটি হুঁকের সাথে লাগিয়ে দিলো। নিকি জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিলে?

তোমার নিরাপত্তার জন্যে। তুমি তো আগে কখনো বাইভার্বালে ওঠ নি। তাই হঠাৎ করে যদি পড়ে যাও সে জন্যে।

আমি মোটেও পড়ে যাব না।

আমি জানি তুমি পড়ে যাবে না। কিন্তু তুমি জান তোমার ব্যাপারে আমি কখনো কোনো ঝুঁকি নেব না। তুমি যখন বাইভার্বাল চালানো শিখে যাবে তখন নিরাপত্তার এই ব্যাপারগুলো দরকার হবে না।

আমি কী এটি চালাতে পারব?

অবশ্যই পারবে। পৃথিবীতে যখন মানুষ বেঁচে ছিল তখন অবশ্যি কখনোই তোমার বয়সী একটি শিশুকে কেউ বাইভার্বাল চালাতে দিত না।

কেন দিত না?

প্রয়োজন হতো না। সেজন্যে দিত না। তখন ছোট শিশুদের কোনোরকম দায়িত্ব ছিল না। তারা শুধু মজা করত।

আমারও কোনো দায়িত্ব নাই। নিকি গম্ভীর হয়ে বলল, আমিও শুধু মজা করি।

না। ক্রিনিটি তার গলার স্বরে খানিকটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলল, তোমার অনেক দায়িত্ব। তুমি এর মাঝে কাপড় পরা শিখে গেছ। এখন তোমাকে এই বাইভার্বাল চালানো শিখতে হবে। তোমাকে যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করা শিখতে হবে। তোমাকে মনে হয় একটু-আধটু অস্ত্র ব্যবহার করা শিখতে হবে। তাছাড়া–

তা ছাড়া কী?

আমরা যদি সত্যি সত্যি কোনো মানুষের দেখা পেয়ে যাই তাহলে আমি সেখানে কোনো কথা বলতে পারব না। আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট, মানুষের সাথে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। তোমাকে তার সাথে কথা বলতে হবে।

আমি তার সাথে কী কথা বলব?

সেটা যখন সময় হবে তখন তুমি ভেবে বের করে ফেলতে পারবে। এখন চল সকাল থাকতে থাকতে আমরা রওনা দিই।

বাইভার্বালটির কাছাকাছি একটি গাছে কিছু পাখি বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করছে। কাছাকাছি আরেকটি গাছে নানাবয়সী বানর। ক্রিনিটি বলল, নিকি, তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নাও।

কেন বিদায় নেব ক্রিনিটি? আমি কী মরে যাব?

না। মরে যাবে না। কিন্তু যখন কোনো মানুষ অন্যদের কাছ থেকে চলে যায় তখন বিদায় নেয়।

নিকির মুখটা হঠাৎ ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে। সে নিচু গলায় বলল, আমি চলে যেতে চাই না। আমি এখানে থাকতে চাই।

ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করে, সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল তারপর ঘুরে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি, তুমি সারাজীবন এখানে থাকতে পারবে না। তোমাকে এখন যেতে হবে, অন্য মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে।

আমি যেতে চাই না। আমি অন্য মানুষ খুঁজে বের করতে চাই না।

তোমার মা আমাকে বলেছে আমি যেন অন্য মানুষকে খুঁজে বের করে তোমাকে তাদের কাছে নিয়ে যাই। তোমাকে যেতে হবে নিকি।

মায়ের কথা বলা হলে নিকি কখনো অবাধ্য হয় না। এবারেও হলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে আমি যাব। কিন্তু আগে বল তুমি আমাকে আবার এখানে নিয়ে আসবে।

তুমি যদি চাও তাহলে আমি আবার তোমাকে এখানে নিয়ে আসব। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই তুমি নিজেই বড় মানুষের মতো হয়ে যাবে। তুমি তখন

একা একা এখানে ফিরে আসতে পারবে।

আমি বড় মানুষের মতো হতে চাই না। আমি ছোট থাকতে চাই।

ক্রিনিটি এই কথাটির উত্তর দিলো না–বলল, তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নাও, বাইভার্বাল চালু করা হলে তার ইঞ্জিনের শব্দে তারা ভয় পেয়ে চলে যেতে পারে।

নিকি তখন মাথা ঘুরিয়ে গাছের ওপর চুপ করে বসে থাকা পশুপাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, বলল, বিদায় কিকি। বিদায় মিকু। বিদায় সবাই

কিকি এবং মিক্কু নিচু স্বরে একধরনের শব্দ করল কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাইভার্বালের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল এবং তার তীব্র শব্দে তাদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। বাইভার্বালটি একটি ঝাঁকুনি দিয়ে মাটি থেকে এক মিটারের মতো উপরে উঠে গেল এবং আবার একটি ঝাঁকুনি দিয়ে সেটি সামনের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। নিকি মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল, অনেকগুলো পাখি কর্কশ শব্দ করে উড়ছে, তার মাঝে কোনো একটি কিকি। দূরে একটি গাছে একধরনের উত্তেজনা দেখা যায় সেখানে নিশ্চয়ই মিক্কু এই মুহূর্তে গাছের একটি ডাল ধরে তার ভাষায় চিৎকার করছে। নিকি চাপা স্বরে বলল, আমি ফিরে আসব। আমি আবার ফিরে আসব। আসবই আসব।

নিকি অবাক হয়ে লক্ষ করল তার চোখে কেন জানি পানি চলে এসেছে। ব্যাপারটি সে বুঝতে পারল না।

 

ক্রিনিটি বলল, নিকি। তুমি প্রথমে লক্ষ কর আমি কেমন করে বাইভার্বালটি চালাই, তারপর আমি তোমাকে চালাতে দেব।

আমি লক্ষ করছি ক্রিনিটি। কিন্তু তুমি কিছুই করছ না।

তুমি ভুল বল নি। আমি আসলে কিছুই করছি না—এই বাইভার্বালগুলোর ভেতরে সে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে সেটি নিজে থেকেই সবকিছু করতে পারে। আমি শুধু কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ রাখছি আর স্টিয়ারিং হুঁইলটা ধরে রেখেছি।

নিকি কন্ট্রোল প্যানেলটির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, এখানে কী দেখা যায়?

সামনে কী আছে সেটি দেখা যায়।

আমি তো কিছু বুঝি না। এখানে তো শুধু লাল নীল কিছু রং!

তোমাকে এটি শিখতে হবে। রংগুলো দেখাচ্ছে তাপমাত্রা। আকৃতিগুলো দেখে কী দিয়ে তৈরি সেটি বোঝা যায়। কতদূরে সেটি আছে সেটিও বোঝা যায়। ক্রিনিটি ছোট একটি বিন্দুকে দেখিয়ে বলল, যেমন এটি হচ্ছে একটি প্রাণী। সম্ভবত হরিণ।

কেমন করে বুঝলে?

অভিজ্ঞতা থেকে। আমি আগে বাইভার্বাল চালিয়েছি।

নিকি দেখল ক্রিনিটির অনুমান সত্যি, বাইভার্বালটি যখন কাছে এসেছে তখন দেখা গেল একটি গাছের কাছাকাছি একটি বড় হরিণ দাঁড়িয়ে আছে। হরিণটি বাইভার্বালটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ইঞ্জিনটির শব্দ স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথে সেটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল।

নিকি বাইভার্বালের রেলিংটি ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বনভূমিটি পার হয়ে তারা বিশাল একটা জলাভূমিতে চলে এলো। জলাভূমিটি পার হওয়ার পর শুকনো পাহাড়ি এলাকা শুরু হল। এখানে তারা কিছু বিধ্বস্ত বাড়িঘর দেখতে পায়, গাছপালা এবং লাতগুল্ম সেই বাড়িগুলোকে ঢেকে ফেলছে, কোথাও কোনো প্রানীর চিহ্ন নেই। ক্রিনিটি তার বাইভার্বালটি নিয়ে খুব নীচে দিয়ে বাড়িঘরগুলোর উপর দিয়ে উড়ে গেল, বাইভার্বালের ইঞ্জিনিরে শব্দে সচকিত হয়ে কিছু পাখি কিছু বুনো প্রাণী এদিক-সেদিক ছুটে গিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করতে থাকে।

 

সারাদিন তারা বাইভার্বালে করে মাটির কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যেতে থাকে। যতদূর চোখ যায় ধ্বংসস্তুপের মতো ছোট ছোট বাড়িঘর। গাছপালা ঝোপঝাড় আর লতাগুল্মে ঢাকা। ঝড় বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত। শ্যাওলায় ঢাকা। দেখে দেখে নিকি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

সন্ধ্যেবেলা ক্রিনিটি একটি বাড়ির সামনে তার বাইভার্বালটি থামাল। নিকি জিজ্ঞেস করল, এখানে কেন থেমেছ ক্রিনিটি?

আমরা রাতে এখানে থামব। তুমি ঘুমাবে। আমি একটু কাজ করব।

কী কাজ?

আমি নেটওয়ার্কের ভেতর ঢুকতে চাইছি। মানুষের নেটওয়ার্ক যদি নাও থাকে রোবটদের একটি নেটওয়ার্ক থাকার কথা?

নিকি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আমরা তাহলে মানুষদের খুঁজে পাব? শুধু রোবটদের খুঁজে পাব?

এখনো সেটি আমরা জানি না নিকি। যদি রোবটদের নেটওয়ার্কটি খুঁজে পাই তাহলে সেখানে সবরকম খোঁজ পাব। মানুষ আছে কী নেই সেটিও আমরা জানতে পারব।

ও।

বাইভার্বালটি থামার পর নিকি লাফিয়ে সেটি থেকে নেমে এল। বড় বাসাটির দিকে তাকিয়ে সে যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেল ক্রিনিটি তখন তাকে থামাল, বলল, নিকি, দাঁড়াও।

কী হল?

তুমি একা একা এখানে ঢুকো না।

কেন ক্রিনিটি?

বহু বছর এখানে কেউ থাকে না। ভেতরে কী আছে আমরা জানি না। হয়তো এমন কিছু আছে যেটি দেখে তোমার খারাপ লাগবে। হয়তো কোনো বুনো পশু, বিষাক্ত সাপ–

আমি বুনো পশু আর বিষাক্ত সাপকে ভয় পাই না।

কিন্তু তারা তোমাকে দেখে ভয় পেতে পারে। কেউ যখন ভয় পায় তখন তারা খুব অদ্ভুত কাজ করে ফেলতে পারে।

ক্রিনিটি বাইভার্বাল থেকে কিছু যন্ত্রপাতি আর একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নামিয়ে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতর আলো জ্বালিয়ে এদিক-সেদিক দেখল। ঘরের মাঝখানে একটি আলট্রাসনিক বীপার বসিয়ে অপেক্ষা করল। নিকি লক্ষ করল ঘরের ভেতর থেকে কিছু পোকামাকড়, ছোট ছোট প্রাণী ছুটে বেরিয়ে যেতে থাকে। ক্রিনিটি তার ফটোসেলের চোখ দিয়ে চারদিকে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে বলল, নিকি, তুমি এখন ভেতরে আসতে পার।

নিকি বাসাটির ভেতরে ঢুকল। বহুবছর এখানে কোনো মানুষের পা পড়ে নি, তারপরেও বাসাটি সাজানো গোছানো। ক্রিনিটির সাথে সে বাসাটির ভেতর ঘুরে দেখে, উপর তলায় দুটি ছোট ঘরে দুটি ছোট বিছানা। এখানে নিশ্চয়ই দুটি ছোট শিশু ঘুমাতো। ঘরের দেয়ালে শিশুগুলোর ছবি টানানো, হাসিখুশি দুটি বাচ্চা।

নিকি বাচ্চাগুলোর ছবি দেখে বুকের ভেতর একধরনের ব্যথা অনুভব করে। সারা পৃথিবীর এরকম লক্ষ লক্ষ শিশু বেঁচেছিল,এখন কেউ নেই। সে একা এখন এই নির্জন পৃথিবীতে মানুষ খোঁজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে জানে না যদি একসাথে অনেকগুলো মানুষ থাকে তাহলে কিভাবে কথা বলতে হয়। কী করতে হয়। সত্যি সত্যি যদি কোনো মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে সে কী করবে? তার সাথে কী কথা বলবে?

রাতে ঘুমানোর সময় ক্রিনিটি উপর তলায় ছোট একটি বাচ্চার বিছানা গুছিয়ে নিকিকে শেয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুক্ষণ পর সে তাকে একবার দেখতে এসে আবিষ্কার করল নিকি বিছানা থেকে চাদরটা নিয়ে মেঝেতে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। যে বিছানাটি অন্য একজন শিশুর সেখানে সে শুতে চাইছে না। কেন নিকি বিছানায় শুতে চাইছে না ক্রিনিটি সে বিষয়টা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল না। মানুষের অনেক বিষয় সে বুঝতে পারে না, সে বোঝার চেষ্টাও করে না, বিষয়টি মেনে নেয়।

ক্রিনিটি নিকির শরীরটি চাদর দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিয়ে তার গলার মাদুলিটি খুলে নীচে নেমে আসে। ক্রিস্টাল রিডারে দিনলিপি রেকর্ড করে সে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে বসল। যখন পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে ছিল তখন বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের পুরো স্পেকট্রামটা ব্যস্ত ছিল, অসংখ্য সিগনাল আনাগোনা করত। এখন পুরো স্পেকট্রামটি আশ্চর্যরকম নীরব। ক্রিনিটি একটু একটু করে বিশ্লেষণ করতে করতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অত্যন্ত দুর্বল একটি সিগনাল আবিষ্কার করল। সে দীর্ঘ সময় সেটিকে বিশ্লেষণ করে, এখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে শখানেক কিলোমিটার দূর থেকে সেটি আসছে। কাছাকাছি গেলে হয়তো উৎসটা খুঁজে বের করা যাবে।

ক্রিনিটি বাকি রাতটুকু বাইভার্বালকে আরেকটি দীর্ঘ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত করে কাটিয়ে দিল। মানুষের মতো রোবটকে ঘুমাতে হয় না,রোবটকে বিশ্রমিও নিতে হয় না। ক্রিনিটি তাই দিনরাত একটানা কাজ করতে পারে। যখন পৃথিবীর মূল তথ্যকেন্দ্র চালু ছিল তখন সে ব্যাপারটি বোঝার জন্যে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করেছে, ব্যাপারটি সে বুঝতে পারে নি। ঘুম বিষয়টি তার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। স্বপ্ন বলে মানুষের ঘুম সম্পর্কিত আরো একটি বিষয়ের কথা সে শুনেছে, সেটি কী ক্রিনিটি তা অনুমান পর্যন্ত করতে পারে না।

 

ভোরবেলা নিকিকে নিয়ে ক্রিনিটি আবার রওনা দিয়ে দেয়। কোনদিকে যেতে হবে সেটি মোটামুটিভাবে জানে তাই ক্রিনিটি নিকিকে মাঝে মাঝেই বাইভার্বালটি চালাতে দিচ্ছে। আগে হোক পরে হোক নিকিকে এই ধরনের কাজগুলো শিখতেই হবে। যে শিশুটি পৃথিবীর একমাত্র জীবিত মানুষ তার দায়িত্ব অনেক বড়, তাকে সেভাবে গড়ে নিতে হবে।

উত্তর-পশ্চিমে যেতে যেতে হঠাৎ করে তারা একটি রাস্তা আবিষ্কার করল, কংক্রিটের রাস্তা অব্যবহারের কারণে জঞ্জালে ঢাকা পড়ে আছে। নিকি এই রাস্তা ধরে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে নিল। ডানপাশে একটি নীল, হ্রদ আবিষ্কার করে নিকি অকারণেই পুরো হ্রদটি একবার ঘুরে এলো। ক্রিনিটি নিকিকে বাধা দিল না, বাইভার্বালটি আবার যখন পথের উপর উঠে এলো তখন ক্রিনিটি বলল, নিকি, তুমি বাইভার্বালটি ডান দিকে ঘুরিয়ে নাও।

কেন?

সামনে আমি একধরনের সিগন্যাল দেখেছি।

কোথা থেকে আসছে সিগন্যালটি?

আমি এখনও জানি না। কাছে গেলে বুঝতে পারব।

নিকি বাইভার্বালটিকে ডান দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে অল্প কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কন্ট্রোল প্যানেলে দুটি ছোট ছোট বিন্দু ফুটে ওঠে। নিকি বলল, ক্রিনিটি, এই দেখ সামনে আরো দুটি হরিণ।

ক্রিনিটি মাথা নাড়ল, বলল, না এগুলো হরিণ না।

এগুলো তাহলে কী?

আমার মনে হয়, এগুলো রোবট।

রোবট?

হ্যাঁ। এটির শরীর ধাতব। এটি নড়ছে।

কী মজা! নিকির মুখে হাসি ফুটে উঠল, তোমার সাথে তোমার রোবট বন্ধুদের দেখা হবে।

নিকির কথা শেষ হবার আগেই কর্কশ গুলির শব্দ শোনা গেল এবং বাইভার্বালের সামনে বায়ুনিরোধক স্বচ্ছ কাচের একটি অংশ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। নিকি বিদ্যুৎগতিতে নীচু হয়ে চিৎকার করে উঠল, কী হয়েছে?

ক্রিনিটি বলল, গুলি করছে।

কে গুলি করছে?

রোবটগুলো।

কেন গুলি করছে রোবটগুলো?

মনে করছে আমরা তাদের এলাকায় বেআইনীভাবে ঢুকে পড়েছি। ক্রিনিটির গলার স্বরে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই, খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি নিচু হয়ে থাক। তোমার শরীরে যেন গুলি না লাগে।

তুমিও নিচু হয়ে যাও ক্রিনিটি।

আমি রোবটগুলির সাথে যোগাযোগ করছি।

ক্রিনিটির কথা শেষ হবার আগে দ্বিতীয়বার কর্কশ শব্দ করে এক ঝাঁক গুলি ছুটে এলো, বাইভার্বালের বায়ুনিরোধক যেটুকু কাচ বাকি রয়ে গিয়েছিল সেটুকুও এবার উড়ে গেল। নিকি চিৎকার করে বলল, ক্রিনিটি বসে পড়!

ক্রিনিটি বসে পড়ল না বরং মাথা উঁচু করে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করে বাইভার্বালটি ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে পড়ে এবং চোখের পলকে চারদিক দিয়ে অনেকগুলো বীভৎস ধরনের রোবট বাইভার্বালটিকে ঘিরে ধরে। তাদের হাতে বিকট-দর্শন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। বাইভার্বালটি থামার সাথে সাথে রোবটগুলো একসাথে তাদের অস্ত্রগুলো উঁচু করে চারদিক থেকে তাদের দিকে তাক করে ধরল।

নিকি চাপা গলায় বলল, বোকা! কী বোকা!

একটি রোবট মাটিতে পা ঠুকে বলে, বোকা কে বলেছে আমাদের?

নিকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি।

তুমি? তুমি কেন আমাদের বোকা বলেছ?

তোমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অস্ত্র তাক করেছ। এখন সবাই যদি গুলি কর তাহলে একজন আরেকজনকে মেরে ফেলবে।

রোবটগুলো বেশ কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলল না, তারপর সবাই একসাথে তাদের অস্ত্র নামিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগল। শেষে একটি রোবট জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

আমার নাম নিকি।

তুমি কত মাত্রার রোবট? সিস্টেম কতো ধাপের?

আমি রোবট না।

তাহলে তুমি কী?

আমি মানুষ।

সাথে সাথে রোবটগুলোর মাঝে ভয়ংকর এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গেল। তারা একে অপরকে ধাক্কা দিতে থাকে, কথা বলতে থাকে, একবার অস্ত্র উপরে তুলে তারপর নামিয়ে আনে এবং সেগুলো কঁকাতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যায় তখন ক্রিনিটি হাত তুলে বলল, তোমরা খাম।

রোবটগুলো সাথে সাথে থেমে যায়। একটি রোবট মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে নিকিকে দেখিয়ে বলল, এই যন্ত্রটি আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।

ক্রিনিটি বলল, নিকি যন্ত্র নয়। নিকি আসলেই মানুষ।

রোবটটা আবার মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, পৃথিবীতে কোনো মানুষ বেঁচে নেই। সব মানুষ মরে গেছে।

দ্বিতীয় একটি রোবট বলল, মরে গেছে।

তখন অন্য সবগুলো রোবট হল্লা করতে শুরু করল, মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করল, মরে গেছে। মরে গেছে।

নিকি অবাক হয়ে এই বিভৎস দর্শন রোবটগুলোকে দেখে, তাদের এই বিচিত্র ব্যবহার দেখে সে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল।

সাথে সাথে সবগুলো রোবট হঠাৎ পাথরের মতো জমে যায়। সবগুলো। রোবট তাদের ফটোসেলের চোখ দিয়ে নিকির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা। অস্ত্রগুলো নামিয়ে নেয় তারপর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করে, হেসেছে।

এটি নিশ্চিত ভাবে হাসি। অন্যকিছু নয়।

অন্যকিছু নয়।

শুধু মাত্র মানুষ হাসতে পারে।

মানুষ শুধুমাত্র মানুষ।

তার অর্থ এই বস্তুটি একটি মানুষ।

সত্যিকারের মানুষ।

আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমরা সত্যিকারের একটি মানুষকে দেখতে পাচ্ছি।

সৌভাগ্যবান। অনেক সৌভাগ্যবান।

আমাদেরকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল। সকল মানুষ মারা যায় নি।

মারা যায় নি।

বস্তুটি একটি মানুষ। আমি মানুষটিকে স্পর্শ করে দেখতে চাই।

স্পর্শ করতে চাই। আমার তথ্যকেন্দ্রে তথ্য রয়েছে মানুষের শরীরে তাপমাত্রা নির্দিষ্ট। এটি স্থির থাকে।

চামড়া কোমল এবং খানিকটা আর্দ্র।

এদের চোখ অত্যন্ত সংবেদনশীল।

সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এদের মস্তিস্ক। দশ বিলিয়ন নিউরন।

আলোচনা এভাবে হয়তো আরো দীর্ঘ সময় ধরে চলত কিন্তু ক্রিনিটি হাত তুলে তাদের থামাল। বলল, তোমাদের অনুমান সত্যি। আমার সামনে পঁড়িয়ে থাকা এই শিশুটি একটি সত্যিকারের মানব শিশু। আমি তৃতীয় মাত্রার একটি রোবট। আমার প্রতিষ্ঠানিক নাম ক্রিনিটি।

সামনে উপস্থিত রোবটগুলো একসাথে কথা বলতে শুরু করে, আমরা দ্বিতীয়মাত্রার রোবট। আমাদের নাম নেই, শুধু সংখ্যা দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বাইনারীতে আমার সংখ্যাসূচক শূন্য এক শূন্য শূন্য এক…

ক্রিনিটি আবার তাদের থামাল, বলল, তোমাদের সংখ্যা সূচক বলার। প্রয়োজন নেই। আমরা যে কাজে এসেছি তোমরা আমাদের সে কাজে সাহায্য কর।

অবশ্যই অবশ্যই আমরা সাহায্য করব। আমাদের যেটুকু ক্ষমতা আছে তার পুরোটুকু দিয়ে আমরা সাহায্য করব।

পৃথিবীর মানুষের মৃত্যু হবার পর তাদের নেটওয়ার্কটি অচল হয়ে গেছে। আমরা কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি না। আমরা খোঁজ করছি অন্য কোনো নেটওয়ার্ক চালু আছে কিনা। যদি চালু থাকে তাহলে আমরা কিছু তথ্য পেতে চাই।

আমাদের একটি নেটওয়ার্ক আছে। আমরা সেই নেটওয়ার্ক থেকে কিছু তথ্য পেতে পারি। মানুষের মৃত্যুর পর তথ্যের গুরুত্ব কমে গেছে। আমাদের দায়িত্ব নিয়ে আদেশ নির্দেশ আর পাঠানো হয় না। আমরা সেই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করি না।

ক্রিনিটি বলল, আমি সেই নেটওয়ার্কটি ব্যবহার করে একটু তথ্য সংগ্রহ করতে চাই।

বিভৎস দর্শন একটি রোবট বলল, চল, আমাদের সাথে চল। আমাদের কন্ট্রোল রুমে নেটওয়ার্ক সংযোগ আছে।

নিকি বলল, আমি কন্ট্রোল রুমে যেতে চাই না। নেটওয়ার্ক দেখতে চাই।

ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি কী করতে চাও?

আমি জায়গাটি ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই।

এটি অপরিচিত জায়গা। তোমার যদি কোনো বিপদ হয়?

মাঝারি আকারের বিদঘুটে একটি রোবট বলল, আমি মহামান্য নিকিকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রদান করব।

সাথে সাথে আরো কয়েকটি রোবট বলল, আমরাও মানব সন্তান মহামান্য নিকিকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিতে পারি।

ক্রিনিটি বলল, তা হলো আমরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারি। কয়েকজন আমার সাথে এসো, অন্যেরা নিকির সাথে থাকো।

বিভৎস রোবটটি বলল, ঠিক আছে।

 

বিশাল একটি বিল্ডিং-এর পাশে একটি কৃত্রিম হ্রদ। হ্রদটি ঘিরে বড় বড় গাছ। সেই গাছে পাখি কিচিরমিচির করছে। নিকি মাথা তুলে পাখিগুলোকে দেখার চেষ্টা করল।

একটি রোবট বলল, মহামান্য নিকি? পাখিগুলোর চেঁচামেচি কী আপনাকে বিরক্ত করছে? আমি তাহলে এই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে পাখিগুলোকে শেষ করে দিতে পারি।

নিকি আঁতকে উঠে বলল, না, না, না! খবরদার পাখিগুলোর কখনো কোনো ক্ষতি করবে না।

আপনার ইচ্ছা মহামান্য নিকি। আপনি যেটি বলবেন সেটিই আমরা মেনে নেব।

নিকি হি হি করে হেসে বলল, আর আমাকে মহামান্য নিকি বলে ডেকো না! যখন আমাকে তোমরা মহামান্য নিকি বলে ডাকো তখন আমার যা হাসি পায় সেটি বলার মতো না। হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যথা হয়ে যায়।

রোবটটি বিড় বিড় করে বলল, হাসি এবং ব্যথা এই দুটিই একটি মানবিক প্রক্রিয়া। আমরা এই প্রক্রিয়াগুলো বুঝি না।

নিকি গম্ভীর হয়ে বলল, ভাগ্যিস ক্রিনিটি এখানে নেই। সে থাকলে বলত তোমাদের বুদ্ধিমত্তা কম! ক্রিনিটি সারাক্ষণ আমাকে শুধু বুদ্ধিমত্তা বোঝানোর চেষ্টা করে।

রোবটগুলো কোনো কথা বলল না। নিকি বলল, আমার কী মনে হয়। জানো?

কী?

ক্রিনিটির নিজেরই বুদ্ধিমত্তা কম।

রোবটগুলো এবারেও কোনো কথা বলল না। নিকি বলল, তবে ক্রিনিটির মনটি খুব ভালো। সে আমাকে খুব ভালোবাসে।