মুনি বলিলেন শুন তবে জন্মেজয়।
কুরুসভা মধ্যে গেলা ধৌম্য মহাশয়।।
সভায় বসিয়া আছে কৌরবের পতি।
সুহৃদ অমাত্য বন্ধুগণের সংহতি।।
শত ভাই কুরুবংশ রাধাপুত্র আর।
ভীষ্ম দ্রোণ আর গুরুর কুমার।।
ধৃতরাষ্ট্র বিদুর অমাত্য যত জন।
সভা করি বসিয়াছে কৌরব নন্দন।।
হেনকালে কহে গিয়া ধৌম্য তপোধন।
অবধান কর রাজা অম্বিকানন্দন।।
পাণ্ডুপুত্র পঞ্চভাই পাঠান আমারে।
আপন বিভাগ মত রাজ্য লইবারে।।
কহিলেন বিনয় করিয়া ধর্ম্মরায়।
সে সকল কথা রাজা কহিতে তোমায়।।
জ্যেষ্ঠতাতে কহিবা আমার নিবেদন।
তোমার প্রসাদে জীয়ে ভাই পঞ্চজন।।
তুমি যে করিবা আজ্ঞা না করিব আন।
তব অনুবর্ত্তি পঞ্চ পাণ্ডুর সন্তান।।
যত দুঃখ সহিলাম তোমার কারণ।
তব বশ হইয়া হারাই রাজ্যধন।।
যে নির্ণয় পূর্ব্বে হৈল তোমার সাক্ষাতে।
তাহাতে হইনু মুক্ত দুঃখ সঙ্কটেতে।।
মহাদুঃখ পাইলাম অরণ্যে বিশেষ।
জটাবল্ক পরিধান তপস্বীর বেশ।।
তৎপরে অজ্ঞাতবাস করি লুকাইয়া।
পরসেবা করি পর আজ্ঞাযর্ত্তি হৈয়া।।
রাজপুত্র হইয়া ক্লীবের ব্যবহার।
হীনসেবা করিলাম হীন দুরাচার।।
পাইলাম এত দুঃখ নাহি করি মনে।
সব দুঃখ পাসরিনু তোমার কারণে ।।
আপন পৈতৃক ভাগ উচিত যে হয়।
দিয়া প্রীত কর রাজা আমা সবাকায়।।
ভাই ভাই বিরোধতে নাহি প্রয়োজন।
এই মত কহিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
ভীম কহিলেন দর্প করিয়া অপার।
অন্ধেরে কহিবে অগ্রে মম নমস্কার।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আর পৃষতকুমারে।
আমার বিনয় জানাইবে সবাকারে।।
কহিবা নিষ্ঠুর বাক্য রাজ্য দুর্য্যোধনে।
যত দুঃখ দিল তাহা সর্ব্বলোক জানে।।
ক্ষমিলাম সে সকল চাহিয়া অন্ধেরে ।
উচিত বিভাগ যেন দেয় পাণ্ডবেরে।।
না দিলে আমার হাতে হবে বংশক্ষয়।
এইরূপ কহিলেন ভীম মহাশয়।।
অর্জ্জুন কহিলেন করিয়া মিনতি।
কহিবা অন্ধের পদে আমার প্রণতি।।
যত দুঃখ দিল দুষ্ট তাহা নাহি মনে।
তোমার কারণে ক্ষমিলাম দুর্য্যোধনে।।
যত অপমান কৈল দেখিলে সাক্ষাতে।
দ্রৌপদীর কেশে ধরি আনিল সভাতে।।
কপট পাশায় যত সর্ব্বস্ব লইল।
দ্বাদশ বৎসর বনবাসে পাঠাইল।।
সহিলাম সই সেব তোমার কারণে।
আমার বিভাগ ছাড়ি দেহ এইক্ষণে।।
সম্প্রীতে না দিলে দুঃখ পাইবে অপার।
এইরূপে বলিলেন ইন্দ্রের কুমার।।
সহদেব নকুল কহিল বহুতর।
ধৃষ্টদ্যুন্ন দ্রুপদাদি যত নরবর।।
পাণ্ডবের সমুচিত বিভাগ যে হয়।
সন্তোষহ তাহা দিয়া পাণ্ডুর তনয়।।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র করিল উত্তর।
যে কহিলা অসদৃশ নহে মুনিবর।।
পাইল অনেক দুঃখ পাণ্ডুপুত্রগণে।
মম হেতু ক্ষমিলেক পাপ দুর্য্যোধনে।।
কর্ণ দুঃশাসনে নিন্দা করিল অপার।
মম হেতু ক্ষমিলেক পাণ্ডুর কুমার।।
এখন যে কহি তাহা শুন সভ্যজন।
প্রিয়ম্বদ দূত যাক পাণ্ডবের স্থান।।
প্রিয়বাক্য কহিয়া আনিয়া হস্তিনায়।
সমুচিত ভাগ দিয়া তোষ তা সবায়।।
নানা বস্ত্র অলঙ্কার ধন বহুতর।
পুরষ্কার দিয়া তোষ পঞ্চ সহোদর।।
সেই ইন্দ্রপ্রস্ত পুনঃ দেহ অধিকার।
যত রত্ন ছিল তার যতেক ভাণ্ডার।।
যেই সত্য করিলেক তাহে হৈল পার।
সমচিত ভাগ দেহ উচিত তাহার।।
বলেতে অশক্ত নহে ভাই পঞ্চজন।
মুহূর্ত্তেকে জিনিবারে পারে ত্রিভুবন।।
অতএব দ্বন্দ্ব কিছু নাহি প্রয়োজন।
অর্দ্ধ রাজ্য দিয়া তোষ পাণ্ডু পুত্রগণ।।
ভীষ্ম বলিলেন ভাল নিল মম মনে।
উপযুক্ত যুক্তি বটে কর এইক্ষণে।।
বিরোধ হইলে রাজা হবে কোন্ কাজ।
সমুচিত ভাগ তারে দেহ মহারাজ।।
না দিলে নিশ্চয় রাজা হবে কুলক্ষয়।
অতএব সাবধানে শুন মহাশয়।।
প্রিয়ম্বদ দূত রাজা দেহ পাঠাইয়া।
পাণ্ডবেরে হেথা আন বিনয় করিয়া।।
তবে সে তোমার হিত হইবে রাজন।
আমারে এতেক কহ কোন প্রয়োজন।।
কৌরবের পতি তুমি কৌরবের গতি।
তোমা বিনা কুরুকুলে নাহি অব্যাহতি।।
তুমি যে কহিবে তাহা কে করিবে আন।
যেই চিত্তে লয় তাহা করহ বিধান।।
ভীষ্মের এতেক বাক্য শুনি সভ্যগণ।
সাধু সাধু বলি প্রশংসিল জনে জন।।
দ্রোণ কৃপ বিদুরাদি বাহলিক নৃপতি।
পাণ্ডবে আনিতে সবে দিল অনুমতি।।
পুনঃ পুনঃ নানামতে কহিল অন্ধেরে।
সম্প্রীতে আনহ রাজা পঞ্চ সহোদরে।।
সমুচিত ভাগ তারে দেহ রাজধানী।
এই কর্ম্ম তব প্রিয় শুন নৃপমণি।।
এইরূপে কহিল সক সভাজন।
মনে মনে ক্রোধে জ্বলে রাজা দুর্য্যোধন।।
পাণ্ডবের প্রশংসা কর্ণেতে লাগে শাল।
ক্রোধভরে হেঁটমাথা কুরু মহীপাল।।
তবে দুর্য্যোধনে কহে অন্ধ নরপতি।
আমার বচন সুত কর অবগতি।।
সবার সম্মান রাখ শুন মম বাণী।
পাণ্ডবেরে সমুচিত দেহ রাজধানী।।
ভাই ভাই সংপ্রীতে করহ রাজাসুখ।
কলহেতে কার্য্য নাহি জন্মে মহাদুঃখ।।
লোকেতে কুযশ ঘোষে অপকীর্ত্তি হয়।
পূর্ব্বের কাহিনী শুন কহি যে তোমায়।।
মন দিয়া শুন বৃক রাজার আখ্যান।
ঘুচিবে মনধন্ধ লভিবে দিব্য জ্ঞান।।
মহাভারতের কথা সুধা সঞ্জীবনী।
কাশীরাম কহে, ভব পারের তরনী।।