কিরীটী হরিদাস সামন্তর দিকে ফিরে তাকাল।
এই আপনার সুভদ্রা, সামন্ত মশাই?
হ্যাঁ। কি মতলব করেছে ওরা জানেন? আজই ওরা ভোরাত্রের গাড়িতে বর্ধমান যাবে।
শুনলাম তো।
শুনেছেন?
হ্যাঁ। ঘরে ঢোকার মুখে আপনাদের শেষের কথাগুলো কানে এল।
কিন্তু আমারও প্রতিজ্ঞা, তা হতে দিচ্ছি না। সামন্ত বললেন।
সামন্ত মশাই, ও কালনাগিনী। মিথ্যে শুধু ছোবল খাবেন। যাক সেকথা। আপনাদের পালা। শুরু হচ্ছে কখন?
রাত ঠিক আটটা। এখন সাড়ে ছটা। আর দেড় ঘণ্টা বাদে।
আমাকে আসরে বসবার একটা জায়গা করে দেবেন? নিশ্চয়ই।
ভাল কথা, আপনাদের এই নাটকে কোন অঙ্কে যেন রাখালকে বিষ দেবার কথা!
বিষ কেউ দিচ্ছে না। পালায় আছে বিষ, আমিই নিজে স্বেচ্ছায় পান করব সুভদ্রা তার প্রেমিকের সঙ্গে চলে যাচ্ছে জানতে পেরে।
ওঃ, তাহলে জেনেশুনেই বিষপান? বিষপ্রয়োগ নয়? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, জেনেশুনেই বিষপান।
তবে—
কি তবে?
দৃশ্যটা কি রকম বলুন তো?
আমি একটা গ্লাস হাতে আসরে যাব, তাতে বিষ রয়েছে।
তারপর?
আসরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করব বিষটা, তারপর গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টলতে টলতে বের হয়ে আসব আসর থেকে।
তাহলে আসরের মধ্যে পতন ও মৃত্যু নয়?
না। নেপথ্যে।
তাহলে আর আপনার এত ভয় কেন?
মানে?
গ্লাস তো আপনিই নিয়ে যাবেন নিজে হাতে আসরে?
না।
তবে?
সুভদ্রাকে ডেকে বলব গ্লাসটা নিয়ে আসতে। সে এনে দেবে গ্লাস আসরে।
তাই নাকি! এ যে দেখছি—
কিরীটীর কথা শেষ হল না।
সুভদ্রা ও শ্যামলকুমার এসে সাজঘরে ঢুকল।
সুভদ্রার হাতে এক কাপ চা। কিরীটী দেখল, শ্যামলকুমারের বয়স আটাশ-ঊনত্রিশের বেশী হবে না।
ভারি সুশ্রী চেহারাটি। যেমন নায়কোচিত দেহের গঠন, তেমনি পুরুষোচিত স্বাস্থ্য ও যৌবন যেন কানায় কানায় উপচে পড়ছে।
কালো রং হলেও দেখতে সুন্দর। যাকে বলে সত্যিকারের সুপুরুষ। অভিনেতার মতই চেহারা বটে।
সুভদ্রা হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে কিরীটীর দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললে, এই নিন চা। এই আমাদের শ্যামলকুমার, নাটকও এরই লেখা।
আপনিই নাট্যকার?
আজ্ঞে।
এই বুঝি আপনার প্রথম নাটক? কিরীটী শুধায়।
হ্যাঁ। বিনীতভাবে জবাব দিল শ্যামল। শুনলাম আপনি সামন্তবাবুর বন্ধু। আজ আমাদের নাটকটা দেখে যান না।
এসেছি যখন দেখে যাব বৈকি।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী আবার বললে, কিন্তু নাটকের অমন একটা অদ্ভুত পৌরাণিক প্যাটার্নের নাম রাখলেন কেন শ্যামলবাবু?
শ্যামলকুমার মৃদু হেসে বললে, নাটকটা না দেখলে বুঝতে পারবেন না। আগে দেখুন, তারপর আপনার সঙ্গে আলোচনা করব। আচ্ছা তাহলে আমরা চলি। প্রথম দৃশ্যেই আমার আর সুভদ্রার প্রবেশ আছে। এস সুভা–
শ্যামলকুমার সুভদ্রাকে ডেকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী গোড়া থেকেই লক্ষ্য করছিল আড়চোখে, শ্যামলকুমার আর সুভদ্রার দিকে জ্বলন্ত অগ্নিক্ষরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন হরিদাস সামন্ত।
মনে হচ্ছিল যেন এখুনি ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং পারলে ওদের দুজনের টুটি ছিঁড়ে ফেলেন।
ওরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই হরিদাস সামন্ত যেন ফেটে পড়লেন, দেখলেন—দেখলেন তো স্বচক্ষে রায় মশাই! এরপরও বলবেন, ওরা মনে মনে আমাকে হত্যা করবার সঙ্কল্প আঁটছে না? উঃ কি সাঙ্ঘাতিক, কি ভয়ানক শয়তানী!
অধীর হবেন না সামন্ত মশাই।
অধীর হব না, কি বলছেন রায় মশাই? আমি তো একটা মানুষ, না কি?
ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তাহলেও একটা কথা কি জানেন? ওরা মনে মনে যদি কোন মতলব এঁটেই থাকে কৌশলে ওদের পথ থেকে আপনাকে সরাবার, রাগারাগি করে চেঁচামেচি করলে বা এমন করে অধৈর্য হলে ওদের তাতে করে সুবিধাই হবে।
পারছি না, এত অত্যাচার আর আমি সহ্য করতে পারছি না রায় মশাই। তাছাড়া আপনাকে তো এখনও একটা কথা বলিইনি।
কি কথা?
আজ আবার ঐ রাস্কেলটার সঙ্গে দুপুরে আমার একচোট হয়ে গিয়েছে।
কার কথা বলছেন? কিরীটী শুধাল।
কার কথা বলছি বুঝতে পারছেন না? ঐ শ্যামলকুমার!
কি হল তার সঙ্গে আবার?
জানেন, ও আমাকে আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছে আজ।
আলটিমেটাম?
হ্যাঁ। দুপুরের ট্রেনে আসতে আসতে শ্যামলকুমার আমাকে বলেছে—
কি বলেছে?
ওদের পথ থেকে যদি আমি না সরে দাঁড়াই তো ওরাই আমাকে সরাবার ব্যবস্থা করবে।
তাই নাকি!
কথাটা কয়েকদিন আগেও শ্যামলকুমার আমাকে একবার বলেছিল।
ওরাই—মানে কি? আপনার কি মনে হয়, ঐ ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুভদ্রাও আছে?
নিশ্চয়ই আছে।
কিরীটী ক্ষণকাল যেন কি ভাবল। তারপর বলে, ঠিক আছে।
বাইরে ঐ সময় পালা শুরু হবার প্রথম বেল পড়ল।
ঐ যাঃ, প্রথম বেল পড়ল—প্রথম দৃশ্যের শেষের দিকে আমার অ্যাপিয়ারেন্স আছে। হরিদাস। সামন্ত বলে উঠলেন।
আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন।
আপনি?
আসরে আমার বসবার একটা জায়গা করে দিন সামনের রোতে, যাতে করে ওদের দুজনকে আরও ভাল করে দেখে নাটকটা ভাল করে শুনতে পারি।
ঠিক আছে। চলুন, আপনাকে আমি বসিয়ে দিয়ে আসি। তারপর মেকআপে বসব, চলুন।
চলুন।
সামন্ত মশাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী ওঁর গ্রনরুম থেকে বেরুল।
গমগম করছিল যেন আসর।
দর্শনাথীতে একেবারে যেন ঠাসাঠাসি আসর তখন।
তিল-ধারণেরও স্থান নেই। হরিদাস সামন্ত পাল মশাইকে বলে প্রথম সারিতেই আসরের একেবারে সামনাসামনি একটা চেয়ারে কিরীটীকে বসিয়ে দিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষন পরে পালা শুরু হল।
.
কিরীটী তন্ময় হয়ে পালা শুনছিল।
নাটকটি বেশ লাগে কিরীটীর। চমৎকার লিখেছে ছেলেটি। কে বলবে একটি তরুণের ঐ প্রথম প্রয়াস।
যেমন ঘটনার বাঁধুনী তেমনি নাটকীয় সংঘাত, আর তেমনি নাটকের সংলাপ।
আরও আশ্চর্য লাগছিল কিরীটীর, হরিদাস সামন্তর কাছে কয়েকদিন আগে শোনা তাঁর জীবনকাহিনীই যেন নাটকের কাহিনীর মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে।
এক বৃদ্ধের এক তরুণীর প্রতি আকর্ষণ,—যে আকর্ষণের টানে সে তার নিজের সংসারকে ভাসিয়ে দিল, অথচ ঐ বৃদ্ধ ঐ তরুণীর সম্পর্কে পালিত পিতার মতই। এমন সময় নাটকে শুরু হল ওদের সংসারে এক তরুণকে নিয়ে সংঘাত।
মেয়েটি সহজেই তরুণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল স্বভাবতই, আর তাইতেই সংঘাত। এক ত্রিকোণ সংঘাত।
শেষ পর্যন্ত পালিত পিতার নিজের বিকৃত বাসনার জন্য মেয়েটির প্রতি জেগে ওঠে এক গভীর অনুশোচনা, যার ফলে সে স্থির করল সে নিজেই স্বেচ্ছায় ওদের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে।
সে বিষপান করবে।
বিষ সংগ্রহ করে নিয়ে এল বৃদ্ধ এবং সেই বিষ সে এনে জলের পাত্রের মধ্যে ঢেলে দিল এবং মনস্থ করল মেয়েটির হাতের থেকে বিষ-মেশানো জল পান করবে, যাতে করে
সেই জল পান করলেই মৃত্যু হয়।
ক্রমশঃ নাটকের সেই দৃশ্য এল।
সুভদ্রা (নাটকের নায়িকা) কোথায় বের হয়েছিল, অনেক রাত্রে ফিরে এসে দেখে সেই বৃদ্ধ ঘরের মধ্যে একাকী চুপ করে বসে আছে।
সুভদ্রা বললে, পাশের ঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছিলাম, খেয়েছ?
আজ আর কিছু খাব না সুভদ্রা। খাবে না?
না।
শুধু এক গ্লাস জল। টেবিলের ওপরে আছে, এনে দাও তো জলের গ্লাসটা।
শুধু জল খাবে?
হ্যাঁ।
সুভদ্রা চলে গেল এবং একটু পরে এক গ্লাস জল নিয়ে এল, এই নাও জল।
যাও, তুমি শুয়ে পড়ো গে।
সুভদ্রা চলে গেল।
নিজের হাতে বিষমিশ্রিত সেই জল পানের পূর্বে বৃদ্ধের সংলাপ : সুভদ্রা, তুমি সুখী হও। আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। একটা চিঠি রেখে যাব, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
এই জলে বিষ মিশিয়ে রেখেছি তুমি জান না, তোমরা হাত দিয়েই এই বিষ আমি পান করছি। আর তাই তো তোমরা মনে মনে চেয়েছিলে—তাই হোক, তাই হোক।
সংলাপগুলো উচ্চারণ করতে করতে টলতে টলতে হরিদাস সামন্ত জলটুকু পান করে গ্লাসটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর আসর থেকে প্রস্থান করলেন।
শেষ দৃশ্য।
রাখাল-বেশী হরিদাসের প্রস্থানের পরই সুভদ্রা আর নায়কের প্রবেশ।
কিরীটী যেন নাটকের কাহিনীর মধ্যে ড়ুবে গিয়েছিল।
সুভদ্রা।
বল জ্যোতির্ময়!
আর এই খাঁচার মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতে পারছি না।
কি করতে চাও?
এ যেন সত্যি আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমারও।
আমি ঠিক করেছি—
কি ঠিক করেছ?
আজ রাত্রেই আমরা পালাব।
আমি প্রস্তুত।
ইচ্ছে ছিল না আদৌ আমার এভাবে তোমাকে অপহরণ করে চোরের মত রাতের অন্ধকারে সরে পড়বার, কিন্তু–
কিন্তু কি?
সামনে দিয়ে গেলে ঐ বৃদ্ধ মনে নিদারুণ আঘাত পাবে। সুখের ঘর বাঁধতে চলেছি, কারও মনে কোন দুঃখ দেব না। ভাল করে শেষবারের মত ভেবে দেখ, তোমার মনে কোন চিন্তা বা সংকোচ নেই তো?
এতটুকুও না। ওর কুৎসিত দৃষ্টি আমাকে যেন লোভীর মত সর্বক্ষণ লেহন করছে। অথচ ও আমার পালিত বাপ। মুক্তি চাই আমি—মুক্তি চাই।
চল।
দুজনে হাত ধরাধরি করে আসর থেকে বের হয়ে যাবার উপক্রম করবে, আর ঠিক বেরুবার আগেই বাড়ির ভৃত্য এসে বলবে, দিদিমণি, শিগ্রী চলুন, বাবু কত্তাবাবু বোধ হয় মারা গেছেন।
কিন্তু ভৃত্য আর আসে না।
ভৃত্যও আর আসে না, ওরাও নাটকের সংলাপগুলো বলতে পারে না। ওরা ঘন ঘন ভৃত্য আসার প্রবেশপথের দিকে তাকাতে থাকে। নিজেদের মধ্যেই অস্ফুট কণ্ঠে বলাবলি করে ওরা। কিরীটী সামনে বসেই শুনতে পায়।
কি ব্যাপার, চাকর আসছে না কেন?
দু মিনিট, চার মিনিট, পাঁচ মিনিট কেটে গেল। অথচ ভৃত্য আসছে না আসরে।
সুভদ্রা আর শ্যামলকুমার পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
দুজনেরই চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি।
দর্শকরা প্রথমটায় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি, কিন্তু প্রায় যখন আট দশ মিনিট ঐ অবস্থায় কেটে যাবার উপক্রম হল তখন তাদের মধ্যেও একটা ফিসফিসানি, চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।
লে বাবা, এরা দুটি সঙের মত দাঁড়িয়ে রইল কেন? কে একজন বললে।
আর একজন টিপ্পনী কাটল, কি বাবা, ভাগব বলে এখনও দাঁড়িয়ে কেন? কেটে পড় বাপু, দুটিতে তো বেশ জোট মানিয়েছে!
ওরাও বোধ হয়—সুভদ্রা আর শ্যামলকুমার কেমন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। বৃদ্ধের ভৃত্যের আবির্ভাবের পর যে সংলাপ তাও বলতে পারছে না, এদিকে ভৃত্যেরও দেখা নেই।
অবশেষে বুদ্ধি খাটিয়ে শ্যামলকুমার বললে, চল সুভদ্রা, আর দেরি করা উচিত নয়।
হ্যাঁ, চল।
ওদের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে সারা প্যান্ডেল যেন এক অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল।
কিরীটী নাটকের শেষটুকু জানত। হরিদাসের মুখেই শুনেছিল।
কিরীটীও ঠিক বুঝতে পারে না, ব্যাপারটা ঠিক কি ঘটল!
ভৃত্যের আসরে আবির্ভাব হল না কেন?
হঠাৎ কি একটা কথা মনে হওয়ায় তাড়াতাড়ি কিরীটী উঠে পড়ল এবং দ্রুতপদে সাজঘরের দিকে পা বাড়াল।
দর্শকরাও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না।
তারা তখন হাসি থামিয়ে রীতিমত চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, এটা কি হল? এ কেমন পালা রে বাবা?